Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিস্মৃত ডাক্তার সুধাকর রাও, আমাদের বিবশ বিবেক এবং অতিমারিকাল

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 


লেখক চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী, প্রাবন্ধিক

 

 

 

বিশ্বাস করুন, দস্তয়েভস্কির “ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট”-এর নায়ক রাস্কলনিকভের মতো আমার কোনও “ব্রেন ফিভার” হয়নি। রাস্কলনিকভের মতো আমার নিজেকে জ্বরগ্রস্ত রোগীও আদৌ মনে হচ্ছে না যে করোনার মতো প্রাদুর্ভাব বা “প্লেগ” পূবের দেশ থেকে এসেছে (“He dreamed that the whole world was condemned to a terrible new strange plague that had come to Europe from the depths of Asia.”)— এ জাতীয় কিছু আমার চিন্তায় আসবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত আজ কোনও এক দুর্যোগ ঘটেছে আমার অস্তিত্বে। নাহলে ব্রেন ফিভারের মতো আমারও স্মৃতির ছায়াপথে আজ আবার আবছা করে কেন মনে পড়বে যে ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে আরেক ডাক্তার রাও (শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ ভাস্কর রাও) তাঁর চেম্বারে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন— নির্যাতিত মানুষের জন্য কথা বলার অপরাধে। সেদিন কিন্তু আমার কিচ্ছুটি মনে হয়নি। আরও অনেকের মতো বরঞ্চ মনে হয়েছিল— এমনটা তো হতেই পারে! এগুলোর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। অহেতুক ঝামেলা, অহেতুক আপদ।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের (১৮.০৫.২০২০) খবর “Migrant worker’s health deteriorates on way home, his friend sticks with him till end”। অমৃত কুমার এবং মোহম্মদ সাইয়ুব একসঙ্গে গুজরাট থেকে উত্তর প্রদেশের বস্তি জেলায় তাদের গ্রামে ফিরছিল। পথে অমৃত কুমার অসুস্থ বোধ করে, জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। মোহম্মদ সাইয়ুব ওকে ছেড়ে যায়নি। কোনও পার্সোনাল/সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানেনি। সবাই ছেড়ে চলে গেলেও শেষ অবধি মোহম্মদ সাইয়ুব বন্ধুর সঙ্গে ছিল, হাসপাতালে মৃত্যু পর্যন্ত। করোনা অতিমারি বন্ধুত্বের এক নতুন চিত্রনাট্য রচনা করল কি? জীবনের ভালোবাসার স্রোতধারা যখন একের পরে এক রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন লেখার নান্দীমুখে হাজির থাকে মোহম্মদ সাইয়ুব এবং অমৃত কুমাররা।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস (১৮.০৫.২০২০) একই দিনে আরেকটি খবর করেছে “’Silent protest is so powerful’: Belgian medics turn their backs on PM during visit to hospital”। ব্রাসেলসের সেন্ট পিটার্স হাসপাতালের চিকিংসক-চিকিৎসাকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট সবার কোভিড-১৯ রোগীদের বাঁচানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরকারের তরফে বাজেট বরাদ্দ কমানো, ডাক্তারদের মাইনে কমিয়ে দেওয়া এবং কম মাইনেতে নিম্নমানের নতুন স্টাফ নিয়োগ করার ফলে ৯,০০০-এর ওপরে কোভিড-১৯-এ মৃত্যু ঘটেছে। তাই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পৃষ্ঠ ও পশ্চাদ্দেশ দেখিয়ে নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ডাক্তারেরা।

একই দিনে অর্থাৎ ১৮ মে সকাল থেকে আবার অদ্ভুত এক ঘোর ঘোর লাগছিল। মে মাসের (২০২০) মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। এতদিনের ঘটনার স্মৃতি কি আর থাকে? অন্ধ্রের চিকিৎসক ডঃ সুধাকর রাও করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট পিপিই নেই বলে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন। পুলিশ রাস্তায় ফেলে, অর্ধ-উলঙ্গ করে, দুহাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বেঁধে জনসমক্ষে লাঠিপেটা করে। অবশ্য সুধাকর রাও বলে কোনও ডাক্তারকে আমি চিনি না। কিন্তু তাঁর ঘটনায় মনে হচ্ছে জার্মান লুথেরান পাদ্রি মার্টিন নিমোলার (Martin Niemoller) আমাকে আজ ভর করেছেন। নাৎসি জার্মানিতে ৭ বছর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাটিয়েছিলেন হিটলারের নারকীয় মানবতা-বিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা করবার জন্য। কিন্তু আমি তো কারও কোনও বিরোধিতা কখনও করিনি। বরঞ্চ আমার সবসময়েই মনে হয়েছে আমার জীবনের বীজমন্ত্র— “আমরা তো অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে/আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।”

