Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মেরুদণ্ড সোজা রাখার শাস্তি পাচ্ছেন অনুরাধা ভাসিন

সৌমিত্র দস্তিদার

 


লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, তথ্যচিত্রনির্মাতা

 

 

 

কথা নেই বার্তা নেই, বিনা নোটিশে কোনও কারণ ছাড়াই একটা জনপ্রিয় দৈনিক কাগজের অফিস বন্ধ হয়ে গেলে একটু অবাক লাগে ঠিকই। কিন্তু দেশটার নাম যেহেতু ভারত, তাই ইদানিং আর কোনও কিছুতেই অবাক হই না। এখানে এখন শাসকদের কথাই শেষ কথা। গণতন্ত্র কেতাবি শব্দ মাত্র। বাস্তবে, যতদিন যাচ্ছে ততই গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা খোদ সংবিধান থেকেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এ এক অভূতপূর্ব ভারত। যেখানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর খারাপ। যেখানে নতুন নতুন আইন এনে ছলেবলে কৌশলে বিরোধী স্বর আটকানো দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ধর্ষণ শাসক বিজেপির রাজ্যগুলোতে এক নিয়মিত কর্মসূচি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেখানে সাংবাদিকদের ওপর হামলা স্বাভাবিক ঘটনা, সেখানে একটা খবরের কাগজের অফিস বন্ধ করে দেওয়া কোনও খবরই নয়। তাও আবার কাশ্মিরের মতো রাজ্যে, যেখানে কলমের এক খোঁচায় দীর্ঘদিনের কাশ্মিরের জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল, পার্লামেন্টকে অন্ধকারে রেখে ৩৭০ ধারা যে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাতিল করে গোটা কাশ্মিরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হল তা এদেশের ভাবমূর্তি যে গোটা বিশ্বের কাছে ম্লান করে দিয়েছে তা অন্ধ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর ভক্তরা ছাড়া সবাই স্বীকার করবেন।

তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ইতিমধ্যেই কাশ্মিরকে বিজেপি সরকার একটা মস্ত জেলখানায় বদলে দিয়েছেন। হাজার হাজার বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা সেখানে বিনা বিচারে বন্দি। ৩৭০ ধারা বাতিলের সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে, মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে কাশ্মিরকে সারা দেশের মধ্যে এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপ করে রাখা হয়েছিল। হয়েছিল বলছি কেন! বলা ভালো যে এখনও ছবিটা প্রায় তাই-ই। বিবর্ণ। ধূসর। নেটওয়ার্ক ফিরলেও তার স্পিড কম। চার-জি কল্পনার বিষয়। ওই দু-জি যে আছে তাও কয়েক মাস আগে ছিল স্বপ্নের ব্যাপার। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে থেকে কয়েকশো সামরিক আধাসামরিক বাহিনী নিরাপত্তার নামে কাশ্মিরে পাঠানো হয়েছে। বস্তুত আইনশৃঙ্খলার গোটা বিষয়টি এখন তাদের হাতে। জায়গায় জায়গায় পুলিশ চৌকিও পাহারা দিচ্ছে প্যারামিলিটারি জওয়ানেরা। আসলে ভারত সরকার। কাশ্মিরের জনসাধারণ সম্বন্ধে এতটাই অবিশ্বাসী যে তাদের প্রতিনিধি সাধারণ পুলিশকেও বিশ্বাস করা দিন দিন রাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে।

কাশ্মিরে সত্যিই কী ঘটছে তা জানার কোনও উপায় নেই। সরকারের লাল চোখ উপেক্ষা করে যেটুকু যা খবর বাইরে আসছিল তার কৃতিত্ব, বলাই বাহুল্য এখনও অবধি বিক্রি না হয়ে যাওয়া কিছু নির্ভীক সংবাদমাধ্যমের। তাই সবচেয়ে বেশি রাজরোষ যে তাকেই সইতে হবে তা তো জানা কথাই। এই কয়েক মাসে কাশ্মিরে কত শত সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা হয়েছে, কতজন সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। নিংসন্দেহে কাশ্মির টাইমসের শ্রীনগরের দপ্তর বিনা কারণে বন্ধ করে দেওয়ায় তাই অবাক হইনি। প্রায় একই সময়ে সংবাদপত্রের এক্সুকিউটিভ এডিটর অনুরাধা ভাসিনের জম্মুর ফ্ল্যাটে দুষ্কৃতীদের হামলা ও জোর করে অনুরাধাকে উচ্ছেদ করা, এই দুটো ঘটনা একই সূত্রে বাঁধা তা বুঝতে কোনও ব্যোমকেশ বক্সী বা শার্লক হোমসের দরকার হয় না।

