সুজন ভট্টাচার্য
লেখক প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক
প্রকাশ্যে ঝোলানো কতগুলো ব্যানার। ‘মেঘালয়ের বাঙালি মানেই বাংলাদেশি’। ‘মেঘালয়, ত্রিপুরা, আসাম ও মিজোরামে বাংলাদেশিদের অত্যাচার বন্ধ হোক’। তাদের মোদ্দা বক্তব্য হল এটাই। ঘটনাস্থল মেঘালয়ের শিলং। আর ব্যানার ঝুলিয়েছিল খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, মেঘালয়ে যাদের প্রতিপত্তি যথেষ্ট। সেই ব্যানারের ভিডিও বা ছবি প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হল হইচই। শেষ পর্যন্ত মেঘালয় পুলিশ ব্যানারগুলো সরিয়ে দিল। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত সম্প্রদায়ের কাছেই আবেদন করলেন শান্তি বজায় রাখার। শিলং-এর কেন্দ্রীয় পূজা সমন্বয় মঞ্চ-ও একই আবেদেন করলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে কিছু ছাত্র মাথা গরম করে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। তাও তারা কাউকে মারেনি কিংবা দাঙ্গা করেনি। আর সরকার ও পুলিশও দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। তাহলে আর মাথাব্যথার কারণ কী?
মাথাব্যথা নেওয়ার দায় না নিতে চাইলে অবশ্যই নেই। কিন্তু ঘটনাক্রম সম্ভবত উল্টো কোনও ইঙ্গিতই দিচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া। ব্যানার লাগাল তারাই। পুলিশ সেই ব্যানার সরিয়ে দিল। সরকার আবেদন করলেন। কেন্দ্রীয় পূজা সমন্বয় মঞ্চের মত সক্রিয় বাঙালি সংগঠনও সম্প্রীতি বজায় রাখার আবেদন করলেন। খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন কিন্তু সেই রাস্তায় এখনও হাঁটেনি। বরং এই ব্যানারের স্বপক্ষে তারা সাফাই দিয়েছেন ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া ইছামতী কাণ্ডের। এবং সেই সূত্র ধরেই তারা যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছেন বাঙালিদের উপর। তারা নাকি নিরুপায় হয়েই এমন ব্যানার দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্থাৎ খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বার্তার মধ্যে কোনও সদর্থক ইঙ্গিত নেই। তার মানে বিষয়টা মেটেনি। আর সমস্যার বীজটা লুকিয়ে আছে এখানেই। কাজেই মাথাব্যথাটা থেকেই যাচ্ছে।
ইছামতী কাণ্ডের ইতিহাসও একবার দেখে নেওয়া যাক। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সংসদে পাস হল নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী। এই সংশোধনীতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ ভারতের প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ থেকে চলে আসা মুসলিম ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হল। নাগরিকত্ব প্রদানের শর্তাবলি যা, তাতে সাকুল্যে হাজার-তিরিশেক মানুষই সম্ভবত নাগরিকত্ব পেতে পারেন। পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে এমনই বলেছিলেন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো-র ডাইরেক্টর জেনারেল। তাহলেও নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল শোরগোল হয়েছিল। কেউ কেউ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন, এবারে সব হয়ে যাবে। আবার বিপরীতে কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়েছিলেন, মাতৃভূমিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে হবে।
