অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
গিরি নামক বছর ত্রিশের লোকটা বসেছিল এক প্রাচীন বটগাছের নীচে। তার পাশেই একটি অশ্বত্থগাছ। দুজনেই ছায়া দেয় মাটিকে ও নদীকে। ছায়া পায় জল, ছায়া পায় পাখিরা। পাখিদের বাসা সেই ছায়ার কারণে রৌদ্রে উত্তপ্ত হয় না। পাখিরাও তীব্র গরমের দিনে গাছের পাতার নীচে বসে ঝিমোয়। তেষ্টা নিবারণ করে গঙ্গার পরিশুদ্ধ জলে। আর ছায়া পেয়ে নদীও যেন বাঁচে। নইলে গরমে গরমে সেও সারা হয়ে যেত।
অনেক রাতে যখন তার ঘুম ভেঙে যায়, বাইরে এসে এই গাছের নীচেই এমনই করেই বসে সে। দেখে গঙ্গার জল নেমে গেছে কতদূর— সেই মাঝগঙ্গা অবধি! একাকী, মাঝরাতে গঙ্গার ধার তার বেশ লাগে। দিনের গঙ্গা আর রাতের গঙ্গার তফাৎ কত! তার বিহার-দেশগাঁতে নদী নেই, গঙ্গা তো দূর! দিনের গঙ্গায় পানসি ভাসে, মাছ ভাসে, মানুষের দেহ ভেসে চলে; আর রাতের গঙ্গায় গঙ্গা সরে যায়; বেরিয়ে আসে জলকাদা, বালি; তাতে নেমে আসে গোলাপি সারসের ঝাঁক!
তার কাজ শুয়োর চড়ানো। গঙ্গাপাড় ধরে সেই সব শুয়োরের পাল খাবার খুঁজে নেয়, নিজেদের মধ্যে মারপিট করে আর সমানে ঘোঁতঘোঁত করে যায়। সে তাদের পিছন পিছন থাকে। আগে আগে যায়। হ্যাট হ্যাট করে, তাড়ায়। যখন দ্যাখে সব ঠিক আছে, সে একটু বসে যায় স্থানীয় বস্তির ছেলেপুলেদের সঙ্গে। গাছের গোড়ায় নিজেকে ঠেসে দিয়ে ছিলিম টানে। আর মাঝে মাঝে খেয়াল রাখে কোনও শুয়োর দলছুট হল কিনা। আর তার ঘরের পাশে যে ফাঁকা জায়গা সেখানে সে রান্না সারে। কেবল নিজের নয়, শুয়োরদের জন্য তাকে ভাত ফোটাতে হয় সেই একই পাত্র, একটি বড় হাঁড়িতে। নিজেরটুকু তুলে নিয়ে বাকিটুকু ঢেলে দেয় একটি বড় পাত্রে। সেখানে আরও কিছু সামগ্রী মিশিয়ে তৈরি হয় শুয়োরের খাবার। একবার হাঁক দিলেই তারা গঙ্গার কাদামাটি থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এখন প্লাসটিকের ছিলিম বেরিয়েছে। কিন্তু ওতে গাঁজা টানতে সে অভ্যস্ত নয়। মন ভরে না। নিজের গেঁজে সে রেখে দেয় মাটির ছিলিম। বহুদিনের সঙ্গী তার। এটিতে গাঁজা পুরে টানতে সে খুব আরাম বোধ করে।
গিরি জানে, ওরা হল সমুদ্র-সারস।
কিন্তু গাঁজাখোরেরা তা বিশ্বাস করে না। বলে, ওসব হল কল্পনা। ওসব হল না-ঘুম আসার অলসতা। অত্যধিক গাঁজা টানার ফল। আরও টানো— দেখবে গোলাপি সারস থেকে গোলাপি পরী হয়ে গেছে। তখন একটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘরে নিয়ে এসে তুললেই হল। একটা বউ পাবে তুমি।
সকলে তখন হেসে ওঠে।
একজন বলে, ঘরে এনে ডানাগুলি পুড়িয়ে ফেলো। নইলে আবার উড়ে পালাবে।
আবার হাসি।
গিরি ভাবে, গাঁজাভরা মাথার ভেতর কি এমনই ক্রিয়াকলাপ চলে? অনন্ত তার বিস্তার? মাথার রঙিন বুদুবুদেরা গোলাপি সারস হয়ে ডানা মেলে কি দূর-দিগন্তে?