তবে কাশ্মিরি টাইমস কি আর নিছক কোনও সংবাদপত্র! এ হচ্ছে কাশ্মিরের আবেগ! বলা হয় সংবাদপত্র সমাজের আয়না। গোটা সমাজের ছবি এই আয়নায় প্রতিফলিত হয়। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে কোনও সন্দেহ নেই বছরের পর বছর ধরে কাশ্মিরে এত অশান্তি, রক্তপাত, হানাহানি, বিষাদ, নিরীহ প্রাণের চলে যাওয়া সব কিছুই দিনের পর দিন উঠে এসেছে কাশ্মির টাইমসের পাতায় পাতায়।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যেমন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ওপর একটা ধাক্কা এসেছিল, প্রাচীন এক ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে গুঁড়িয়ে দিয়ে আজকের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করেছিল যে বিজেপি, সঙ্ঘপরিবার, তারাই আজ কাশ্মিরের মুক্ত বিবেককে বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ১৯৫৫ সালে অনুরাধার বাবা বিশিষ্ট অ্যক্টিভিস্ট সাংবাদিক বেদ ভাসিন কাশ্মির টাইমস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কলকাতায় একবার মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর সম্মেলনে অনুরাধাকে দীর্ঘ ইন্টারভিউ এর সুযোগ হয়েছিল আমার। তখনই কাশ্মিরে গণতন্ত্রের যাবতীয় কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সেদিন অনেক বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। কথায় কথায় প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসছিল বেদ ভাসিনের প্রসঙ্গ। অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিল এ যেন আর এক জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধির আখ্যান শুনছি। প্রকৃতপক্ষে অনুরাধার অসমসাহস, কঠিন লড়াই করার মানসিকতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব অনেকটাই পাওয়া ওঁর বাবার কাছ থেকে। বেদ ভাসিন কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন একদিকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে ও অন্যদিকে অতি উগ্র মুসলিম সংগঠনের বিপক্ষেও সুর চড়িয়েছেন। একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন শিবসেনা বজরংদলের হাতে। কিন্তু নিজের অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শ থেকে এক চুলও সরে দাঁড়াননি। বেদ ভাসিনই প্রথম কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কানাডায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারত পাকিস্তান জনগণের মৈত্রী সমিতি। এই সমিতি আজও হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দুদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে যাতে বন্ধুত্ব বজায় থাকে।

অনুরাধা ভাসিন নিঃসন্দেহে সেই বাবার যোগ্য উত্তরসূরি। আক্ষরিক অর্থেই ড্যাডিস ডটার। বাবার মেয়ে। অনুরাধা কবিও। ছোটবেলায় বাবার কাগজে গল্প কবিতা লিখত যে মেয়েটা সেও যে একদিন বাবার মতোই মস্ত সাংবাদিক হবে তা বোধহয় বাবাও ভাবেননি। পরিবেশ পরিস্থিতিই সাংবাদিকতায় টেনে আনে বেদ ভাসিনের কন্যাকে। বাবার কিন্তু প্রথম প্রথম একটু দোনোমোনো ছিল মেয়ের সাংবাদিক হওয়া নিয়ে। স্বাভাবিক। কোন বাবা আর চান যেখানে পদে পদে প্রাণ চলে যাওয়ার আশঙ্কা সেখানে, সেই পেশায় সন্তানকে ঠেলে পাঠাতে! বাবা আর সাংবাদিক এই দুইয়ের টানাপোড়েনে অবশ্য সাংবাদিক বেদ ভাসিনই জিতলেন। আমরাও পেলাম এই সময়ের সত্যিকারের এক দক্ষ সাংবাদিককে।