এর বাইরে আরেকটা পক্ষও আছেন, যারা মূলত উত্তর-পূর্বের পার্বত্য উপজাতি সম্প্রদায়। এদের ধারণা হয়েছিল, এই সংশোধনীর বলে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিটি হিন্দুই ভারতীয় নাগরিক হয়ে যাবে। তাহলেই তারা কব্জা করে নেবে পার্বত্য উপজাতিদের বাসভূমি। বাস্তবত, পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে মাথায় রেখে গেরুয়া শিবির এমন ঢালাও হারে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলেও চলেছিল। আবার মতুয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নেতাও প্রকাশ্যেই এমন কথাকে সমর্থন করেন। এর ফলে উত্তর-পূর্বের আদি বাসিন্দাদের মনে আশঙ্কার জন্ম হয়। মুশকিল হল, অসম ও ত্রিপুরা তো বটেই, উত্তর-পূর্বের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই বাঙালি-বিরোধী মনোভাব কমবেশি আছে। বিভিন্ন সময়ে তার বহিঃপ্রকাশও আমরা দেখেছি। হ্যাঁ, অসমের মত ব্যাপক জাতিগত উচ্ছেদ হয়তো অন্যত্র হয়নি। কিন্তু যতটুকু হয়েছে, তাতেও আশঙ্কার কারণ আছে।
ত্রিপুরায় বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য সবকটি রাজ্যেই মূল জাতীয়তাকে বাদ দিলে বাঙালিরাই দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তৃতীয় স্থানে হিন্দিভাষীরা। ২০১১ সালের সেনসাসের রিপোর্টে এইসব রাজ্যগুলোয় প্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যায় অসমিয়া, বাংলা ও হিন্দিভাষীদের সংখ্যাটা দেখা গেল এমনই:
রাজ্য | অসমিয়াভাষী
(প্রতি ১০ হাজারে) |
বাংলাভাষী
(প্রতি ১০ হাজারে) |
হিন্দিভাষী
(প্রতি ১০ হাজারে) |
অরুণাচল প্রদেশ | ৩৯০ | ৭২৭ | ৭১০ |
সিকিম | ১৪ | ১১৪ | ৭৯৬ |
নাগাল্যান্ড | ৮৭ | ৩৭৮ | ৩১৮ |
মণিপুর | ৯ | ১০৭ | ১১১ |
মিজোরাম | ১২ | ৯৮৩ | ৯৭ |
ত্রিপুরা | ৬ | ৬৫৭৩ | ২১১ |
মেঘালয় | ১৩৪ | ৭৮৪ | ২১২ |
অসম | ৪৮৩৮ | ২৮৯২ | ৬৭৩ |
অসমে বাঙালি-বিরোধী দাঙ্গার যে ধারাবাহিক ইতিহাস, তার সূত্রটাও লুকিয়ে আছে এইখানে। হ্যাঁ, অসমে বাঙালিদের উপস্থিতি অনেকটাই প্রবল, প্রায় ২৯ শতাংশ। ত্রিপুরায় বাঙালিরাই প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যগুলোতে তো তেমনটা নয়। তাহলে এমন বাঙালিবিদ্বেষ সেখানেও দেখা যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব সরল নয়। অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিস্তারের তারতম্যের ইতিহাস একটা প্রবল কারণ তো বটেই। তার পাশাপাশি আছে রাজনীতির উদগ্র ক্ষুধা। একটা তথ্যের সন্ধান করলেই সেটা বোঝা যাবে। একদিনে নিহতের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ভারতের সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনা কোনটা? যদি প্রাক-স্বাধীনতার ভারতকেও হিসাবে নিই? নোয়াখালি বলার জন্য অনেকেরই জিভ লকলক করবে। দুঃখিত। উত্তরটা হল অসমের নেলি। সরকারি হিসাবেই ১৯৮৩-র ১৮ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬ ঘণ্টায় খুন করা হয়েছিল ২১৯১ জন মানুষকে। এরা সকলেই ছিলেন মুসলমান। আর হ্যাঁ, বাঙালি।