বিশ্বাস করুন, কেবলমাত্র নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য, নিজের সর্বোত্তম অবস্থা সুনিশ্চিত রাখতে আমার এক জোরদার হাতিয়ার আছে— সবকিছুকে মানিয়ে নেওয়ার, সবার সঙ্গে গা ঘষে চলার, দেঁতো হাসি হেসে উপঢৌকন দেওয়ার হিসেব আমার বিলক্ষণ জানা আছে। সেভাবেই চলি। কিন্তু কী যে হল। ঐ জার্মান পাদ্রি নিমোলারের কথাগুলো বড় কানে বাজছে। আমার এতদিনের স্বাভাবিক অভ্যেসে চিড় ধরল নাকি? আমি গভীরভাবে শঙ্কিত বোধ করছি আমার সত্তায় যদি ভেজাল কিছু ঢুকে যায়!

নিমোলার কেন যে বলতে গেলেন—

First they came for the socialists, and I did not speak out— because I was not a socialist.
Then they came for the trade unionists, and I did not speak out— because I was not a trade unionist.
Then they came for the Jews, and I did not speak out— because I was not a Jew.
Then they came for me— and there was no one left to speak for me.

(ওরা প্রথমে এল সোশ্যালিস্টদের জন্য, আমি একটি কথাও বলিনি— কারণ আমি সোশ্যালিস্ট নই।
এরপরে ওরা এল ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীদের জন্য, এবং আমি কিছু বলিনি— কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নের কর্মী নই।
এরপরে ওরা এল ইহুদিদের জন্য, এবং আমি কিছুই বলিনি— কারণ আমি তো ইহুদি নই।
এরপরে ওরা এল আমার জন্য— আর তখন আমার হয়ে কথা বলার জন্য কেউ পড়ে নেই।)

বেশ কদিন আগে ঘটেছে সুধাকর রাওয়ের ঘটনা। বিশাখাপত্তনমের সিনিয়র অ্যানেস্থেটিস্ট ডঃ সুধাকর রাওকে পুলিশ প্রকাশ্যে বড় রাস্তায় ফেলে লাঠি দিয়ে মারে, প্রকাশ্যে লাথি দেয়, পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দেয়। তখন আমি গা করিনি। মার্টিন নিমোলারের মতোই আমাকে তেমন আঘাত করেনি। কিন্তু কদিন গড়ানোর পরে আমার ভেতরে কেমন একটা হতে লাগল— আমাদের অনেকেরই যেমন হয়। এরপরে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে আক্রান্ত ও অভিযুক্ত চিকিৎসকের সাময়িক স্বস্তি মিলল। এরকম সময়েই বিবিসি একটি খবর করল— Doctor who raised concerns over PPE shortage admitted to mental hospital.

কীরকম একটা উন্মাদের, ঘোরতর পাগলের মতো বিষয় মনে হচ্ছে না? ডাক্তারির শিক্ষাক্রমে যেন শোনা যাচ্ছে— “শিক্ষা নাও শিক্ষা এই উন্মাদের পাঠক্রম/খুলে দিলাম আজ থেকে ছাত্রদের সংখ্যা কম”।

