দেবর্ষি সারগী
এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজনীতিক এবং এখন স্মৃতিশক্তি হারানো আমার বাবা হুইলচেয়ারে বসে আছে বাইপাসের ধারে আমাদের বিশাল আঠেরোতলা উঁচু ফ্ল্যাটে, একটা প্রকাণ্ড স্লাইডিং জানালার সামনে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকালে ধূ ধূ আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বাইরের প্রবল হাওয়ায় আকাশটা যেন আস্তে আস্তে কাঁপছে। ফিনফিনে কাপড়ের মতো।
ড্রয়িংরুমের ওই জানালাটার সামনে মুখ করেই বাবা সারাদিন বসে থাকে। ফলে আমরা বাবার পেছন দিকটাই বেশি দেখতে পাই। সামনের দিকটা দেখি আয়া যখন চেয়ারটার চাকা ঘুরিয়ে বাবাকে বাথরুমে নিয়ে যায় বা খাবারের টেবিলে নিয়ে আসে।
রোজকার আয়া আজ ছুটি নিয়েছে। সেন্টার থেকে অন্য একজনের আসার কথা। প্রায় দুপুর হয়ে গেল কিন্তু এখনও এল না। খানিক আগে ফোন করেছিলাম। জানাল পাঠিয়ে দিয়েছ, একটু পরেই পৌঁছে যাবে। আজ মা ও বোনও বাড়িতে নেই। বর্ধমানে মাসির বাড়ি গিয়েছে। রাতে ওখানে থেকে কাল দুপুরে ফিরবে।
ফলে জাগরীকে আসতে বললাম। ও থাকে এই অ্যাপার্টমেন্টের তেরোতলায়। আমরা প্রেম করি। মায়ের আপত্তি না থাকলেও বাবা আমাদের সম্পর্ক পছন্দ করে না। কারণ, আমরা সান্যাল, ওরা মণ্ডল। বাবার মতে আমাদের সম্পর্ক হতে পারে না। মিশতে মানা করত বাবা। তবে এখন তো স্মৃতিভ্রংশ। জাগরীকে চিনতে পারবে না। তাই সাহস করে ওকে আসতে বললাম। মা ও বোন বাড়ি নেই। ফলে সারাদিন জাগরী থাকতে পারে। এমনকী রাতেও। রাতে থাকবে জাগরী? থাকতে রাজী হবে? ওর বাড়ি অনুমতি দেবে? ভাবতে ভাবতে আমার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করছিল। জাগরী এল। অনেকদিন পর। কিন্তু রাতে থাকার কথাটা ওকে এক্ষুনি বললাম না।
আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছি। পেছনদিক থেকে। ভারী শরীর, ছোট করে চুল ছাঁটা গোল বড় মাথা। একটু ভীত মুখে জাগরী তাকিয়ে বাবার দিকে। আমার মুখেও একটু ভয়। বাবাকে তো সবাই ভয় পেয়ে এসেছে। রাজনৈতিক নেতাদের তো সবাই ভয় পায়। ওদের বাড়ির লোকেরাও। আর বাবাকে সবাই একটু বেশিই ভয় পেত, কারণ বাবা দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ছিল। ভোটে জিতেছে, ভোটে হেরেছে কিন্তু প্রতাপ কখনও কমেনি। ভালো কাজ কিছু করেছে, কেউ কেউ বলে। কিন্তু খারাপ কাজ যে প্রচুর করেছে, সবাই বলে। আমরাও জানি।
জাগরী একদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে। ওর একটা হাত ধরে আমি ওকে অভয় দিলাম। এখন আর তোমাকে কিছু বলতে পারবে না, আমি বললাম। এখন তো তোমাকে চিনতেই পারবে না।
–একদম কথা বলতে পারেন না?
–না। শুধু তাকিয়ে থাকে।
–অনেক দিন হয়ে গেল, না?
–হ্যাঁ। প্রায় এক মাস। এক মাস আগেই তো ঘুম থেকে উঠে আমরা দেখি বাবা হঠাৎ কথা বলছে না, কাউকে চিনতে পারছে না।
–অদ্ভুত— কেমন ভয় করছে!
–ডাক্তার বলল এরকম নাকি হয়।
–সারাদিন কী করেন?
–এভাবে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
–রাতে?
রাতে ঘরে নিয়ে গিয়ে আয়া শুইয়ে দেয়। কোন ঘরে? ওটায়। আমি একটা ঘর দেখিয়ে বললাম। ওটা আমার মা ও বাবার বেডরুম নয়। অন্য একটা ঘর।
জাগরী ঘরটার ব্দিকে তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। সারা রাত একা একা ওই ঘরে ঘুমোয়।
–ভয়ে কখনও চেঁচিয়ে ওঠেন না?
–কীসের ভয়?
জাগরী কয়েক মুহূর্ত ভাবল।
–এই ধরো অন্ধকারের।
–স্মৃতিভ্রংশ মানুষ হয়তো অন্ধকারকেও চিনতে পারে না।
জাগরী তাকিয়ে থাকল বাবার দিকে। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো চৈত্রের হাওয়া দৌড়াদৌড়ি করছিল চারপাশে। ঐ হাওয়ায় আকাশটা কাঁপছিল। ড্রয়িং রুমের পর্দারা দুলছিল। জাগরীর কপালে চুল লুটোপুটি খাচ্ছিল, যেন ওর কপাল থেকে ছিঁড়ে চুলগুলি জানালার বাইরে উড়ে যাবে। যত উঁচুতে ফ্ল্যাট, হাওয়াও তত বেশি।
আয়া নিয়ে আমার উদ্বেগ ক্রমে বাড়ছিল। এখনও কেউ এল না। আবার ফোন করলাম।
–কেউ এল না তো এখনও?
–সে কী? আমরা তো সকালেই পাঠিয়ে দিয়েছি।
–তবে?
–আচ্ছা— খোঁজ নিচ্ছি।
–এক্ষুনি পাঠান। বাথরুমে যেতে চাইলে কী করব?
–হ্যাঁ হ্যাঁ দেখছি— নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার! এখনও কেন পৌঁছল না বুঝতে পারছি না।
জাগরীর মুখেও উদ্বেগ।
–খাওয়ার কী হবে? সে জিজ্ঞেস করল।
–দুপুরের খাওয়াটা মা খাইয়েই গিয়েছে। চা-ও আমি করে দেব। কিন্তু বাথরুম পেলে? বিশেষ করে পায়খানা?
উদ্বিগ্ন মুখে জাগরী তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।
–ঠিক আছে, আমি নিয়ে যাব, সে বলল।
–তুমি পারবে না। তোমার তো অভ্যেস নেই।
একটা দমকা হাওয়ায় ওয়াল-ক্যাবিনেটের মাথায় রাখা একটা পেতলের কাপ শব্দ করে মাটিতে পড়ল। ওটা বোনের স্পোর্টসের প্রাইজ। তুলে ডাইনিং টেবিলে রেখে দিলাম। চা এখন খাবেন? বানিয়ে দেব?
এখন না। চারটের পর। চা আর আখরোট। আখরোট খেতে ভালবাসে।
জাগরীর হাত ধরে আমার ঘরে নিয়ে এলাম।
বইপত্র, ডিভান, ডেস্ক, কম্পিউটার। আর সেলফের এক কোণে জাগরীর একটা ছোট্ট ছবি। ওটা সম্প্রতি রেখেছি, বাবা স্মৃতিশক্তি হারানোর পর। মা দেখেছে, আপত্তি করেনি।
ছবিটা দেখে জাগরী অবাক হয়ে হেসে ফেলল, তারপর আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মুখ লুকালো। আমি ওর চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলাম। এ ঘরে হাওয়ার দাপট কম।
–কত দিন পর এলাম তোমার ঘরে।
–হ্যাঁ। আগে বাবা থাকত না বলে তাও আসতে পারতে। গত দেড় বছর বাড়ি থেকে তো প্রায় বেরোয়ইনি বলতে গেলে। আসলে লাস্ট ইলেকশনে হেরে গিয়ে একেবারে মুষড়ে পড়ল। তার ওপর নানা সমালোচনা, দুর্নাম। বাইরে বেরনোই বন্ধ করে দিল।
–মাঝে শুনতাম প্রাণহানির আশঙ্কাও নাকি হয়েছিল। ওঁর শত্রুরা নাকি মেরে ফেলার হুমকি দিত।
–হ্যাঁ, অনেকেরই তো রাগ আছে। লোকের ক্ষতি তো কম করেনি! হতদরিদ্রদেরও ক্ষতি করেছে। কাজের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকের কাছ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাকড়ি নিয়েছে। চারজন তো সুইসাইড করল। সবাই জানে এ সব।
–কী লাভ হল শেষ পর্যন্ত? এই তো শেষ হয়ে যাচ্ছে জীবনটা!
