Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রাইমটাইম ও আগাছার বিষ

চার্বাক মিত্র

 

লেখক রাজনৈতিক ভাষ্যকার

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি পুরনো সাক্ষাৎকার ঘুরছে মার্কেটে, যেখানে গাঙ্গুলি শিশুতোষ সারল্যে বলছেন, ম্যাচ ফিক্সিং কীভাবে হয় তা তিনি জানতেনই না একটি সময় অবধি। এমনকী, ম্যাচ ফিক্সিং যে সম্ভব— তা-ই বহুদিন যাবৎ বিশ্বাস করেননি তিনি। এতে দোষ কোথায়? দোষ কারও নয় গো মা! সবাই যে ঘুঘু হয়ে ময়দানে নামবে তা তো নয়! কিন্তু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের রূপনারাণের কূলে এই বিস্ময়ে জেগে ওঠার থেকেও বড় খিল্লি— যখন জি নিউজ কোমর বেঁধে লাগে রিপাবলিককে গাল পাড়তে। যখন টাকা দিয়ে টিআরপি কেনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের চোখ হঠাৎ ঠেরিয়ে যায়। রাজদীপ সরদেশাই নাহয় প্রকাশ্য চ্যানেলে আঙুল তুলে অর্ণব গোস্বামীর নাম করে বলছেন, দয়া করে আপনি সাংবাদিকতাকে আর নীচে নামাবেন না, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ নাহয় প্রথম পাতায় হায়েনার চিৎকার করার ছবি ছেপে তার তলায় লিখছে, এর সঙ্গে কোনও টেলিভিশন অ্যাঙ্করের মিল পেলে তাতে হায়েনাটির দোষ নেই মোটেও। কিন্তু এই যে সব সংবাদমাধ্যমই কমবেশি আঁতকে উঠছে, খচে যাচ্ছে, ভাবছে এ কী বিষম কাণ্ডখানা— এসব নেহাত ন্যাকামো ছাড়া কিস্যু নয়। হ্যাঁ, একটা বিষয় আছে বটে। টিআরপি-কে যারা অর্জনীয় মনে করে, তাদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। এই যেমন ধরুন সুধীর চৌধুরী, যিনি একটি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মানুষ অসভ্যতা, ইতরামি দেখতে ভালবাসে। হট্টমেলা বসিয়ে জাতি-ধর্মের আফিম খাওয়ানো মানুষ পছন্দ করে। লোকের পেছনে লাগা, অকারণে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা লোকজন পছন্দ করে। তাই এসব দেখাতে হয়। অর্থাৎ, বহু কষ্টে-কসরতে যে অসহ্য কনটেন্ট বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে তারা, তা না করে টাকা দিয়ে লোককে টিভির সামনে বসিয়ে রাখলেই হত?

এখন দুটো কথা বলি। প্রথমত, এই দেশের কতসংখ্যক দর্শককে নেহাত টাকার লালিপপ ধরিয়ে টিভির সামনে বসিয়ে রেখে টিআরপি বাড়ানো সম্ভব? এদেশের এই বিপুল জনসংখ্যার যে অংশ রিপাবলিক দেখে, বা বলা ভালো গেলে, তাদের কতটা অংশকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করানো হয়েছে? আদতে টিআরপি একটা নিরালম্ব বায়ুভূত বই কিচ্ছু নয়। আপনি টিভি খুলে চ্যানেল ঘোরাচ্ছেন, কোনও একটি চ্যানেলে এসে আপনি হয়তো দশ সেকেন্ড থমকেছেন, টিভির এপার থেকে শব্দে-সেনসেশনে টিভির ওপারে আপনার উপস্থিতি টের পাওয়া গেলেই সেই চ্যানেলের টিআরপি গণনায় আপনি সামান্য হলেও ফ্যাক্টর হয়ে রইলেন। ফলে টিআরপি তালিকায় ফার্স্ট বয় হতে চেয়ে যদি রিপাবলিক কিছু লোককে বলে টিভি খুলে বসে থাকুন, শুনতে বা দেখতে হবে না— তাতে আদতে সংখ্যার কিছু হেরফের হয় মাত্র।

দ্বিতীয় যে কথাটা, এই যে বলা, টিভি খুলে বসে থাকুন, শুনতে হবে না, দেখতে হবে না— এই প্রবণতার কথা একটু ভাবুন। অর্থাৎ, এই লোকগুলো শুধু টাকার জন্য টিভির সামনে বসছে, রিপাবলিক কোন পক্ষে লড়ছে, মোগল না রাজপুত, তাতে এদের বিলকুল এসে যায় না। এইসব লোকের রাজনৈতিক অভিমুখ কী? এরা কি রিপাবলিকের গিলিয়ে দেওয়া প্রোপাগান্ডা হজম করে, নাকি সেই প্রোপাগান্ডার বিরোধী? অথবা তাদের কিছুই এসে যায় না। এই দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধরনের লোক যদি থেকে থাকে, তাহলে তারা জেনে বা অজান্তেই, নেহাত না চেয়েও রিপাবলিকের রাজনৈতিক হারাকিরিতে ধুনো দিচ্ছে? এই ১৩০ কোটির দেশে এইধরনের ছায়ামূর্তি কতগুলো আছে? সেই ছায়ামূর্তিরা তাহলে কি অবদান রাখছে এই গোয়েবেলসীয় কার্যক্রমে?

এখন ঘটনা হচ্ছে, শুধু টাকার লোভে কয়েকটা লোক টিআরপি বাড়াচ্ছে একটা চ্যানেলের, এটা টিভি-অর্থনীতির পক্ষে, সাংবাদিকতার নীতির প্রশ্নে কিছুটা সমস্যাজনক বটে, তবে পুরোপুরি নয়। এটা নেহাতই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে থেকে যেতে পারত, যদি এটা হত শুধুই সংখ্যার হিসেব। কিন্তু টিআরপি বাড়ানোর এই খেলা আসলে কী করছে? রিপাবলিকের রাজনৈতিক ন্যারেটিভকে আরও শক্তিশালী করছে। এখন সুধীর চৌধুরী, অমিশ দেবগণ, নভিকা কুমার, অঞ্জনা ওম কাশ্যপ— এরা কি আঙুল চুষছে বসে? আজ্ঞে না। এরাও তো ওই একই প্রোপাগান্ডা যন্ত্রটির হাতল ঘোরাচ্ছে। তাহলে রিপাবলিক আলাদা কোথায়? নেহাতই সংখ্যায়।

আসলে নিউ মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া যদি কোনও কিছুকে বিপদে ফেলে থাকে— সেটা হল ইলেকট্রনিক মিডিয়া। টুইটার ফেসবুকে প্রথম খবর বেরোচ্ছে, পোর্টালেই পাওয়া যাচ্ছে পোস্ট এডিটোরিয়াল লেখা, এটা আদতে প্রিন্ট মিডিয়াকে একচুলও বিপদে ফেলেনি। প্রিন্ট সময়ের নিরিখেই পুরনো। তাই হয়তো ডিজিটালের প্রযুক্তি তাকে একটু নড়বড়ে করেছে। কিন্তু আদতে তা সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে কেবল ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে। ‘দ্য সোশ্যাল ডিলেমা’ নামক একটি সাম্প্রতিক তথ্যচিত্র দেখিয়েছে, কীভাবে বিভিন্ন দেশকে অস্থির করে তুলতে পারে এই সামাজিক মাধ্যমের নেপথ্যের অর্থনৈতিক কাণ্ডারীরা। এদেশেও আইটি সেল সেই ভূমিকা পালন করছে। অর্থাৎ দক্ষিণপন্থী প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রেও আদত ভূমিকা পালন করছে সোশ্যাল মিডিয়া বা নিউ মিডিয়া। ফেক থেকে ডিপফেক তৈরি এবং প্রচার-প্রসার— এই গোটাটাই একটা বড় খেলা। সেখানে প্রোপাগান্ডা প্রচার করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া তো আর আদর্শ ধুয়ে জল খাবে না। তাদের দরকার অঙ্ক। সোজা কথা।

