Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি — দুই দিগন্ত, পর্ব ৩

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চাতকপ্রাণ

বিকেলের আলো মরে সন্ধ্যা নাবার সময় সুতপা কি এক বোবা কষ্টে মুহ্যমান হয়। মনে হয় একটা চাপ বাঁধা অন্ধকার ধীরে ধীরে দিনের সব আলো শুষে নিচ্ছে। ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে দম আটকে আসে। বুকে একটু খোলা হাওয়া টানতে পায়ে পায়ে উঠোন পেরিয়ে বাইরের গ্রিলটা ধরে দাঁড়ায় সুতপা। কিন্তু রিকল পার্কের রাস্তায় বড় বেশি চেনা লোক। নিজেকে লুকানোর অভ্যাসে গেটের থামটার আড়ালে ত্যাড়চা করে দাঁড়ায়। সে বাইরেটা বেশ দেখতে পায়। কিন্তু সুতপার ক্ষীণ শরীর থামের আড়ালে বেমালুম ঢাকা পড়ে যায়। এটাই ভাল। চেনা কারও মুখোমুখি হয়ে একই প্রশ্নের জবাব দিতে হয় না। ডাক্তার কী বলছে? শানু কি ভালো হবে? বাড়িতে না রেখে ওদের ওখানে রাখলেই তাড়াতাড়ি ভালো হত না? আচ্ছা, আর কাউকে মারধোর করেনি তো? সাতসতেরো প্রশ্ন, যার একটারও সদুত্তর কারও জানা নেই। ওর পুরনো সহকর্মীদের বউদের কেউ রাস্তায় বিকেলের পায়চারি করতে করতে হয়তো দাড়িয়ে আহা উহু করে গেল, তুমি কি রোগা হয়ে যাচ্ছ সুতপা, নিজের একটু খেয়াল রাখো। তারপরেই সব তো জানাই আছে ধরনের জ্ঞানের থেকে বলা, কী করবে বলো, তোমার দিকে থেকে তুমি তো সবই করেছ। এরপর ভগবানের হাতে। উপরওয়ালার কলকাঠি যেমন নড়বে, আমরা তার হাতের পুতুল বই তো নই, ওমনি নাচব। সবচেয়ে রাগ হয় শানুর সহপাঠীদের কারও মা যখন সব জেনে বুঝেও নিজেদের ঢাকপেটানো সামলাতে পারে না। নিজেরা যে জিতে গেছে আর সুতপারা হেরে গেছে সেটা নিয়ে সাতকাহন করার আর কী আছে এতদিন বাদে? একদিন যেমন প্রণতি, প্রফেসর সরকারের বউ বললেন। একে একদম সহ্য করতে পারে না সুতপা। ছিল কোন জমিদারের বংশের মেয়ে, দেমাকে পা পড়ত না। মুশকিলের মধ্যে ওর ছেলে মণীশ ছিল শানুর বয়সী। এখন ছেলে বিদেশে বহুদিন। তাকে দেখতে পেয়ে রিক্সা থামিয়ে কথা বলে গেল। কথা তো নয়। শুধু নিজের ছেলের সুখ্যাতি। জীবনে নিজের সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাওয়াই যে জীবনের সার্থকতা সেইসব জ্ঞানের বচন। সব শেষে শানুর পাগল হয়ে যাওয়ায় সুতপার জীবন যে তছনছ হয়ে গেছে সেটা মনে করিয়ে দিয়ে তবে রিক্সায় ফিরে উঠল। যাওয়ার সময় বারবার ওর বাড়িতে আসতে বলে গেল নাতনির ছবি দেখাবে বলে।

কারও বাড়িতে যাওয়া বহুদিন হল ছেড়ে দিয়েছে সুতপা। এসব কথা এড়ানোর জন্যই। এমন অনেকে আছে যারা ভাবে অন্যের আরও দুঃখের খবর শুনলে বোধহয় সুতপার কিছুটা স্বস্তি হবে। কেউ তার পিসতুতো দেওরের পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটার স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরোনোর পর ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করার গল্প শুনিয়ে বলে পাগল হোক, ছাগল হোক! তুমি তো তাও ছেলেকে নিজের চোখের সামনে নড়েচড়ে বেড়াতে দেখছ। একবার এই মায়ের কথা ভাবো দেখি? জলজ্যান্ত ছেলেটা এক নিমেষে রক্তমাংসের তাল হয়ে গেল। কী ভাবা উচিত সুতপার এই সময়ে? নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেবে বসে বসে? উপদেশও শুনতে হয়। ছেলের একটা বিয়ে দিতে পারছ না? নাহয় কোনও গ্রামের মেয়ের সঙ্গেই বিয়ে দিলে। আমার এক ভাসুরপোর ছিল মৃগী রোগ। ওমনি একটা কম লেখাপড়া জানা গরীব ঘরের মেয়েকে বউ করে নিয়ে এসেছিল। বললে বিশ্বাস করবে না, তারপর ওই ছেলেকে একদিনের জন্যেও রাস্তাঘাটে গড়িয়ে পড়তে দেখেনি কেউ। এতগুলো বছর ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই ধরনের কথাগুলো শুনে শুনে কান এমন পচে গেছে, যতটা পারে সুতপা এড়িয়ে চলে। গ্রিলের থামের আড়ালে বোগেনভেলিয়ার ঝোপঝাড়ে নিজেকে মিশিয়ে বাইরেটা দেখে।

গ্রিলের একসময়কার হলদে আস্তরণ জায়গায় জায়গায় চটকে গিয়ে মরচে বাদামী রং দাঁত বের করেছে। ঠিক যেমন সুতপার একসময়ের ফটফটে গৌরবর্ণে বয়সের বাদামী ছাপ। গ্রিলের রডে শীর্ণ আঙুল জড়িয়ে সুতপা বাইরের রাস্তা থেকে জীবনের স্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করে। এই সময়ে রাস্তা বেশ সরগরম। সাইকেলে বড় ছেলেরা ছোট ছোট দল পাকিয়ে এদিক ওদিক যায়, বেশিরভাগই টিউশনে যাচ্ছে কিংবা টিউশন থেকে আসছে। কখনও বা একঝাঁক মেয়ে। তারাও কখনও বা সাইকেলে। আজকাল আবার স্কুটার চালিয়েও যায়। মেয়েরা পর্যন্ত। ওটাকে নাকি স্কুটি বলে। স্কুটি চালিয়ে চুল উড়িয়ে যাওয়া কোনও মেয়েকে দেখে সুতপা মনে মনে চাপা ঈর্ষা অনুভব করে। উদ্গত দীর্ঘশ্বাস বুকের ভিতর ঠেলে ঢোকাতে ঢোকাতে ভাবে, জীবন থেকে তার পাওয়ার খাতাটা এমন তলানিতে কেন ঠেকল! কীভাবে! কবে!