এই দুই গাছ ঠিকঠাক ছায়া দেয় তার বর্তমান আবাসস্থল, দুই গাছের মধ্যে অবস্থিত সেই লোকটির এই ঘরটিকে। এককামরা ছোট্ট ইটের ঘর। মাথায় ভাঙা টিন। তার উপর রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা রাজনৈতিক দলের ফ্লেক্স তুলে এনে বেঁধে দিয়েছে লোকটা। বৃষ্টির জল টুপটাপ করে তার উপর দিয়ে গড়িয়ে যায়। লোকটা নাকি বলত, ওই ফোঁটাগুলি আসলে বৃষ্টির ফোঁটা নয়; নদীর জল, নদীরই ফোঁটা— নদীই আসলে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। যে-কোনও বৃষ্টি আসলে আকাশগঙ্গার জল।
না, লোকটিকে দেখেনি কখনও হিমরাজ গিরি। এসব শুনে শুনে সে একটা ধারণা করে নিয়েছে মাত্র। রোগাসোগা একটি লোক, কাঁধে পাট করা একটি গামছা চাপিয়ে নীরবে ঘুরে বেড়াত গঙ্গার পাড় ধরে। ফাঁকা জায়গা পেলে গাছ পুঁতত। বট, অশ্বত্থ আর না-জানি কোন না গাছের চারা। এইভাবে গাছ পুঁততে পুঁততে ও নদীকে চোখে চোখে রাখতে রাখতে লোকটি একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
সে কোথায় গেছে কেউ যেমন জানে না; সে বেঁচে আছে কিনা; সে আদৌ ফিরবে কিনা— এটাও কারুর জানা নেই। এই ঘরটি তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন। হিমরাজ গিরি এখন এখানেই থাকে। তালাবন্ধ ঘরের গায়েই একটি চালা। এটিতে তালা নেই। পাশের ঘরটার মতই টিনের দরজা। তবে হাফ। এখানেই, একটি সরু ও একজনের শোয়া-বসা করা যায়— এমনি ঘরে সে থাকে।
রাতে শয়নের পর গিরি শুয়ে শুয়ে লোকটার কথা ভাবে। অজানা-অচেনা একটি লোক, যাকে সে চোখে দেখেনি কোনওদিন; হয়ত দেখবেও না— অথচ তার ঘরে সে বাস করে যাচ্ছে, লোকটা তা জানছে না— সে তার ঘরে বসে খাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, নিদ্রা যাচ্ছে, সারস দেখছে; সে লোকটাকে ভেবে যাচ্ছে— ভেবে ভেবে সে বেরিয়ে পড়ে টিনের আগল ঠেলে আর দেখে লকডাউনের জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। নদীর জলে ভাটা। ভাটার টানে অনেক নেমে গেছে জল আর সেই কাদামাটিতে খেলা করছে একদল গোলাপি সারস!
রাত্রিটান শেষ হলে ঠুকে ঠুকে ছাই ফেলে পুনরায় সেটিকে গেঁজেতে পুরে নিতে নিতে ভাবে, লোকটি যদি ফিরে আসে আবার, ঘরটিকে তবে ছেড়ে দিয়ে হবে? তখন কোথা যাবে সে?
বস্তির ছেলেরা বলে, সে খ্যাপার কথা বাদ দাও— নদীর সঙ্গে সঙ্গেই হয়ত হেঁটে যাচ্ছে।
হুম!
