জয়ন্ত ভট্টাচার্য
লেখক চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য কর্মী, প্রাবন্ধিক
বেড়ে ব্যাটাকে ধরার (পড়ুন চিনাদের) প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে করোনা অতিমারির একেবারে সূচনার সময় থেকে। মহামান্য ট্রাম্প মার্চ মাসেই করোনাভাইরাসকে “চিনা ভাইরাস” বলে দেগে দিয়েছিলেন। এতে গলা মিলিয়েছিলেন ব্রাজিলের চরম দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপ্রধান বলসারেনো। এমনকি নেচার-এর মতো বিশ্ববন্দিত সায়ান্স জার্নালও একটা সময় সহমত হয়েছিল। পরে নেচার পত্রিকা “End coronoavirus stigma now” শিরোনামে (৯.০৪.২০২০) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এখানে উল্লেখ করার যে একেবারে শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারির শেষেও এ ভাইরাসকে নোভেল করোনাভাইরাস বা nCoV-19 নাম দেওয়া হয়েছিল। পরে এর নাম দেওয়া হয় সার্স-কোভ-২, আর রোগটির নাম হয় কোভিড-১৯। যাহোক, নেচার-এর প্রতিবেদনটিতে খুব স্পষ্ট করে বলা হয়— “COVID‑19, the name was quickly adopted by organizations involved in communicating public-health information. As well as naming the illness, the WHO was implicitly sending a reminder to those who had erroneously been associating the virus with Wuhan and with China in their news coverage— including Nature. That we did so was an error on our part, for which we take responsibility and apologize.” সহজ বাংলা করে বললে, কোন জায়গায় ভাইরাসের উৎপত্তি এটা বিচার্য নয় বৈজ্ঞানিক নামকরণের ক্ষেত্রে। নেচার-ও এ ভুল করেছিল। এজন্য তারা ভুলের দায়িত্ব নিচ্ছে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছে।
এ প্রতিবেদনেরই শেষে বলা হল—
এটা খুব বেদনাদায়ক হবে যদি কলঙ্কচিহ্নের কারণে, যাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে করোনাভাইরাস, এশিয়ার যুবক সম্প্রদায় তাদের লেখাপড়া ছাঁটকাট করে আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলো থেকে পেছিয়ে যেতে শুরু করে। এর ফলে এদের নিজেদের এবং আন্ত্রর্জাতিক ক্ষেত্রে গবেষণার ক্ষতি হবে— ঠিক সেসময়ে যখন পৃথিবী বেশি বেশি করে নির্ভর করছে এরকম গবেষণার ওপরে। করোনাভাইরাসের কলঙ্কলেপন অবশ্যই বন্ধ হতে হবে— এখুনি।
আজ থেকে ১৫ বছর আগে আরেকটি বিশ্ববন্দিত সায়ান্স জার্নাল সায়ান্স-এ প্রকাশিত হয়েছিল একটি গবেষণাপত্র “Bats Are Natural Reservoirs of SARS-Like Coronaviruses” শিরোনামে (২৮.১০.২০০৫)। এর অর্থ ২০০৫ বা তার আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন বাদুড়ের দেহ সার্স গোত্রের করোনাভাইরাসের আধার বা ধারক।
এসবের পরেও করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব বাতাসে ভাসবে, মিডিয়ার খবর হবে, আমরা সবাই গোগ্রাসে গিলে নেব। আর কে না জানে গুজবের জোর, গোমূত্রের শক্তি যুক্তির চেয়ে ভারী। কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে প্রাণ আকুল করে তোলে!