বিগত কয়েক বছর ধরে সমস্ত বিষয়েই আসলে একটি সরকারি ন্যারেটিভ তৈরির প্রকল্প চলছে। আর সেই ন্যারেটিভই যাতে গণন্যারেটিভ হয়ে ওঠে, তার প্রচেষ্টা চলছে। এখন, যাঁদের কথা সেই ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে, তাঁদের অবস্থান খুব সুবিধেজনক নয় শাসকের কাছে। কেন নয়? ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে যতই ফাঁকফোকর থাকুক না কেন, শাসক-বিরোধী একটা সমীকরণ তো আছে। তবে? আসলে, এ জাতীয় ন্যারেটিভ তৈরির উদ্দেশ্যই হচ্ছে, বিরোধিতাকে বিচ্যুতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ জনগণ যে ন্যারেটিভ দ্বারা চালিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার লোক থাকলেই মুশকিল। তাই ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হতে পারে আইনি অভিযোগ। আইনি ব্যবস্থায় তাঁদের ফাঁসানো গেলে সবচেয়ে সুবিধে। সে দিল্লি দাঙ্গা হতে পারে, ড্রাগ পাচার হতে পারে। একবার আইনি জালে জড়িয়ে দিতে পারলে, জনগণ সহজেই বিশ্বাস করবে যে, সরকারের এই বিরোধীরা আদতেই অপরাধী। এতে বেশ একটা বলিউডি ন্যায় দেওয়া যায়, যা গণতন্ত্রের শর্তের ঊর্ধ্বে। ‘শৌর্য’ ছবির কড়া মিলিটারি কে কে মেননকে মনে করুন। তিনি বারবার ‘ব্লাডি ডেমোক্রেসি’ বলে বিষোদগার করতেন। ফেক এনকাউন্টার তাই এখন নিউ নর্মাল। বিচার আসলে প্রহসনমাত্র। কথায় শুধু নয়, কাজেও তা প্রমাণিত। ট্রাম্প একটি চাঞ্চল্যকর কথা বলেছেন। বলেছেন, ভোটে হারলেও ক্ষমতা ছাড়বেন না। সুপ্রিম কোর্টে বুঝে নেবেন। আর রুথ বিডার গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর বিচারপতি নিয়োগও এখন ট্রাম্পের হাতে। তাই তাঁর এই স্বপ্ন সার্থক হতেই পারে। ঠিক যেভাবে কৃষি বিল পাশ হল, বা বাদল অধিবেশনে বিরোধীদের প্রশ্ন করা বন্ধ হল, সেভাবেই পরবর্তীতে সরকারি ন্যারেটিভ চলবে। যত প্রশ্ন কম হবে, তর্ক কম হবে— তত সেই ন্যারেটিভ হবে জনপ্রিয়।

আর এই গোটা রাজনৈতিক প্রকল্পকে ধুনো দেওয়ার জন্য রয়েছে প্রসাদধন্য গণমাধ্যম এবং আইটি সেলের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিজম‌‌। এটাও একটা প্রতিযোগিতা। সেখানে পিছিয়ে পড়লে চলবে কী করে? তাই অর্ণব গোস্বামীর ড্রাগ দো ড্রাগ দো হুঙ্কার দেশের যে বিপুল জনসংখ্যার কাছে পৌঁছচ্ছে, তার প্রমাণ হিসেবে দরকার টিআরপি-র অঙ্ক। আর কিছু না। এদেশের লোকজনকে সরল ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। তারা এই জাতীয়তাবাদী, ঘৃণার চাষ করা ভাবের বেলুনে বাস করে। এটা ভুলে গেলে চলবে না মোটেই। শশী কুমার এই টিভি অ্যাঙ্করদের বলেছিলেন ‘প্যারাসাইটস অফ প্রাইমটাইম’। রবীশ কুমার নিজে বলেছেন, দেখবেন না প্রাইমটাইম শো। অর্থাৎ এনডিটিভি প্রাইমও তার মধ্যে পড়তে পারে ভেবেও তিনি বলেছেন একথা। এই বিষাক্ত আগাছা আমাদের গণতন্ত্রের দেওয়ালে কতটা ফাটল ধরায়, দেখা যাক সেটা।


*হেডার ছবি: কুইন্ট, হিন্দি