Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মৌন মর্মর

মৌন মর্মর -- অবিন সেন

অবিন সেন

 

সকাল পেরিয়ে বেলা দুপুরের দিকে ঢলে পড়েছে। শানিত বল্লমের মতো রোদের ফলায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে চরাচর।

কিন্তু বাজারের পথ তটস্থ। তারা ছোট ব্যবসায়ী। পথের ধারে বেতের ঝাঁকায় পসরা সাজিয়ে তারা বেসাতি করছিল। তারা সব দৌড়ে চলে যাচ্ছে। ওই তো দূরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে রাজার সৈন্যরা সার বেঁধে আসছে। যুদ্ধে চলেছে তারা। ঘোড়ার খুরে আর পদাতিকের পদ-সঞ্চারে ধুলোর মেঘ ঘনিয়ে আসছে। সবাই উৎসুক, ‘এত সৈন্য কোথায় চলেছে!’ তারা শঙ্কিতও হয়। ‘দেশে কি তবে আবার যুদ্ধ লাগল!’ যুদ্ধ বড় সর্বনেশে জিনিস। রাজ-কর বেড়ে যায়। কত মায়ের কোল খালি হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ কেউ যুদ্ধ চায় না। তবু যুদ্ধ হয়।

মাথায় দই-দুগ্ধ-মিঠাইয়ের ঝাঁকা নিয়ে মাণিকা বাজারের পথে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটি বড় চঞ্চলা। সুন্দরী কিন্তু মুখরা। চতুরা কিন্তু দুঃখী। স্বামীর ঘর পায়নি। বাপের ঘরেই থাকে। মাথায় দই মিঠাইয়ের ঝাঁকা নিয়ে সে বাজারে আসে।

সৈন্যদের দল তখনও অনেকটা দূরে। কিন্তু দুই কিশোর ঘোড়সওয়ার যেন তাদের বাহিনীকে ছাড়িয়ে অনেকটা আগিয়ে এসেছে। ঠা ঠা রোদে তাদের তেষ্টা পেয়ে গিয়েছে। তারা ভেবেছিল বাজারের কাছে এসে তারা কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পানাহার করে নেবে। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে সৈন্যদের আগমনের সংবাদ পেয়ে বিপণিগুলি সব বন্ধ হতে শুরু করেছে। সামনে মাণিকাকে দেখে কনিষ্ঠটি তার ঘোড়া থামিয়ে বলল,

–হ্যাঁগো দিদি, তোমার ঝাঁকায় কী আছে?

মাণিকা তাদের দিকে ভালো করে তাকাল। যেন সদ্য কিশোর তারা। কিন্তু বলশালী চেহারা। যে কথা বলছিল সে কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু এমন কালো সুন্দর মুখ সে যেন আগে কখনও দেখেনি। কালো রঙের মধ্যে থেকে যেন চিকন আলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। মুখে প্রগলভ হাসি। অপর কিশোরটির বয়স তুলনায় বেশি। গৌরবর্ণ দেহ। কৃষ্ণাঙ্গটির মতো ছিপছিপে নয়, বরং বস্ত্র ভেদ করে দেহসৌষ্ঠব প্রকট। মুখের ভাবে গাম্ভীর্য।

কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি তার শাদা ঘোড়া থেকে নেমে মাণিকার মাথা থেকে ঝাঁকা নামাতে সাহায্য করল। তারা পাশের একটি গাছের ছায়ায় দাঁড়াল। মাণিকার খুব ভালো লেগেছে কিশোরটির আচরণ। সে তার সঙ্গে বকবক করছিল।

–তোমার নাম কী বাছা?
–আমি জগন্নাথ সিংহ। ও আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। আমরা মামার বাড়িতে মানুষ।
–তা বাছা, তোমাদের কতই বা বয়স? এই বয়সে তোমরা কেন যুদ্ধে বেরিয়েছ?
–কী করব দিদি? আমরা মাঠে মাঠ খেলে, দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম। যখন মামা শুনল, দেশে যুদ্ধ লাগছে, তখন বলল, ‘বসে বসে আর অন্ন ধ্বংস করতে হবে না, তোরা গিয়ে সেপাইদের দলে নাম লেখা।’ জানো তো দিদি আমার এই দাদাটি কিন্তু গদাযুদ্ধে দারুণ পারদর্শী।

মাণিকা মনে মনে বলল, আহা রে, বাছা আমার।

সে উত্তমরূপে তাদের মিষ্টান্ন ও দুগ্ধ সেবন করাল।

জগন্নাথ তার বস্ত্রের ভিতরে থেকে একটি তঙ্কা বের করে মাণিকার হাতে দিতে গেলে সে বলল,

–এই তঙ্কায় তো হবে না বাছা। আমার মিষ্টান্নের মূল্য।

জগন্নাথ মৃদু হেসে বলল,

–কিন্তু দিদি, আমাদের কাছে যে আর কোনও তঙ্কা নেই।

মাণিকাও হাসল।

–কিন্তু তঙ্কা না দিলে আমিও যে তোমাদের ছাড়ব না।

কিন্তু জগন্নাথ সিংহও নিরুপায়, তার কাছে আর কোনও তঙ্কা নেই। তখন মাণিকা বলল,

–এক কাজ করো না কেন! আমি বরং তোমাদের সঙ্গে এখানে দাঁড়াই, রাজা যখন এই পথ দিয়ে যাবে তখন তাঁর কাছ থেকে তোমারা আমার মিষ্টান্নের দাম চেয়ে দেবে।

একটু থেমে সে জিজ্ঞাসা করল,

–কি রাজি তো?