আর ফিরলে তোমার অসুবিধে কী? তুমি তো আর তালা ভেঙে ঢোকনি। পাশের ঘরে আশ্রয় নিয়েছ। নিজে নাওনি, মালিক বলেছে। ঝামেলা করলে মালিক বুঝবে। বেশি কিছু হলে, মালিককে বলে কিছু টাকা মাস গেলে হাতে গুঁজে দিও। নাও, এখন আর এক ছিলিম টানো দিকিনি— মজা বয়ে যায়।
আর একজন বললে, সে যা-লোক, মনে তো হয় না ফিরলে ঝামেলা করবে।
গিরি একটু সাজগোজ ভালোবাসে। মালিক তাকে একটা পুরনো নীল রঙের জিন্স দিয়েছে। সর্বক্ষণ সেটা পরেই থাকে গিরি। খালি গা। তার পেটানো চেহেরা। তবে ইদানীং নাভির নীচে ভুঁরির আভাস মিলেছে। গলায় নকল রুদ্রাক্ষের মালা। চুলের সামনেটা মেরুন কালার। দাড়ি-গোঁফ চাঁচা। চেহারা ও চলনে-বলনে একটা হিরো হিরো ব্যাপার আছে তার। লুকটাও তেমনি বজায় রাখতে চায়। তাই ভুঁড়ি তাকে পীড়া দিলেও সেটা কমাতে পারে না। কাজ মিটলে চালায় ঢুকে সেটি পালটে একটি বারমুডা পরে নেয়। শোবার সময় লুঙ্গি পড়ে।
‘বাবু, এক ফোন করনা হ্যায়, মদত করোগে?’
তখন বটের নীচে দুপুরের রান্না করছিল গিরি। কাঠকুটো দিয়ে রান্না, ইটের উনুন। বড় একটা কাঠ সে গুঁজে দিচ্ছে তখন শুনল। ঘুরে তাকাল গিরি। দেখল, মাথার উপর থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে এক মহিলা। পরনের শাড়িও মলিন, আলুথালু বেশবাস। সে ফিরে যাচ্ছে লকডাউনের চতুর্থ দফায়।
–ফোন কোথ্যা করবে?
–ঘর।
কদিন আগে উম্পুন ঝড় হয়ে গেল। কতশত বড় গাছ পড়ে গেল। গঙ্গার ওদিকের বস্তি, এদিকে বন্ধ হয়ে থাকা পরপর দুটি চটকল দিব্যি আছে। যে বড় দুই গাছের নীচে তার বাস ও পাখিদের বাসা, তারাও দিব্যি আছে। অবিশ্যি বটের দু-একটি ডাল ভেঙেছে। মহিলাকে দেখে গিরির মনে হল, লকডাউন এখনও চলছে।
মহিলার বাড়ি বিহার। কিন্তু আর কোনও কথা বলছে না। অঝোরে কাঁদছে। তাকে দেখে কিছু একটা হয়েছে ভেবে গাঁজাখোররাও এগিয়ে এল।
–কী ব্যাপার?
ঝড়ের ফলে গিরির এক সুবিধে হয়েছে। সেটা হল জ্বালানির। আগে কাঠকুঠোর জন্য এদিক-ওদিক খুঁজতে হত। এখন হাত বাড়ালেই ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের কোনও না কোনও ডাল মিলে যায়। কাঠের ব্যাপারে তার আর কোনও ভাবনা নেই। আর এই ঝড় যেন উড়িয়ে নিয়ে গেছে করোনাভাইরাসের ভয়। মাস্কের কোনও বালাই নেই। কেউ আর পরছে না দেখে গিরিও মাস্ক তুলে রেখেছে। কারও মাস্ক অবস্থান করছে গলায় বাঁধা নেকলেসের মত।
ভাত ফুটছে। হাঁড়ির মাথায় চাপানো আছে একটি ঢাকনা। সেদিকে একঝলক তাকিয়ে গিরি বললে, মেরে পাস ফোন নেহি হ্যায়।
বলে সে বাকি গাঁজাখোরদের দিকে তাকাল।
জানা গেল, মহিলার নাম উঙ্গা দেবী। গঙ্গার ওদিকে কয়েকটি ইটভাটা আছে। আরও অনেক মহিলার সঙ্গে এখানের কোনও এক ইটভাটায় কাজে এসেছিল সে। এতদিন আটকে পরেছিল। কিন্তু এখন সে ফিরে যাবে বলে মনস্থ করেছে।
গাঁজাখোরের দল বলল, তা যাও। কে বারণ করেছে? এখন সরকার ট্রেন চালাচ্ছে। শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন। লোকে বলে করোনা-এক্সপ্রেস! তাতে চেপে চলে যাও তোমার বাড়ি।
সমস্যা সেখানেই!
