চার নম্বর নিউজডেস্ক
প্রাককথন
সম্প্রতি চলে গেছেন রায়া দেবনাথ। বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ। হঠাৎ হৃৎযন্ত্রে বিকলন ও করোনাকালে উপযুক্ত হাসপাতালে জায়গা না পাওয়াই এর কারণ। তাঁর মৃত্যুর পরে এই শহরেই অন্তত দুটি কল্যাণকামী উদ্যোগ হয়েছে তাঁর নামে। দমদমে একটি কমিউনিটি কিচেন ‘রায়ার হেঁশেল’-এর আয়োজন করেছিল একদিন। আর টালায় শুরু হয়েছে ‘রায়ার পাঠশালা’৷ এসব তাঁর কমরেডদের উদ্যোগ, তাঁকে মনে রেখে। এছাড়া তাঁর সাংবাদিকবেলার লেখালেখি, কিছু পরবর্তী সময়ের লেখালেখি, আর অনেক বেশি ফেসবুকের লেখালেখিকে একত্রিত করে প্রকাশিত হয়েছে একটি বই– ‘রয়ে গেল রায়া’। বইটির কোনও মূল্য ধার্য করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত একপয়সাও নেওয়া হয়নি কারও কাছ থেকে৷ ভবিষ্যতে যদি কেউ স্বেচ্ছা-অনুদান হিসেবে কিছু দেন, তাহলে তা যাবে রায়ার পাঠশালারই কাজে। এই প্রতিবেদনে রায়াকে নিয়ে তিনটি উদ্যোগের চুম্বক ধরা রইল তিনটি আলাদা লেখায়। লিখেছেন-
সৌম্য চট্টোপাধ্যায় (রায়ার পাঠশালা)
অনির্বাণ মাইতি (রায়ার হেঁশেল)
বিশ্বজিৎ রায় (রায়ার বই)
***
রায়ার পাঠশালা
সৌম্য চট্টোপাধ্যায়
এক বছর হতে চলল। মানুষগুলোকে টালা ব্রিজের তলা থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হল আর পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন করার পর কর্পোরেশন থেকে থাকতে দেওয়া হল কালো প্লাস্টিকের ঘুপচি ঘরে – খালপাড়ে, রেলের জমিতে, নর্দমার পাশে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। রায়া তখন বারবার ফোন করত আর বলত “এইভাবে মানুষকে থাকতে দিতে পারে? এটা কখনও মানুষের থাকার ব্যবস্থা হতে পারে? না না, এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
এই বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষের লড়াই-আন্দোলনের সার কথা। মানুষের-মতো মর্যাদায় বাঁচার লড়াই! যেই স্বপ্নের তাড়নায় রায়ার বস্তি আন্দোলনে ছুটে আসা। রায়া শারীরিকভাবে আজ আমাদের মধ্যে নেই। টালাব্রিজের “রায়ার পাঠশালা”-র মাধ্যমে আমরা বাঁচিয়ে রাখবো তাঁর এই স্বপ্নগুলোকে।
১১ অক্টোবর টালায় “রায়ার পাঠশালা”র পথ চলা শুরু হল। রায়ার হয়ে টালার বাচ্চাদের উপহার দেওয়া হল নতুন জামাকাপড়। উপস্থিত ছিলেন রায়ার মা, বাবা, পরিবার পরিজন, বন্ধু, ভাই, বোন, কমরেডরা।
সেখানে ভবিষ্যতের বীজে জলসিঞ্চন চলবে। রায়া বিশ্বাস করত, এভাবেই আসলে সমস্ত ঘৃণার রাজনীতি সরিয়ে ভালোবাসার লড়াই জিতে যাবে এই পৃথিবীতে। সেই বিশ্বাস এগিয়ে নিয়ে যাবার দায় আমাদের সবার।
***
রায়ার হেঁশেল
অনির্বাণ মাইতি
লকডাউনে মানুষের খাদ্যের জোগান যাতে ব্যহত না হয়, তাই দমদমে আমাদের কমিউনিটি কিচেনটি চলছিল দীর্ঘদিন। তার মধ্যে হঠাৎ রায়ার মৃত্যুর খবর। অতঃপর ১২ই অগাস্ট দিনটি আমরা রেখেছিলাম শুধুমাত্র রায়ার জন্য৷ এই উদ্যোগই রায়াকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য উপযুক্ত বলে মনে হল। প্রায় ২৫০ জন মানুষ সেদিন রায়ার জন্য এসেছিলেন আমাদের হেঁশেলে। আমরা যতটা সম্ভব রায়াকে চেনানোর চেষ্টা করেছি। শঙ্খশুভ্র-র যে মাস্কগুলো রায়ার দেওয়ার কথা ছিল এখানে, সেগুলো সেদিন মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রায়ার বন্ধু এবং পরিবারকে কৃতজ্ঞতা জানাই, সেই দিনটাকে সফল করার জন্য।
***
রায়ার বই
বিশ্বজিৎ রায়
রায়া বা পিকুকে আমি প্রথমটায় জেনেছি কুশলদা- আলপনাদির সন্তান বলে। পরে নানা প্রতিবাদ মিছিলে- সভায় উদ্দীপ্ত শ্লোগানে মুখর মেয়েটিকে কিছুটা জেনেছি, বিশেষ করে মোদি সরকারের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি প্রকল্পের বিরুদ্ধে পার্ক সার্কাস ময়দানে প্রতিবাদী ধর্নার পর্বে। তবে সে সময় রাতজাগা রায়ার ভাবনা, আবেগ ও কাজের জগতের বিস্তৃত পরিচয় পেলাম ও চলে যাওয়ার পর। ওর নানা বয়সের বন্ধু- সহযোদ্ধাদের সযত্ন ভালবাসায় সাজানো ওর লেখা ও আঁকা, ছবিতে সাজানো ‘রয়ে গেল রায়া’ সংকলনটি পড়তে পড়তে, রেডিও কোয়ারাইন্টানে জীবনের নানা ক্ষেত্রে ওর ঘনিষ্টজনদের স্মৃতিচারণ শুনতে শুনতে আফসোস হল। এমন বাঁধ-না-মানা নদীর মতো উচ্ছল অথচ গভীর, মনকাড়া অথচ মননঋদ্ধ মেয়েটাকে আগে কেন ভালো করে জানলাম না! তবে এটাই তো বারবার ঘটে আমাদের জীবনে। কত জানার যোগ্য মানুষ বিদায়ের আগে অজানা থেকে যান এই ভুবনব্যাপী আন্তর্জালে বন্দি সময়েও। সুপার-শাসকদের সুপারি নেওয়া মগজখুনিদের এলগরিদম-নিয়ন্ত্রিত প্রতিধ্বনি-বলয়ে বাস করেও কত চেনা মানুষ অচেনা রয়ে গেল। বাঁধা গতের বুলিতে যখন বধিরপ্রায়, তখন নতুন চিন্তা ও বোধের ঝিলিকগুলোও চেতনায় ঘাই তোলার আগেই গতানুগতিকতার গহ্বরে তলিয়ে যায়। মাঝে মাঝে মৃত্যু এসে সম্বিৎ ফেরায়। এই লেখা রায়ার হঠাৎ থমকে যাওয়া জীবনে চলকে ওঠা আমার আধো-চেনা, আধো-জানা সময়ের অভিঘাতকে বোঝার চেষ্টা। ওর প্রজন্মের সঙ্গে আমার প্রজন্মের মিল-অমিলকে জানার চেষ্টা।
পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে রায়ার সরেজমিন অভিজ্ঞতার পৃথিবী গার্ডেনরিচ থেকে দার্জিলিং, নেপাল থেকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ছড়ানো। পাঁচ-ছয়ের দশকের জাতক আমাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এই বিস্তৃতি শুধু মানসভ্রমণেই সম্ভব। কিন্তু ওর মাটিতে পা ছিল। দাঙ্গা-দেশভাগ পেরিয়েও কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের শিল্পাঞ্চলগুলিতে হিন্দু-মুসলমান, বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি, বাংলা-হিন্দি- উর্দু ত্রিভাষী মহল্লাগুলি মিশ্র সংস্কৃতির আবাদভূমি ছিল। এসব অঞ্চলে যারা মন্দির-মসজিদ-মাজারের সহাবস্থানে বেড়ে উঠেছেন, তারা জানেন সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তত্ত্ব বা তথ্যচর্চার আগে একদিন