জাগরীর মুখে ফুটে উঠেছিল গভীর বিষ্ময় ও বিভ্রান্তির ছাপ, যেন জীবন নিয়ে কোনও জটিল ধাঁধার কবলেই সে পড়েছে।
একটাই সান্ত্বনা, ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম। বাবার আর কিছু মনে নেই। ফলে আর জ্বালা-যন্ত্রণাও নেই। আর লোভ নেই, হিংসা নেই, অ্যাম্বিশন নেই, দাপট নেই। এখন হয়তো ভাল আছে বাবা।
মোবাইলটা বাজল। হ্যালো?
–আমি সেন্টার থেকে বলছি।
–বলুন— এখনও তো এল না।
–সেটা জানাতেই তো ফোন করলাম, স্যার। যাকে পাঠানো হয়েছিল, আপনার ওখানে যেতে গিয়ে তার গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। রাস্তা পার হওয়ার সময়।
হতভম্ব হয়ে আমি কিছুক্ষণ ফোনটা ধরে রাখলাম। আর একজন আয়াকে পাঠাতে বলতে পারলাম না। এবার কী হবে? বাবা বাথরুমে যেতে চাইলে? পায়খানা করতে চাইলে? মায়েরা তো আসবে কাল সকালে।
ঠিক করলাম আমিই নিয়ে যাব। বাবার তো আর বোধ নেই, তাই আমার সামনে কাপড় ছাড়তে লজ্জা পাবে না। হঠাৎ ছোটবেলার স্মৃতি মনে এল। আমাকে কাঁধে বসিয়ে বাবা বিকেলের পার্কে ঘুরে বেড়াত। লোকদের ডেকে ডেকে বলত আমার ছেলে!
আমার চোখে জল আসছিল।
আমার বাবা! হঠাৎ জাগরীর কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। আমার বাবা!
আস্তে আস্তে বিকেল হতে লাগল। হাওয়ার গতি আরও বাড়ল। মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীটাই যেন হাওয়ায় ভেসে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। মায়ের ঘর থেকে নীচের রাস্তাঘাট ভাল দেখা যায়। জাগরীকে নিয়ে ওখানকার বড় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নীচে তাকিয়ে থাকলাম।
আমাদের জানলা দিয়ে তো এদিকটা দেখা যায় না, জাগরী বলল। আমরা পেছন দিকটা দেখতে পাই।
নীচে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ছোট ছোট মানুষ, প্রকাণ্ড আকাশটার তলা দিয়ে গুরুত্বহীন জীবের মতো ছোট ছোট পায়ে চলাফেরা করছে। ওদের কোনও কথাবার্তা, কোনও পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল না বলে মনে হচ্ছিল ওরা যেন কারও স্বপ্নের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। অথচ নীচে গেলেই স্বপ্নটা ভেঙে যায়। মানুষগুলো নিমেষে বাস্তব হয়ে ওঠে— ওদের চিৎকার, ক্রোধ, ঘৃণা ও অসীম ব্যস্ততা সমেত। বাইপাস দিয়ে গাড়িগুলি ছুটছিল রঙ-বেরঙের গুবরে পোকার মতো। আর এই সব কিছু সম্পর্কে প্রগাঢ় উদাসীনতা নিয়ে দূরের দিগন্তে নীরবে নামছিল একটা প্রকাণ্ড গোধূলি, দু চোখে গভীর ঘুম নিয়ে।
ঘুমে যেন আমারও দু চোখ ডুবে যাচ্ছিল। এবং হয়তো জাগরীর দু চোখও, কারণ সেও কোনও কথা বলছিল না।