নেলি-র গণহত্যায় একজনও শাস্তি পায়নি। কেন? কারণ তথ্যের অভাবে ৩৭৮টি কেস খারিজ হয়ে যায়। অসম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাকি ৩১০টি কেস কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যাহার করে নেয়। সব মিলিয়ে শিক্ষাটা কী দাঁড়াল? দল বেঁধে যদি বাঙালিদের নিকেশ করা যায়, শাস্তির কোনও ভয় নেই। অসম তো তেমনটাই প্রমাণ করে রেখেছে। আর এই শিক্ষাই সচেতন করে দিয়েছে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতকে। ফল তো এমনই হওয়ার কথা। যাই হোক, আমরা আবার মেঘালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনায় ফিরে আসি। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী পাস হওয়ার পর মেঘালয়ে খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন প্রবল বিরোধিতা করেছিল। তাদের একমাত্র আশঙ্কা, এর সুযোগে বাংলাদেশিরা ভারতীয় নাগরিক বনে যাবে আর এসে খাবলা মারবে তাদের জমিতে।
২০১৩ সালে খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আন্দোলনে নেমেছিল। দাবী ছিল মেঘালয়েও ইনার লাইন পারমিট চালু করতে হবে। আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং চারজনের মৃত্যু হয়। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর বিরোধিতা করার পাশাপাশি খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আবার ইনার লাইন পারমিটের দাবী তুলতে শুরু করে। তার অবশ্য বিশেষ কারণও ছিল। ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করে। এর প্রায়োগিক তাৎপর্য হল নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী মণিপুরে প্রযোজ্য হবে না। অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের সঙ্গে মণিপুরও একই বন্ধনীতে চলে এল। এই ঘটনাই মেঘালয়ের গারো জনজাতিকে উৎসাহিত করল। ইনার লাইন পারমিটের আওতায় আনা মানেই নাগরিকত্ব প্রদানের কোনও সুযোগ না থাকা। এক ঢিলে দুই পাখি মারার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।
২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সংলগ্ন ইছামতীতে খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন সিএএ-বিরোধী একটি সভার আয়োজন করে। সভার পরে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে খাসিদের সংঘর্ষ হয় এবং লুরশাই হাইনেইওয়াতা নামক একজন খাসি নিহত হন। সেই সূত্র শিলঙে বাঙালিবিরোধী দাঙ্গা হয় এবং দুজন বাঙালি মুসলমান খাসিদের হাতে নিহত হন। সভাস্থল হিসাবে ইছামতীকে বেছে নেওয়ার পিছনেও যথেষ্ট কারণ ছিল। বাংলাদেশের সন্নিহিত ইছামতীতে লাইমস্টোনের খনি আছে। খনিতে খাসিদের পাশাপাশি বাঙালি শ্রমিকও অনেক। আবার অনেক বাঙালি ইছামতী বা আশপাশের অঞ্চলে ব্যবসা করেন। অর্থাৎ ইছামতীতে বাঙালির উপস্থিতি যথেষ্টই। সেখানে যদি খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের শক্তি দেখানো যায়, তাহলে বাঙালিরাও ভয় পেয়ে যাবেন।
উদ্দেশ্য যাই হোক, ২৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরেই লাইমস্টোনের খনির বাঙালি শ্রমিকদের বরখাস্ত করা হয়। এমনকি খাসিদের চিরাচরিত গ্রামসভার অনুমতি না মেলার অজুহাতে বাঙালিদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। লকডাউনের অন্তত তিন সপ্তাহ আগেই ইছামতীর বাঙালি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ অক্টোবর তিনজন বাঙালি ব্যবসায়ী রাজ্যপালের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন, রাজ্য প্রশাসন ইচ্ছে করেই ‘হিন্দু’দের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ করছেন। রাজ্যপালের নির্দেশে পুলিশ নড়েচড়ে বসে। এবং খানিকটা তদন্তের পর সরকার জানিয়ে দেন, ‘দরবার শ্নং’ অর্থাৎ খাসিদের গ্রামস্তরের চিরাচরিত সামাজিক সংগঠনের অনুমোদন ছাড়া ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব নয়। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই মেঘালয়ের বাঙালি মানেই বাংলাদেশি ব্যানারের আবির্ভাব।
খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বক্তব্য অনুযায়ী, অ-উপজাতিদের থাকা নিয়ে তাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু মেঘালয়ের আর্থিক কারবারে খাসিদেরই প্রাধান্য থাকা উচিত। মূলত এদের চাপেই ইছামতী অঞ্চলের দরবার শ্নং বাঙালি ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সের নবীকরণ বন্ধ রেখেছে। আর সেই অজুহাতেই পুলিশ এদের দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য করছে। অর্থাৎ মোদ্দা সমস্যাটা হল অর্থনৈতিক। মেঘালয়ে অ-উপজাতি কেউ এসে করে খেতে পারবে না। মুশকিল হল, ইছামতী অঞ্চলের যাঁরা এর কোপে পড়েছেন, তাঁরা কেউই কিন্তু সম্পন্ন মানুষ নন। ছোট দোকানদার, খনিশ্রমিক, পরিবহন ব্যবসায়ী ইত্যাদি। যেহেতু ভারতের আর্থ-ব্যবস্থা প্রতিদিন সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে, তার দায় এসে পড়ছে নিচুতলার মানুষদের উপরেই। জীবনের দায়ে তাই নিজেদেরটুকু বুঝে নেওয়ার উন্মাদ দায় এসে চেপে বসেছে ঘাড়ে।
উত্তর-পূর্বের ছোট ছোট রাজ্যগুলোর প্রতিটির সঙ্গেই হয় অসম নয়তো পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত আছে। বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, অসমেও বাঙালিদের সংখ্যা যথেষ্ট। আবার বাঙালিরা উত্তর-পূর্বের সর্বত্রই কমবেশি ছড়িয়ে আছেন। এবং মূলত শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রায় সর্বত্রই সামাজিক জীবনের উচ্চস্তরেই তাদের আসন ছিল। সরকারি কর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক কিংবা প্রযুক্তিবিদ হিসাবে বাঙালিরা উত্তর-পূর্ব ভারতে পরিচিত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই জনজাতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কোনওদিনই একমাত্রিক ছিল না। পার্বত্য জনজাতিদের এই উচ্চস্তরের বাঙালিরা অবজ্ঞার চোখেই দেখতেন। স্বাধীনতার পরে জনজাতির মধ্যে আধুনিক শিক্ষার বিস্তারের ফলে প্রতিপত্তির নতুন ভাগীদার হাজির হল। তাদের হাতে আছে ভোটের জোর। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালির সেটা নেই। সেই জোরেই বাঙালির অবনমন ঘটানো শুরু হল।
নিজস্ব ভূখণ্ডে স্বজনদের অধিকার আগে বজায় থাকবে, এই দাবীকে অন্যায্য বলা যায় না। কিন্তু এক্ষেত্রে কতগুলো সমস্যাও আছে। ধরা যাক সিকিম। এখানে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা বাংলাভাষীদের চেয়ে অনেক বেশি। কিংবা মণিপুর। বাংলাভাষীদের চেয়ে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা সামান্য হলেও বেশি। আবার নাগাল্যান্ড কিংবা অরুণাচল প্রদেশে বাংলাভাষীরা একইভাবে হিন্দিভাষীদের থেকে সামান্য এগিয়ে। কোনওদিন শুনেছেন, সিকিম কিংবা মণিপুরে হিন্দিভাষীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার? না শোনেননি। অসমে বাঙালিবিরোধী আন্দোলনের নামে গণহত্যা আর নির্বিচারে উচ্ছেদের কাহিনির অন্ত নেই। আসামে হিন্দিভাষীদের ঘনত্ব বাঙালিদের চার ভাগের একভাগ, অন্ততপক্ষে নাগাল্যান্ড, অরুণাচল বা মিজোরামের চেয়েও বেশি। তাহলে কি সেখানে হিন্দিভাষীদের থেকে কোনও আশঙ্কার গন্ধ কেউ পায় না? কেন? বাঙালিদের মধ্যে এমন কি আছে যার জন্য তাদের হজম করা যায় না? কিন্তু হিন্দিভাষীদের নির্বিবাদে মেনে নেওয়া যায়? রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এখানেই।