এর উত্তর সুতপা কিছুতেই করতে পারে না। জীবনটা যেন সাপলুডোর খেলার এক বিশাল ছক। শুরুতে একের পর এক ছয় ফেলে, ঠিক সময় বাড়িয়ে দেওয়া মইতে চেপে লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কী ছিল না তার! বাবা মা বোন। উপযুক্ত স্বামী। সাজানো বাগানের মত জীবন। ব্যাস তারপরেই পুট পড়া শুরু। এরপর একদম সাপের মুখে। এক সাপের লেজ ধরে নাবে তো আর এক সাপের ফনা আছড়ায়। নাবতে নাবতে এখন আর মনেই নেই সেই মই দিয়ে উপরে ওঠার দিনগুলো। পরমেশের সঙ্গে বিয়ে হল, সবাই বলেছিল হীরের টুকরো ছেলে। মেয়ের কপালে এবার সুখই সুখ। সেই কত যুগ আগে পরমেশের হাত ধরে নেবেছিল সুদূর অ্যামেরিকার টেক্সাসে, প্রথমে জাস্টিনে হীরেনদার বাড়ি। জাস্টিন ডালাস থেকে খানিক দূরের এক ছোট্ট শহর, ছবির মত। পরে অবশ্য গ্র্যানবারিতে অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে উঠে গেছিল তারা। এখন ভাবলে মনে হয় সেটা যেন অন্য কারও জীবন, সুতপার নয়। কী আনন্দে যে কাটছিল তার। যে কদিন ছিল হীরেনদা আর মন্দিরাবৌদি, তাদের লোকাল গার্জিয়ান যেন। এমনকি কিছুদিন একটা লাইব্রেরিতে কাজ করেছিল, সেটাই প্রথম আর শেষ চাকরি। সেখানে বন্ধু ভানিসা, স্প্যানিশ মেয়ে। খুব ভাব হয়েছিল। নামটা এখনও মনে আছে ভেবেই অবাক লাগে। গলার কাছটা কেমন পাকিয়ে উঠল সুতপার, ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া সুখে, দুঃখে ভরা সেই দিনগুলোর কথা মনে করে। তারপর শানু এল। সেও যে কী কাণ্ড। পরমেশ রাত করে ল্যাবে কাজ করছে, আর তার বেদনা উঠল। কাটা পাঁঠার মত ছটফট করতে করতেও দাঁতে দাঁত চেপে শুয়েছিল, পরমেশ না আসলে যাবে কোথায়? তারপর যখন ও এল, সে কী হুড়োহুড়ি। আর একটু দেরি হলেই বুঝি গাড়িতেই প্রসব হয়ে যেত। তখন ওই দূরদেশে বাচ্চা মেয়ে বই তো নয়, সব সামলেছিল একা একা। তবু নিজেকে একলা মনে হয়নি তো। তাহলে আজ এই বুড়ো বয়সে যখন এগোবার বা পেছোবার কোনও জায়গা আর অবশিষ্ট নেই, তখন কেন একাকিত্বে ডুকরে কেঁদে মরে? কপাল। না হলে যে সুতপা নিজের হাতে একগ্লাস জল গড়িয়ে খেতে জানত না, কেমন করে ওই দেশে গিয়ে এমন চৌকশ হল? মা মাসিরা অবাক হয়ে যেত। তাদের আহ্লাদি সুতপা যে এমন নিজের হাতে পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে কেউ ভাবতেও পারেনি। আর হলই যদি তাহলে আবার দেশে ফিরে আসা কেন? আসলে সে সামলে নিলেও পরমেশ থিতু হয়ে বসতে পারছিল না। নিজের দেশে পড়াশোনায় এত নামডাক, কিন্তু ওখানে কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিল না। কিছুটা ওর মেজাজের জন্যও হবে হয়তো। স্থায়ী একটা জায়গা করতে পারল না কিছুতেই। সংসারে শান্তি মুছে যাচ্ছিল। একদিন আবার পরমেশের সঙ্গে চিরতরে দেশে ফেরা। দুর্গাপুরে এসে বাসা বাঁধা। তেমনটা সুতপা চেয়েছিল সেরকম নয়। তবে অত কিছু খারাপ হয়নি। স্বচ্ছল সংসার, স্বামীর ভালো নামডাক, ছেলের সুনাম— সবকিছু ছকে বাঁধা সুখের সিঁড়ির মত উঠে যাচ্ছিল আবার। হঠাৎ সবকিছু এমনভাবে ভেঙে পড়তে পারে সুতপা স্বপ্নেও ভাবেনি।

পরমেশের রাগ বরাবরের লাগামছাড়া। তেমনি একগুঁয়ে। নাহলে অমন করে কেউ আমেরিকা থেকে চলে আসে? কথা নেই বার্তা নেই একদিন সুতপাকে বলল, এবার দেশে ফিরে যাব চলো। এদেশে চামড়ার রং আসল, বিদ্যার কানাকড়ি মূল্য নেই। কীভাবে এমন সিদ্ধান্তে পৌছাল তার কোনও ব্যাখ্যা সুতপাকে দেয়নি, সুতপারও এমন সাহস হয়নি যে জিজ্ঞেস করে। ওর চাওয়ায় কখনও সেভাবে বাধা দেয়নি সুতপা। সব সময়ে ভেবেছে পরমেশের যেটাতে ভাল, তাতেই সংসারের মঙ্গল।

কার সংসারে ঝগড়া হয় না? কিন্তু মুখ বুজে মেনে নেওয়া সুতপার সংসারে সব ঝগড়া একতরফাই হত। তাই ঝড় উঠত, কিন্তু কিছু ভেঙে পড়ত না। অন্তত ঝগড়ার মুখে সুতপা কোনও ইন্ধন জোগায়নি। সেটাই কি তার ভুল ছিল? তার কি আর একটু জোরে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল? নিজের জন্য না হলেও সংসারের জন্য? শানুর জন্য?

লোকটা খারাপ নয় আদতে। শুধু ওই গোঁ। বরাবরের একটেরে লোক। ফল পাচ্ছে এখন। হাতি কাদায় পড়লে তার কি কষ্ট কম? পরমেশের জন্য গুমড়ে ওঠা কষ্টটা বুকের মধ্যে তলিয়ে দিল সুতপা। ভাগ্যে লেখা থাকলে কে আর খণ্ডাবে। গুরুদেবও তাই বলেন। সব হারিয়ে সুতপা এখন গুরুদেবকেই আঁকড়ে ধরেছে। ঠিক ভুল জানে না অত, কিন্তু গুরুদেবের শরণ নেওয়ার পর থেকে বুকের ভিতরের সবসময়কার দমফাটা চাপা কষ্টটা একটু কমেছে। এই একটা ব্যাপারে ওর না শোনেনি সুতপা, নিজে জেদ করে গেছে। দুদিন লোকটা মুখ গোমড়া করে বসেছিল। আগেকার দিন হলে দক্ষযজ্ঞই বাধিয়ে দিত। কিন্তু শানুর ঘটনার পর থেকে একটু হলেও শুধরেছে পরমেশ, অন্তত সুতপাকে কষ্ট থেকে দূরে রাখতে চায়। কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করে হয়তো।

ওকেও যদি একবার ধরে নিয়ে যেতে পারত! পরমেশ এসবে বিশ্বাস করে না। জপতপ পুজোআচ্চা এসব তার জন্য নয়। তার মতে নিজের কষ্ট, হতাশা, অপ্রাপ্তি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতে হয়। দুঃখের আদানপ্রদানে বিশ্বাস করেনি কখনও। দুঃখ তবুও মাখে মাঝে মনের কানা বেয়ে উপচে পড়ে। সুতপার কাছে। অথবা রাগের আকারে ছেলের উপর। এইটুকু ছাড়া এত ঝড় ঝাপটাতেও, জীবন তাকে বাঁকাতে পারেনি। ভাঙবে তবু মচকাবে না গোত্রের লোক। অনেক বড় কিছুর আশা নিয়ে জীবনের যাত্রা শুরু করেছিল। জীবনে যেভাবে যা চেয়েছে সব তো সেভাবে হয়নি। অন্য পথ খুঁজে নিয়েছে, অন্তত চেষ্টা করেছে। বড় আশা করে আমেরিকা গেছিল। কাজ কি খারাপ করেছিল? না, কিন্তু টেনিওর পেল না। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে অতগুলো বছরের পরিশ্রম, কাজের খতিয়ান এক ঝটকায় নেই হয়ে গেল। আর কেউ হলে ভেঙে পড়ত, পরমেশ নয়। নতুন রাস্তা খুঁজেছে। অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসার হয়ে চালাতে পারত, কিন্তু সইল না। অন্য কোনও চাকরির খোঁজ করা যেত। কিন্তু কেন জানি মনে হয়েছিল এখানে হবে না, কাউকে বলেনি কিন্তু ভিতরে ভিতরে জাতিবিদ্বেষের গন্ধ পেয়েছে। প্রমাণ করা মুশকিল, তাই ঠিক করল দেশে ফিরে আসবে। একবার ঠিক করলে পরমেশকে তার থেকে আর নড়ানো যায় না। সুতপা কম বলেছে? কিন্তু তার যে কথা সেই কাজ। খারাপ কিছু হয়নি, দেশে ফিরে দুর্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এতগুলো বছর সুনামের সঙ্গে কাজ করেছে। করেছে আর স্বপ্ন দেখেছে নিজে যা করতে পারেনি ছেলে করবে। শানুর উপর বড় আশা ছিল পরমেশের। কার আশা ছিল না? মাধ্যমিকে পুরো জেলায় প্রথম হল, রাজ্যে প্রথম দশে। তখন তাদের রিকল পার্কের বাড়ির সামনে কত ভিড়। ছেলেমেয়েদের, তাদের বাবামায়ের। পরমেশকে এমনভাবে খুশি হতে দেখেনি আর কখনও। একটু বাদে বাদে সুতপার দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়েছে। ভাবটা, দেখলে তো যেমন চেয়েছি তেমনটাই…