বাড়ির ভেতর আলো জ্বালাব বলে আমি জানলা থেকে মুখ সরিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি দরজার গোড়ায় বাবা দাঁড়িয়ে। আমার হৃৎপিণ্ড যেন প্রচণ্ড জোরে একটা পাক খেল। বিশাল দেহ ও ছোট করে চুল ছাঁটা গোলাকার মাথাটার জন্য বাবাকে ফিকে অন্ধকারে দাঁড়ানো একটা অস্পষ্ট পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছিল।
বাথরুমে যাবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমার বুকের ভেতর ধকধক করছিল।
মুখ ঘুরিয়ে জাগরী বাবাকে দেখেই অস্ফুটস্বরে আঁতকে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকের দেওয়ালে হাত দিয়ে আলো জ্বালালাম। ছুটে এসে জাগরী আমার পাশে দাঁড়াল।
ভয় পেও না, জাগরীর দিকে তাকিয়ে বাবা বলল। তোমাদের সম্পর্ক আমি চাইনি, কারণ তোমরা মণ্ডল, আর আমরা সান্যাল। আমাদের গ্রামের বাড়িতে মণ্ডলরা আমাদের চাষের জমিতে লাঙল টানত। যা-হোক, ভয় পেও না। তোমাদের সম্পর্ক মেনে নিলাম আমি।
বাবার মতটা আমাকে ততটা উল্লসিত করেনি, যতটা করল যে বাবার স্মৃতিশক্তি ফিরে এসেছে, বাবা আবার আগের মতো কথা বলতে পারছে। বড় হওয়ার পর বাবার বিশেষ কাছে আমি কখনও যাইনি। এই মুহূর্তে একটু কাছে এগিয়ে গেলাম, তারপর বাবার একটা হাত ধরে অভিভূত গলায় বললাম, তোমার স্মৃতিশক্তি আবার ফিরে এসেছে বাবা! দাঁড়াও— মাকে আগে ফোন করে জানাই!
কাউকেই ফোন করতে হবে না, বাবা বলল, কারণ আমার স্মৃতিশক্তি কখনওই হারায়নি।
জাগরী ও আমি দুজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম বাবার মুখের দিকে। আমার হঠাৎ মনে হল আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোনও অচেনা লোক— আমার বাবা ড্রয়িংরুমের জানলার ধারে আগের মতোই নিথরভাবে বসে আছে।
আমি শুধু মনে মনে চাইতাম যে আমার স্মৃতিশক্তি সত্যি সত্যি হারিয়ে যাক, বাবা বলল। আমার মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে যাক। মাঠে পড়ে থাকা একটা নরখুলির মতো নিঃশব্দ হয়ে যাক মাথার ভেতরটা। বা মাথায় শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতার শব্দ বাজুক। কিন্তু কী করে ওটা সম্ভব? ভেবেছিলাম যদি কথা বলা বন্ধ করে দিই, কারও দিকে না তাকাই, স্মৃতি হারিয়ে গিয়েছে— এইরকম ভান করে দিনরাত চুপ করে বসে থাকি, তা হলে হয়তো স্মৃতিগুলি আস্তে আস্তে সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবে। যেমন মানুষের টুঁটি টিপে ধরে রাখলে মানুষ মারা যায়, তেমনি আমার স্মৃতিগুলোর টুঁটি টিপে ধরে রাখলে আস্তে আস্তে হয়তো ওরাও মারা যাবে। তাই একদিন ঘুম থেকে উঠে কথা বলা একদম বন্ধ করে দিলাম। লোকের মুখের দিকে সরাসরি তাকানো বন্ধ করে দিলাম। এমনকী চিন্তা থামাবারও চেষ্টা করতে লাগলাম। বুঝতে পারতাম দূরে দাঁড়িয়ে লোকে আমাকে দেখছে। কিন্তু ভাবতাম— ওরা নিশ্চয়ই আমাকে দেখছে না— কোনও জড়বস্তুকে দেখছে। এমন তো হতেই পারে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় ওরা হয়তো ভাবছে কোনও জড়বস্তুর দিকে তাকিয়ে আছে। ফলে আমাকে আর ঘৃণা করছে না, কারণ জড়বস্তুকে তো কেউ ঘৃণা করে না।