কিন্তু এই প্রস্তাবে দুই ভ্রাতা রাজি হতে পারছে না। দুই ভাইয়ের চোখে চোখে ইশারা খেলে গেল।

–না না তা কী করে হবে? মহারাজের আসতে তো এখনও অনেক দেরি। পর পর কতগুলো বাহিনী আসবে, তারপরে তো আসবেন মহারাজা। তুমি কি এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? দিদি, তোমার বাড়িতে চিন্তা করবে না?

মাণিকা বিষাদ মাখা গলায় বলল,

–কে আর চিন্তা করবে ভাই! বরং খালি হাতে ফিরে গেলে গঞ্জনা শুনতে হবে আমাকে। তার চেয়ে আমি অপেক্ষাই করি।

জগন্নাথ সিংহ নিরুপায় হয়ে তার বস্ত্রের ভিতর থেকে একটি অঙ্গদ বার করল। তার একমাত্র সম্বল অলঙ্কারটি মাণিকার হাতে তুলে দিয়ে বলল,

–দিদি এই আমার শেষ সম্বল। মহারাজা যখন এই পথে আসবে তখন তুমি তাঁকে এই অলঙ্কারটি দেখিও, তিনি তোমাকে এর উপযুক্ত মূল্য দেবেন।

মাণিকা সেই অলঙ্কারটি হাতে ধরে কিছুটা বিশ্বাস অবিশ্বাস মেশানো চোখে তাকিয়ে থাকে। এই দুই কিশোরকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।

 

দুই

অশ্ব শকটে বসে মহারাজা শ্রীপুরুষোত্তমদেব বিষণ্ণভাবে আকাশ পাতাল ভাবছিলেন। তাঁর মনে কোনও শান্তি নেই। কোথাকার কোন কর্ণাটের রাজা তাকে অপমান করে গেল! বলে কি না, ঝাড়ুদারের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিবাহ দেবেন না!

কর্ণাট রাজা নরসিংহ নিজের কন্যার সঙ্গে উৎকলাধিপতি শ্রীপুরুষোত্তোমদেবের বিবাহ প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সেই বিবাহের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে, উৎকল অধিপতি কর্ণাটের রাজাকে নিজের রাজ্যে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা আগতপ্রায়। রাজা নরসিংহ নিশ্চয়ই রথযাত্রার সময়ে ভগবানের আশীর্বাদ পেয়ে ধন্য হবেন। সেই সঙ্গে বিবাহের বিষয়ে পাকা কথাও সারা হয়ে যাবে। পুরুষোত্তমদেব বিবাহের বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। কারণ, কর্ণাট রাজকন্যা পদ্মাবতীর রূপ-গুণের খ্যাতি তিনি শুনেছেন।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধল রথযাত্রার সময়ে। রাজপরিবারের প্রথা মেনে ছেরা পহরার সময়ে মহারাজা পুরুষোত্তমদেব স্বর্ণ সম্মার্জনী হাতে শ্রীজগন্নাথদেবের যাত্রাপথ মার্জন করছিলেন। এই দৃশ্য দেখে নরসিংহ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। কী, এক রাজা ঝাড়ুদারের কাজ করছেন! আর সেই ঝাড়ুদারের সঙ্গে তিনি রাজ কন্যার বিবাহ দিতে চলেছেন? তিনি উৎকলের অমাত্যদের সামনেই কটুবাক্য বলতে লাগলেন। সেই দিনই উৎকলের মন্ত্রী বৃদ্ধ মাধব শাস্ত্রীর কাছে বিবাহপ্রস্তাব ফিরিয়ে নেবার নিধান দিয়ে নিজ রাজ্যে যাত্রা করলেন। তিনি পুরুষোত্তমদেবের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ করলেন না। দেব-আরাধনা সমাধান করে উৎকালাধিপতি যখন এই সংবাদ শুনলেন, তখন রাগে অপমানে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন।

কী, এত অপমান?

–মন্ত্রীমশাই, আপনি এখুনি কর্ণাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করুন। কর্ণাট রাজ্য ধ্বংস করে ওই বুড়ো ভাম নরসিংহের মুণ্ডু কেটে নিতে না পরলে আমার শান্তি নেই।

মন্ত্রী মাধব শাস্ত্রীও মনে মনে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনিও যুদ্ধে সায় দিলেন।

কর্ণাট রাজা নরসিংহও কম বীর নন। তিনিও জবরদস্ত প্রত্যাঘাত করলেন। পুরুষোত্তমদেব জুত করে উঠতে পারলেন না। নিজের বাহিনীর প্রভূত শক্তি-ক্ষয় করে, কর্ণাট বিজয় না করেই তাঁকে ফিরে আসতে হল।

গুপ্তচর মারফত তিনি সংবাদ পেলেন, কর্ণাট রাজকন্যা পদ্মাবতীর অন্যত্র বিবাহের চেষ্টা চলছে। এই সংবাদে রাজা পুরুষোত্তমদেব আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। দ্বিতীয় বার তিনি কর্ণাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। এইবার তিনি সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করেছেন।

তবু মনে মনে তিনি কোনও শান্তি পাচ্ছেন না। ভাবলেন, শ্রীজগন্নাথদেবের কৃপা থেকে তিনি কি বঞ্চিত হয়েছেন? না হলে কেন এমন হবে? কর্ণাটের মতো একটি ক্ষুদ্র রাজ্যকে তিনি জয় করতে পারছেন না!

