প্রতিভা সরকার
লেখক অধ্যাপক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
সব পুজো বন্ধ হলে হোক, হাইকোর্ট দুর্বারের পুজো যেন বন্ধ না করে।
মুহূর্তের জন্য হলেও আমার মনে কিন্তু এইরকম মূঢ় অবোধ ভাবনা এসেছিল এবং তার জন্য আমি লজ্জিতও নই।
কেন নই সেকথা বলি তাহলে। প্রথম কথা অতিমারির বিরুদ্ধে কী করে লড়তে হয়, সে নিয়ে কোনও বিচারসভা বসলে উঁচুর দিকের পুরস্কার বাধা থাকবে সোনাগাছির। শারীরিক নৈকট্য এখানে যেহেতু চূড়ান্ত, সাবধানতাও চূড়ান্ত হবে, নানা আলোচনার মাধ্যমে সেকথা দুর্বারের কর্মীরা শিখিয়েছেন এই তল্লাটের বাসিন্দাদের। ফলে ফাঁকা সোনাগাছিতে যে কজন কাস্টমার এখনও ঘোরাফেরা করে তাদের কপালে জুটছে সেরা সতর্কতা। হাত পা সাবান দিয়ে ধোয়ানো, হাত স্যানিটাইজ করা এসব তো মামুলি, পারলে মেয়েরা তাদের সর্বাঙ্গ স্যানিটাইজ করে। টাকা কামাই করেই যৌনকর্মীরা সতর্কতাবিধি ভুলে যায় না। বরং সেই টাকাকে ভালোমতো স্যানিটাইজ না করে কিছুতেই ট্যাঁকে তোলে না। যতই অর্থকষ্ট চলুক না কেন, কাস্টমারের শারীরিক অবস্থা একটু সন্দেহজনক দেখলে তাকে পত্রপাঠ বিদেয় করা এখন সোনাগাছির নিউ নর্মাল। বাইরের হুল্লোড়বাজ, মাস্কহীন, গায়ে গা লাগিয়ে চলা পাবলিকের সঙ্গে এই নেই-রাজ্যের বাসিন্দাদের কত যে ফারাক তার সম্যক উপলব্ধি হবে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে দুর্বারের পূজামণ্ডপের সামনে এলে।
হাইকোর্ট যা যা বলেছে দুর্বার অনেক আগে থেকেই সেকথা ভেবেছে ও সেগুলোকে বাস্তবায়িত করেছে। পুজোর অনেক আগে থেকে দুর্বারের নেতৃত্বে বিভিন্ন টিমে ভাগ করা হয়েছে কর্মীদের। নানা আলোচনাসভায় তাদেরকে পাখিপড়া করে শেখানো হয়েছে অতিমারির সঙ্গে লড়াই করবার নানা সুলুকসন্ধান। টিম লিডারের নেতৃত্বে গোটা এলাকার মেয়েদের মধ্যে চালানো হয়েছে ব্যাপক প্রচার, স্যানিটাইজার মাস্ক বিলি। তার ফল আস্ত কাস্টমারকেই পারলে স্যানিটাইজারে চুবিয়ে দেওয়া, আর ঝকঝকে তকতকে পূজামণ্ডপ, যেখানে সবাই হাঁটাচলা করছে বাঞ্ছিত দূরত্বে, মুখে রয়েছে মাস্ক, টেবিলে বিরাট স্যানিটাইজারের বোতল। যারা নানা থিমযুক্ত বিখ্যাত মণ্ডপের ব্যাপক ভিড় দেখে আতঙ্কিত, লোকের ঘাড়ে লোক, নাকের নীচে মাস্ক পরা বাবার কাঁধে খোলা মুখ ছোট্ট ছেলেকে দেখে বিরক্ত, তারাও যদি কোনওক্রমে এসে পড়তে পারেন সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে এই তল্লাটে, তাহলে হয়ত বেরোবার সময় অবাক হয়ে ভাববেন, কলকাতায় এইরকম পুজোও হয়!