মনে হচ্ছে না আমরা ১৮-১৯ শতকের আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার দিনগুলিতে পশ্চাৎযাত্রা করছি? ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল— একজন চিকিৎসক (ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার সরঞ্জামের দাবী জানানোর আগে পর্যন্ত স্বাভাবিক), করোনার বিরুদ্ধে যারা সবচেয়ে অগ্রণী সৈনিকদের প্রথম সারিতে আছে্‌ন, দাবী করলেন উপযুক্ত ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম বা পিপিই (Personal Protective Equipment) দিতে হবে। এ দাবীর মধ্যে কোনও অসঙ্গতি বা অস্বাভাবিকতা নেই আপাতদৃষ্টিতে— যেমনটা ছিল না কাফিল খানের অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগার করার মধ্যে— অন্তত আমাদের মতো সাধারণ চুনোপুঁটিদের চোখে। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে ঠিক এমনটা মনে হয়নি। আধুনিক রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সমস্ত নাগরিককে সুশীল, অনুগত (docile), বাধ্য (obedient), এবং রাষ্ট্র-নির্ধারিত স্বাভাবিকতাকে মান্যতা দিতে প্রস্তুত (normalized) নাগরিক হিসেবে তৈরি করার এবং জন্ম দেওয়ার জন্য।

এখানে অনেকেরই ফুকোর কথা মনে পড়বে— Naturally it’s medicine which has played the basic role as a common denominator. It was in the name of medicine both that people came to inspect the layout of houses and, equally, that they classified individual as insane, criminal or sick. (Power/Knowldge, 1980, p. 62)। ১৯ শতকে আধুনিক রাষ্ট্র তৈরির শুরু থেকেই রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল মানুষ যাতে “স্বাভাবিক (normal)” এবং “অস্বাভাবিক (pathological)”— এই দ্বৈত বিভাজনের গবাক্ষ দিয়ে দেখতে শেখে, সড়গড় হয়ে ওঠে। কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়োত্তর গবেষণা সবকিছুর মধ্য দিয়ে এ শিক্ষা চারিয়ে যায় প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বোধের মধ্যে।

পশ্চিমী দেশগুলোতে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মাঝে নিরন্তর টানাপোড়েন এবং লড়াইয়ের ফলে একটি গণতান্ত্রিক সামাজিক পরিসর তৈরি হয়— যাকে আমরা বলি নাগরিক পরিসর বা তৃতীয় পরিসর বা কোনও ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বাম পরিসর। কিন্তু ইউরোপের আধুনিকতার বিকাশ এবং বেড়ে ওঠার সঙ্গে ভারতের কিছু পার্থক্য স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই রয়ে গিয়েছিল।

Engrafted মডার্নিটির যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে ভারতে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সবাই মানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠল নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষ্যণীয় যে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে যেখানে ব্রিটিশ রাষ্ট্র বা ইউরোপের একটি বড় অংশ প্রায় ৩০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে ভারত সেসমস্ত ধাপ অতিক্রম করার জন্য পেয়েছে কয়েক দশক মাত্র। ফলে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ দেশগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথমে ব্যক্তির অভ্যুদয়, পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সহাবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (secularism) যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা ভারতে হয়নি। যেভাবে শ্রমিক তথা মার্ক্সের ধারণানুযায়ী সর্বহারা শ্রেণির এবং পুঁজির সঙ্গে শ্রমের টানাপোড়েন থেকেছে বিভিন্ন স্তরে, যেভাবে দেশগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সামাজিক ও শ্রেণিসম্পর্কের মানুষের একটি পাব্লিক ডিসকোর্সের পরিসর তৈরি হয়েছে, যেভাবে চার্চ এবং রাষ্ট্র পৃথক হয়েছে, যেভাবে সমাজজীবন থেকে অপসৃত হয়ে ধর্মানুগত্য ব্যক্তিগত রুচি এবং পরিসরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিকভাবে— সেসব পরিবর্তনের পর্যায়গুলি এখানে হয়নি। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ভারত নামের ভৌগোলিক ভূখণ্ডে সামন্ত রাজা, উদীয়মান বৃহৎ শিল্পপতিশ্রেণি, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং ওকালতি ও ডাক্তারির মতো বিভিন্ন স্বাধীন পেশার ব্যক্তিদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগ্রামের বিভিন্ন সফলতা ও ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করেছে ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষ।