কিন্তু জীবন কি আর অমনি ছকে বাঁধা! সেই শানুই যখন সব কিছুতে শেষের খাতায় চলে গেল, সেটা নিতে পারেনি পরমেশ। নিজের ব্যাপারে শক্ত হাতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে লোকটা। সবসময়। কিন্তু ছেলের হয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে? চেষ্টা করেনি তা নয়, কিন্তু ওর মধ্যে সেই জেদ, জয় করবার আকাঙ্ক্ষা জাগাবে কীভাবে? পারেনি, আর যত দিন গেছে সেই অক্ষমতা বিদ্বেষে বদলে গেছে। মুখ বুজে সেটাও হজম করেছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভাঙচুর চলেছে। একসময় বাইরেও তার একটা ছাপ বেরিয়ে আসতে বাধ্য। পরমেশ আনন্দ পেলে হো হো করে হাসতে পারত, রাগলে তেমনি বোমার মত ফেটেও পড়ত। কিন্তু এখন তার বদলে এক অপরিসীম বিরক্তি তাকে গ্রাস করেছে। জীবনের উল্টো দানে মেজাজটা সবসময়ে তিরিক্ষে। জিভটা যেন বাঁকা কথা বলা, উপহাস করবে বলে শান দিয়ে প্রস্তুত। মাঝে মাঝে সুতপাকে, বেশিরভাগ সময়ে শানুকে। ছেলেকে দেখলেই পরমেশের চোখে ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে দেখে সুতপা।

পরমেশ নিজেকে সামলাতে পারে না। নিজের সমস্ত স্বপ্নের অপমৃত্যুকে চোখের সামনে ঘুরতে দেখে গা রি রি করে। মনে হয় সব ইচ্ছা করে করেছে ছেলেটা, তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। এই বুড়ো বয়সে তো আর যখনতখন হাতে মারা যায় না, তাই যত রাগ মুখে। শানু যখন উসকোখুসকো চুলে পাজামার দড়ি কষতে কষতে সামনে দিয়ে যায়, যত বিতৃষ্ণা ঠোঁটের দু কোণে এসে জমা হয়। বাক্যবাণ ছুঁড়তে একটুও কসুর করে না পরমেশ। চললেন বাবু, বাপের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে।

চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে শানু। একেকদিন তার মাথাভরা চাপ চাপ কুয়াশা। ধরাছোঁয়া যায় না এমন এক অসীম বেদনার অন্ধকার কেমন গ্রাস করতে চায় তার দিনটাকে। এমন হলেই শানুর চোখ থেকে ভাষা হারিয়ে যায়। কান থেকে শব্দ। তাই বাবা কিছু বলছে বুঝতে পারে কিন্তু শব্দগুলো নেহাতই অর্থহীন আওয়াজের মত কানের উপর আছড়ে পড়ে। চলার পথে বাধা পাওয়ার অসহিষ্ণুতা নিয়ে বাবার দিকে ঘুরে তাকায় শানু। কী বলতে চায় বাবা? কী বলার আছে? ছেলের চোখমুখ দেখে পরমেশের মনে হয় ওকে জিজ্ঞেস করে গতকাল রাতে ওষুধগুলো খেয়েছিলি শুতে যাওয়ার আগে? ভাবে দু পা এগিয়ে একবার ছেলের মাথায় হাত বোলায়, শরীরটা কি খারাপ লাগছে আজ তোর? কোথাও তাহলে বেরোস না আজ আর। কিন্তু ভাবনাগুলো শব্দ হয়ে বেরোয় না মুখ দিয়ে, জমা হয় চোখে। অথচ বাবা কিংবা ছেলে, কেউই কারও চোখের ভাষা পড়তে জানে না। বরং বেরোনোয় বাধা পাওয়ার অসহিষ্ণুতা শানুর মুখে বিরক্তির ছায়া ফেলে, জিনে টানপড়া ঘোড়ার মত পা ঠোকে মেঝেতে। শানুর ভুরু কুঁচকে তাকানোতে পরমেশের মাথায় যেন রক্ত চড়ে যায়। বসে থাকতে থাকতে লাফ দিয়ে ওঠে। কী হয়েছে কী? সোজা কথার একটা উত্তর দিতে মান যাচ্ছে নাকি বাবুর? দেখো সুতপা দেখো তোমার গুণধর পুত্রকে। বাবার কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনটাও বোধ করে না আজকাল। ছেলের জন্য যে ভাবনার কোমলতা দানা পাকাচ্ছিল, সব এক ফুৎকারে উড়ে যায়। উল্টে তীব্র রাগ আর তিক্ততায় ডুবে যায় পরমেশ। কিন্তু কোনও শব্দই শানুর মনে কোনও অর্থ তৈরি করতে পারছিল না। এইসময় অক্ষরগুলো নিজের মত করে তার মাথার মধ্যে নাচতে থাকে যেন। আর নতুন করে জুড়ে জুড়ে শব্দজব্দ খেলে। মাথার মধ্যে শব্দের এই খেলায় এবার হাসি পেল খুব শানুর। শান্ত সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার সারা মুখে, তার ভাসা ভাসা চোখের দুই কিনারে। হাসতে হাসতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল পরমেশের দিকে।

একসময়ের বুদ্ধিদীপ্ত, চৌকশ ছেলের দিক থেকে এমন উদ্দেশ্যবিহীন চাহনি পেয়ে কেমন কুঁকড়ে গেল পরমেশ। যে সন্দেহটা মাঝেমাঝেই মাথা চাড়া দেয় তার বুকের মধ্যে, যেটাকে দাবিয়ে রেখে তেজের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় পরমেশ, এইসব মুহূর্তে সেটাই মাথাচাড়া দেয় নতুন করে। আমিই কি, আমিই কি? এই প্রশ্নটা তাকে মাংস কাটা ছুরির তীক্ষ্ণতায় ফালাফালা করতে থাকে।

 

এ ঘরে বাইরের আলো ঢোকে না। কিন্তু মেয়েটা জানে বাইরে এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। খেলা শেষের লালচে ভালোবাসার ওমে জড়ানো আকাশটা দেখবার জন্য মেয়েটার মন উশখুশ করছিল। যাবে? লোকটার ভারী লোমশ হাতটা এখনও বুকের ওপর রাখা। সরাবে কি? নিজেকে মেয়েটার মধ্যে নিঃশেষ করে ফেলার পর, লোকটা এরকম হালকা ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যায়। ঘুমোবার সময় হাতটা রাখবে ঠিক তার বুকের উপর। লোকটার বড় বড় লোমওলা আঙুল নিয়ে হাতটা ঠিক যেন থাবা। মেয়েটার সাদা পায়রা বুক থাবার বেড়ে নিয়ে আঙুলগুলো আস্তে আস্তে বোলাতে থাকবে বোঁটার চারপাশে। আর ওইভাবেই একসময় ঘুমিয়ে পড়বে। লোকটার আঙুলের ছোঁয়া এইসময় খুব নরম, কে বলবে একটু আগেই মেয়েটাকে প্রায় হামলে পড়ে শরীরের মধ্যে পিষেছে এই লোকটাই। গোপাল রায় লোকটার সম্ভোগের ভঙ্গিতে একটা হিংস্রতা আছে। কোথায় একটা নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা লুকোনো। তাই মেয়েটাকে সক্রিয় হতে হয় না, বরং একতরফা দখলের দাবিদারিতে ওর শক্ত শক্ত আঙুলগুলো খুরপির মত মেয়েটার শরীরের আনাচেকানাচে খুঁজতে থাকে। প্রথম প্রথম খুব রাগ হত। একবার ভেবেছিল শক্তিকে বলবে এর আসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আবার এটাও দেখেছে যে এই একই লোকের ব্যবহার অন্য সময়ে খুব শান্ত, মার্জিত। কথা বলে এত কম, বললেও মনে লাগার মত কথা মেয়েটাকে কোনওদিন শোনায়নি। এ নিয়ে একবার নিজেই বলেছিল লোকটাকে, বেশ শ্লেষের সঙ্গেই। শুনে তখনকার মত কুঁকড়ে গেছিল। কিন্তু কদিন বাদে আবার যে কে সেই। তবে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। বছর খানেক ধরে নিচ্ছে তো। লোকে যেমন ভালোবাসার জন্য অনেক কিছু সহ্য করে নেয়, তেমনি হয়তো অভ্যাস থেকেও। সময়ের তালে তালে মেয়েটার মনের কোথাও কি গোপাল রায়ের জন্য কোনও জায়গা তৈরি হয়েছে? চোখ কুঁচকে একবার ভাবল মেয়েটা। নিজের অজান্তেই মাথা নাড়ল, সেটা কখনওই নয়। রায় প্রতি মঙ্গলবার করে আসে, কিন্তু বুধ থেকে সোম তার কথা কি আর মাথায় ঘোরে? বরং গুণদীপের কথা মাঝেমাঝেই মনে হয়। যদিও সেই পাগল লোকটার আসার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সব সময়ে কলকাতাতেই থাকে না। তবুও কেন জানি গুণদীপের উপর মেয়েটার একটা আকর্ষণ আছে। টাকার সম্পর্কের বাইরে। গোপাল রায়ের জন্য সেটা কক্ষনও তৈরি হয়নি। তবে কি মায়ার টান? যদি রায় হঠাত একদিন আসা বন্ধ করে দেয় তার কি খারাপ লাগবে? ঘুমন্ত রায়ের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই হাসল মেয়েটা। ডান হাতে মেয়েটার বাঁ বুক জড়িয়ে ঘুমোতে থাকা রায়ের মুখটা এখন মাই নেওয়া বাচ্চার মত, খাওয়া হয়ে গেছে কিন্তু ছাড়তে মন চাইছে না। একেকজনের একেকরকম নেশা।

