প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য
মোল্লা নাসিরুদ্দিন ইতিহাসের মানুষ কিনা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তিনি লোককথার নায়ক৷ ইওরোপের তুরস্ক, গ্রিস, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়া, ম্যাসাডোনিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, আফগানিস্তান হয়ে দূর প্রাচ্যে চিন দেশের সিনচিয়াং অবধি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে প্রায় আটশো-নশো বছর ধরে নাসিরুদ্দিনের জনপ্রিয় কাহিনিগুলির চলাচল। নানা দেশে ও নানা ভাষায় অনূদিত হতে হতে মোল্লা নাসিরুদ্দিন আজ বিশ্বসাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, মানবিক কমেডির প্রোটাগনিস্ট। গোপাল ভাঁড় বা বীরবলের মতো ভাবনা ও চরিত্রে প্রায় কাছাকাছি হলেও, মোল্লা নাসিরুদ্দিন এদের মতো নিজের দেশকাল দ্বারা আবদ্ধ নয়। তিনি এক 'দিব্য ভাঁড়', যিনি মজার ছলে রাষ্ট্রের নানা অনাচারকে প্রতিনিয়ত নগ্ন করেন। বাংলাভাষার মৌলিক ও ব্যতিক্রমী চিন্তক প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য লোককথার মোল্লাকে হাজির করেছেন সমসময়ের প্রেক্ষিতে, বোখারা শহরের চায়ের মজলিশে বসে মোল্লার শাণিত যুক্তি উন্মুক্ত করেছে দখলদার রাষ্ট্র্র ও পুঁজিবাদের স্বরূপ। ২০০৬ সালের নভেম্বরে মন্থন প্রকাশন প্রকাশিত 'তেরছা নজরে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প' থেকে একটি অংশ তুলে আনা হল এবারের স্টিম ইঞ্জিনে।
বোখারা শহর। উজবেকদের প্রিয় ঋতু বাহার বা বসন্তের দ্বিগিজয়ী সঞ্চরণ চোখে কানে নাকে আর ত্বকের কোষে কোষে কোষে জানান দিচ্ছে।
এক সাবেকি সরাইখানার জীর্ণ ইমারতের একাংশ সারিয়ে বানানো হয়েছে এক সস্তার রেস্তোরাঁ, তার কপাটের মাথায় আঙুরলতা। সেখানে সামোভার ঘিরে বসেছে চায়ের মজলিশ। মোল্লা নাসিরুদ্দিন হাজির। মজলিশে নিরঙ্কুশ গণতন্ত্র; তবু চুম্বকটান অবশ্যই নাসিরুদ্দিনের দিকে।
ইরাক-যুদ্ধের আজ কুড়ি দিন৷ বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে বাগদাদের পতন আসন্ন। আড্ডাধারীরা স্বভাবতঃই বিষন্ন ক্ষুব্ধ তিক্ত ক্রুদ্ধ। কেবল মোল্লা স্বয়ং ঈষৎ ব্যতিক্রম। তাঁর মেজাজ ইলাস্টিকের ফিতের মতন: টান পড়লে লম্বা হয়ে যায়, আবার সহজেই ফিরে আসে আগের সাইজে।
আড্ডার গন্ধে জুটে গেছেন এক উজবেক তুলোচাষী। ঝানু। সোভিয়েত আমলে মোটামুটি সচ্ছল ছিলেন; নয়া জমানায় কালো বাজারের জোয়ারে হালে পানি পাচ্ছেন না। উনি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন নাসিরুদ্দিনকে, ‘আচ্ছা, মোল্লা, তৈমুর বাদশা আর আপনাকে নিয়ে এই একটা কিসসা হাটেবাজারে চলছে বহুত দিন থেকে: এক দিন তৈমুর লঙ্গ আপনাকে বলেন, “মোল্লা, দুনিয়ার তাবৎ বাদশা এইরকম সব খেতাব নেন– ঈশ্বরপ্রসাদ, ঈশ্বরবান্দা, ঈশ্বরসিংহ ইত্যাদি। তো, আমি কী নেব?” আপনি ঝটপট জবাব দেব, “খোদা-হে-বাঁচাও”।
“এ নিয়ে আমার দুটো প্রশ্ন। এক, বুশের জুতসই খেতাব কী? দুই, তৈমুর আর বুশ, দুজনেই, ইরাকের ওপর বর্বর আক্রমণ করেন। ওঁদের মধ্যে তফাতটা কোথায়?”
নাসিরুদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ, শাহানশা-বাদশাহের খেতাব যেমন রকমারি, তেমন রঙদার। বুশের খেতাব? “ইশ্বরের খুশকি”!
‘তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে দুটো কথা বলব। প্রথমত, তৈমুর বাদশার হাতিয়ার ছিল সেকেলে; বুশের একেলে, হাই টেক। দ্বিতীয়ত, তৈমুর ছিলেন নিখাদ যোদ্ধা; বুশ হাড়েমজ্জায় বেনে। বুশের যুদ্ধ, বেনের যুদ্ধ৷ যুদ্ধের আগেও হিশেব, মধ্যেও হিশেব, পরেও হিশেব। সবার ওপরে আছে একটা আদত হিশেব: ক্ষমতার দাপকে দ্বিগুণ তিনগুণ চৌগুণ — ক্রমাগত, ক্রমাগত — বাড়িয়ে যাওয়ার ঠান্ডা-হিম হিশেব। ক্ষমতার সেই হিম হিশেবের সঙ্গে তেলদখলের এই লড়াইটার অঙ্ক গায়ে গায়ে সাপটানো। তাই তো বলছি, বুশের সবটাই বেনের হিশেব।’
আড্ডা দিতে এসেছেন উজবেক কাগজের এক অভিজ্ঞ রিপোর্টার। তথ্যের নিঃস্পৃহ নাড়াচাড়ায় তিনি অভ্যস্ত; তবে সত্য কী– এইটে জানতে চাইলে কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান। শরাবের প্রতি তাঁর আসক্তিটুকু নিষ্কাম এই অর্থে যে, আজ বসন্তের এই মদির বিকেলে উজবেকিস্তানের সস্তা শরাবের প্রলোভন ছেড়ে জুটেছেন এই চায়ের মজলিশে। নাসিরুদ্দিনের মুখের কথা শেষ হতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘বেশক! আরে, যুদ্ধ শুরুর ঢের আগেই তো মার্কিনিরা অঙ্ক ক’ষে বলে দেয়, ইরাক-দখলের পর, সেখানে ফৌজ মোতায়েন রাখতে খরচ পড়বে ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা ইরাকের মোট জাতীয় উৎপাদনের সমান। আজকের খবর হ’ল: হিশেব ক’ষে দেখা যাচ্ছে ধ্বস্ত ইরাককে ফের গড়ে তুলতে বছর পাঁচেক তো লাগবেই আর সে-বাবদ ফি বছরে খরচ করতে হবে অন্তত ১০০ বিলিয়ন ডলার। আর এই হামলা চালাতে মার্কিনিদের যা ক্ষয়ক্ষতি, খরচাপাতি হল, সে-ও তো উসুল করতে হবে, তারও দর কষা হচ্ছে ডলারের হিশেবে।’
উজবেক ইনজিনিয়ারিং কারখানার শ্রমিক: ‘কে দেবে এই গুণাগার?’
উজবেক গালচেওয়ালা: ‘অবশ্যই ইরাকিরা! তেল দাও, তার বদলে রুটি নাও — এই নিয়ম তো আমেরিকা চালাবেই। আবার, তেলের দাম থেকে যুদ্ধের খরচপত্র তুলে নেবে, আদায় করবে খেসারত৷ বিধ্বস্ত ইরাক গড়ে তুলতে মোটা মুনাফার কনট্র্যাক্ট, কে কতটা পাবে, তা নিয়ে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, কোম্পানিতে কোম্পানিতে জোর রেষারেষি তো শুরু হয়ে গেল, এরই মধ্যে। দেখলেন না, তেলের খনির আগুন-নেবানোর ঐ শাঁসালো কনট্র্যাক্টটা কেমন হাতিয়ে নিলেন মার্কিন রাষ্ট্রের খোদ ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিজেই- কী বেশরম!’
ইনজিনিয়ারিং শ্রমিক: ‘লজ্জা ঘৃণা ভয়, পুঁজির তিন থাকতে নয়।’
ওই গালচেওয়ালা মানুষটি মার্কিন টুরিস্টকে ঠকিয়ে দু পয়সা কামিয়ে থাকেন। হিশেবের অঙ্কটা বোঝেনও বিলক্ষণ। তবে নিজের বুদ্ধি-বিবেকের জিম্মাদারি এখনও ডলারের থলিতে সঁপে দেননি পুরোপুরি।
আগের কথার জের টেনে তুলোচাষী বললেন, ‘হাল আমলের ওই বহুজাতিক বেনে আচ্ছা চশমখোর বটে! কিন্তু এত খেসারত ইরাকিরাই-বা জোগাবে কোথথেকে? কেমন করে? উপায় কী, মোল্লা?’
নাসিরুদ্দিন: ‘উপায়? কী জানি! তবে আমিও একবার পড়েছিলুম ওই খেসারতের ফেরফারে। সে-গল্পটা তাহলে বলি। শোনো।
‘একবার ষাঁড়ের লড়াই হচ্ছিল এই বোখারাতেই৷ জব্বর লড়াই৷ তা হল কী, মস্ত ক্ষমতাওয়ালা জায়গিরদারের বেয়াড়া এক ষাঁড় আমার ষাঁড়টিকে মারলে এক মোক্ষম গুঁতো– লড়াইয়ের রীতরেওয়াজ-ভাঙা একদম বেকানুন মার। তক্ষুণি আমার ষাঁড় তো ঘায়েল। খুন চড়ল আমার মাথায়। তখন মনে পড়ল এক বুড়ো ইরাকি চাষীর উপদেশ। বরফের মতন ধবধবে দাড়িতে বিলি কাটতে কাটতে বলেছিলেন, “বাবা, প্যাঁচপয়জার যদি মারতে হয় ঠান্ডা মাথায় মেরো।” তাই মোকামে গিয়ে বিবিজানকে বললুম, “ওগো একপাত্র তরমুজের শরবত বানাও দেখি।” শরবত খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে মামলা রুজ্জু করলুম ওই জাঁদরেল জায়গিরদারটার খেলাপে।
‘কাজিসাহেব ফরিয়াদি আর আসামিকে অনেক ক্ষণ জেরা করলেন। তারপর, নাকে চশমা আঁটলেন। তারপর, কোরান হাদিস আর মোটামোটা আইনের কেতাব ঘাঁটলেন, ঢুঁড়লেন, পড়লেন। তারপর, একটা বিকট হাই তুলে রায় দিলেন, “জায়গিরদার সাহেব বেকসুর খালাস। আর, মোল্লা নাসিরুদ্দিন, তোমার দশ হাজার টাকা জরিমানা।”
‘আমি তো থ। হায়রে ইনসাফ! আমি বললুম, “কেন হুজুর? আমার কসুরটা কী?”
“জায়গিরদার সাহেবের ষাঁড় যে তোমার ষাঁড়কে অমন মারাত্মক গুঁতোল, তাতে ওর প্রভূত শক্তিক্ষয় হয়েছে। তারই খেসারত বাবদ এই জরিমানা তোমাকে দিতে হবে।”
‘বিদ্যুৎ বেগে আমি কাজির গালে ঠাস ক’রে একটা ওজনদার থাপ্পড় মারলুম। তৎক্ষণাৎ নাক থেকে ছিটকে পড়ল কাজির চশমা। চটপট আমি আভূমি কুর্নিশ ঠুকে গড়্গড় করে বললুম, “হুজুর, এই থাপ্পড়টা মারতে আমারও যে প্রভূত শক্তিক্ষয় হল! তার খেসারত বাবদ আমারও পাওনা দাঁড়ায়, দশ হাজার টাকা। ওই টাকাটাই আপনি মেহেরবানি করে জায়গিরদার সাহেবকে দিয়ে দিন৷ ” এক লহমায় আমি মারলুম ভোঁ-চম্পট!’
ইনজিনিয়ারিং শ্রমিকটি টেবিল চাপড়ে বলে উঠলেন, ‘সাবাশ, মোল্লা! খাশা! ইরাকিরাও-বা কেন খেসারত জোগাবে? কীসের জন্য, শুনি? নিজেরাই ওরা আগুন লাগাক ওদের সমস্ত তেলের খনিতে! পুড়ে যাক ইরাকের সব তেল, বেবাক! ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়!’
এই শ্রমিকটি তরুণ। দেশে সোভিয়েত ব্যবস্থা ভেঙে-পড়ার পর ঝুঁকেছেন অ্যানার্কিজমের দিকে৷ ওঁর সঙ্গে মোল্লার সব সময়ে মতের মিল হয় না, তবে দিলের মিল খুবই।
শ্রমিকটির কথা শুনে মোল্লা নাসিরুদ্দিন মুচকি হেসে বললেন, ‘বেরাদর, তোমার ওই প্রবাদটি ন্যাংটার দিক থেকে পরিস্থিতিকে দেখছে৷ আমি একটি আরবি প্রবাদ বলছি– অনেকটা একই রকম– সেখানে কিন্তু পরিস্থিতিটা দেখা হচ্ছে অপর পক্ষের দিক থেকে। শোনো, সেই প্রবাদ: ন্যাংটাকে স্বয়ং আল্লাও ডরান! আরে, ন্যাংটাকে যদি স্বয়ং খোদা-ই ডরান, তবে তো এই দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাওয়ালা বাটপাড়ও তাকে ভয়ডর করবে!’
ইনজিনিয়ারিং শ্রমিক: ‘ঠিক। তবে খামকা আপনি খোদাকে টানছেন কেন? আপনার ওই খোদায়-টোদায় আমাদের বিশ্বাস নেই। খোদা আর রাষ্ট্র– দুই-ই — খতরনাক; আমরা ওই দুটোই খতম করব। তবেই মানুষের মুক্তি।’
নাসিরুদ্দিন: ‘নও-জোয়ান, তোমার অ্যানার্কিজমের চেয়ে আমার অ্যানার্কিজম আরও মৌলবাদী। আমি সব বাঁধা-ছক, বাঁধা-ধারণা — মায় অ্যানার্কিজম — বোম মেরে উড়িয়ে দেব। তবেই মানুষের মুক্তি।’
ইনজিনিয়ারিং শ্রমিকটি ফিকফিক করে হেসে উঠলেন৷ তারপর বললেন, ‘যাক। যে-কথা হচ্ছিল– আমি বলতে চাই, আত্মরক্ষা আক্রান্ত-ইনসানের জন্মগত অধিকার। আত্মরক্ষার জন্য আত্মহত্যাও সঙ্গত।’ বলতে বলতে দপ ক’রে কালো-আগুন জ্বলে উঠল ওঁর দুই চোখে।
নাসিরুদ্দিন ভাবতে ভাবতে, একটু থেমে থেমে বললেন, “আদত কথা হচ্ছে: আত্মরক্ষা — এই তো? তাহলে, আত্মহত্যা থেকে আত্মরক্ষাও ইনসানের জন্মগত অধিকার। সুতরাং, ইরাকের সমস্ত তেল বেবাক পুড়িয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া যদি যৌথ-আত্মহত্যা হয়, তবে, তা থেকেও, ওই আত্মরক্ষার হক, ইরাকিদের আছে — কী বলো তুমি?’
শ্রমিকটি একটু থতমত খেয়ে, মাথা নেড়ে, বললেন, ‘হ্যাঁ।’
নাসিরুদ্দিন: ‘যৌথ-আত্মঘাত ছাড়া যৌথ-আত্মরক্ষার অন্য পথ আছে কিনা সেটাই তো ইরাকিদের খুঁজে দেখতে হবে।
‘দুনিয়া-সুদ্ধ মানুষ নিঃস্ব, ন্যাংটা হয়ে যেতে পারলে তো মুশকিল আসান! যত সব মাল্টিন্যাশনালও জব্দ: খদ্দের গায়েব মানে বাজারও গায়েব। সব ল্যাঠা চুকে যায়! কিন্তু সেটা কি ঠিক কাণ্ডজ্ঞানের কথা?’
তুলোচাষী আর গালচেওয়ালা হাঁ-হাঁ করে, প্রায় একই ভাষায়, বলে উঠলেন, তাহলে আমার সংসারই-বা চলবে কী করে?
নাসিরুদ্দিন: ‘হ্যাঁ, সেটাও ভাববার কথা বৈকি। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা-ভাঙা বুদ্ধির লক্ষণ নয়। কাণ্ডজ্ঞানের পথ আছে কিনা, সেইটেই যে খোঁজবার। খুঁজবেন কীভাবে? সুফি মুরশিদ [গুরু] তো বলেন, চলতে চলতেই পথের খোঁজ মিলবে।
‘হ্যাঁ, ওই কাণ্ডজ্ঞানের কোনও পথ হয়তো আছে। হয়তো সে-পথের একটা হদিস দেন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস৷ ওঁর মতন আমরাও বাজারে গিয়ে নিজের নিজের আমি-কে এই আপসহীন, ক্ষান্তিহীন প্রশ্নটি করতে পারি: এই-যে এত পণ্যসম্ভার, এর মধ্যে কোনটা কোনটা আমার না-হলেই নয়, আর, আমার পক্ষে বাড়তিই-বা কোনগুলো?
‘সক্রেটিসের এই পন্থায় আমি নিজেও– অবশ্যই আমার মতন করে– একবার চলেছিলুম, ফলও পাই হাতে হাতে।
‘হাটের দিনে সমরকন্দের হাটে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে হাত পেতে দাঁড়াতুম আমি৷ এক টাকা, পাঁচ টাকা বা দশ টাকা কেউ দিতে এলে নিতুমই না। নিতুম শুধু কেউ এক পয়সা দিলে। লোকে বুঝে নেয় আমি একটা আস্ত গাধা; তাই আমায় নিয়ে মশকরা করত। শেষমেশ, এক জাঁহাবাজ আর থাকতে না-পেরে বলেই ফেললেন, অতীব মুরুব্বিয়ানার ঢঙে, “কী যে কর, মোল্লা! কেউ বেশি টাকা দিলে নাও না কেন? তাতে তো আয়ও বাড়ে, লোকে মশকরাও করে না।”
‘আমি বলি, “কিন্তু আমি যদি বেশি টাকা নিই, তাহলে তো লোকে আমার গাধামি নিয়ে তামাশা দেখার গরজে ওই একটি পয়সাও দেবে না আর। তার চেয়ে এই তো বেশ৷ শূন্য হাতে ফিরি না কোনওদিন৷ হপ্তায় একদিন পোলাও-কোর্মা আর বাকি ছ’দিন খাবি খাওয়ার চেয়ে রোজ শাকভাত খাওয়া মন্দ কী?”
ইনজিনিয়ারিং শ্রমিক: ‘বেশক! পণ্যরতিই হচ্ছে হারাম। ওইটের মায়া কাটালে বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে এখন এঁটে ওঠাই দায়৷ ওরে ভাই, নিজের লোভ বাগে না রাখলে, লাগাম-ছেঁড়া মুনাফার আর ক্ষমতার লোভকে শায়েস্তা করব কী করে?’
স্তব্ধতা নামল মজলিশে। ঝিরঝিরে দক্ষিণে হাওয়া কাঁপন তুলল রেস্তোরাঁর সামনে একটি চিনার গাছের উদ্ধত পাতায়। দিনান্তের সূর্যমুখী রঙের আলো প’ড়ে চিনারপাতার চিকন সবুজ থেকে একটা হালকা বেগুনি আভা ঝিকমিক করছিল। সেদিকে তাকিয়ে মোল্লা নাসিরুদ্দিন আত্মগত স্বরে বললেন, ‘আজ ভরসার নতুন রেখাটুকু এই: ইরাকের ওপর হামলার বিরুদ্ধে দেশে দেশে যত ইনসান শামিল হচ্ছেন, এত বিশাল জমায়েত কখনও কেউ দেখেনি। শান্তি আর বেওয়ারিশ নয়। ইরাক-যুদ্ধের ফ্রন্ট বাড়তে বাড়তে তামাম দুনিয়ায়– মায় আমেরিকার ভেতরেও– নানান চেহারায় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুলে যাচ্ছে হয়তো। মার্কিন-রাষ্ট্র এই যুদ্ধ শুরু করলে বটে; কিন্তু শেষ-করাটা হয়তো তার হাতে নেই। বুশ হচ্ছেন সেই গল্প -বলিয়ে যিনি কিসসার গোড়াটা জানেন; আখেরটুকু জানেন না।’
ছেদ টানলেন নাসিরুদ্দিন। আবার কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। হঠাৎ কথার মোড় ঘুরিয়ে এই প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলেন তিনি: ‘আচ্ছা, রিপোর্টার সায়েব, ওই যে সবজে চিনারপাতায় বেগুনি আভার ঝিকিমিকি– ওটা সত্যি, না, মায়া?’ রিপোর্টার একটা সূক্ষ্ম জাপানি যন্ত্রে কথাবার্তা টেপ করছিলেন, লুকিয়ে চুরিয়ে। এই প্রশ্নে — যথারীতি — ভ্যাবাচাকা খেয়ে তিনি আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন, ‘ইয়ে … আলোর তরঙ্গ … বায়ুমণ্ডলে ভাসমান অসংখ্য ধূলি আর জল-কণা … ইয়ে … ম্যাক্সওয়েল … হার্টস … প্লাঙ্ক … আইনস্টাইন … ইয়ে … সাতরঙের মধ্যে বেগুনির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম … ইয়ে …
*বানান অপরিবর্তিত