এ ধরনের বিভিন্ন সময়-চিহ্নের স্থায়ী ছাপ নিয়ে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হল সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের ক্ষমতাচিহ্ন। এরকম এক ঐতিহাসিকতায় প্রধানত কৃষিসম্পর্কে আবদ্ধ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রে মডার্নিটি বা আধুনিকতা প্রকৃত অর্থে engrafted হয়ে যায়, ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক পরিবর্তন ও গতিশীলতার (social and historical dynamics) নিয়মে জন্ম নেয় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার যে সম্পর্ক নতুন করে রচিত হয় ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষে তা প্রায়-সম্পূর্ণ ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংবিধানের ধারায় তৈরি হওয়া।

প্রধানত শিল্পবিপ্লবোত্তর ইউরোপে সমাজ এবং কৌমের ধারণা খসে গেছে প্রায় ২০০ বছর জুড়ে। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মাঝে সরাসরি সম্পর্ক— অধিকার এবং কর্তব্যের বাঁধনে, cash nexus-এর প্রবল উপস্থিতিতে। এখানে মধ্যস্থতাকারী কোনও সামাজিক পরিসর নেই, যা আছে তা নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস। ডেমোক্রেসির স্বর্ণযুগে কিংবা সামাজিক পরিসরের সবল, জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর, কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে— indiscernible থেকে discernible হয়ে ওঠে, invisibility থেকে visibility-র স্তরে উঠে আসে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-৭০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্রবিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের কথা কিংবা সাম্প্রতিক কালের “Another World is Possible” বা “Occupy Wall Street” আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এরকম একটা পরিসরে নাগরিক হওয়ার ধারণার সঙ্গে নাগরিক না-হওয়ার কিংবা অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিকভাবে মান্যতা, গ্রাহ্যতা পায়। বহু ভাষ্যের নির্মাণ হতে থাকে।

কিন্তু সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটাই যদি ভিন্নধর্মী হয়? যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় প্রভুত্বকারী সামন্ত রাজা ও এর উপযোগী পরিব্যাপ্ত মানসিকতা, কৃষি শ্রম, শিল্পীয় শ্রম, শিক্ষিত জায়মান নাগরিক সমাজ, বৃহৎ পুঁজি এবং জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ পর্বে গড়ে ওঠা ছোট বা স্বাধীন পুঁজির মধ্যেকার অসংখ্য বাস্তব দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে? যদি গড়ে ওঠে জাতিসত্তার প্রশ্নকে সমাধানের আওতায় না এনে? Integer বা পূর্ণসংখ্যা না হয়ে, কোন ত্রৈরাশিক বা ভগ্নাংশ কিংবা অ-নাগরিক হয়ে কেউ থাকতে পারে না। আধুনিকতার একটি এবং একমাত্র ভাষ্যেই এদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি সবসময়েই কেন্দ্রাভিমুখী। প্রান্ত এখানে প্রান্তিক, কখনও ব্রাত্যও বটে। অসংখ্য দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত রেখে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য চলমান চরিত্র (দলিলও বলা যেতে পারে) সতীনাথ ভাদুড়ীর সৃষ্ট ঢোঁড়াই। এরকম দলেই পড়বে আমার মতো সুশীল, সুবোধ, গোপাল-বালক গোছের মানুষজন।

ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাষ্য, যা আমাদের দেশে ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে অনুসৃত হচ্ছিল, তার উপাদানের মাঝে (matrix) নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের মতো নাগরিকদের ধরা হবে একেকটি integer বা পূর্ণ সংখ্যা হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশের কোনও জায়গা নেই। উদো-বুধোর ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, এসব ভাবার কোন অবকাশই নেই। মণিপুরী বা কাশ্মিরী বলে আবার আলাদা কিছু হয় নাকি? এগুলো তো ভগ্নাংশ। পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়।

এরকম এক social psyche তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা এবং disciplinary time তথা শৃঙ্খলাবদ্ধ সময়। আবার পূর্ণ সংখ্যা পজিটিভ বা ইতিবাচক হতে পারে, যেমন স্থিতধী, প্রজ্ঞাবতী-প্রজ্ঞাবান সব নাগরিক। পূর্ণ সংখ্যা নেগেটিভও (নেতিবাচক) হতে পারে। ভাবুন দেখি নেগেটিভ পূর্ণ সংখ্যার কি ভারী একখানা দল। এর মধ্যে সুধাকর রাও, কাফিল খান, গৌরী লঙ্কেশরা পড়বেন। এখানেও তো আবার অন্য বিপদ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে numbing of collective consciousness— বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা, যাকে বলে historical and social amnesia— ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ।