রায়েরমুখ দেখতে দেখতে মেয়েটার মনে হল সুকুর কথা। গোপাল রায় বলেছে আসছে মাসে একদিন একটু বেশি সময় হলে ভাল হয়, দিঘা যাবে। একেবারে সকাল সকাল বেরোতে হবে। ফিরতে সেই রাত। হ্যাঁ না সে কিছু বলেনি। টাকা পাওয়া যাবে অনেকগুলো। এই ফাঁকে একটু বেড়ানোও হয়ে গেল। চিন্তা শুধু ছেলেটাকে নিয়ে। একটা দিন সকাল থেকে রাত অবধি বাড়িতে থাকবে না। সুকুকে কার ভরসায় রাখবে? মেয়েটা জানে কুমুদবুড়ি অত রাত অবধি কক্ষনও থাকতে চাইবে না, ডাবল পয়সা দিলেও। আর কাকে বলবে? ভাবার সময় মেয়েটার সুন্দর করে আঁকা ভুরুটা কুঁচকে যায়, আর অদ্ভুতভাবে গাল ফুলিয়ে ঠোঁটটা ছুঁচোলো করে ফেলে। এমনিতে এরকম করলে হয়তো একটা চটুল ভাব জাগে যেটা তার সম্মোহনী ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু যেহেতু ঠোঁটের লিপস্টিক জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে আর কিছুটা চারপাশে লেপ্টেও আছে, সব মিলিয়ে তার মুখটা হাস্যকর লাগছিল। মেয়েটার সেটা জানার কথা নয়। তবে ঘরের একমাত্র পুরুষ মানুষটি কামতৃপ্ত ঘুমের অতলে, তাই ধরে নেওয়া যায় মেয়েটার এই মুখভঙ্গি নেহাতই অভ্যাসবশত, কাউকে সম্মোহিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। মেয়েটি সত্যি ভাবছিল। কারণ একটা দোটানার মধ্যে রয়েছে সে। আর কেউ নেই যে পরামর্শ নেবে। তাকেই স্থির করতে হবে।

না হয় সুকুর কোনও একটা ব্যবস্থা করল। কিন্তু ভয় হচ্ছে যদি কোনও চেনা লোকের মুখোমুখি হয়ে যায়, তখন কি হবে? এটা নিয়ে ভেবে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছিল না। ফিসফিস গুজগুজকে ভয় লাগে। যে কথা আড়াল রাখার জন্য এত দূরে আসা সেটাই যদি ফাঁস হয়ে যায়! ধুত, কী আর হবে, তার জীবনে কি প্রেমমহব্বত থাকতে নেই? হঠাত মনের ভিতরে অদম্য সাহসের এক জোয়ার এল। এর ফলে মেয়েটার চোখে মুখে একটা আশ্চর্য আলোর ছোঁয়া লাগল যার থেকে বোঝা যায়, ভাবনাটা তার নিজেরও খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটা এবার এত জোরে শ্বাস নিল, যে শ্বাস নেওয়ার সময় তার বুকের সঙ্গে সঙ্গে রায়ের হাতটা বেশ কিছুটা উঠে নেমে এল, আর শ্বাস ছাড়ার প্রাচুর্যে রায়ের হাতের পাতার উল্টোদিকের বড় বড় লোমগুলো দুলে উঠল। মনের মধ্যেও সেই একই ফুৎকারের সঙ্গে সে ঘোষণা করল, নাহয় সবাই ভাববে রায়ের সঙ্গে জুটে গেছি। রায় একেবারে ফ্যালনা লোক তো নয়। ব্যাবসাদার মানুষ। কিসের ব্যাবসা কখনও ভেঙে বলেনি, তবে বেশ বড় কিছুই হবে বলে তার আন্দাজ। পোশাকআশাক, কথাবার্তা থেকে তাই তো মনে হয়। গোপাল রায়ের মত লোকের সঙ্গে তাকে রাস্তায় দেখে তার ভালোবাসার সম্পর্কের কথা যদি কেউ ভাবে, তবে এটাই ভাববে যে ভাগ্য ফেরাবার জন্য সে একটা বুড়োকে ধরেছে। গোপাল রায় তার থেকে বছর পনেরো বড় তো হবেই। আধপাকা চুলের জন্য আরও বেশি দেখায়। আমার বুড়োই ভালো, ভাবল মেয়েটা। ধকল কম। যেন এটা সত্যি কোনও ব্যাপার আর তাতে সায় দিয়ে কৌতুকে ভাসল মেয়েটা। একটা হাসির লহর নিঃশব্দে এবার মেয়েটার শরীর বেয়ে গড়িয়ে গেল। মোদ্দা কথা একটু ভয় থাকলেও, অত ঘাবড়াবার মত কিছু নয়। তাছাড়া নাচতে নেমে ঘোমটা টেনে তো লাভ নেই। চোখের তারা কাঁপিয়ে আর ভুরু কুঁচকে নিজেই নিজেকে শাসায় মেয়েটা। পয়সা কামাতে হবে তাকে, বসিয়ে কেউ খাওয়াবে না। সে রোজগার না করলে তার আর সুকুর খোরপোষ কেউ তুলবে কি? আয়াগিরি করে দেখেছে, লোকের পুঁজ রক্ত থেকে নিয়ে হাগা মোতা সাফ করো, তারপরেও মুখঝামটা শোনো। এতসব করেও দিন গেলে কটাই বা টাকা হাতে পেতো? অথচ মুফতে খুবলে খাওয়ার লোকের অভাব ছিল না। সুকুকে রেখে রাতের কাজ নেওয়াও যেত না, এরকম আয়া নার্সিং হোমে রাখবে কেন? তার চাইতে এই ভালো আছে, দেখনদারি সতীসাবিত্রীপনা তার কখনও ছিলও না। ছেলেদের নজর তার বরাবরই ভালো লেগেছে, স্বপনের সঙ্গে ঘর বাঁধার আগে বা পরেও। তাই সেটা নিয়ে মেয়েটা ভাবে না। আবার ভাবেও। এই যে এতক্ষণ মাথার মধ্যে নিজে নিজেই এতগুলো যুক্তি খাড়া করল, সেটাও তো ওই ভাবনা থেকেই। কারণ নিজের জন্য না হলেও নিজের ছেলেকে এসবের থেকে আড়াল করার দায় আছে। মেয়েটার মুখে আবার আলোছায়ার খেলা চলছিল। বোঝা যাচ্ছে তার মনের দিক পরিবর্তন হচ্ছে আবার। ছেলে স্কুলে পড়ছে, একবার খবর ছড়ালে আর রাখবে সেখানে? শান্ত পুকুরে মাছের ঘাই মারার মত সুকুর কান্নামাখা মুখ ভেসে উঠল; বাচ্চারা সুকুর পেছনে ছুটছে আর বলছে— তোর মা বেশ্যা, বেশ্যা! এই ছবিটার আকস্মিকতায় তার শরীরটা এমনভাবে কেঁপে উঠল যে রায়ের চটকা প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল। না, টাকার লোভে এরকম ঝুঁকি সে নিতে পারে না। সুকুর গায়ে আঁচ লাগতে দেবে না মোটেই। মনে মনে ছেলের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিল মেয়েটা।