Madison Area Lyme Support Group— এরকম নামের কোনও গ্রুপের নাম শুনেছেন কখনও? আমরা আমজনতা। কত কিছুই তো জানি না, বা বলা ভালো খুব কমই জানি— যদিও বলি অনেক কথা। আবার নিজেদের অজান্তেই বলে ফেলি— বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি? তা, থাক এসব কথা। গুজবে ভেসে, গুজব গিলে, গুজব উগরে দিয়ে আমাদের দিব্যি চলে যায়। বিজ্ঞানের দিব্যি গেলে কত কথাই না বলি। এমনকি রাষ্ট্র নিয়েও দু-এক কথা বলে ফেলি। এই তো হাথরস আর দিল্লিতে কী যেন সব হচ্ছে। কিন্তু যখনই রাষ্ট্র পিঠে টোকা মেরে মিহি গলায় বলে— কী হচ্ছে ভাই এসব দেশদ্রোহী কাজকম্মো? আমরা মাখনের মতো গলে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলি— না না, কী যে বলেন! আমরা এসবের মধ্যে নেই। মেয়েরা যদি নিজেদের সংযত রাখতে না পারে তাহলে এমন তো হবেই। অবশ্য আমাদের বাড়িতেও হাথরস ঘটে যাওয়ার মতো মেয়ে আছে।
আমরা তখন আবার ডুব দিই গুজব-সাগরের অপার ভুবনে। এখানে রাষ্ট্র কিছু বলবে না। আবার আমরা আমাদের ছায়াযুদ্ধে একটি প্রতিপক্ষও পেয়ে যাব— আমাদের জন্য নিরাপদ, ঝামেলা করবে না, তার চেয়েও বড় কথা রাষ্ট্র খুশি হবে আমরা এসবে মেতে আছি জানলে। রাষ্ট্রকে খুশি করতে কে না চায় বলুন? অন্তত আমি তো চাইই চাই।
এজন্যই ঘনাদার গল্পের মতো Madison Area Lyme Support Group-এর কথা তুলেছিলাম। যদি আপনাদের চেনা থাকে! করোনাভাইরাসকে নিয়ে অনেক গণ্ডগোলে পড়া গেছে। লকডাউন, “স্থানান্তরী” শ্রমিকদের লাঠি-গুলি চালানো, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় পূর্ণত লাটে উঠে যাওয়া, অর্থনীতির দুরবস্থা— এসব তো আছেই। তার সঙ্গে আরেকটা গুরুতর ব্যাপার আছে। “ঠান্ডা যুদ্ধ” পরবর্তী সময়ে যে একমেরু বিশ্ব তৈরি হয়েছে, যার একচ্ছত্র “বড়দাদা” আমেরিকা সেই একমেরু বিশ্ব করোনার গুঁতোয় এখুনি ভেঙে না গেলেও বেসামাল হয়ে পড়েছে। আরেক নতুন ধরনের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাস হচ্ছে। এমনকি ইয়ুভাল হারারির মতো রাষ্ট্রপন্থী বিখ্যাত মানুষও বলে ফেলছেন— এবারের করোনা সঙ্কট বিশ্বে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি করেছে। টাইম পত্রিকার মতো নামী পত্রিকায় (১৫.০৩.২০২০) লিখে ফেললেন— In the Battle Against Coronavirus, Humanity Lacks Leadership। এতদূর অব্দি বললেন— “আজকের পৃথিবী এক হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাওয়া সঙ্কটের মুখোমুখি। এ সঙ্কট শুধুমাত্র করোনাভাইরাসের জন্য নয়, বরঞ্চ আরও বেশি করে মানুষে-মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাস (trust) হারিয়ে যাওয়া। একটি মহামারিকে পরাজিত করতে হলে মানুষের প্রয়োজন পড়ে বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস করা, নাগরিকদের প্রয়োজন পড়ে জননেতা এবং আধিকারিকদের বিশ্বাস করা, দেশগুলোর প্রয়োজন পড়ে পরস্পরকে বিশ্বাস করার। বিগত কয়েক বছর ধরে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিজ্ঞানের ওপরে বিশ্বাস করার পরিসরটিকে ভিতরে ভিতরে ক্ষইয়ে দিয়েছে, জননেতৃত্বের ওপরে বিশ্বাসের ভিত ক্ষয়ে গেছে এবং ক্ষয়ে গেছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটি। এর ফল হিসেবে, আমরা আজকের সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছি যেখানে বিশ্বনেতৃত্ব অনুপস্থিত, যারা অনুপ্রাণিত করতে পারে, পারে সংগঠিত করতে এবং আন্তর্জাতিক আকাঙ্খাকে অর্থনৈতিক ও সহযোগিতার সুতোয় বাঁধতে।”
এরকম এক পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতার বাতাসে Madison Area Lyme Support Group-এর আবির্ভাব। বক্তব্য কী এদের? খুব সরল এবং প্রাঞ্জল ইংরেজিতে জানিয়েছে— “Proof That the Pandemic Was Planned & With Purpose Published on September 30, 2020 Written by Dr James Fetzer”। স্বপক্ষে যুক্তি? জার্মানির অনামা এক ডাক্তারদের সংগঠন (এদের ভাষায় ৫০০ জন আছে) “Doctors for Information”, তারা প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে কয়েকবছর ধরে “সুপরিকল্পিতভাবে” বিভিন্ন টেকনিক্যাল যন্ত্রপাতি বিক্রি করার জন্য করোনাভাইরাস অতিমারির গল্পটি ফাঁদা হয়েছে। এদের বয়ানে— “in 2017 and 2018— two years before COVID-19— hundreds of millions of test kits for COVID-19 were distributed worldwide.” এদের আবার একটি সাপ্তাহিক মেডিক্যাল সংবাদপত্র আছে যা সপ্তাহে নাকি ৫০০,০০০ কপি বিক্রি হয়। এবার আমরা একটু সামান্য যুক্তি দিয়ে ভাবি। সাদা চামড়ার এবং জার্মানির মতো দেশ বলে কি আন্তর্জাতিক জগতে মান্যতা পাওয়ার অতিরিক্ত কোনও কারণ আছে? আমাদের এখানে বালক ব্রহ্মচারী মরেহেজে গেলেও তার অনুগামী সংখ্যা হয়তো কয়েক হাজার। এ দিয়ে কি কিছু প্রমাণ হল? রামদেববাবার কোনও বুলেটিন থাকলে সেটাও অন্তত কয়েক লক্ষ কপি বিক্রি হবে ধরে নেওয়া যায়। জার্মানি একদিকে যেমন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানচর্চার পীঠস্থান তেমনি অন্যদিকে আবার ইউজেনিক্সের রাষ্ট্রিক প্রবক্তাও বটে, যার জন্য কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন কিংবা অঙ্গহানি হয়েছে একসময়ে। ফলে যুক্তি দিয়ে ভাবলে এগুলো কিছু দাঁড়ায় না।