এই বিস্মরণের জোরেই কিনা আমার সুধাকর রাওকে নিয়ে কোনও কথাই আমার মনে হয়নি আজকের সকাল অবধি।

কী বিচিত্র বিষয় ভেবে দেখি একবার! নাগরিক-অনাগরিক, ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দি-অহিন্দি, কেন্দ্রের ভারত-প্রান্তের ভারত, আলোর ভারত-আলোআঁধারির ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লাছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড ডে মিলের ভারত!… উফ, মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। অ্যাত্তো অ্যাত্তো ভারতকে মনে রাখতে হবে? সবাইকে প্রকাশ করতে হবে “তোমারই প্রকাশ হোক”-এর মতো পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? আমার পরিচালক রাষ্ট্র তো সে কথাই বলছে। আমাদের কি আর নেগেটিভ সংখ্যা হওয়ার— এরকম দলভারী মিছিল দেখার পরেও— কোনও “সদিচ্ছা” আছে বা থাকতে পারে!

হয় তুমি ভারতীয়, নয় তুমি ভারতীয় নও। মানে তুমি আধুনিক, থুড়ি, বর্তমান রাষ্ট্রের নিয়ম-টিয়ম মানো তো? আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রথম যুগে মানে ইউরোপে যখন এলায়িত সামন্ত রাজ্য/রাষ্ট্রগুলো নতুন করে জুড়ে এবং বিন্যস্ত হয়ে ধীরে ধীরে আধুনিক শিল্পনির্ভর জাতীয় রাষ্ট্র হয়ে উঠছে সেসময় থেকেই তো অস্তিত্বের অন্য সব স্তর তলিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নাগরিক সত্তার মাঝে। একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ড নিয়ে, তার নিজস্ব আইনকানুন নিয়ে একটি রাষ্ট্র— বহুলাংশেই জনমতের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (যাকে এখন অ্যাকাডেমিক জগতের ভাষায় বলে “manufacturing consent”)। আরও একধাপ এগিয়ে আবার আমার আপনার মতো কোনও অর্বাচীন, অকালপক্ক, অর্ধশিক্ষিত দেখে এর মাঝে hegemony তথা মান্যতা নিয়ে টিঁকে থাকবার নানারকমের কৃৎকৌশল রয়েছে। কৃৎকৌশল রয়েছে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার চারিত্র্যলক্ষণের মধ্যে। আছে ঘৃণাকে ক্রমশ সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া— শব্দে, চিত্রকল্পে, প্রাত্যহিক সংলাপে।

হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী করে তুলতে হবে (spectacularized violence)। ধীরে ধীরে এগুলোকে সহনীয় করে তোলা হয়। নিজের নিয়মেই সহনীয় হয়েও যায়। যাকে পছন্দ করি না তাকে ‘দানব’ বানিয়ে দাও (demonization), শিক্ষা থেকে সরিয়ে দাও প্রশ্ন করার সাহস, উৎসাহ এবং পরিসর। সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব আসবে রবীন্দ্রনাথকে— শিক্ষার আঙ্গিনা থেকে। শিক্ষকেরা হয়ে যাবে educational managers— ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার অভিলাষী কোনও জ্ঞানভিক্ষু নয়। একটি সংস্কৃতির জন্ম হবে যার ভিত্তি হবে কেবল তাৎক্ষণিকতা-নির্ভর, শুধুমাত্র বর্তমানকে চিনি বুঝি যাপন করি, অন্য কিছু নয়। অতীতের এবং ইতিহাসের পুনর্নিমাণ হবে। সমাজের অন্ধকার জগৎ (যাদেরকে চালু ভাষায় লুম্পেন বলা হয়) আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেওয়ার, ক্ষমতার বৃত্তের সঙ্গে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে।