আস্তে করে রায়ের হাত সরিয়ে এবার বিছানায় উঠে বসল। রায়ের ভারী হাতের চাপে লাল দাগ বসে গেছে একেবারে। দু হাতে ডলে ডলে বুকের উপর থেকে দাগ সরাতে সরাতে নিজের দিকে তাকিয়ে খুশি হয় মেয়েটা। কে বলবে তার এত বড় ছেলে আছে! চেহারা একদম টানটান। সুন্দর সে সবসময়েই ছিল, কাটাকাটা চোখমুখ, মাজা রং, ভরা বুক— যেখানে যাবে শরীরে চোখের আঁচ পায় সে। মিথ্য বলে লাভ নেই, ভালো লাগে মেয়েটার। এটা তার জীবনে টক ঝাল মিষ্টি স্বাদ এনে দেয়। নেহাত স্বপনের সঙ্গে ঝুলে না গেলে বাপ-মা ভালো বিয়েই দিত তার। কোনও পয়সাওয়ালা দোকানদার বা বাপের মতই কোনও হোটেলওয়ালা। এই ভাবনার সময় মেয়েটার মুখে কোনও ছাপ পড়ছিল না। আসলে এই ভাবনাটা নতুন নয়, আগেও অনেক ভেবেছে বলে এই চিন্তাস্রোত শরীরের অনেক ভেতর দিয়ে বয়ে যায়। এই ভাবনার উত্তরে তার মন সবসময়ে জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু তাতেই যে ভালো হত সেটাই বা কি লিখে দিতে পারে? দেখা যেত সেই দোকানদার হয়তো গোপাল রায়ের মত অন্য কারও সঙ্গে শুতে চলল। সে বাড়িতে ঝিগিরি করে মরত। ফিক করে হেসে ফেলল মেয়েটা। না, খুব বড় করে হাসি নয়, হালকা একটা হাসি যেটা দাঁত না দেখিয়ে ঠোঁটে ছড়িয়ে যায়। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তৃপ্তি ভরা হাসি। কারণ ও ভাবছিল, এই ভালো হয়েছে, নিজের শরীরের মালিক সে নিজে, আর রোজগারটাও কিছু খারাপ নয়। শক্তি বলে ইংরাজিটা বলতে পারলে, আরও ভালো হত। তবে তার মধ্যে নাকি বেশ একটা পালিশ আছে, বড় ঘরের ধার। আর আছে বলেই টেন পাশ মেয়েটা, যার আসল নাম শিউলি, মধ্যবিত্তবাড়ির বউ অনন্যা সেজে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। রোজ রোজ তার এই শিউলি থেকে অনন্যা হওয়া, আবার অনন্যা থেকে শিউলি সেজে বাড়ি ফেরা।

শিউলি হয়ে কেন একই কাজ করতে পারে না, শক্তিকে এই প্রশ্নটা করেছিল। নাম বদলানো ঠিক আছে, কিন্তু অন্য মানুষের মত সাজা। এই একই সঙ্গে দুর্গাপুরের শিউলি আর কলকাতার অনন্যা হওয়াটা? এক জায়গায় সে একাধারে সুকুমারের মা-বাবা সব, আপাতদুখী জীবন, এইটুকু বয়সে কত উথালপাথালের মধ্যে দিয়ে গেছে বলে হয়তো লোকের করুণার পাত্র। আবার সেই একই মেয়ে কলকাতার এই বাড়িতে এসে অনন্যা, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের বেষ্টনী ডিঙিয়ে যে শরীরের খেলায় নেমেছে, পয়সা নিয়ে কিন্তু যেন পয়সাটাই সব নয় এমন ভাব। বাজারি বেশ্যা নয়, তাই এক্সক্লুসিভ। দামী তার সঙ্গ। তার দুপুরের টাইমিং-এর সঙ্গে এই পরিচয়টা খুব খাপ খায়। এটাই বুঝিয়েছে শক্তি। এর মধ্যে তাই শুধু শরীর নয়, অভিনয়েরও একটা অংশ আছে। স্টেজে হওয়া নাটকের মত। সবাই জানে সত্যি নয়, আসল লোকগুলো আলাদা। কিন্তু যখন হয় তখন শিউলি অনন্যা হয়ে যায়। সে নিশ্চিত গোপাল রায়েরাও আসলে গোপাল রায় নয়, অন্য কেউ। কিন্তু মেয়েটার বেলায় পরিবর্তন শুধু নামে নয়। তার চলনে, বলনে, পোশাকে। অনন্যা হয়ে যে জীবন তার কখনও ছিল না সেটাকে জীবন্ত করে তোলা, যেন এসবের শেষে দুর্গাপুরের ছেলেকে নিয়ে তার একলা সংসারে নয়, সে ফিরে যাবে স্বামীপুত্রসজ্জিত এক সুখী গৃহকোণে; যেন দুপুরবেলার এই শারীরিক মিলন তার নিজের শরীরের না-মেটা চাহিদা মেটানো, যেন সে পুরুষ খুঁজছে, পুরুষ নারীকে নয়। এই অভিনয়ের সফলতা তাকে তৃপ্তি দেয়, তার কাছে আসা সংসারে সমাজে আপাত সফল কিন্তু নিঃস্ব মানুষগুলোকে সে যেন তার অভিনয়ে, স্পর্শে, গ্রহণের মধ্যে দিয়ে উত্তীর্ণ করছে। এই অভিনয়ে সে সফল, মেয়েটি নিজেকে মনে করায়। এখন তো তার শরীরে কুটোটি পর্যন্ত নেই, নেই অনন্যার পরার শাড়ি, গয়না। তবু আয়নায় যে মেয়েটি তার দিকে চেয়ে রয়েছে তার তাকানো, দাঁড়ানো, ঠোঁটের হাসি সব যেন অনন্যার, আলাদা করে বোঝা যায়, মোটেই শিউলির নয়। তবে কি শিউলি মেয়েটি অনন্যার মত হয়ে গেছে? এই আচমকা ভাবনাটা বিচলিত করল মেয়েটিকে। চোখের তারা নিমেষের জন্য কেন্দ্রবিন্দু হারাল। ছেলে সুকুর কাছে সে তার মা হয়ে থাকতে চায়, সেখানে অনন্যার প্রবেশ নিষেধ। কদিন আগে বাড়ি ফেরার পর সুকু এসে তাকে দুহাতে জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে হঠাত প্রশ্ন করেছিল, তুমি অফিস থেকে ফিরলে তোমার গায়ের গন্ধটা অন্যরকম থাকে কেন মা? একটু সচকিত হয়ে শিউলি জিজ্ঞেস করেছিল, কেন? কীরকম গন্ধ? বাজে? হতেও পারে ট্রেনে বাসে ভিড়ের মধ্যে আসি, কত লোকের ঘামের গন্ধ। না, না, সুকু বলেছিল। খুব মিষ্টি গন্ধ মা, কিন্তু তোমার মা মা গন্ধটা পাই না। তারপর থেকে মেয়েটি সাবধান হয়ে গেছিল। এখান থেকে বেরোনোর আগে ভালো করে একবার স্নান করে বেরোয় আর গায়ে লাগায় শিউলির পারফিউম। অনন্যা আর শিউলির গন্ধ আলাদা থাকুক, নিজের ছেলের কাছে অনন্যাকে ঘেঁষতে দেবে না শিউলি।

এইসব হঠাত চিন্তা বাদ দিলে, আর সব দিক দিয়ে একাজে মেয়েটির সুবিধা আছে। বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ। কোলফিল্ড ধরতে পারলে সাড়ে আটটার মধ্যেই ঘরে ঢুকে পড়ে। এর বেশি দেরি হলে কুমুদবুড়ি রাগ করে। বলে, তোমার অফিসের টেইমটা বদল করো বাপু, এই ছোটছেলেকে সামাল দেওয়া আমার কাজ নয়। তুমি না এলে ছেলে কিছু মুকে দেবে? দেবে না আর ঘ্যানঘ্যান করবে। তাই যেদিন কোলফিল্ড মিস করে অগ্নিবীণা ধরে ফেরে, বুড়ির মুখখারাপ শুনতে হয়। চোপা থামাতে হাতে করে বুড়ির জন্য কিছু নিয়ে ঢোকে। তবে বুড়ির থেকেও রাগ করে বেশি সুকু। মুখ গোমড়া করে থাকে খানিকটা সময়। নেচেকুঁদে ছেলের মান ভাঙাতে হয়।

একেকবার ভেবেছে সে, মরতে দুর্গাপুরে কেন পড়ে থাকা? এতটা ট্রেনজার্নি করে আসাযাওয়া। বরং কলকাতার ভিড়ে মিশে গেলে তার কাজের দিক দিয়ে সুবিধা। কিন্তু অনেক অসুবিধাও আছে। একলা মেয়েছেলেকে কে বাড়ি দেবে, সাতরকম প্রশ্ন। তারপর অচেনা শহরে সুকুকে কার কাছে ছাড়বে? তার চেয়ে এই ভালো। দুর্গাপুরে তার নিজের জায়গায়, ডাক দিলে দুটো লোক পায়। এদিকে সে যে কলকাতা শহরে এসে কী করছে কেউ জানতেও পারছে না। দূরত্ব তাকে বাঁচিয়ে দেয়, হাজার হলেও ভদ্রঘরের মেয়ে সে।

বাস-ট্রেনের চক্করে দেরি না হয়ে গেলে বেশি রাত হওয়ার আগেই মেয়েটি বাড়ি পৌঁছাতে পারে। রাতে খাওয়ার সময় ছেলের অনেক প্রশ্ন, সারাদিনের গল্প জমা থাকে। সেসময় না পৌঁছালে সুকু রাগ করে। সেইজন্যেই সন্ধ্যার কাজ নেয় না, বেশি টাকা পেলেও। অসুবিধা হয় এরকম বিশেষ অনুরোধ এলে। যদিও তার না করার সহজ পথ আছে। বলবে মধ্যবিত্ত ঘরের বউ, লুকিয়ে দুপুরবেলায় আসছে, সারাদিন কেমনভাবে থাকবে। সেটাই বলবে সে, এবার মেয়েটির চোখে শুধু নয়, শরীরেও সিদ্ধান্তের কাঠিন্য জায়গা করে নেয়। শক্তি রেগে যাবে, বলবে এইটুকু তো করতেই হবে। না হলে এ কাজে এগোনো যাবে না। এগোনো মানে টাকার দিক দিয়ে আর কি। তখন মনে করিয়ে দিতে হবে সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কেটে ফেলার গল্পটা। শক্তির ব্যাবসাবুদ্ধি ভালই, বুঝবে। এখন দুপুরের কাজে পাঁচ পায় অনন্যা। তার থেকে দুই শক্তির। সপ্তাহে এক বা দুই দিন কাজ, খারাপ কী? মেয়েটির কাছে এটাই সোনার ডিম। এই ফ্ল্যাটের ভাড়া, দেখাশোনা, কাস্টমারদের সঙ্গে যোগাযোগ সব শক্তিই করে। কাজের জন্য ওর যে নাম অনন্যা, সেও তো শক্তিরই দেওয়া। কাস্টমার প্রোফাইল অনুযায়ী। মেয়েটি শুনেছে শক্তির এরকম অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে। বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন রকমের মেয়েও। এই ফ্ল্যাটের সামনের দিকে একটা অফিস, ম্যানপাওয়ার সার্ভিস। আর পিছনদিকে ওম্যানপাওয়ার— শক্তিই বলে। ভেবে নিজের মনেই হাসল মেয়েটি, গজদাঁত দেখানো এই হাসিতে কোনও চিন্তার ছায়া ছিল না। ফ্ল্যাটের দুটো আলাদা দরজা, পিছনেরটা মেয়েটার আর তার কাছে আসা লোকেদের জন্য। সামনের অফিসটা থাকার ফলে সুবিধা এই যে লোকে এই ব্যাবসাটার কথা জানতে পারে না। এমনিতেই হরেক লোকের যাতায়াত, তাই অন্য দরজা দিয়ে কে ঢুকছে বেরুচ্ছে সেটা ধরা যায় না। সবকিছুই খুব গোপনীয়তার সঙ্গে চলে। এমনকি কাস্টমার এমনভাবে বাছে, যাদের সঙ্গে বাইরে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। যেমন তার জন্য তার এলাকায় যাতায়াত আছে এরকম কোনও কাস্টমার কক্ষনও দেবে না শক্তি। লোক ঠিক করার আগে এসব নাকি ভালো করে জেনে নেয়। শক্তি বলে, বাড়ির মেয়েবউ নিয়ে কাজ করাই, তাদের দিকটা তো দেখতে হবে। ওর মতে, অনন্যার নাকি ভালো ডিমান্ড। দেখতে তো সে ভালোই, মাজা রং। টানাটানা চোখ। নাকের পাতাটা একটু ছড়ানো, কিন্তু গজদাঁতের জন্য তার মুখের হাসিতে চোখ চলে যায়, নাক কে দেখছে। সবচেয়ে বড় কথা এত বড় ছেলে থাকা সত্ত্বেও তার শরীরে টান আছে। পেছন আর বুক ভারি হলেও কোমরটা সরু, পিঁপড়ে পেছলানো পেট। শক্তির কথা অনুযায়ী অনেকেই ওকে চায়, তার গৃহস্থবাড়ির বউ ভাবটা লোককে টানে খুব। কিন্তু সবার সপ্তাহের মধ্যে দুপুরবেলায় পোষায় না। আবার সন্ধ্যাবেলায় বা ছুটির দিনে সুকুকে ছেড়ে তার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং সপ্তাহে এই এক দুই দিনই ভালো। অন্য দিনগুলো মেয়েটাকে এদিক ওদিক ঘুরতে হয়। কাজে এবং অকাজে। কারণ বাড়িতে বসে থাকা যায় না, লোকে দশরকমের প্রশ্ন করবে। কী কাজ যেটা সপ্তাহে শুধু দুদিন? তাই কাজ না থাকলেও রোজ বেরোতে হয় মেয়েটিকে। সময় কাটানোর জন্য পার্ট টাইমে ক্লাস করতে শুরু করেছে। পড়াশোনাটা বিয়ের সময় বন্ধ হয়ে গেছিল। এই ফাঁকে আবার শুরু হয়ে গেছে। স্পোকেন ইংলিশ, পালিশ দেবে। তবে ওই দিনগুলো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারে মেয়েটা, শক্তিপুঞ্জ ধরলে সন্ধ্যার মধ্যেই।

শাড়ি ব্লাউজটা পড়ে নিল মেয়েটা। চুলটা এলোমেলো হয়ে গেছিল, ব্রাশ করে নিল। লিপস্টিকটা ছড়িয়ে গিয়েছিল, আবার করে বুলাল। আয়নার সামনে কপালের মাঝখানে টিপটা সেট করছে, তখনই ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। প্রথমে অবাক হয়েছিল শিউলি, এখানে তো সাধারণত ফোন আসে না কারও। শুধু শক্তি করে আসা যাওয়ার হিসাব রাখতে। তাহলে? কুমুদবুড়িকে এই নাম্বার দিয়ে রাখা আছে কিন্তু কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে থাকলে… তাহলে কি কোনও দুর্ঘটনা? বুকটা একেবারে ছ্যাঁত করে উঠল মেয়েটার। তাড়াতাড়ি ফোন তুলতেই ও পাশে বুড়ির গলা। চাপা স্বরে কী, কী হয়েছে কী? বলেই মেয়েটা সচকিত হল। এখন শিউলি কথা বলছে, অনন্যা নয়। গোপাল রায় যদি শুনে ফেলে?