নেচার-এর মতো বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানের গবেষণা পত্রিকায় ৬ অক্টোবর, ২০২০-র একটি প্রবন্ধের শিরোনাম “The COVID-19 social media infodemic”। এখানে বলা হল—
The case of the COVID-19 epidemic shows the critical impact of this new information environment. Theinformation spreading can strongly influence people’s behavior and alter the effectiveness of the countermeasures deployed by governments… Social media platforms such as YouTube and Twitter provide direct access to an unprecedented amount of content and may amplify rumors and questionable information… This shift from the traditional news paradigm profoundly impacts the construction of social perceptionsand the framing of narratives;it influences policy-making, political communication, as well as the evolution of public debate, especially when issues are controversial.
আমি বিভিন্নভাবে জার্মানির ডাক্তারদের যে সংগঠনটির কথা বলেছে শুরুতে উল্লেখিত রিপোর্টে সে সংগঠনটির ব্যাপারে সার্চ করে কিছু পাইনি। কোনও অস্তিত্বই দেখাচ্ছে না। তবে এর চাইতে গুরুতর অভিযোগ এসেছে চিন থেকে পালিয়ে আসা ডাক্তার লি-মেং ইয়ান-এর কাছ থেকে। এই মহিলা চিকিৎসক এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা একটি “গবেষণাপত্র”-ও লিখে ফেলেছিলেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে করোনাভাইরাস চিনের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। Hearst Television ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০-তে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে— “Report resurrects false claim that coronavirus was bioengineered”। এতে দেখানো হয়েছে এই “কন্সপিরেসি থিওরি” এবং গুজবের তত্ত্বের ইউটিউবে দর্শকের সংখ্যা ২০,০০,০০০-র কাছাকাছি এবং এই লিঙ্কটি ফেসবুকে ৫০,০০০ বার শেয়ার করা হয়েছে। লি-মেং ইয়ান-এর তৈরি করা পেপার একটি ওপেন-অ্যক্সেস ওয়েবসাইটে সেপ্টেম্বর ১৪-তে আপলোড করা হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে “Rule of Law Society & Rule of Law Foundation”-এর তরফে। এর দুটি সংগঠন আবার স্টিভ ব্যাননের (যিনি একসময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপদেষ্টা ছিলেন) সঙ্গে যুক্ত। এ দুটি সংগঠনের আরেকজন কর্তাব্যক্তি গুয়ো ওয়েংগুই (চিন থেকে পলাতক বিলিওনেয়ার)। Hearst Television-এর তথ্য অনুযায়ী— “Guo’s work in the U.S., including consulting services from Bannon, has drawn the interest of federal investigators, The Wall Street Journal has reported.” আবার জুলাই ৯, ২০২০-তে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রের (Distinct Today) খবরের শিরোনাম— “Billionaire Chinese fugitive is being investigated by the FBI over the funding of his media activities in the US and his ties to Steve Bannon”। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর (আগস্ট ১৯, ২০২০) অন্য একটি খবরের শিরোনাম— “Fundraising at Company Tied to Steve Bannon and Guo Wengui Faces Probe”।
ব্যাপারটা এত দূর গড়িয়েছে যে আমেরিকায় সরকারিভাবে “Coronavirus Rumor Control” নামে একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে Federal Emergency Management Agency (FEMA)-র তরফে।
এবার কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য দেখা যাক। নেচার-এ ১৭ মার্চ, ২০২০-তে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল— “The proximal origin of SARS-CoV-2”। এখানে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হল—
We offer a perspective on the notable features of the SARS-CoV-2 genome and discuss scenarios by which they could have arisen. Our analyses clearly show that SARS-CoV-2 is not a laboratory construct or a purposefully manipulated virus.