প্রতিদিনের যাপিত জীবনে এই মহার্ঘ উত্তরাধিকার আমাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে। বিগত দশকগুলিতে তা ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে হতে এখন গেরুয়া-রাজনীতির দাপটে সেই পুরোন সামাজিক বুনোট ধবংসপ্রায়। এই প্রেক্ষিতে মহানগরের অন্যতম পুরোন মিশ্র বসতি বন্দর-এলাকার এক পাড়ায় বেড়ে-ওঠা রায়ার শৈশব- কৈশোরের স্মৃতি দ্রুত বদলে- যাওয়া সময়টাকে তুলে ধরে।
‘সাকিন গার্ডেনরিচ’ ঘিরে ওর পর্যবেক্ষণ- নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত, হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি- অবাঙালি কাছাকাছি বাস করে কোনও ‘বাফার জোন’ ছাড়াই। “ধর্মের দিক থেকে এখানে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হলেও সামগ্রিক ভাবে সংখ্যাগুরুর কালচারাল ডমিনেন্স কী বিষয় তা এখানে এলে মালুম হয়। এখানে মূল সংঘাত কিন্তু ধর্মীয় নয়, ভাষাগত”। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পর্ব নিয়ে সেদিনের পিকুর স্মৃতিভাষ্য, ‘ হ্যাঁ, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ আমায় একটা কঠিন বাংলা শব্দ শিখিয়েছে। দাঙ্গা।’ ঘরবন্দি জানালায় দোল খাওয়ার সেদিনগুলোর কথা বাবা-মায়ের কাছে শুনতে শুনতে, দাঙ্গাবাজদের কবল থেকে মন্দির-মসজিদ বাঁচাতে ওর ইকবালদা আর অসীমমামার মতো আদর্শনিষ্ঠ বামপন্থী মানুষজনের কথা জানতে জানতে অন্ধকারে আলো খুঁজতেও শিখেছিল।
না, বড় হয়ে কোনও বিরোধহীন সহাবস্থান, মতাদর্শজারিত কল্পস্বর্গের ছবি ও আঁকেনি। বরং এক রক্তমাংসের প্রতিবেশ উঠে এসেছে ওর অকপট গদ্যে- “ঝগড়াঝাটি নেই কি আর? বিলক্ষণ আছে। … দুপুরে শিরা ফুলিয়ে ঝগড়া, ফলোড বাই ঢিসুম ঢিসুম, এরপর বিকেলবেলা একে অপরের কাঁধ ধরে আড্ডাও আছে। ঐ যে বললাম গার্ডেনরিচ এখনও পড়শিতে ভরসা করে। আধুনিক ও না-আধুনিকতার ট্রান্সিশনে বাস করে কিনা…”। এই যে বিলম্বিত পর্বান্তর– একে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রান্তসমাজের গোধূলিকাল বলব না মোদির নয়া ভারতের আগ্রাসনের মুখে প্রতিরোধী পুরোন ভারতের এক টুকরো ছবি– জানি না। তবে রায়ার বয়ানে উঠে এসেছে ওর শৈশব- কৈশোরের সঙ্গী দুই বৃদ্ধ শ্রমিক, গার্ডেনরিচ নাগরিক পরিষদের দুই কর্মী উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা ব্রাহ্মণ আসরফি প্রসাদ আর মেটেবুরুজের মহম্মদ আজিজের বন্ধুতার কথা। একদা লাল ঝাণ্ডা তাঁদের মিলিয়ে ছিল। ঝান্ডাকেন্দ্রিক বুলির বাধ্যতা নয়, নেপথ্যের নাগরিক চেতনায় বিশ্বাস থেকে গ্রামীন ভারতের ক্ষীণধারা তবু আজও বহমান মানবিক উত্তরাধিকার তাঁদের সম্পর্ককে অমলিন রেখেছিল। এতটাই যে ধর্মের রাজনীতির বিরোধী প্রসাদের ছেলে মুলুক থেকে ফোনে ‘জয় শ্রী রাম’ চিৎকারে ভক্তি জাহির করলেও তার পুনরুক্তি করতে বাধেনি রায়ার আজিজ জেঠুর। পাল্টা জিজ্ঞাসায় শুধু ছিল, ‘ক্যায়সে হো বেটা?’