এরকম এক সময়ে ফ্যাতাড়ুরা আর অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারে না। এরা নিজেরাই রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া অন্তর্ঘাতের অংশীদার হয়ে যায়। এর হিংসা আর শক্তি প্রদর্শনের extra-judiciary, extra-state হাতিয়ার হয়। এরা “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে”-র সৌম্যকান্তি পাগল চরিত্রটির মতো দুর্বোধ্য “গ্যাৎচরেৎশালা” উচ্চারণ করে না। এরা স্পষ্ট ভাষায় হিংসা-ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেয় “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যেতে থাকে। আমাদের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছে না। ঘটনাচক্রে এখানে আক্রান্ত হন বেচারা বিদ্যাসাগর। তিনি এই চলমান ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে যান।

আবার সুধাকর রাওয়ে ফিরে আসি এসব শক্ত কথা ছেড়ে। অথচ সামান্য পিপিই কিট নিয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি সহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে ডাক্তারদের মধ্যে বিক্ষোভ ক্রমধূমায়িত। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন (NEJM)-এ প্রকাশিত “In Pursuit of PPE” প্রতিবেদনে (৩০.০৪.২০২০) বলা হয় করোনা-আমেরিকায় যুদ্ধের একেবারে সামনের সারিতে থাকা যোদ্ধা হিসেবে থাকলেও ডাক্তাররা “continue to be stymied by a lack of personal protective equipment (PPE)”। NEJM-এর আরেকটি প্রতিবেদনেও (৩০.০৪.২০২০) বলা হয়েছে— “Equally worrisome is the lack of adequate PPE for frontline health care workers, including respirators, gloves, face shields, gowns, and hand sanitizer. In Italy, health care workers experienced high rates of infection and death partly because of inadequate access to PPE.” অর্থাৎ, আমেরিকা, ইতালি ইংল্যান্ডের চিকিৎসকের উল্লেখযোগ্য অংশের মৃত্যুর একটা কারণ পিপিই-র অপ্রতুলতা। লান্সেট=এ প্রকাশিত (২৩.০৫.২০২০) প্রতিবেদন (The plight of essential workers during the COVID-19 pandemic) জানাচ্ছে আমেরিকাতে ২৭ জন, ইংল্যান্ডে ১০৬ জন এবং রাশিয়ায় ১৮০ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু ঘটেছে পিপিই-র যথেষ্ট সরবরাহ না থাকার জন্য।

তাহলে আমাদের দেশে “বেড়ে ব্যাটাকে ধর”-এর মতো সুধাকর রাওকে এত নিগ্রহ এবং অপমান সহ্য করতে হল কেন? প্রশ্ন করেছিলেন বলে? প্রশ্ন করা তো বুনিয়াদি গণতন্ত্রের কাঠামোকে শক্তিশালী করে, আবহকে বেগবান করে।

আর আমরাই বা এরকম নিশ্চুপ হয়ে থাকছি কেন? এর খানিকটা উত্তর আছে ভারত রাষ্ট্র গড়ে ওঠার ঐতিহাসিকতার মধ্যে, আংশিক উত্তর আছে বর্তমান সময়ে জন্ম নেওয়া নিজেকে ছাড়া অন্য সব বিষয়ে চরম ঔদাসীন্য এবং নিস্পৃহতার মাঝে, এবং বাকি উত্তর এ সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার রাস্তায় যে সামাজিক মান্যতা ও গ্রাহ্যতা অর্জন করছে তার মধ্যে। এরপরেও কিছু উত্তর অধরা থেকে যাবে। হয়তো আরও কিছু সময় গেলে বুঝব।

এর মধ্যে দু-একটা রূপালি রেখা আছে। পশ্চিমবাংলার ডাক্তারদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম সক্রিয় প্রচারে নেমেছে।

ডাক্তারদের সর্বভারতীয় সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট সেশন কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দিয়েছেন সরাসরি ডঃ সুধাকর রাওয়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের রিপোর্ট জমা দিতে।

রাষ্ট্র বনাম নাগরিকের এই দ্বৈরথ অন্তত নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আমরা সবাই একেকজন সুধাকর রাও— সম্মান নিয়ে, মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই। আমাদের কোন “ব্রেন ফিভার” নেই, পাগলামো নেই। আমরা সম্পূর্ণ সুস্থ। জীবিত থাকা অবধি আর্ত মানুষকে বাঁচাতে চাই।