বলা হল—
Irrespective of the exact mechanisms by which SARSCoV-2 originated via natural selection, the ongoing surveillance of pneumonia in humans and other animals is clearly of utmost importance.
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এর মতো পত্রিকায় প্রকাশিত হল (এপ্রিল ২, ২০২০) “Escaping Pandora’s Box— Another Novel Coronavirus”। এ প্রবন্ধে বলা হল— “বিজ্ঞানীরা আমাদের জানিয়েছেন যে সার্স-কোভ-২ কোন ল্যাবরেটরির জার থেকে পালিয়ে যায়নি। এতে আরএনএ-র যে সিকোয়েন্স আছে সেটা সে সমস্ত ভাইরাসের মতো যারা নিঃশব্দে বাদুড়ের মাঝে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং এপিডেমিওলজির তথ্য বলে বাদুড়ে উৎস এমন একটি ভাইরাস ইয়ুহানের বাজারে বিক্রি হয় এরকম মধ্যবর্তী কোনও প্রাণীর মাঝে আশ্রয় নিয়েছিল।” সায়ান্স জার্নালে (২৪.০৭.২০২০) একটি খবরের শিরোনাম— “Trump ‘owes us an apology.’ Chinese scientist at the center of COVID-19 origin theories speaks out”। চিন দাবী করছে ট্রাম্পের “চক্রান্তের তত্ত্ব” চাউর এবং ফেরি করার জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে মান্য একজন ভাইরোলজিস্ট সত্তরোর্ধ শি ঝেং-লি সায়ান্স জার্নালের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন— “Here, I would like to make an appeal to the international community to strengthen international cooperation on research into the origins of emerging viruses. I hope scientists around the world can stand together and work together.” এর পরে আর কী বলার থাকতে পারে?
ডঃ ফ্রান্সিস কলিন্স আমেরিকার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ-এর “ডিরেক্টর’স ব্লগ”-এ (২৬.০৩.২০২০) লিখলেন—
No matter where you go online these days, there’s bound to be discussion of coronavirus disease 2019 (COVID-19). Some folks are even making outrageous claims that the new coronavirus causing the pandemic was engineered in a lab and deliberately released to make people sick. A new study debunks such claims by providing scientific evidence that this novel coronavirus arose naturally.
কর্পোরেট পুঁজি শুধু পুঁজির বিস্তার ঘটায় না, পণ্য এবং গুজব–নির্ভর একটি বিশেষ সামাজিক মানসিকতা প্রতি মুহূর্তে নির্মাণ করে। বিশেষ করে অতিমারির এই সঙ্কট সময়ে যখন মানুষ যা কিছু হাতের কাছে পাচ্ছে আঁকড়ে ধরতে চাইছে তখন এই social psyche তথা সামাজিক মনস্তত্ত্ব বিশেষভাবে কাজ করে। আমরা এক অদ্ভুত সময় অতিক্রম করছি যখন অবদমিত আতঙ্ক এবং ভেবে-নেওয়া মৃত্যুভয়ের সমাপতনে হাইড্রোক্সক্লোরোকুইনের মতো চিকিৎসার গুজব, অতিকথা এবং গল্পগাছায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। ভারতে রামদেববাবাও ঢুকে পড়েছে, হোমিওপ্যাথির অব্যর্থ ফললাভের গল্প শুরু হয়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাও হয়তো ব্যতিক্রম নয়। নেচার-এ (২৭.০৪.২০২০) প্রতিবেদন লেখা হয়— “Pseudoscience and COVID-19— we’ve had enough already.” সে প্রতিবেদনে বলা হয়— “Cow urine, bleach and cocaine have all been recommended as COVID-19 cures— all guff… And countless wellness gurus and alternative-medicine practitioners have pushed unproven potions, pills and practices as ways to ‘boost’ the immune system.” নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল–এ বিশেষ প্রবন্ধ লেখা হয়— “Covid-19— A Reminder to Reason” (এপ্রিল ২৯, ২০২০)। এখানে বলা হল— “এমনকি চিকিৎসকেরাও যারা বিজ্ঞানী হিসেবে প্রশিক্ষিত হয়েছেন, যাদের কাছে প্রত্যাশিত যে তারা একটি হাইপোথিসিস–অনুসৃত, যৌক্তিক, এভিডেন্স–নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন ক্লিনিক্যাল সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও, তারাও এরকম সঙ্কটের চাপে বিভিন্ন গল্পগাছায় ভেসে যেতে পারেন।”