সেই সাতরঙের বাহারি গার্ডেনরিচে এখন ‘রেটে গণেশপুজো’, জয় শ্রীরাম লেখা ব্যানার আর স্কুলের ঘনিষ্ট বন্ধুদের ‘হঠাৎ করে বেশি হিন্দু হয়ে ওঠা’ আর ‘সবেতেই বর্ডারে সেনা দেখানোর’ সূত্রে ধর্মীয় মেরুকরণের ক্রমবর্ধমান কালো ছায়াকে দেখে পিকু মন খারাপ করেছে। এভাবেই জন্মভূমির বদলে যাওয়া দেখতে শিখেছে। নিজের ‘সুবিধাবাদী সামাজিক অবস্থান’কে না লুকিয়েও ওর প্রজন্মের ‘অভিশপ্ত শৈশব’ তথা ’৯২ এর দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি আটকাতে পথে নামার অঙ্গীকার করেছে। আর সেই অঙ্গীকারের তাড়না থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে গেছে সাম্প্রতিক দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের নাঙ্গা নাচের অকুস্থলে। জল্লাদদের রঙ্গমঞ্চের পাশেই খুঁজে পেয়েছে ধর্মের বেড়া পেরিয়ে পাশাপাশি বাঁচতে চাওয়া সন্তানহারানো মমতা সিং বা রক্তাক্ত খুরশিদদের। যার যেমন স্বভাব!
লিঙ্গসাম্য ও শ্রেণিচেতনার মিশেল থেকেই রায়া মানেসর থেকে ভাঙড় শ্রমিক- কৃষকের লড়াইয়ের পক্ষে পথ হেঁটেছে কলকাতা বা দিল্লিতে, লিখেছে ফেসবুক থেকে ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। দেশ- জাতি-ধর্ম-ভাষা– বর্ণবিভেদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিকতাবাদ আজ যখন কার্যত পরিত্যক্ত, রক্তপতাকাবাহীরাই পরস্পরের রক্ত ঝরায় বা দলবাজির দেওয়াল তুলে শ্রমিকদের বিভক্ত করে, তখন চিলি থেকে আমেরিকায় সাতরঙা গণজোয়ারে প্রভুত্বকামী দলতন্ত্র বা কর্তাভজা গোষ্ঠীতন্ত্রের পাপগুলো ধুয়ে যাওয়ার স্বপ্নে উচ্ছসিত হয়েছে রায়া। হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর নারীবিদ্বেষী, অভিবাসী ও ইসলামবিদ্বেষী, সাদা আধিপত্যকামী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কে বিপুল মিছিলে যোগ দিয়ে রায়া অভিভূত সহগামীদের লিঙ্গ-বর্ণ- ধর্ম- ভাষা, দেশীয় ও এথনিক উৎস তো বটেই, ভাবনা ও সংগঠনের বৈচিত্র্যেও।
আমি অভিভূত হয়েছিলাম আমেরিকায় মিছিলের রিপোর্ট রায়া নেপালি পত্রিকা ‘লালী গুরাস’- এর জন্য লিখে পাঠানোয়। দার্জিলিং পাহাড়ের শ্রমজীবী মানুষের কাছে আন্দোলন-সংগঠন সূত্রে ও বারবার ছুটে গেছে। পাহাড়িদের রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে দাড়িয়েছে। তাঁদের ভাষা শেখার চেষ্টা করেছে। কলকাতায় পড়তে আসা গোর্খালিভাষী ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু হয়ে উঠেছে। তা যে কতটা অকৃত্রিম ছিল তা ওর পাহাড়ি বন্ধুদের স্মৃতিচারণায় স্পষ্ট।