বাবা থামল। তারপর মায়ের ঘরটার জানলার কাছে গিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকল। দূরে দূরে কিছু আলো জ্বলছিল অন্যান্য উঁচু বাড়ির। কিন্তু অন্ধকারটাই বেশি। যেন চারপাশে অন্ধকারের সমুদ্র। এরকমই ভাবতাম আমি, আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বাবা বলল। কিন্তু আজ দুপুরে তোরা যখন আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলি আমাকে, আমি বুঝতে পারছিলাম তোরা আমাকে কোনও জড়বস্তু ভাবছিলি না। আমাকে তুই তোর বাবাই ভাবছিলি। মেয়েটা ভাবছিল সে দেখছে একজন অসৎ, ভয়ঙ্কর রাজনীতিককে। এমন কাউকে, যাকে সবাই ভয় পায়। যাকে সবাই ঘৃণা করে। এমনকী, অনেকে যার মৃত্যুকামনাও করে।
চুপ করে বাবা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
তুইও তো ঘৃণা করিস আমাকে! হঠাৎ আমাকে বলল। তোর মা ঘৃণা করে, তোর বোন ঘৃণা করে। রাজনীতি করে প্রচুর টাকা করেছি। নানা উপায়ে। সে সব তোরা জানিস। টাকাটা তোরা ভোগ করিস, আবার আমাকে ঘৃণাও করিস। টাকাটা ভোগ করিস, কারণ তুই বা তোর বোন কেউ এখনও রোজগার শুরু করিসনি। আর আমাকে ঘৃণা করিস, কারণ তোরা জানিস টাকা আমি কীভাবে করেছি। এরকম নানা দ্বন্দ্ব, মানসিক যন্ত্রণায় তোরা ভুগিস, আমি জানি। এটা স্বাভাবিক। তোর মা তো আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও আজকাল দেখা করতে লজ্জা পায়। আমাকে একদিন চাপা স্বরে বলেছিল। বর্ধমানে তোর মাসির বাড়ি গেল— সেটা নেহাত মাসি মরণাপন্ন বলে। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা তো আমিও বহুকাল বন্ধ করে দিয়েছি। চোখ তুলে কেউ আমার দিকে তাকালেই আমার মনে হয়— একজোড়া গভীর কালো গর্ত হাঁ করে আমার জন্য ওৎ পেতে আছে।
বাবা চুপ করল। আস্তে আস্তে হেঁটে ড্রয়িংরুমে ফিরে এল, তারপর হুইলচেয়ারটার কাছে দাঁড়িয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকল। চেয়ারে বসল না। আমি ও জাগরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
তোমার জন্য চা বানিয়ে দিই বাবা? একটু এগিয়ে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম। বাবা উত্তর দিল না। জানলার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। দূরে দূরে স্তব্ধ, উঁচু উঁচু বাড়ি চোখে পড়ছিল।
এর মধ্যে জাগরী দেখি চা বানিয়ে কাপটা বাবার কাছে এনে রাখল। বাবার দৃষ্টি বাইরে। চা খেল না। কিছু বলতে আমার সাহসে কুলোচ্ছিল না। এই মুহূর্তে মা বা বোন থাকলে ভাল হত। ওদের কথায় বাবা হয়তো চা খেত। কে জানে। তো কারও সঙ্গে তেমন কথা বলত না। মা বা বোনও কম কথা বলত। তারপর তো হঠাৎ ‘স্মৃতিভ্রংশ’ হবার ঘটনা। এবং বাবার কণ্ঠস্বর একদম বন্ধ হয়ে গেল।