সহসা কিছুর একটা গোলমালে তাঁর সম্বিৎ ফিরে এল। রক্ষীকে বললেন,

–দেখো তো কিসের এত গোলমাল?

সে সরেজমিনে সংবাদ নিয়ে এসে জানাল,

–এক যুবতী এক সেনানীর সঙ্গে বচসা করছে। বলেছে, তাকে আমাদের সঙ্গে নিতে হবে, নতুবা মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে।

মহারাজা বললেন,

–সে কি! কোন যুবতীর এত স্পর্ধা!

মনে মনে ভাবলেন, তবে তো দেখতে হচ্ছে বিষয়টা!

তিনি সেই যুবতীকে তাঁর সামনে নিয়ে আসতে বললেন।

মাণিকা আগে কখনও মহারাজকে দেখেনি। সে অবাক হয়ে গেল! এই কি সেই বীরের বীর, মহাপরাক্রান্ত শ্রীপুরুষোত্তমদেব! ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ, উন্নত শির, কী তার শোভা! এ সে সাক্ষাৎ কৃষ্ণ-ঠাকুর। মাণিকা অবাক বিস্ময়ে মহারাজের দিকে তাকিয়ে থাকল।

মহারাজা তার বিস্ময়বিমূঢ় অবস্থা দেখে মনে মনে যেন হাসলেন। কিন্তু মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,

–ভগিনী, তুমি কী চাও? শুনলাম তুমি নাকি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাও?

ভয়চকিত মুখে মাণিকা বলল,

–মহারাজা অপরাধ নেবেন না। আপনার এক সেনা আমার কাছ থেকে দুগ্ধ মাখন খরিদ করে মূল্য না দিয়েই চলে গেছে। সমস্ত ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে বলল মাণিকা।

মহারাজা তার কাছ থেকে অঙ্গদটি দেখতে চাইলে, মাণিকা তার বস্ত্রের অঞ্চল থেকে সেটি খুলে মহারাজার হাতে দিল।

অঙ্গদটি হাতে নিয়ে মহারাজা বিস্ময়ভরা চোখে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এ কেমন করে হবে! এ যে শ্রীজগন্নাথের অঙ্গদ! এই বৎসরই তিনি এই অষ্টধাতুর অলঙ্কার গড়িয়ে আরাধ্য দেবতার পায়ে উৎসর্গ করেছেন। এই অলঙ্কার এই কন্যার কাছে কীভাবে গেল? কে এই কন্যা? মন্দির থেকে এই অলঙ্কার চুরি করা তো অসাধ্য। একটি কথা ভেবে মহারাজের সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠল! তবে কি সেনার ছদ্মবেশে স্বয়ং শ্রীজগন্নাথ চলেছেন যুদ্ধে! ভগবান কি তবে এইবার মুখ তুলে তাকিয়েছেন? তাঁর মনে পড়ল, যখন তিনি প্রথম সিংহাসনে বসলেন তখন বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে এইভাবেই তিনি প্রভুর কৃপা পেয়েছিলেন। তাঁর দুই চোখ সজল হয়ে উঠল।

তবু মনে তাঁর সন্দেহ। আসলে যখন মানুষের মন দুঃসময়ের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে তখন তার মন থেকে কিছুতেই সন্দেহ দূর হতে চায় না। মহারাজা সমীহের চোখে মাণিকার দিকে তাকালেন।

এক রক্ষীকে ডেকে বললেন,

–এই ভগিনীকে মন্ত্রীমশাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। তিনি একটি বার্তা লিখে রক্ষীর হাতে দিলেন।
–ভগিনী মাণিকা, তুমি এই বার্তা নিয়ে মন্ত্রীর কাছে যাও। তিনি তোমাকে উপযুক্ত অর্থ মূল্য প্রদান করবেন। সেই সঙ্গে তোমাকে রাজ-অন্তঃপুরে উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থাও করে দেবেন। তোমাকে আর ঘুরে ঘুরে দুগ্ধ বিক্রি করতে হবে না!

মাণিকা মহারাজাকে আভূমি প্রণাম করে চলে গেলে মহারাজের সমরসজ্জা আবার কর্ণাটের অভিমুখে চলতে শুরু করল। পুরুষোত্তমদেব মনে মনে ভাবলেন, মেয়েটিকে চোখে চোখে রাখতে হবে। যুদ্ধের ফলাফলের উপরেই তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন, মেয়েটি কি সত্যই প্রভুর দেখা পেয়েছে! তবে তো সে সাধারণ মেয়ে নয়!