অনুরাধা আনুষ্ঠানিকভাবে টাইমসে যোগ দিলেন ১৯৮৯এ। জার্নালিজমের তুখোড় ছাত্র খোদ বাবার কাগজে সামান্য এক ট্রেনি জার্নালিস্ট হয়ে যোগ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে নিজের যোগ্যতায় আজকের এক্সিকিউটিভ এডিটর। যে সময়ে অনুরাধা সাংবাদিকতায় আসছেন তখন কাশ্মিরের রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। ছোটখাটো অজস্র সংগঠন মিলে গড়ে উঠেছে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট। বিধানসভায় ভোটে ফারুক আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স ও কংগ্রেস জোটের কাছে তারা গোহারান হারলেও জনসাধারণের এক বড় অংশের সমর্থন ছিল ওই ফ্রন্টের দিকে। তার বড় কারণ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বিরোধীদের এই অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। নব্বই সাল কাশ্মিরে ঘটনাবহুল বছর। রাজ্যপাল হিসেবে লেফটেন্যান্ট জগমোহনের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের নীল নকশা নির্মাণ, ফারুকের বেশ কিছু উস্কানিমুলক কথাবার্তা, গণতন্ত্রের পরিসর না থাকায় অনিবার্যভাবে কিছু গোষ্ঠীর উগ্র ভারত বিরোধিতা, পাশাপাশি রাজনৈতিক ‘শত্রু’ নিকেষের আকাঙ্খায় বিরোধী সবাইকেই ভারতবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী বলে চিহ্নিত করে জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কানি দেওয়ার পুরনো এদেশীয় কৌশল— সব মিলিয়ে কাশ্মিরের আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সূচনাপর্ব নিংসন্দেহে সেই সময়।

ভুলে গেলে চলবে না ওই সময় পাঞ্জাবের পরিস্থিতিও অগ্নিগর্ভ। খলিস্তান আন্দোলন ভারত রাষ্ট্রের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কাকতালীয় হতে পারে কিন্তু এটা ঘটনা যে পাঞ্জাব আর কাশ্মিরের রাজনীতি একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইতিহাসের সাধারণ ছাত্র মাত্রই জানে একদা জম্মু ও কাশ্মিরের ডোগরা রাজাদের রাজা হওয়ার পিছনে শিখ রাজা পাঞ্জাবকেশরী রণজিৎ সিংহের অবদান বিরাট। পথের ধুলো থেকে ডোগরা বংশকে নিজের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে দিয়েছিলেন রণজিৎ সিংহ। তাঁর মৃত্যুর পরে শিখ সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে যাওয়ার পরে, ছলেবলেকৌশলে ব্রিটিশদের ঘুষ দিয়ে জম্মু ও কাশ্মিরের ক্ষমতা দখল করেছিলেন ডোগরারা।

সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ, অন্য এক আখ্যান। যদিও প্রত্যেকটির সঙ্গে অন্যটির যোগ নিবিড়। তবুও আপাতত যেটা বলার তা হচ্ছে ওই সময়ের কাশ্মির ও পাঞ্জাব দুই ‘কনফ্লিক্ট জোন’-ই অনুরাধা ভাসিনকে আজকের অনুরাধা হতে সাহায্য করেছে। চোখের সামনে বাবার ওপরে হামলা করেছে শিবসেনার গুন্ডারা। তবু বাবা অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াননি— এও তো চোখের সামনে দেখা অনুরাধার। আজ যখন কাশ্মিরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চরমে, তখন অনুরাধা ভাসিনও চুপ করে থাকবেন না এটা শাসকদের অনুমান করা উচিত ছিল। কাশ্মিরের সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যে একতরফা হামলা তার বিরুদ্ধে অনুরাধা কোর্টে মামলা করার সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মির টাইমসের যাবতীয় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তবু অনুরাধা ভাসিনকে দমানো যায়নি। একের পর এক সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে সোচ্চার থেকেছে কাশ্মির টাইমস। সংবাদপত্রের গণ্ডি পেরিয়ে সে হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতির বিবেক। ফলে যতই অন্যরকম কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, কাশ্মির টাইমসের দপ্তর বিনা কারণে বন্ধ করে দেওয়া বা জম্মুর ফ্ল্যাটে দুষ্কৃতিদের হামলা কিছুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যম কাশ্মির টাইমসের ওপর পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সোচ্চার হয়েছে। আমাদের তরফ থেকেও একগুচ্ছ লাল গোলাপ শুভেচ্ছা বন্ধু অনুরাধা ও কাশ্মির টাইমসের লড়াকু মেরুদণ্ড সোজা রাখা সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের।