Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঈশানী নদী, গঙ্গাটিকুরি ও উত্তর রাঢ়ের কথা

ঈশানী নদী, গঙ্গাটিকুরি ও উত্তর রাঢ়ের কথা -- সম্পর্ক মন্ডল

সম্পর্ক মন্ডল

 

জলঙ্গি যেমন কৃষ্ণনগরের, হুগলি যেমন কলকাতার, বা কোপাই যেমন বোলপুরের, ঠিক কেতুগ্রাম বা গঙ্গাটিকুরির তেমন ঈশানী। সেই সুদূর প্রাচীনকালে গঙ্গার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এই ভূখণ্ডের (কেতুগ্রাম ২ ব্লক অঞ্চল) পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলা ক্ষীণতোয়া নদীটি, রাঢ়দেশের আত্মার সঙ্গে গভীর বন্ধনে বেঁধে চলেছে প্রতিটা মুহূর্ত। কথিত আছে, দূরপ্রাচীনকালে মুর্শিদাবাদ-বর্ধমান সীমান্ত লাগোয়া বন্দর গ্রামের পাশেই ছিল গঙ্গার ধারা এবং ওখানেই ছিল গঙ্গা-বন্দর। ওখান থেকেই উত্তরবঙ্গের দিকে রাঢ়দেশীয় রাজারা তাদের বাণিজ্যতরী পাঠাতেন, তাই গ্রামের নাম আজও ‘বন্দর’। পরে ধীরে ধীরে গঙ্গার ধারা সরে গিয়ে আজকের উদ্ধারণপুরের পাশ দিয়ে স্রোতোবহা গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে চলেছে তার আপন মহিমায়। সেই প্রাচীনকালেই গঙ্গার প্রবাহ সরে গেলে সেখান থেকে একটি নতুন ভূখণ্ডের জন্ম হয়— যা পরে গঙ্গাতীরবর্তী উচ্চভূমি বা ডাঙা হিসাবে গঙ্গাটিকুরি নামে পরিচিত হয়। যদিও গঙ্গাটিকুরি নামটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে, কেউ বলেন এটি গঙ্গা-পাশ্ববর্তী বালিয়ারির উপর মানুষ বসবাস শুরু করে হয়েছে! কিন্তু এই তথ্যটি ভুল প্রমাণিত হয় যখন আমরা দেখি গঙ্গাটিকুরি নিকটস্থ কিছু গ্রামের নাম বিপ্রটিকুরি বা বদ্যিটিকুরি, অথচ সেই গ্রামগুলির একটিও নদীর তীরবর্তী বালিয়ারির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অতএব একটি তথ্যই খাটে গঙ্গাটিকুরি নাম সম্পর্কে, সেটি হল গঙ্গাটিকুরি হল গঙ্গা তীরবর্তী উচ্চভূমি বা টিকরা। টিকরা গৌড় ও বঙ্গে প্রচলিত একটি দেশি শব্দ (টিকরা, পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৭৮, চলন্তিকা, আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান, সঙ্কলিত: রাজশেখর বসু)। তাই গঙ্গা+টিকরা হয়ে গঙ্গাটিকরা উচ্চারিত হতে হতে ক্রমে কিছুটা সুর যোগ হয়ে গঙ্গাটিকুরি রূপে প্রকাশ পায় এবং মূলত ঈশানী নদীকে কেন্দ্র করেই গঙ্গাটিকুরি গ্রাম ও কেতুগ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দাদের বসতি স্থাপন হয়। কথিত আছে এককালে এই গঙ্গাটিকুরি ভূখণ্ড ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা। বাঘ-হরিণ-বনমহিষের চারণভূমি ছিল এই অঞ্চল। তখন উত্তরবঙ্গের রাজারা এখানে হরিণ শিকারে আসতেন। তাঁরা হরিণ শিকার করে নিয়ে যেতেন। তাই আজও একটি স্থানের নাম ‘হরিণডাঙা মাঠ’ হিসাবে পরিচিত এখানে। হয়তো তখন বিরাটকার কুমির থাকত ঈশানীর বুকে, পরে তারা স্থানাভাবে গঙ্গায় আশ্রয় নেয়। তবে তৎকালীন ঈশানী নদীর নাম ছিল সিঙ্গটিয়া নদী। এই সিঙ্গটিয়া নামের উৎস সম্পর্কে জানা যায় না, কিন্তু ঈশানী নামটি সম্পর্কে ধারণ করা হয় যে বীরভূমের চিতগ্রাম-উড়ুন্দি থেকে সৃষ্টি হয়ে ক্রমে ক্রমে ঈশান কোণের দিকে বাঁক নিতে থাকায় তার নাম লোকমুখে ঈশানী বলে প্রচার পেয়েছে। যদিও তার উৎসস্থান নিয়েও কিছু মিথ প্রচলিত আছে, বলা হয় ঈশানী নাকি চিতগ্রাম-উড়ুন্দি গ্রামদ্বয়ের মাঝে একজন কৃষকের সারগাদা থেকে সৃষ্ট। যদি এই তথ্যটি সর্বাঙ্গীণভাবে সত্যি হয় তাহলে হয়তো ঈশানী একমাত্র নদী পৃথিবীতে, যার জন্ম কোনও জলজ উৎস থেকে নয়! আমরা ছেলেবেলায় আশ্চর্য হতাম তা ভেবে, কিন্তু বড় হয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই তথ্যটি একদম মিথ্যা। আদতে বীরভূমের উড়ুন্দির গায়ে একটি জলের ক্যানাল বা নালা থেকে এটি সৃষ্টিলাভ করে চিতগ্রাম থেকে নদীর রূপ পেয়েছে এবং ধীরে ধীরে তা বড় হতে হতে কেতুগ্রামের পাশ দিয়ে এসে বেলুনের কাছে বেঁকে খণ্ডবিল্ল বা খাঁড়ুলিয়ার পাশ দিয়ে গঙ্গাটিকুরির ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে, তারপর গঙ্গাটিকুরির শিবলুন ব্রিজ লাগোয়া জায়গায় এটি দুইভাবে বিভক্ত হয়ে আবার নৈহাটির আগে মাসিসেঁকোর সঙ্গে মিলিত হয়ে মিলিত ধারায় বয়ে গিয়ে শাঁখাইয়ের কাছে অজয় নদীতে পড়েছে। কেতুগ্রামের কাছে এই ঈশানীর তীরেই অট্টহাস সতীপীঠ, যেখানে উপাস্যমান শিবের নাম নদীর নাম অনুযায়ী— ঈশানেশ্বর। এবং প্রায় তার এক কিলোমিটারের মধ্যেই অতি প্রাচীন কেতুগ্রাম-মহাশ্মশান ও বহুলাক্ষী মন্দির। এককালে এই নদীপথে ও তার পার্শ্বীয় ভূমি কাঁপিয়ে ডাকাতি করত নশু ডাকাত, কারণ সুদূরকালে নদীপথই ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আজও অট্টহাসে গেলে এই বটগাছটি দেখা যাবে, যেখানে তারা নরবলি দিত। আবার এই ঈশানী বেলুনগ্রামের কাছে শিবাই নদী নামে পরিচিত (জীবপ্রেমী তন্ময় ঘোষের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে এখানেই গড়ে উঠেছে বেলুন জলবাড়ি, যা একদম নদীর কাছেই)। অন্যদিকে ঈশানীর আর একটি পরিচয় হল— সে মহাপ্রভুর স্পর্শধন্য। জানা গ্যাছে, শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু যখন রাঢ়দেশ পরিভ্রমণ করছিলেন, তখন তিনি কেতুগ্রামের কুলাই হয়ে এই ঈশানী দিয়েই জলপথে গঙ্গার নিকট উদ্ধারণপুরে পৌঁছেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে একটি লেখায় মাননীয় ডঃ স্বপন ঠাকুর মহাশয় জানিয়েছেন—

শ্রীচৈতন্যদেব সতীপীঠ কেতুগ্রামের ভৈরবতলার চণ্ডীমন্ডপে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এখানকার চট্টোপাধ্যায় বংশের জনৈক ব্যাক্তির কাছে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল পান করেছিলেন। আগে ভৈরবের স্থানে প্রচুর পশুবলি হত। মহাপ্রভুর সম্মানার্থে পরে বলিপ্রথা উঠে যায়। কেতুগ্রাম থেকেই নাকি মহাপ্রভুকে ঈশানী নদীপথে উদ্ধারণপুর এবং সেখান থেকে গঙ্গাপথে শান্তিপুর নিয়ে যাওয়া হয়।

আবার এই ঈশানী সাক্ষী, তার পরিমণ্ডলের সংখ্যাতীত মহামানবের জন্মভূমির প্রিয় নদী হিসাবে, সে দেখেছে গঙ্গাটিকুরির অদূরে ঝামটপুরের বৈষ্ণব কবি কৃষ্ণদাসের ১২ বছর বয়সের গৃহত্যাগ এবং বৃন্দাবন যাত্রা, সে দেখেছে কেতুগ্রামের অদূরে কাঁন্দরায় কবি জ্ঞানদাসের লীলাময় পদের খেলা, সে দেখেছে কুলাইয়ের বৈষ্ণব পদকর্তা বাসুদেব ঘোষ ও তার ভাই তথা অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ ঘোষের জন্ম, সে দেখেছে বাসুদেবের কনিষ্ঠ ভাই মাধব ঘোষের কীর্তন রসের প্রেমালাপ, সে দেখেছে লক্ষ্মণ সেনের মা হেরম্ব দেবীর নৈহাটিতে গঙ্গাপূজা, সে দেখেছে উদ্ধারণপুরের প্রাণপুরুষ, নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দ্বাদশ গোপালের অন্যতম উদ্ধারণ দত্তের বৈষ্ণবধর্ম প্রচার, সে দেখেছে গঙ্গাটিকুরির লেখক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রসসাহিত্যের তুফান, যে তুফানে সারা বাংলায় হিল্লোল উঠেছে বারবার, সে দেখেছে গঙ্গাটিকুরির সাপুড়ে-বেদেদের মাটির কুটিরে লেখক তারাশঙ্করের বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পালাপ, সে দেখেছে মারাঠি বর্গি লুঠেরাদের অত্যাচার, চারদিকে আগুন, গঙ্গাটিকুরি-পাঁচুন্দি-কেতুগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের পর গ্রামে বর্গিদের অত্যাচার, ধর্ষণ, লুঠ। সে শুধু দেখেছে, হাজার হাজার বছর ধরে সে শুধু দেখেই চলেছে আর বোবাস্বরে তার প্রবাহবেগের গায়ে লিখে রাখছে বোবালিপি।

গঙ্গাটিকুরি অঞ্চলের অনেক বৃদ্ধমানুষের গল্প থেকে জানা গেছে— ১৯০০ সালের আগে বা তারপরেও বহুবছর গঙ্গাটিকুরি লাগোয়া কোনও স্থানে ছিল না বড় কোনও মুদিখানা দোকান। তাই সেইসময় অজয় নদী দিয়ে প্রবেশ করে ঈশানীতে আসত বড় বড় বজরা নৌকা— যেগুলি ছিল এক একটা বিরাট বিরাট মুদিখানা দোকান। তাতে তেল, গুড়, আতর, বিভিন্ন ভোজ্যসামগ্রী তথা মশলাদি থাকত। গঙ্গাটিকুরি বা কেতুগ্রামের কাছাকাছি এইসব বজরাগুলো নোঙর করে চলত বিনিময় প্রথায় কেনাবেচার পালা। গ্রামের মানুষজন চাল, ডাল, গম, আলু ইত্যাদির বিনিময়ে মশলাদি সংগ্রহ করত। জানা যায়, অনেক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা তাদের কন্যাদের বিবাহ দিতে সক্ষম না হওয়ার জন্য সেই সব দোকান তথা বজরা মালিকদের হাতে তুলে দিতেন, হয়তো মৌখিক প্রতিশ্রুতি তাতে থাকত একটা, হয়তো সেই দায়গ্রস্ত পিতা আশার আলো দেখতেন তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে। কিন্তু জানা যায়নি সেইসব মেয়েদের আদৌ বিয়ে হয়েছিল কিনা!

সেই সুপ্রাচীনকালের ইতিহাস বুকে নিয়ে সে আজও বয়ে চলেছে রূপবতী রূপে, শরতকালের চাঁদনি রাতে কাশফুলের চাদরে ঢাকা ঈশানী যেন একটি স্বর্গীয় দৃশ্যের প্রতিলিপি। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ তেমন রূপ দেখলে চন্দ্রাহত হয়ে যেতে বাধ্য! তাই তার রূপে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় বাউল গান বেঁধেছে, গঙ্গাটিকুরির বোলান পালাকার তথা আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাণবল্লভ মন্ডল তাকে নিয়ে বোলানের পদ বেঁধেছে। সেই পদগুলি যুগের হাওয়ায় হারিয়ে গেছে, কিন্তু ঈশানীর রূপের মাধুরী একটুও নষ্ট হয়নি। রাজ্য সরকার মহত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ রোজগার যোজনার আওতায় ঈশানীর নাব্যতা বাড়ানোর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করেছেন কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অসচেতন স্থানীয় শ্রমিকদের ব্যর্থতা সঠিক লক্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করেনি। তাই প্রতি বছর শ্রাবণ এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাসের প্রাক্কালে ঈশানী তার রূপবতী রূপ ঝেড়ে ফেলে ভয়ঙ্করী রূপে যেন আবির্ভূত হয়, তাতে স্বর্ণালী আউশ ধানের মাঠ মাইলের পর মাইল ডুবে যায়, প্রচুর মানুষ ঘরছাড়া হয়।

এই অঞ্চলে একটা মিথ চালু আছে যে— প্রতি ২২ বছর অন্তর বিপুলকায় বন্যা হবে এই রাঢ়দেশের প্রান্তভাগে। হয়তো কিছুটা সেই মিথে নির্ভর করলে আশ্চর্যভাবে মিলে যায় ১৩৬৩ সালের বিরাট বন্যার পর ১৩৮৫-তে আরও বিরাট বন্যা হয়, তাতে ভেসে যায় গঙ্গাটিকুরি ও কেতুগ্রাম লাগোয়া বেশিরভাগ গ্রামই, তারপর আবার বাইশ বছর পর ১৪০৭ বা ২০০০ সালের বন্যায় চারদিক লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। স্থানীয় অধিবাসীরা তাই প্রহর গোনে ১৪২৯ বা ২০২২ সালে আবার একটি বিধ্বংসী বন্যা হবে, হয়তো ঈশানীর বর্তমান নাব্যতা যদি এই একইভাবে কমে যায় বা সরকারের তরফে ড্রেজিং না করা হয় তাহলে গোটা কেতুগ্রাম অঞ্চল পরবর্তী বড় বন্যাতে স্রেফ তলিয়ে যাবে। কারণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় এবং বারবার তার ধাক্কায় সমাজের নিচুতলার মানুষ জীবনের প্রতি স্বাভাবিক আস্থা হারায়। আর তাদের দৈনন্দিন জীবনে শুধু খাওয়াপরার উপর তৈরি হয় বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। তবুও এই ঈশানীকে কেন্দ্র করেই মানুষ আশা করে আউশ-আমন-বোরো চাষে আবার মন দেয়, আবার তার জলেতেই পুষ্ট হয়ে ভরে ওঠে সরষের হলুদখেত, আবার শরতের নতুন আলোতে কাশফুলের মেলা বসা ঈশানীর দিকে তাকিয়ে মানুষ নিঃশ্বাস নেয় আর ভাবে— তাদের উমা আসছে ঘরে!


ছবি: লেখক