 

একবার প্রাণপণ যুদ্ধ করে উৎকলের আক্রমণকে রুখে দিতে পেরেছিলেন ঠিকই। কিন্তু নিজের রাজ্যের অর্থনীতি তাতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। তার উপরে বৃষ্টি কম হওয়ায় রাজ্যে ফসল ফলেনি ভালো। দেখা দিল খরা। এমনিতেই গ্রামে গ্রামে মড়ক দেখা দিয়েছে। কোনও উপায় না দেখেই নরসিংহ রাজনৈতিক সুবিধা চরিতার্থ করার জন্য বিজয়নগর, বাহমনী প্রভৃতি রাজ্যের কাছে নিজের কন্যার বিবাহের চেষ্টা করছেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী রাজারা জানেন, রাজকন্যার কারণেই উৎকলের সঙ্গে কর্ণাটের বিবাদ। এই বিবাদের মধ্যে তাঁরা নিজেদের কেন যেচে জড়াতে চাইবেন! সুতরাং নরসিংহ এই বিষয়ে খুব একটা সুফলের আশা করছেন না!

আবার যুদ্ধের কথা শুনে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি সত্বর একটি পরিকল্পনা করলেন। উৎকলের আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। সুতরাং তিনি যে দিক থেকে উৎকলের সৈন্যদের আসার সম্ভাবনা সেই দিকে একটি পরিখা খনন করাতে লেগে গেলেন। দিন রাত্রি শ্রমিকদের বিরতিহীন কাজে লাগিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে কয়েকটি উচ্চ পরিদর্শন স্তম্ভ নির্মাণ করালেন। নিজের রাজপ্রসাদকে করে তুললেন দুর্গের মতো সুরক্ষিত। মনে মনে ভাবলেন, দেখি কী করে এই চক্রব্যূহ ভেদ করে প্রবেশ করে উৎকলের ঝাড়ুদার রাজা। তিনি নিজে যথেষ্ট কুশলী। পুরুষোত্তমদেবকে তিনি বীর বলেই মনে করন না। ঝাড়ুদারের হাতে আবার তলোয়ার শোভা পায় নাকি!

কর্ণাট রাজ্যের সীমানায় পৌঁছে পুরুষোত্তমদেব দেখলেন, ভালো যুদ্ধের প্রস্তুতি করেছে বুড়ো ভাম নরসিংহ। কিন্তু তিনি এইবার কোনও ত্বরা দেখালেন না! অবাক হয়ে দেখলেন কোনও এক অদৃশ্য সেনানায়ক যেন তাঁর সেনাদের কর্ণাটদের সদ্য খোঁড়া পরিখার একপাশে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তারা যেন কর্ণাট রাজ্য অবরোধের পরিকল্পনা করেছে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছেন পরিদর্শন স্তম্ভের উপরে তীরন্দাজরা বসে আছে। কিন্তু তাদের তীর উৎকল সেনাদের সারি পর্যন্ত এসে পৌঁছাবে না। উঁচু উঁচু টিলার উপরেও তীরন্দাজরা বসে আছে। কিন্তু ওড়িশার সেনারা সেখানেও প্রতিপক্ষের তীরের পাল্লার বাইরে আছে। পুরুষোত্তমদেব যেন উৎসুক চোখে মাণিকা বর্ণিত সেই দুই তরুণের খোঁজ করছিলেন। কিন্তু কোথাও তাদের দেখতে পেলেন না। কিন্তু তিনি মনে মনে যেন অনুভব করতে পারছেন, তারা আছেন। নিশ্চয়ই তারা আছেন।

মাসাধিক কাল এই ভাবে তাঁরা কর্ণাট অবরোধ করে বসে থাকলেন। কর্ণাট রাজ্যের সমস্ত রসদ ও যোগাযোগের সমস্ত পথ তাঁরা বন্ধ করে দিলেন। এমনিতেই খরায় দুর্বল কর্ণাট রাজ্যের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। খবর পাওয়া যেতে লাগল রাজ্যে মড়ক লেগে গেছে।

একদিন, রাত্রে প্রাকারের মূল তোরণ দ্বারের সামনে বিশাল এক আগুনের ঝলকানি ঝলসে উঠল। যেন আকাশ থেকে ইন্দ্রের বজ্র নেমে এসেছে। মড় মড় শব্দ করে সেই বিশাল দ্বার ভেঙে পড়ল। দূর থেকে রাজা পুরুষোত্তমদেব দেখলেন সেই আগুনের ঝলকানির ভিতরে কৃষ্ণকায় এক তরুণ অস্ত্র আস্ফালন করে সৈন্যদের কর্ণাট রাজ্যের ভিতরে যেন সম্মোহিত করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। মহারাজের মনের ভিতরে খুশির আলো জ্বলে উঠল। ওই তো। ওই তো। স্বয়ং জগতের প্রভু তার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। তিনি বীর বিক্রমে কর্ণাট রাজ্যের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর সমস্ত সৈন্যদের কর্ণাট ধ্বংস করার নির্দেশ দিলেন। বাধাহীন সৈন্যরা পঙ্গপালের মতো তাদের ধ্বংস লীলা শুরু করল। লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নারীধর্ষণ কোনও কিছুই তারা বাদ দিল না।

নরসিংহ, নিজের দুর্গ রক্ষা করতে পারলেন না। নরসিংহকে বন্দি করে উৎকল অধিপতি রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বন্দি করবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কঠোরভাবে বলে দিলেন, কেউ যেন রাজকুমারীর অঙ্গ স্পর্শ না করে। তারপরে বন্দি কর্ণাট রাজা নরসিংহকে সামনে দাঁড় করিয়ে সকলের সামনে প্রতিজ্ঞা করলেন, রাজকুমারীর সঙ্গে তিনি এক ঝাড়ুদারেরই বিবাহ দেবেন।