কীরকম?
লকডাউনে ইটভাটা বন্ধ। জমানো টাকা ও মালিকের কিছু দান ও অন্যান্য জায়গা থেকে আসা সামান্য সাহায্যে তারা চালিয়ে নিচ্ছিল কোনওরকমে। রিলিফের কিছু চালও মিলেছিল। কিন্তু যেই ট্রেন চালু হল, অনেকে চলে যেতে চাইল।
হ্যাঁ। চলে যেমন যাচ্ছে, চলে আসছেও তেমন। আর লকডাউনের বাজারে দেশের মানুষের সংসার এই চেয়েচিন্তেই চলছে।
করোনাভাইরাসের প্রতি মানুষের ভয়টা কমে যাচ্ছে। তারা ঝড়ে পড়া গাছের ডাল টেনে আনছে, কেটে পিসপিস করে নিচ্ছে। বাচ্চার দল লাফাচ্ছে, খেলছে। তাদের মায়েরা একত্রে বসে গল্প করছে। মাস্কের বালাই নেই। এরা সব পাটকলের শ্রমিক ছিল এককালে। এখন নানা ধরনের কাজকারবার করে। ওরা এখানেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। ওদের প্রজন্মের অনেকেই বিহার দেখেনি, দেশ দেখেনি।
এর পর মহিলা যা বললে তা হল এইরকম: দেশ থেকে ফোন এসেছিল কাল সকালে। তার স্বামী জমিতে কাজ করত। গতকাল রাতে সে মারা গেছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেছে বিহার যাবার। পারেনি। এদিকের রাস্তাঘাট সে কিছু চেনে না। তাই দেশে ফিরবে বলে কিছু ইট-শ্রমিকের সাথে সে পথে বেরিয়েছিল। পথে জুড়ে গেল আরও একঝাঁক অভিবাসী। মাঝে একস্থানে লঙ্গরখানা খুলেছিল। সেখানে সেই দল খিচুড়ি খেতে বসে যায়। তার পর থেকে হাঁটা আর হাঁটা। কিন্তু সেই দল পথে তারা হারিয়ে যায়। সে একা হয়ে পড়ে। এখন সে ফিরবে কী করে? পথঘাট কিছুই চেনে না।
শুনে সকলে চুপ করে যায়। গাঁজাখোরেরা যেন তাদের নেশার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সকলে চুপ করে থাকে ও এ-ওর মুখের দিকে চায়। অনেকে নদী দেখে। লকডাউনের ফলে জেলে নৌকা এখন ক্বচিৎ দেখা মেলে। নদীজলে শুশুক খেলা করে।
তারা ফোন তুলে দেয় মহিলার হাতে। এই ফোনে সে ডায়াল করতে পারে না। কাগজে লেখা একটি নাম্বার দেয়।
গাঁজাখোরেরা রিং বাজায়। নম্বরে ফোন ঢোকে না।
–নম্বর ঠিক আছে তো?