কুমুদবুড়ি ওদিকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল, রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে গেছে দিদিমণি, সুকু গাড়িচাপা পড়েছে।

মেয়েটি বিকেলের আলোর খোঁজে উঠেছিল। বাইরে বিকেলের আলো তখনও থাকলেও, এবার চোখের সামনে ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল।

 

সুকু আর লোকটা খেলছিল।

সুকুর ডান হাতটা ব্যান্ডেজ বেঁধে গলার থেকে ঝুলছে। ফরসা গালদুটোর জায়গায় জায়গায় কালসিটে, কিছু কাটাছেঁড়ার দাগ। লিউকোপ্লাস্টে আঁটা তুলোর ভেতর থেকে রক্তের ছিটে বাইরে এদিক ওদিক প্রথম সূর্যের গোপনতায়। নীল হাফ প্যান্টের তলা থেকে হাঁটুর মাথা অবধি আর একটা ব্যান্ডেজ। সেখানের রক্তে প্রগাঢ়তা । কিন্তু আনন্দে ঝাঁকড়া চুল কাঁপানো ছেলেটার সেদিকে কোনও হুঁশ আছে বলে মনে হয় না। অন্তত ঠোঁটের কোণা দিয়ে চলকে পড়া হাসি দেখে সেটা বোঝা যায় না। ছেলেটা বারবার হাসছিল। লোকটাও।

মুখভর্তি দাড়ি আর অবিন্যস্ত পোশাকের এই লোকটাকে আর কোনও সময় বা অন্য কোথাও দেখলে সুকু হয়তো ধারেকাছেই ঘেঁষত না। কিন্তু এখন তাদের মাঝখানে ছড়ানো ঝিনুকের সারির উপর কান পেতে থাকা লোকটার মুখ দেখে সুকুর মোটেই ভয় করছিল না। বরং উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেশ করল, কাকু, শোনা যাচ্ছে?

এই ঝিনুকের সংগ্রহ সুকুর খুব প্রিয়। একটা পুরনো হরলিক্সের শিশি ভর্তি করে রাখা বিভিন্ন আকারের ও রঙের ঝিনুক আর শঙ্খ, আর কোথা থেকে পাওয়া একটা সমুদ্র নীল রঙের দশ পয়সা— সুকুর সংগ্রহ। পয়সাটা কীভাবে নীল হল কে জানে! সমুদ্রের জলের নীল থেকে? সুকু যখন কল্পনায় সমুদ্রের ঢেউ ঠেলে খেলে বেড়ায়, তার শরীরও তাই ভরে যায় নীল রঙে। সত্যি এরকম হয় কিনা জানে না, বেচারা সমুদ্রে কখনও যায়নি তো। এগুলো যারা গিয়েছে তাদের কাছ থেকে পাওয়া। সময় পেলেই সুকু এই ঝিনুকগুলো ছড়িয়ে সমুদ্র সমুদ্র খেলে। কিন্তু তা বলে সমুদ্রের আওয়াজ কোনও ঝিনুকের মধ্যে পায়নি। অথচ এই অদ্ভুত চেহারার কাকুটা বলছে ঝিনুকের মধ্যে নাকি সমুদ্রের শব্দ ভরা থাকে। ওই শব্দ আটকে রাখার জন্যেই নাকি ঝিনুকের মুখ জোড়া হয়। ভুরু কুঁচকেছিল সুকু, যাঃ সেটা আবার হয় নাকি? তাহলে সে কেন শুনতে পায় না?

হবে নাই বা কেন, বাজাতে জানো না তাই শুনতে পাও না, বুঝিয়েছিল লোকটা।

ঝিনুক আবার বাজাতে হয় নাকি? আর শব্দ ঝিনুকে ঢুকবেই বা কেমন করে? প্রাণ আছে নাকি? এই নতুন খেলাটা দারুণ লাগছিল সুকুর।

হা হা করে হেসে উঠল লোকটা, ছিল তো। ওই ঝিনুকের মধ্যে প্রাণ তো ছিল যখন সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ও  খেলে বেড়াত। তখনই ওরা সমুদ্রের শব্দও ভরে নিয়েছে নিজের মত করে।

কী সব কথা বলে লোকটা। মাঝে মাঝে মজা লাগছিল, আবার কখনও যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না। অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, যাহ, সেটা আবার হয় নাকি? যদি সত্যিও হয় আর কেউ কেন শুনতে পায় না?

হবে না কেন? না হলে মনে কর, রেডিওর মধ্যে কেমন করে শব্দ বেরোয়? এমনিতে শুনতে পাস সেই শব্দ? শুনতে গেলে রেডিও চালাতে হয়, হয় কি না?

অকাট্য যুক্তি, হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ে সুকু। রেডিওর কথাটা মনে ধরেছিল ওর। ঠিক কথাই তো। সেও তো কতবার ভেবেছে কিভাবে রেডিওর মধ্যে আওয়াজ ঢোকে। ছোট ছোট অন্য এক মানুষের দল কি রেডিওর মধ্যে এসে ঢুকে কথা বলে, গান করে?

তবে? আসলে কি জানিস, চালাতে না জানলে কিছু শোনা যায় না। তেমনি ঝিনুকের মধ্যে ভরা সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দও চালাতে জানতে হয়। বলে হা হা করে হেসেছিল লোকটা। লোকটার ভাসা ভাসা চোখটা হঠাৎ চিকচিক করছিল অনেকদিন বাদে। আনন্দ ছলকে পড়লে যেরকম করে।

কিন্তু কাকু, এই ঝিনুকে কি আর কোন শব্দ বাকি আছে? সব ঝিনুকই যে এক পাল্লা। ভেবেই সুকু মনমরা।

লোকটা সেটা মানল না। বলছিল, ভাঙা ঝিনুকেও অনেক সময় নাকি কিছু শব্দ রয়ে যায়। লোকে বুঝতে পারে না, শুনতে চায় না। তাই শুনতেও পায় না। আসলে ঝিনুকের গায়ে জড়িয়ে থাকা শব্দ বের করতে জানতে হয়। ছড়ানো ঝিনুকের উপর কান পেতে দাড়িওয়ালা লোকটা সেটাই শোনার চেষ্টা করছিল। সুকুর যে একেবারে বিশ্বাস হচ্ছিল সেটাও নয়, কিন্তু বিশ্বাস করতে ভালো লাগছিল। তাছাড়া কথা না শুনলে লোকটা হঠাত হঠাত খুব কেমন রেগে ওঠে। রাগটা যদিও দপ করে নিভে যাচ্ছিল, কিন্তু তবু গায়ে কাঁটা দিয়েছিল কেমন।

আছে! হঠাত চোখ বড় বড় করে বলে উঠল লোকটা। দাড়ির ফাঁক দিয়ে দুপাটি দাঁতের সারি ঝলমলাল। একদম জ্বল জ্বল করছিল ওর চোখ। সব অবিশ্বাস ভুলে ওর এই উৎসাহ ছড়িয়ে পড়ল সুকুর মধ্যেও। কী মজা না? সে কক্ষনও সমুদ্রে যায়নি, আর এখন ঘরে বসেই ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনতে পাবে। ভেবেই সুকুর মন ছটফট।

সাদা একটা ঝিনুক, তার ছড়ানো ডানায় হালকা নীলের ছিটে, আর শাড়ির পাড়ের মত গাঢ় নীলের বর্ডার।  লোকটা দুহাতের পাতা বন্ধ ঝিনুকের মত করে তার মধ্যে আসল ঝিনুকটাকে রেখে সুকুর কানের কাছে নিয়ে এল। মুখে মৃদুমন্দ হাসি। ঝিনুকপানা হাতের মুঠো সুকুর কানের কাছে এনে বলল, এবার চোখ বন্ধ কর আর মন দিয়ে সমুদ্রের কথা ভাব। দেখ তো শুনতে পাস নাকি? চোখ বন্ধ সুকু প্রথমে কিচ্ছু শুনতে পেল না, তারপর ডেড টেলিফোন লাইনের ওপার থেকে সোঁ সোঁ শব্দ আসল যেন। সুকুর কানে সত্যিই একটা শব্দ আসছিল আস্তে আস্তে, এটাই কি ঢেউ? বন্ধ চোখের আড়াল থেকে সারা ঘরটা এখন যেন সমুদ্র, আনন্দে দুলছিল সুকু।

কুমুদবুড়ি ব্যস্ত মুখে ঢুকল, পাগলাবাবু তুমি চলি যাও। দিদি এখুনি এসে পড়বি।

আসুক না, দিদির জন্যেই তো বসে আছি। কেন, দিদি কি আমাকে মারবে? হা হা করে হেসে উঠেছিল লোকটা।

দোষটা আমারই বাবু। আমিই ভয়ের মুখে দিদিকে বলিছিলাম, কি তুমার দুষেই ছেলের অ্যাস্কিডেন্টে রক্তারক্তি হয়িছে।