অন্তরাল থেকে এই কথা শ্রবণ করে রাজকুমারী পদ্মাবতী চোখের জল ফেললেন।

 

তিন

কর্ণাট বিজয় তো হল। কিন্তু মহারাজা পুরুষোত্তমদেবের মনে তবু কোনও শান্তি নেই। কেন নেই? তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না। ভেবেছিলেন কর্ণাট রাজ বুড়ো শৃগালটার মুণ্ড ছেদন করে তিনি বিপুল হর্ষ প্রাপ্ত হবেন। সেই মনস্কামনা তো তাঁর অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। নরসিংহকে তিনি হত্যা করেননি কিন্তু অন্ধ-কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। সেই বা কম কী? কই তবু তো কোনও আনন্দ হচ্ছে না তাঁর! শুধু বারে বারে কেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে অন্তঃপুরের স্বচ্ছ মসলিনের পর্দার আড়াল থেকে এক ঝলকের দেখা দুটি ভ্রমর কৃষ্ণ চক্ষু। মহারাজের বুকের ভিতরটা যেন মথিত হয়ে যায়। এক নিমেষে আনন্দের সমস্ত আলোক যেন নির্বাপিত হয়ে যায়!

নিজের প্রতিজ্ঞামতো তিনি মন্ত্রী মাধব শাস্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন, রাজকুমারীর উপযুক্ত ঝাড়ুদারের অন্বেষণ তিনি যেন সত্বর করেন। যতদিন না উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে ততদিন রাজকুমারী যথাযথ মর্যাদায় প্রাসাদ অন্তঃপুরেই বসবাস করবেন। তাঁর যেন কোনও বিষয়ে কোনও অমর্যাদা না হয়।

বৃদ্ধ মাধব শাস্ত্রী মুখে কিছু বলেন না। ঘাড় কাত করে মহারাজের কথায় সায় দিয়েছেন, আর মনে মনে হেসেছেন। মহারাজের ইচ্ছা অনুসারে তিনি মাণিকাকে রাজকুমারীর খাস পরিচারিকা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন।

ওদিকে রাজকুমারীর মনেও আশঙ্কার শেষ নেই। রাজ ঐশ্বর্য ছেড়ে তাঁকে হতে হবে এক ধাঙড়ের ঘরণী! এর থেকে কি মৃত্যু ভালো ছিল না? কিন্তু বন্দিনীর সেই অধিকার কই! সে তো আসলে বন্দিনী। ভিখারিনীর মতো মহারাজা তাকে কৃপা ভিক্ষা দিয়েছেন। এই দয়ার দানে সে যেন আরও ছোট, হীন প্রতিপন্ন হয়ে গিয়েছে। এর থেকে তাকে পিতার মতো জেলখানায় বন্দি করে রাখলে কিংবা মৃত্যুদণ্ড দিলে বুঝি ভালো হত। বরং সে হত সম্মানের।

এতো দুঃখের মধ্যেও পদ্মাবতীর একটি মাত্র সান্ত্বনা সে মাণিকার মতো এক সখী পেয়েছে। মাণিকা তার সঙ্গে খুনসুটি করে। সারা রাজ্যের গল্প শোনায়। কি ভাবে সে এই রাজবাড়িতে কাজ পেল!

পদ্মাবতী মুগ্ধ হয়ে সেই সব গল্প শোনে।

মাণিকা গল্পে গল্পে মহারাজ পুরুষোত্তমদেবের প্রভূত বীরত্বের, দান-দয়ার গল্প শোনালে পদ্মাবতী দুরু দুরু বুকে সেই কাহিনি শোনে। শুনতে শুনতে বুকের ভিতরে শ্বাসবায়ুর অপ্রতুলতা টের পায়। মনে মনে বলে,

ছাই তোদের রাজা! বর্বর। অবুঝ। দস্যু।

মুখে বলে,

–হ্যাঁ রে মনি, তোর সেই দুই ভাই আর তোর সঙ্গে দেখা করেনি?

মাণিকা বিষণ্ণ মুখে বলল,

না গো দিদিরানি। তারা আর এল না। হয়তো এসেছিল। আমার খোঁজ করেছিল। আমি তো রাজবাড়িতে চলে এসেছি। হয়ত খুঁজে পায়নি।

যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন সম্ভাবনা মুখেই আনতে চায় না সে।

বিষণ্ণ পরিবেশটা কাটাতে পদ্মাবতী বলল। একটু যেন রাগ দেখিয়েই বলল,

–এই মুখ-পুড়ি, তুই কেন আমাকে দিদিরানি বলিস রে? আমি কি রানি? শুধু দিদি বলতে পারিস না?

হাসি রাগের ছলে বলতে গিয়েও তার গলাটা যেন বিষণ্ণ হয়ে আসে শেষের দিকে।

মাণিকা কী যেন ভাবে। মুখ টিপে হেসে বলে,

–রানিকে রানি বলব না!
–অন্য রানিদের কানে এই কথা গেলে তারা কী ভাববে বল তো?