আড়ম্বরহীন দুর্বার-দুর্গা মন জয় করে নেন ভক্তিতে আর শুচিতায়। পুজোর এ কদিন নগর-নটীরা সবাই গৃহলক্ষ্মী। সভ্যতার আদিকাল থেকে যত কাদা মাখানো হয়েছে ওদের সব ধুয়ে ফেলে এই কদিন ওরা গেরস্তের মেয়ে। পুজোর ফল কাটা, ভোগ রাঁধা, উপচার সাজানো সবেতেই উদগ্রীব তারা। লালপাড়ের সঙ্গে রংমিলান্তি খেলায় যোগ দেয় সিঁদুরে রাঙানো সিঁথি। সোনাগাছিতে বেশিরভাগ মেয়েই সিঁদুর পরে। যে সমাজ এই মেয়েদেরকে মানুষ বলেই স্বীকৃতি দেয় না, তার কাছ থেকেই ছিনিয়ে নেওয়া ঐ সিঁদুর, আর এই পুজো। ছিনিয়ে নেওয়া বৈকি, কারণ দুর্বারের দুর্গাপূজার পেছনে এক লম্বা ইতিহাস। অনেক আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও সমাজ সংসার প্রশাসন কেউই চায়নি এই পূজা হোক। যুক্তি ছিল অদ্ভুত। রাস্তায় দুর্বারের পুজো হলে মেয়েদের দেখতে নাকি এমন ভিড় হবে যে ট্রাফিক জ্যাম হয়ে কলকাতার অন্য পুজোর দফারফা হবে। যেন যৌনকর্মীরা চিড়িয়াখানার অদ্ভুতদর্শন জীবজন্তু! আরও নাকি অনেকরকম গোলমাল হতে পারে প্রশাসন যা সামলাতে পারবে না। খুবই আশ্চর্য কথা! কিন্তু আমাদের চিন্তা ও রুচির দৈন্য প্রকট করে দেওয়া এই কথাতেও সোনাগাছি পিছু হটেনি। সমাজের বজ্রমুষ্টি থেকে এইটুকু স্বীকৃতি আদায়ে সে ছিল বদ্ধপরিকর। সেই ১৯৯২ সালে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে দুর্বারের হয়ে কিছু যৌনকর্মী অংশগ্রহণ করে, সেটাই ছিল তাদের প্রথম ঘুরে দাঁড়ানো। নিজেদের লাঞ্ছিত অবস্থান পাল্টাবার দিকে সেই যে যাত্রা শুরু, আজ তা পরিণত হয়েছে অগুন্তি পদক্ষেপে আর সংহত হয়েছে একটি প্রতীকে— দুর্বারের নিজস্ব দুর্গাপূজা।
এই প্রবল চাওয়াকে আটকাবে কোন শক্তি? ফলে নীলমণি মিত্র লেনের সঙ্কীর্ণ অফিসবাড়িতেই বছরের পর বছর পুজো হয়েছে। মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে খোলা রাস্তায় পুজোর চার বছর যোগ করে নিলে দুর্বারের পুজোর বয়স এবার নিয়ে হল আট বছর। এই আট বছরে সোনাগাছির মেয়েরা দেখিয়েছে তারা যেমন ভালো সংগঠক, তেমনি শৃঙ্খলাপরায়ণ। ষষ্ঠীর বোধন থেকে শুরু করে বিজয়ার বিসর্জন, সবের ব্যবস্থাপনা একেবারে নিখুঁত। মেয়েরা বিসর্জনের সময় গঙ্গার ঘাট অব্দি উদ্দাম ধুনুচি নাচে, কিন্তু বেলেল্লাপনার কোনও অভিযোগ আজ অব্দি ওঠেনি। উদ্বোধনের দিন সমাজের অনেক মান্যগণ্য, এমনকি মন্ত্রীসান্ত্রীরাও আসেন। অনুষ্ঠান সারা হয় অত্যন্ত সুসংহতভাবে। সিঁদুরখেলা এই মেয়েদের অত্যন্ত প্রিয় ব্যসন। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশে এবার তা বন্ধ। দুর্বারের মেয়েরা এই নির্দেশ নিশ্চয়ই মান্য করবে, খেলার জন্য মনকেমন জমিয়ে রেখে দেবে আগামী বছরের জন্য।
দুর্বারের ব্যবস্থাপনায় যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত হয়েছে নৃত্যসংস্থা কোমল গান্ধার। তাদের এবারের থিম ছিল করোনাবধ। অভ্যাগতেরা ষষ্ঠীর দিন সে অনুষ্ঠানে মাত হয়ে গেলেন। নাচে গানে রূপসজ্জায় সে এক অসাধারণ শিল্পময়তা! এই শিল্পীরা বাইরেও অনেক শিল্পরসিকদের সামনে অনুষ্ঠান করে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
যদি পুজো বন্ধ হয়ে যেত, ছেদ পড়ত এই প্রাণময়তার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা সংগ্রামী চেতনা ও মর্যাদাবোধে বিরাট ধাক্কা লাগত। তাই চাইনি দুর্বারের পুজো বন্ধ হোক। যেমন এবার অতিমারির দানবকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখালেন দুর্বার-দুর্গা, তেমনই সব বাধাবিপত্তিকে চূর্ণ করে বহমান থাক ওঁর বিজয়রথ! কে না জানে, রথ যারা টানে তারাই আসলে রথী। রথের দড়িতে টান পড়লে তবেই দেবতা নড়েন এবং জাগেন। অসংখ্য নারীর আত্মশক্তি আর সামাজিক সম্মানবোধকে জাগিয়ে তুলেছেন যে দুর্বার-দুর্গা তাঁকে এই নাস্তিকের অকুণ্ঠ প্রণাম!
*লেখার ভেতরের ছবি: মিতুল দত্ত