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল–এর সাম্প্রতিকতম সম্পাদকীয়তে (৮.১০.২০২০) বলা হল যে কোভিড-১৯ বিশ্ব জুড়ে সঙ্কট তৈরি করেছে। এবং এ সঙ্কট দেশের নেতৃত্বকে বুঝে নেওয়ার একটা পরীক্ষা। আমেরিকাতে নেতৃত্ব এ পরীক্ষায় পূর্ণত বিফল হয়েছে। ২০০,০০০ মানুষের উপরে জীবনহানি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, অসংখ্য বেকার তৈরি হয়েছে। সম্পাদকীয়টির সিদ্ধান্ত— সম্পাদকীয়র শিরোনাম “Dying in a Leadership Vacuum— “নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কেউ এভাবে হঠকারীভাবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললে কিংবা টাকা তছনছ করলে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হত। এরপরেও আমাদের নেতৃত্ব তাদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের কাছে অব্যাহতি দাবী করেছে। কিন্তু এই নির্বাচন আমাদের হাতে বিচারের ক্ষমতা দিয়েছে। যৌক্তিক মানুষেরা আমাদের প্রার্থীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আপত্তি জানাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কখনও ‘লিবারাল’ বা ‘কনজারভেটিভ’ নয়। আমাদের জীবদ্দশার সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্যের সঙ্কটের প্রশ্ন যখন আসে তখন পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিপজ্জনকভাবে অকর্মণ্য। আমরা এদেরকে আর উৎসাহ কিংবা সামর্থ্য জোগাতে পারি না যাতে তারা আবার নেতা হিসেবে ফিরে আসে এবং হাজার হাজার আমেরিকানের মৃত্যু ঘটে। আমরা এদের আর ফেরার অনুমতি দিতে পারি না।”
পৃথিবীর সবচেয়ে মান্য মেডিক্যাল জার্নালে (ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ৭৮-এর বেশি) আমেরিকার নির্বাচনের প্রাক্কালে এরকম সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে। আমরা এখানে এ কাজটি করতে কবে পারব?
যাহোক, বর্তমানের গুজব-যাপিত জীবনে, মাটিতে দাঁড়ানোর বদলে স্রোতে ভেসে থাকার সময়ে, রাষ্ট্রের নির্মিত পোস্ট-ট্রুথ দুনিয়ায় যেখানে মিথ্যে কথাকে আপ্তবাক্য ধরে নেওয়া হয়, যখন বিজ্ঞান-যুক্তি বনাম বিশ্বাস-গুজবের দ্বৈরথে দ্বিতীয়টি সাময়িকভাবে প্রাধান্যকারী অবস্থানে থাকে তখন এরকম আরও অনেক ভয়াবহ গুজবের মুখোমুখি আমরা হব। তবলিঘি জমায়েত যে ভারতের করোনা সংক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটা আমাদের কাছে প্রায় বিশ্বাসের পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। কেবল মহারাষ্ট্রের— কোনও ধরনের জমায়েতহীন রাজ্যে— সংক্রমণ হুহু করে বেড়ে বিষয়টাকে পেছনে ফেলে দিল।
ফলে এটা চিনের ল্যাবরেটরিতে “তৈরি” “সুপরিকল্পিত” অতিমারি শুধু নয়। শুরুতেই যে আলোচনা করেছি বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতি-সামরিক-সামাজিক কর্তৃত্বের প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একমেরু বিশ্বের ধরনে কিছুমাত্র পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেনে নেওয়া কর্পোরেট পুঁজির পক্ষে মুশকিল। ফলে এরকম “গুল্পসংগ্রহের” মধ্য থেকে যুক্তি-নির্ভর বিষয়কে ধরে বেঁচে থাকা— এটাও অতিমারিকালের এক পরীক্ষা।