মাণিকা হি হি করে হেসে ওঠে।

–তুমি কি যে বলো দিদিরানি! অন্য রানি আবার কোথা থেকে আসবে! তুমি জানো না, মহারাজের যে এখনও বিয়েই হয়নি।

সে আবার খিল খিল করে হেসে ওঠে।

পদ্মাবতী সত্যি এই সংবাদ জানত না। আসলে সে জেনেই এসেছে রাজা মানে তার বহু পত্নী থাকবে। তাই সে ধরেই নিয়েছিল তরুণ উৎকলাধিপতির নিশ্চয়ই একাধিক পত্নী আছে। পর্দার অন্তরাল থেকে একবার মাত্র সে মহারাজকে দেখেছে। সেই কথা মনে হলেই তার বুকটা দুরু দুরু করে ওঠে। মনে মনে বলে,

দস্যু একটা।

এমনি করে দিন যায়।

বার বার বিষণ্ণ মনে রাজা পুরুষোত্তম তাঁর মন্ত্রীকে তাগাদা দেন,

–মন্ত্রীমশাই, রাজকুমারীর জন্য পাত্র অন্বেষণ কতদূর?

মাধব শাস্ত্রী স্মিত মুখে বলেন,

–রাজকুমারীর উপযুক্ত আবার আপনার পছন্দের পাত্র অন্বেষণ কি চাট্টিখানি কথা! একটু তো সময় লাগবে রাজন।

রাজা আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন,

–কুমারীর কোনও অমর্যাদা হচ্ছে না তো? আপনি উপযুক্ত খেয়াল রাখবেন।

মাধব শাস্ত্রী আবার স্মিত-মুখে বলেন,

আপনি কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না আর্যপুত্র।

মহারাজা যেন মন্ত্রীমশাইয়ের কাছ থেকে রাজকুমারীর বিষয়ে আরও কিছু কথা শুনতে চাইছিলেন। কিন্তু মাধব শাস্ত্রী আর কিছু বললেন না।

তিনি যেন একমনে একটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবের পুঁথির দিকে তাকি ছিলেন। তিনি নিয়মিত নিজে গিয়ে পদ্মাবতীর সংবাদ নিয়ে আসেন। তার মতো সুলক্ষণা আর বিদুষী কন্যা রাজপরিবারেও যেন বিরল। কিন্তু ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস। ওই স্বর্ণপ্রতিমা কি জলে ভাসিয়ে দিতে হবে! তিনি হিসাবে মন দিতে পারেন না। মন তাঁর বিষণ্ণতায় ভারি হয়ে ওঠে।

ওদিকে কারাগারের অন্ধকারে বসে বসে বুড়ো নরসিংহ শাপশাপান্ত করেন। মাঝরাতে তাঁর চিৎকার আর গালিবর্ষণ পাথরের দেওয়ালে বার বার প্রতিফলিত হতে হতে তাঁর নিজের কাছেই ফিরে আসে। তাঁর কটু কথার প্রতিধ্বনি তাঁকেই যেন অভিসম্পাত দিতে থাকে ক্রমাগত।

মহারাজা পুরুষোত্তমদেবেরও রাত্রে ঘুম হয় না। শয্যা থেকে উঠে উন্মুক্ত বাতায়নে পদচারণ করে বেড়ান। আর বারে বারেই আলগোছে তাঁর চোখ অনতি দূরের একটি মহলের মুক্ত গবাক্ষের দিকে চলে যায়। আবার যদি সেই মুখশ্রী বিপুল চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে গবাক্ষ পথে! কী এক উন্মুখ পিপাসা। কিন্তু প্রতি দিনই মহারাজাকে নিরাশ হতে হয়। মাত্র একবার চন্দ্রলোকে সেই মুখটি দেখেছেন তিনি। সেই একবার দেখাতেই মহারাজের বুকের ভিতরে সেই মুখটি যেন চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছে। তিনি তো চাইলেই সেই মুখশ্রীকে নিজের বুকের নিকটে টেনে নিয়ে আসতে পারেন! তিনি রাজা! রাজ্যের সমস্ত কিছুর উপরেই তাঁর অধিকার। অধিকার তিনি চাইলেই আদায় করে নিতে পারেন। তার বদলে তিনি চুরি করে সেই মুখশ্রী দর্শনের অপেক্ষায় বসে থাকছেন। গর্বিত মহারাজা কোনওভাবেই যে নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না! ভরা রাজসভায় তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, রাজকুমারীকে এক ধাঙড়ের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে অপমানের প্রতিশোধ নেবেন। সেই তিনি কি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে প্রজাদের কাছে প্রতিজ্ঞা-ভ্রষ্ট রাজায় পরিণত হতে পারেন? না তিনি তা পারবেন না!

মহারাজা পায়ে পায়ে তাঁর সাধের পুষ্প উদ্যানে নেমে এসেছিলেন। আকাশে যেন মেঘ। বর্ষা এসে গিয়েছে। আর কয়েক দিন পরেই ভগবান শ্রীজগন্নাথের স্নান যাত্রা। তার উদ্যোগে ব্যস্ত সমস্ত রাজ্য। মন্ত্রীমশাই বলেছেন এইবারে দেবতার স্নান যাত্রার আগেই রাজকুমারীর জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করবেন। রাজা বিষণ্ণ মনে মাথা নাড়তে নাড়তে আকাশের দিকে তাকালেন।

মেঘের হানাদারিতে ঢাকা পড়েছে চাঁদের মুখ। সহসা মহারাজা দেখতে পেলেন, ওই দ্বিতল মহলে কিসের আলো! আলো না আগুনের ঝলকানি!