–হা হা।
–রুট বিজি বলছে। পরে দেখছি।
সদ্য বিধাবার হাতে তখনও শাঁখা, কপালে সিঁদুর। গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জল লেপ্টে গিয়েছে পথের ধুলোয়। স্বামীর পারলৌকিক ক্রিয়া না-করে শাখা-সিঁদুর ছাড়বে না, এই তার পণ। ততদিন গঙ্গাজল খেয়ে থাকবে।
বিজি। রুট বিজি।
হাঁটতে হাঁটতে তার পা ক্ষয়েছে। ঘামে সিঁথির সিঁদুর ধুয়ে গেছে। সে ফেলে এসেছে অতীত। পিছু ফিরে দেখা হল না, সে কী ফেলে এল। ফেলে আসাটাকে বিদায় জানানোও হয়নি তার। কী-ই বা নিয়ে সে ফিরছে। পথের ধুলোরা এই ঝড়ে সে-সব নিয়ে উড়ে যায়। শ্রমিকের দল চলেছে। তারা হাঁটছে। ট্রেনে কাটা পড়ছে। তাদের শেষ সম্বল কতগুলি পোড়া রুটি উড়ে যাছে বাতাসে। লঙ্কার জমিতে কাজ করা বছর তেরোর বালিকা হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যাচ্ছে রাস্তায়। তার মৃতপেটের ভেতর থেকে মিলছে ঘাসপাতা, লতাপাতা, বিষফল। তারা শ্রমিকের দল। ফিরছে। ঘরে। ঘরের পথ তারা চেনে না। রাস্তা জানে না। তাই ট্রেন লাইন ধরে হাঁটা ও কাটা পড়া। লাইনের উপর পড়ে থাকে আধপোড়া রুটি। মানুষগুলো হারিয়ে যায়। রুটিগুলো জেগে থাকে ভবিষ্যৎ হয়ে। মৃতজন শুধু জানে একটি ঘর আছে তাদের। সেখানে ফিরলে এই লকডাউন টাইমে তারা খাবার পাবে।
এইসব নিয়ে গাঁজারুরা আলোচনা করে আর গঙ্গার ধারে বসে গাঁজা টানে।
বিজি, বিজি। যাচ্ছে না ফোন।
একজন গাঁজারু বলে, এখন আর করোনা ট্রেন নেই। কবে কী মিলবে, সে খবর মিলবে পড়ে। আজকের রাত তুমি কোথা থাকবে, ভাবী?
উঙ্গাদেবী চুপ। মাথা নীচু।
অন্য একজন বলে, তবে গিরি, তোমার মালিককে ফোন করো, জানাও—
গিরি হাত বাড়িয়ে ফোন নেয়।
খানিক পর বাইক হাঁকিয়ে মালিক চলে আসে।
–কী ব্যাপার?
মালিক উঙ্গাদেবীকে দেখে। ট্রেনের খবর সেই দেয়। আর বলে, আজ রাতে এখানেই থেকে যাও— যাওয়ার তো কোনও উপায় নেই। ট্রেনের সময় জানতে পারলে টিকিট কেটে আমরাই তোমাকে ট্রেনে তুলে দেব, ততদিন থাকো।
গিরি বলে, মালিক, রাত্রে ও শোবে কোথা?
মালিক এদিক-ওদিক তাকায়। আশেপাশে নানা গাছ, বন্ধ থাকা পাটকল, পাড়ে রেখে যাওয়া ভাঙাচোরা একটি বাইক, দেবদেবীর কাপড়খোলা, জলে রং ধুয়ে যাওয়া মূর্তি, শুয়োর চলার পায়ের দাগ। তারপর পলাতক সেই মানুষটির ঘর। সেখানে লাগানো দশ টাকার ছোট্ট একটি তালা।
মালিক বলে, এর তালা ভাঙ। উঙ্গাভাবী এখানেই থাকবে।
–মালিক—
–আমি বলছি ভাঙ। যদ্দিন না ট্রেন আসে, ও এখানেই থাকবে। তুই রান্নায় যা ফোটাস, ওকে দিবি। পয়সা আমি দেব।
–ও খাবে না।
–মানে?
–ওর স্বামী মারা গেছে, ও তাই ঠিক করেছে, গঙ্গাজল খেয়ে থাকবে।
–সে আবার হয় নাকি! খাবার না খেলে ঘর গিয়ে দাঁড়াবে কী করে? এতদিন থাকবে কী করে? না না, গঙ্গাজল খাও খাও, কিন্তু খাবার খেতে হবে। গিরি তো ভাত সেদ্ধ, আলু-পটল সেদ্ধ করে খায়। তুমি যদ্দিন থাকবে আঁশ খাবে না ও— গিরি?