মাকে কি ফোন করব? বাবাকে কি বলব ওকে আমি ঠিক ঘৃণা করি না? ওর আশ্রয়েই তো বেঁচে আছি, পড়াশুনো করছি— ঘৃণা করব কোন অধিকারে? ঘৃণা করার তো উপায় নেই! শুধু কারও সঙ্গে ওর সম্পর্কে আলোচনা করতে একটু ভয় হয়। সঙ্কোচ হয়। কেউ প্রসঙ্গ তুললে মাঝে মাঝে ক্রোধও হয়। বাবাকে কী করে জানাই এ সব কথা? কতদিন ছাদে উঠিনি, হঠাৎ বলল বাবা, অস্ফুটস্বরে, যেন আমাকে বলছে না, আঠারোতলার জানলার বাইরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে— তাকে বলছে। কতদিন বাইরে বেরোইনি। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুধু বাড়িতেই কাটালাম। অন্যদের দৃষ্টিতে আটকে থেকে। যেন মাকড়সার জালে জীবন্ত পোকার মতো আটকে আছি। মাকড়সাটা শুধু দেখে যাচ্ছে আমাকে। মারছে না। অথচ গলা টিপে আমার স্মৃতিগুলোকে হত্যা করতে পারলাম না— অন্যের সামনে একটা নিরেট জড়বস্তু হয়ে যেতে পারলাম না!
সিঁড়ি দিয়ে বাবা ছাদে উঠছিল। কুড়িতলা বাড়ি এটা। আর দুটো তলার পরেই ছাদ। পেছনে পেছনে উঠছিলাম আমি ও জাগরী। এতদিন বাড়িতে এভাবে বন্দি হয়ে থাকলে সত্যি তো দম বন্ধ হয়ে আসে। ছাদে উঠলে কিছুক্ষণের জন্য একটু মুক্তির স্বাদ তো পাবে বাবা!
অচিরেই পেল মুক্তির স্বাদ। কুড়ি তলা ছাদের জমিতে পা দিয়েই বাবা জোরে জোরে সটান হেঁটে গেল সামনের কিনারার দিকে, দু হাতে রেলিং-এর লোহা শক্ত করে ধরল, তারপর চোখের পলকে নেমে গেল বাইরের অন্ধকার সমুদ্রে। পেছন ফিরে আমাদের দিকে একবারও তাকাল না— এখনও বাবার শুধু পেছনদিকটাই দেখা যাচ্ছিল, হুইলচেয়ারে বসে থাকার সময় যেমন দেখা যেত। আশেপাশের উঁচু উঁচু বাড়ির আলোয় আবছা চোখে পড়ছিল কুড়িতলার আকাশে চৈত্রের উন্মাদ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাবা এগিয়ে যাচ্ছে। যেন অনন্ত অন্ধকারের ভেতর নিভে যাওয়া ফানুসের খোলসের মতো ভেসে ভেসে যাচ্ছে জীবন নামক প্রহেলিকাময়, অস্পষ্ট একটা বস্তু।
আমরা দুজনে অসহায়ভাবে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে দেখে গেলাম।
এর দেড় বছর পর আকাশে ভাসতে থাকা এই হাওয়া বাড়ি ছেড়ে আমরা ফিরে গেলাম পাইকপাড়ায় আমাদের আধভাঙা পুরনো বাড়িতে। ওখানেই আমি ও বোন জন্মেছিলাম। একটা চাকরি পেয়ে জাগরীকে বিয়ে করেছি। পাড়ার লোকদের কেউ কেউ মেশে আমাদের সঙ্গে, তবে অনেকেই এড়িয়ে চলে। বাইপাসের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা এবং বাবার অন্যান্য টাকা মা এক জায়গায় দান করেছে। এটা আমাদের মহৎ কোনও কাজ নয়। আমাদের একটা গোপন, সঙ্কুচিত, বেদনাভরা প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা মাত্র। রাস্তায় আমরা মুখ নিচু করে হাঁটি। অন্যেরা আমাদের খারাপ চোখে দেখলেও আমরা প্রসন্ন থাকি। মা, বোন, জাগরী, আমি। আমার ধারণা, বাবাও।