ইদানীং কালে একটা প্রচারকে নির্বিকল্প সত্যির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটা হল ভারতে কোটি কোটি বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী লুকিয়ে আছে। ১৯৯১ সালের সেনসাস রিপোর্টে ১৫ লক্ষ অনুপ্রবেশকারীর কথা বলা হয়েছিল। যদিও তার বিস্তৃত বিবরণ ছিল না। তার পরের দুটি সেনসাস রিপোর্ট এই বিষয়ে নীরব। অসমে এনআরসি চালু করার পিছনে একমাত্র যুক্তি ছিল এক কোটিরও বেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর প্রসঙ্গ, যারা নাকি ধর্মে মুসলিম। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এনআরসিতে বাদ গেলেন ১৯ লক্ষ মানুষ। এবং তাঁদের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন হিন্দুরাই। বাদ গেলেন এমনকি ভারতীয় সেনার কর্মীরাও। শুধু বাঙালি নয়, বাদ যাওয়াদের মধ্যে হিন্দিভাষী, সাঁওতাল, এমনকি অসমিয়ারাও আছেন। তাই অসম জুড়ে এখন একটাই সুর, এই এনআরসি ফালতু কাজ হয়েছে। আবার চাই। আসলে প্রচারের ঢাকঢোল বাঁধার সময় যে অঙ্ক ধরা হয়েছিল, বাস্তবতা তার ধারেকাছে না আসায় মোহভঙ্গ হয়েছে।
যতদিন যাচ্ছে, গেরুয়া শিবির হিন্দুত্ব-হিন্দিত্ব নির্ভর একটা এককাট্টা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রণহুঙ্কার দিচ্ছে। সেই হুঙ্কারের সামনে দুটো প্রতিবন্ধক। একটা হল তামিল স্বাভিমান। অন্যটা হল বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র। তামিলনাড়ুর স্বাভিমানের লড়াইয়ের ইতিহাস দীর্ঘ। কিন্তু তার অস্তিত্ব কেবলমাত্র তামিলনাড়ুর মধ্যেই। অন্যদিকে বাংলা ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের ভাষা। এবং তার ব্যাপ্তি কেবল পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই আটকে নেই। ত্রিপুরার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। অসমের প্রায় ত্রিশ শতাংশের। ঝাড়খণ্ড, বিহার, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় সহ বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতই। সবচেয়ে বড় কথা, সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে খণ্ডন করে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের নজির গড়েছে এই বাঙালিরাই। হ্যাঁ, বাঙালি তেমন কোনও প্রকাশ্য লড়াই করেনি ঠিকই। কিন্তু বাস্তবত গো-বলয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী বিকল্পের জন্ম দিয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি। এবং সেটা আর্যাবর্তের একদম পাশেই। বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে গেরুয়া শিবিরের জাতক্রোধ তাই স্বাভাবিক।
ভারতে অনুপ্রবেশের একচেটিয়া দায় তাই বাঙালির। কারণ তার মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া একটি দেশ আছে একদম গায়ের উপরে। সবচেয়ে বড় কথা, ভাষা যদি হয় সংস্কৃতি ও জাতীয়তার ভিত্তি, তাহলে বাঙালিকে টেক্কা দেওয়ার কেউ নেই এই পোড়া দেশে। হিন্দিওয়ালারা লেকচার অনেকই দিতে পারেন, কিন্তু তার রাজ্যের মুসলিম নাগরিককে দিয়ে বলাতে পারবেন না হিন্দি তার মাতৃভাষা। বাঙালি মুসলমান হোক আর হিন্দু বা বৌদ্ধ, সকলেরই মাতৃভাষা বাংলা। এই একটা জায়গাই হিন্দিওয়ালাদের খুব ভয়ের জায়গা। সেই কারণেই বাঙালির বিরুদ্ধে বিষ না ছড়িয়ে তাদের উপায় নেই। মেঘালয়ের ব্যানার সেই প্রবণতারই প্রতিফলন।