কাছে-দূরে নিজেকে এভাবে ছড়িয়ে দিয়ে, জীবনে জীবন জড়িয়ে নিয়েও ওর গার্ডেনরিচের ঘরের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য, পাড়ার মানুষের জন্য মন কেমন- করা অক্ষরের মন্তাজ চোখ ভিজিয়ে দেয়। ‘এ শহরে সন্ধ্যা আসে না’ এমনই এক লেখা যেখানে নিউ ইয়র্ক আর কলকাতা প্রতিবেশি হয়ে ওঠে, প্রবাসীর গৃহকাতরতা মিশে যায় ‘বড় বিষণ্ণ এ সময়, বড় দুখজাগানিয়া চারপাশ’ -এর আলোছায়ায়। রায়ার বাঙ্গালিয়ানার শেকড়ের সন্ধান মেলে ‘বাঙালি বাড়ি’ নিয়ে ওর রসস্নিগ্ধ, মায়াময় গদ্যে। ওর বর্ণনায় ধরা পড়েছে আমাদের হেঁসেল থেকে বসার ঘরের শব্দ-গন্ধ, দেওয়ালের বিচিত্র দৃশ্যপট, তোরঙ্গ থেকে আলমারিবন্দি কয়েক প্রজন্মের যাপিত জীবনের স্মৃতি তথা পারিবারিক সংস্কৃতির নানা বৈচিত্র্য। স্টিলের আলমারির সঙ্গে কাঠের আলনার সহাবস্থানের মতোই সিনারি-সম্বলিত ক্যালেন্ডারের পাশেই ফ্রেমবন্দি কার্ল মার্ক্স, রাজশেখর বসুর মহাভারতের পাশেই এক কপি কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো, গীতবিতানের পাশে ফেলুদা, পামুকের পাশে কার্তিক ঘোষ, ইউটিউবের যুগেও দেবব্রত, সুচিত্রার অডিও ক্যাসেট এমনকি একটি মৃত্যুপথযাত্রী টেপ-রেকর্ডার, ধুলোপড়া হারমোনিয়াম আর অকেজো সেলাইকল… দেশভাগ-পরবর্তী বাঙ্গালি মধ্যবিত্ততার এমন অজস্র অভিজ্ঞান এখন দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। সঙ্ঘ পরিবারের জমানায় জাতিসত্তাগত ভাবেই বাঙালি পরিচয়ই আজ গভীর সঙ্কটের মুখে।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে রায়া লিখেছে- “এই সংস্কৃতি সেরা কিনা জানি না, ভাবিও না, জানা বা ভাবার ইচ্ছাও নেই। শুধু জানি এ বড় প্রিয়, এই তো অস্তিত্ব। দেশের অন্য প্রান্তে , অন্য কোনও জাতিও নিশ্চয় ঠিক এই ভাবেই নিজেদের চিনে নেয়। অস্তিত্ব খুঁজে পায়। এই অস্তিত্বটুকু থাক… আগ্রাসন বিরোধিতাও থাক, অনর্থক বিদ্বেষ আর হিংসাটুকু বাদ দিয়ে।” এমন সহজ করে আত্মসম্মানবোধ আর আত্মশ্লাঘার মধ্যে ফারাকটা বলতে পারা রায়ার ভাবনার গভীরতা ও পরিমিতিবোধকে চেনায়।