মহারাজা ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। বিন্দু বিন্দু স্ফুলিঙ্গ নিমেষে অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে। মহারাজের যেন হৃদস্পন্দন থেমে গেল। ওই যে পদ্মাবতীর মহাল। পুরুষোত্তমদেব আর কাল বিলম্ব করলেন না! তিনি দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সেই দিকে ছুটে গেলেন। লেলিহান আগুনে মসলিনের পর্দাগুলি অন্ধকারে মুক্তকেশী রাক্ষুসীর মতো নৃত্য করছে। মৃদু বাতাসে তাদের নাচন যেন আরও পাগলপারা। কোন ঘরটা পদ্মাবতীর? মহারাজা কি জানেন? ততক্ষণে মহলে সাড়া পড়ে গেছে। ছুটে আসছে রক্ষীরা। তাদের হাতের মশালের আগুনে বেহিসেবী আগুনের উল্লাস যেন আরও বেড়ে গিয়েছে। সেই রক্ষীদের মধ্যে থেকেই কে এক কৃষ্ণকায় তরুণ যেন মহারাজকে সত্বর বললেন,

–ওই দিকে, ওই দিকে মহারাজা!

মহারাজে এক নিশ্বাসে সেই দিকে ছুটলেন। চারপাশে আগুনের কিন্নরীদের নৃত্য, ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত ঘর, প্রদীপের আর আগুনের আলোকেও তা ঝাপসা। একপাশে সশঙ্ক এক প্রস্তর মূর্তি। যেন থর ঘর করে কাঁপছে।

মহারাজের মুখ দিয়েই অজান্তে বেরিয়ে এল বিপন্ন ডাক,

–রাজকুমারী।

তারপরে কোনও কিছু না ভেবে ছুটে গিয়ে শঙ্কিত বিপন্ন মূর্তিটিকে অনায়াসে তুলে নিয়েছেন নিজের বুকের কাছে। রাজকুমারী পদ্মাবতী তার বিমূঢ় মুখ গুঁজে দিয়েছে মহারাজের বিস্তৃত নিরাপদ বক্ষে। রাজা ভাবলেন, কি পালকের মতো শরীর। তিনি ছুটে গেলেন সুরক্ষিত অন্য এক মহলের দিকে।

বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। বরুণদেব সম্পূর্ণ শান্ত হয়েছেন।

পদ্মাবতীর ভয় কেটে গিয়েছে। শান্ত হয়ে সে একটি উন্মুক্ত গবাক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে জোলো বাতাসে কবরীমুক্ত কেশ দুলে উঠছে। দু-একবার ঝলকে উঠছে বিদ্যুৎ। সেই আলোকে রাজা পুরুষোত্তম যেন রাজকুমারীর মুখ দেখতে পাচ্ছেন।

মহারাজা মৃদু স্বরে বললেন,

–আমাকে ক্ষমা করবেন কুমারী।

পদ্মাবতী যেন ঠিক বুঝতে পারল না। কিসের জন্য ক্ষমা! মহারাজা তাকে বুকে করে নিয়ে এসেছেন সেই কারণে!

সে কোনও উত্তর দিল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিজের কয়েক গুচ্ছ চুল নিয়ে খেলা করছিল।

মহারাজা নিজেও হয়ত জানেন না কেন তিনি ক্ষমা চাইলেন রাজকুমারীর কাছে।

রাজকুমারীকে নিরুত্তর দেখে তিনি আবার বললেন,

–সামনেই শ্রীজগন্নাথের স্নানযাত্রা!

কুমারী মুখের মধ্যে একটি অদ্ভুত শব্দ করে বললেন,

–হ্যাঁ, আমার মুক্তি!

পুরুষোত্তম বুঝতে পারলেন না। রাজকুমারী কি হাসল!

সহসা রাজকুমারী নিজের বস্ত্রের ভিতরে থেকে একটি তীক্ষ্ণ খঞ্জর বার করলেন। ঘরের প্রদীপের মৃদু আলোকে তার চকে চকে ফলা ঝলসে উঠল। রাজকুমারী সেটি হাতে নিয়ে বলল,

–যে কোনও মুহূর্তেই মুক্তি নিতে পারি।

আবার সেই হাসি।

মহারাজা চমকে উঠলেন।

এক কদম এগিয়ে গিয়ে বললেন,

–পাগলামি কোরো না পদ্মাবতী! দাও আমাকে খঞ্জরটি!

তিনি যেন এগিয়ে গিয়ে সেটি কেড়ে নিতে চাইলেন, পদ্মাবতীর হাত থেকে।

পদ্মাবতী বুক চিতিয়ে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াল। উঁচিয়ে ধরল সেই খঞ্জর।

–এক কদম এগোলেই এই বিষাক্ত শলাকা কিন্তু আপনার বুকে বিঁধিয়ে দেব।

মহারাজা ভয় পেলেন না। তিনি এক কদম এগিয়ে গেলেন। সেই শলাকার নখ কি তাঁর বুক স্পর্শ করল! প্রগাঢ় স্বরে বললেন,

–তবে বিঁধিয়ে দিচ্ছ না কেন?