–জ্বি, মালিক।
উঙ্গা আর কোনও কথা বলল না। মাথা নীচু করে রইল।
শাবলের এক চাড়ে তালা ভেঙে গেল। দেখা গেল, ঘরে বিশেষ কিছু জিনিস নেই। বিছানা পাতা আছে। একটু ঝেড়েঝুড়ে নিলেই দিব্যি শোয়া যাবে।
মালিক বলল, ভাবী কোনও টেনশন কোরো না। এখানে তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি আমার দেশোয়ালি ভাবী। আমি কোনওদিন দেশ যাইনি বটে, কিন্তু আমার বাপ-পিতিমের ভিটে তো— নাকি। সেই দেশের মানুষ বিপদে পড়েছে, আর তাকে সাহায্য করব না?
এইসব কথাগুলো হিন্দিতেই হচ্ছিল।
উঙ্গা গাঁইগুঁই শুরু করল। যা জানা গেল তার থেকে, তা এই: তার স্বামী মারা গেছে বটে, তবে দেহ রাখা আছে ঘরেই; উঙ্গাদেবী ফিরলে তবে সৎকার হবে। ঘরের ভেতর, বরফ ছাড়া এতগুলি দিন দেহ থাকবে না। তাকে আজও রাতে বা খুব দেরি হলে কাল সকালেই রওনা দিতে হবে।
সকলে মাথা নাড়ল। না, এটা সম্ভব নয়। লকডাউনের সময় যা ভাবা যায় তা করা হয়ে ওঠে না।
উঙ্গা আর কিছু বলল না। চোখের জল মুছল।
রাতে সত্যিই কিছু খেল না উঙ্গাদেবী। বোতল ভরে গঙ্গা জল তুলে এনেছিল। সেই খেয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল গুটিসুটি মেরে।
রাত হলে গিরি নিজের ছোট্ট আস্তানায় ঢুকে পড়ল।
মাঝরাতে খুটখাট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। প্রথমে ভেবেছিল কোনও ছোটখাট জন্তু। চটকলে কিছু শেয়াল আস্তানা গেড়েছে, তারাও হতে পারে। এই শেয়ালের ভয়ে শুয়োরছানাদের জন্য তাকে সতর্ক থাকতে হয়।
কিন্তু সে শুয়ে রইল না, উঠে পড়ল। পাশের ঘরে একজন মেহমান আছে, তার ঠিকঠাক থাকার দায়িত্ব গিরির উপরই বর্তায়— ভেবে সে উঠল।
আর নিজের ঘরের আগল ঠেলে বেরিয়ে এসে সে অবাক। উঙ্গাদেবীর ঘরের দরজা হাট করে খোলা! ঘুম উড়ে গেল তার চোখ থেকে। কোথা গেল উঙ্গাদেবী?
এদিক-ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দ্রুত তাকাতে লাগল গিরি। আকাশে তখন জ্যোৎস্না এসে গেছে। চারিদিক এমনই ফটফটে সাদা আলো যে, সেই আলোয় অনেকদূর অবধি পরিষ্কার দেখা যায়।
নদীর জল নেমে গেছে অনেক দূর অবধি। বালুশ্রেণি চকচক করে আলোয়। সেখানে এসে গেছে, পাখিরা এসে গেছে; নদীতে নেমে পড়ছে তারা।
ফ্লেমিঙ্গোরা ভীড় জমিয়েছে জল নেমে যাওয়া গঙ্গার চরে। এই রাতেই পুরো চর গোলাপি হয়ে গেছে পাখিদের রঙে।
ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে তার মাঝে নেমে যাচ্ছে উঙ্গাদেবী। গিরি অবাক হয়ে দেখে, উঙ্গাকে দেখে পাখিরা মোটেই ভয় পায় না। বরং যেন সাদরে বরণ করে নেয় তাকে।
বিমূঢ় গিরি দাঁড়িয়ে থাকে ঘাটের মাথায়। কথা বলতে যেন ভুলে গেছে সে। দেখে, পরনের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে উঙ্গাদেবী হয়ে ওঠে এক গোলাপি সারস! আর সে মিশে যায় বাকি পাখিদের সঙ্গে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই অভিবাসীদের সঙ্গে সে উড়ে যাবে স্বামীদেহের পাশে।