নিজেকে নিয়ে রায়ার লেখায় বা বন্ধুদের বয়ানে, ওর ‘ঝাঁঝালো তর্কপ্রিয়তা, ঠোঁটকাটা মত জাহির, সংগঠনের মতো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ার অভ্যেস, গায়ে পড়ে আবেগঘন বন্ধুতা’-র অনায়াস প্রকাশ, এককথায় আবেগপ্রবণ ‘ছেলেমানুষি’র কথা উঠে এসেছে। ওর এক বন্ধুর কথায়- “ আমি বারবার বলেছি এতো ইমোশন দিয়ে হয় না। রায়াদি বলেছে ইমোশন ছাড়া হয় না।” আবার কাউকে বলেছে- ‘ইমোশন ছাড়া মানুষ হয় না’। এটা আসলে ভিন্ন অর্থে ‘পলিটিক্যাল’-এর সঙ্গে ‘পার্সোনাল’-কে মেলানোর তাগিদ। পাঠ ও অভিজ্ঞতাজারিত যুক্তি-বুদ্ধির সাথে সংবেদী হৃদয়ধর্মের এই মেলবন্ধন বাম রাজনীতিতে প্রবল হয়েছিল সত্তরের দশকে গোড়ায়, গোটা দুনিয়ার সঙ্গে এই বাংলাতেও। গোটা অস্তিত্ব দিয়ে সমাজবদলের স্বপ্ন-দেখা সেই সময়ের সঙ্গে আজকের দেশ- দুনিয়ার মেরুপ্রমাণ ফারাক। ফ্যাসিবাদ-মৌলবাদ তথা অতি দক্ষিণপন্থী অর্থনীতি- রাজনীতি ও সংস্কৃতির দিগ্বিজয়ের বিরুদ্ধে দেশে-দেশে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ- প্রতিরোধ আছে। কিন্তু কোথাও কোন হাতে দিনবদলের নীল নকশা নেই, পুরোন নকশাগুলোও ছিঁড়ে একশা। এমন দিনে নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যক্তি জীবনকে মেলানো খুব কঠিন। রায়া চেষ্টা করেছে, এটাই বড় কথা।
শিশুদের জগতেও রায়া ছিল অনায়াস। তাই যাওয়ার আগে রায়ার যাত্রাবিলাস- “আমি একটা ট্রেন কিনবো। তাতে চেপে বাতাসবাড়ি যাবো। আর কাউকে নেবো না। মোদি কি একটা টেরেন দেবে না, দেবা না একটা টেরেন?” মিছিলফেরত রোগাভোগা মেয়েটির নিজের কাছেও ওর বিদায়কালীন ছবিটি বিগত যুগের বাঙালি নষ্টালজিয়া আর অভিমানের গন্ধমাখা। “তা হলে ওই কথাই রইলো। সমস্ত মন আর শরীর খারাপকে গুটিসুটি পাকিয়ে পুরোন ট্রাঙ্কে পুরে রাখবো। মাঝেমধ্যে তাদের বের করে কাটাছেঁড়া করব আর সব্বাইকে ডেকে ডেকে সেই সব নিয়ে বেদম হাসবো। মরার আগের মুহূর্ত অবধি ফক্কুরি চালাবো। তারপর পুটুস করে মরে যাবো। আর সব্বার তখন হেব্বি মন খারাপ হবে।’’ পড়তে পড়তে মার্কসবাদ- নারীবাদ, বিপ্লব-বিদ্রোহ নিয়ে ধুন্ধুমার কূটকচালি দেখতে দেখতে হা-ক্লান্ত মনও ভালবাসায় দ্রব হয়ে ওঠে। মনে হয়, সবকিছুর শেষে ওরা যে আমারই সন্তান। ছকে আস্থা-হারানো মন নিয়েও আমরা অনেকেই যে অন্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখব ওদের কাছেই দুচোখ পেতেছি।
বইটির প্রাপ্তিস্থান:
- পিপলস বুক সোসাইটি (পিবিএস)
- কলকাতা কলেজ স্ট্রিট চত্বরে ১০/২বি রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০৯ ঠিকানায়
ফোনে যোগাযোগ:
- 8585854138
- 9339658239
- 9433715400
রায়ার পাঠশালা ও তার লাইব্রেরির জন্য স্বেচ্ছা-অনুদান দেওয়ার গুগল-পে নাম্বার:
- 9432844923 (Samik)
- 9874866737 (Soumya)
- 9051495819 (Srirupa)
- 9874376536 (Satabdi)