পদ্মাবতী সভয়ে পিছিয়ে গেল। পিছনেই উন্মুক্ত গবাক্ষ।

অন্যদিকে মুখে ফিরিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বলল,

–সে আমার ইচ্ছা!

আবার সেই হাসি।

তখনই বিদ্যুৎ ঝলক। সেই তীব্র নীলচে আলোকে মহারাজা পুরুষোত্তম বিস্ময় বিমূঢ় চোখে দেখলেন, পদ্মাবতীর দুই চোখ, মুখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। এতক্ষণ যা তিনি হাসি ভেবেছিলেন, তা আসলে কান্না!

তিনি পিছিয়ে এলেন। মুখের সমস্ত ভাষা হারিয়ে যায় তাঁর। বহু যুদ্ধ করেছেন তিনি, তলোয়ারের আঁচড়ের ভাষা তিনি বোঝেন। কিন্তু নারীর হাসি কান্নার রহস্য তাঁর কাছে দুর্জ্ঞেয়!

তিনি যখন পিছন ফিরে চলে যাচ্ছেন, শুনতে পেলেন পদ্মাবতী বলল,

–দস্যু।

 

জগন্নাথদেবের স্নান যাত্রার সময় উপস্থিত।

মন্ত্রী মাধব শাস্ত্রীর ব্যস্ততার সীমা নেই। মহারাজকে তিনি বলেছেন আজই পদ্মাবতীর জন্য উপযুক্ত পাত্রকে উপস্থিত করবেন। মহারাজের ইচ্ছাক্রমে রাজকুমারী সেই পাত্রের গলায় বরমালা পরাবেন।

মহারাজের মন ভালো নেই। তিনি আজ কিছুতেই মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না।

মাণিকা আর সখীদের সঙ্গে সুসজ্জিত হয়ে একটি মণ্ডপে এসে দাঁড়িয়েছ পদ্মাবতী। কী অপরূপ তার সাজ। হাতে স্বর্ণথালায় পুষ্পমালিকা। কিন্তু চোখে তীর-বিদ্ধ প্রজাপতির মতো মৃত দৃষ্টি।

ছেরা পহরার জন্য মহারাজা শ্রীজগন্নাথদেবের রথের সামনে পথে নেমে এসেছেন। তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। কাঁধে শাদা উত্তরীয়। কৃষ্ণকায় সৌষ্ঠব শোভিত দীর্ঘ শরীরের সৌন্দর্য দেখে উপস্থিত জনতা ভাবছে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন। তারা সকলে হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠল। চারিদিক থেকে পুষ্পবৃষ্টি এসে পড়তে লাগল পথে।

মহারাজা একবার পদ্মাবতীর দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ যেন ঝলসে গেল। দেখলেন পদ্মাবতী এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য দুর্বোধ্য তার চোখের দৃষ্টি। মহারাজা ধীরে ধীরে সেই দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।

উত্তরীয়কে কটিদেশে বেঁধে তিনি ছেরা পহরার জন্য স্বর্ণ সম্মার্জনী হাতে তুলে নিলেন।

পথ পরিষ্কার করার জন্য আরও অনেক মার্জনকারী পথে নেমেছে। তারা সবাই উৎসুক।

সহসা সকলকে থামিয়ে দিয়ে মহামন্ত্রী মাধব শাস্ত্রী একটি বেদির উপরে উঠে দাঁড়ালেন। ঘোষক একবার ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিল।

মহারাজা বিস্ময়ে সেই দিকে তাকালেন।

মহামন্ত্রী সেই বেদির উপরে উঠে বলতে শুরু করলেন,

–মহারাজা আমাকে একটি গুরু কাজের ভার দিয়েছিলেন। কর্ণাটের রাজকুমারী পদ্মাবতী দেবীর সঙ্গে বিবাহের উপযুক্ত এক সম্মার্জনকারীর অনুসন্ধান করতে হবে। আজ আমি রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্মার্জনকারীকে খুঁজে পেয়েছি।

তিনি একটু থামলেন।

–জগতের রক্ষাকর্তা শ্রীজগন্নাথদেবের যাত্রাপথের যে সম্মার্জনকারী, তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ মার্জনকারী আর কে আছেন এই রাজ্যে! মহারাজা আপনি হলেন সেই উপযুক্ত পাত্র। রাজকুমারী আপনাকেই বরমাল্য দেবেন। আপনার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তা আপনাকে গ্রহণ করতে হবে।

উপস্থিত জনতার হর্ষধ্বনিতে বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল।

রাজকুমারী বরমাল্য হাতে এগিয়ে এলেন। তার মুখে অনির্বচনীয় হাসি। চোখে জলের ধারা। মহারাজা পুরুষোত্তমদেব ধরা গলায় বললেন,

–কুমারী এই ঝাড়ুদারকে পছন্দ তো!

পদ্মাবতী বিদ্যুৎ-বিলোল দৃষ্টি হেনে বলল,

–দস্যু।

গালায় বরমাল্য পরে মহারাজা আবার স্বর্ণ সম্মার্জনী হাতে তুলে নিলেন। বিপুল বাদ্যযন্ত্র আর সমবেত মানুষের হর্ষ ধ্বনির মধ্যে ভগবানের স্নানযাত্রা শুরু হল।