ভুল তো কিছু বলোনি। ওকে আমি সাইকেলে ধাক্কা মেরেছিলাম বলেই না ও ছিটকে গিয়ে ওই মোটর সাইকেলটার সামনে এসে পড়ল।

সেভাবে বললি তো দুষ ধরতি হয় ফুলপার্টির, ওরা অমন দুদমা ফাটাতি আর নাচতি নাচতি যেচ্ছিল বলেই না ছেলি আমাদের রাস্তা ধরে দেখতি ছুটিছিল। এমন দস্যি ছেলি মাগো, এক দণ্ড তিষ্টুতি পারিনিকো। আমি বলি দিছি শিউলিদিকে, ও তুমি যত ট্যাকাই দেখাও, সামনির মাস থেকি আমি আর নেই। সারাডা সময় ভয়ে দুরু দুরু থাকি বাছা, এই বুঝি কিছু হল, ওই বুঝি কিছু হল। ব্যস হয়ি গেল ইবার, আর দুষ কার ধইরবে? কুমুদবুড়ির। একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে বুড়ি হাঁপাচ্ছিল। কিন্তু বলতে পারার খুশি ওর মুখ চোখের বলিরেখায় ঘামতেলের মত জ্বলজ্বল করছিল।

অস্থির হয়ে উঠেছিল সুকু। দিদা তুমি যাও না এখান থেকে, তুমি এলে আর আমার সমুদ্র হারিয়ে গেল।

ঝাঁঝিয়ে ওঠে বুড়ি। তুই দাঁড়া দেখিনি। কোথায় ব্যাথা লেগেছে ছেলে চুপচাপ শুয়ে থাকবে তা না উনি খেলছেন। খড়খড়ে গলা বুড়ির। সুকুও সেয়ানা। বলল, দিদা, আমার ব্যাথা হয়েছে আর তখন থেকে তুমি আমার ওপর চ্যাঁচাচ্ছ। আমি মাকে বলে দেব।

কুমুদবুড়ি একটু লজ্জা পায়। থাক থাক বাছা, আমি তোমায় কখন বকলাম। আর বকলিও বা আমার কি আর মাথার ঠিক আছে। এই পাগলাবাবু না থাইকলে যে আজ কী হত, আমি কি এত সব সামলাতে পারি? কুমুদবুড়ি লোকটার দিকে ফিরল, তুমিই তো সব করলে বাবা, আমি তো ছেলের গায়ে রক্ত দেখেই অজ্ঞান, ডাক্তারের কাছে কি আর নিয়ে যাব। তুমি না থাকলে যে আজ কী হত।

অ্যাক্সিডেন্টটাই হত না, বলে হা হা করে হেসে উঠল লোকটা। লোকটার দাড়ি গোঁফ বেয়ে যেভাবে হাসি গড়িয়ে পড়ছিল কথায় কথায়, মনে হয় অনেকদিন ধরে যেন হাসি জমিয়ে রেখেছিল, বেরোনোর সুযোগ পায়নি। আজ তাই ওর চোখ, নাক, মুখ দিয়ে হাসি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে, অনেক বৃষ্টির পর গাছের পাতা থেকে অকাতরে জল ঝরে যেমন।

সত্যি অনেকদিন পরে হাসছিল লোকটা। এত হাসার সুযোগ কোথায়? সবাই ব্যস্ত, তার সঙ্গে সময় কাটাবার অবসর কার আছে? বেশিরভাগ সময়ে তাই একাই বসে থাকে আর মনের মধ্যে চিন্তাগুলো কেমন ঘূর্ণি পাক খায়, অস্থির করে তোলে। খাঁচায় আটকানো পাখির মত ছটফট করে তখন। কী যেন পাওয়ার ছিল, ঠিক বোঝে না, কিন্তু পায়নি যে সে ব্যাথাটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। সেই কান্নাটাই মাঝে মধ্যে রাগ হয়ে বেরিয়ে আসে, তাতে লোকে আরও পাগল বলে তাকে তাড়া করে। আজও যখন হঠাৎ ছেলেটা বুড়ির হাত ছাড়িয়ে সাইকেলের সামনে এসে পড়েছিল আর ধাক্কা খেয়ে উল্টোদিক থেকে ঝড়ের বেগে ছুটে যাওয়া মোটর সাইকেলের নিচে, বুড়িটা সেই কথাই বলেছিল। ধরো ধরো, ওই পাগলাটা আমার সুকুকে মেরে ফেললি রে— বলে সুর তুলেছিল বুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে ভয় লোকটাকে সাপটে ধরেছিল— মার খাওয়ার ভয়, লোকজনের কাছে অপমানের ভয়। কিন্তু ভীরু, তাড়িত পশুর মত সাইকেল তুলে ছুটে পালাতে গিয়েও আটকে গেছিল ছেলেটার দিকে চেয়ে। রক্তে সত্যি ভাসছিল ছেলেটা, কপালের উপর কেটে গিয়ে সারা মুখ রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। বুড়ির ভয় পাওয়া তাই স্বাভাবিক। মোটর সাইকেলওলা ঝড়ের বেগে পালিয়েছিল। বুড়ির পক্ষে অত জোগাড়যন্ত্র করে ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। লোকটাই তখন পাঁজাকোলা করে ছেলেটাকে তুলে নিয়ে দৌড় মেরেছিল। এতে বুড়ি আরও ভয় পেয়ে, ছেলে নিয়ে পাইলে গেল গো, সুকুডারে নিয়া পাগল পাইলে গেল গো বলে ধেয়ে এসেছিল পিছন পিছন। গরমের দুপুরের রাস্তায় সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাঁচোয়া তাও যে বেলা পড়ে আসছিল, রাস্তায় অত লোক ছিল না। অনেক দোকানেরই তখন ঝাঁপ বন্ধ। মজা দেখার লোক তবু কিছু তো ছিলই। সুকুর দুহাত জড়ানো ছিল লোকটার গলায়, লোকটা একবার করে সুকুর মুখের দিকে চাইছিল, আবার দৌড়াচ্ছিল। লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌড়ে ঢুকে পড়েছিল হসপিটালের এমার্জেন্সিতে।

ভাবতে ভাবতে এবার লোকটার মুখটা কেমন কুঁচকে গেল। একটু কি অপমান, নিজের অসহায়তার কথা মনে পড়ে গেল? আসলে কি হয়েছিল, এমার্জেন্সিতে তো নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তার এমনিতে অবিন্যস্ত চেহারা রক্তে মেখে আরও কিম্ভূত রূপ নিয়েছে। তাই এমার্জেন্সিতে ঢোকাতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাছাড়া কোন সরকারি হাসপাতালে টাকা ছাড়া কাজ হয়? তার মুখ দেখে পকেট যে ফাঁকা সেটা বুঝতে কাউন্টারের লোকটার মোটেই অসুবিধা হয়নি। এরপর মুশকিল ছিল নাম ঠিকানা নিয়ে। ছেলেটার ডাকনামটা সুকু সেটা বোঝা গিয়েছিল, সেই ভরসায় না হয় বলে দিল সুকুমার। বাপের কী নাম, কী ঠিকানা দেবে লোকটার জানা ছিল না। কাউন্টারের কর্মচারীর প্রশ্নচিহ্নসর্বস্ব মুখের দিকে চেয়ে লোকটা বলতে চাচ্ছিল সুকুমার বসু, বাবা শান্তায়ন বসু…। তখনই বুড়ি এসে উপস্থিত। বুড়ির সঙ্গে এসেছিল সুবল, শহরের সবাই তাকে চেনে, ভয়ই পায় লোকে। চেনে শানুও। পছন্দ করে না মোটেই। সুবলের পেছন পেছন আরও দু একটা ষণ্ডা চেহারার লোক। সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টারের লোকটার চাউনি পালটে গেছিল। সুবল এসেই শানুকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। এই পাগলটা এখানে কী করছে? যা এখান থেকে।

রাগে, অপমানে রগের কাছটা দপদপ করছিল শানুর। একবার ইচ্ছে করেছিল ঝাঁপিয়ে পড়ে সুবলের উপর, যা থাকে কপালে প্রথমে তো দিয়ে নেবে দু এক ঘা। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া ছেলেটার দিকে চেয়ে থমকে গেল। খামোকা ওর চিকিৎসার দেরি হয়ে যাবে। এইসব সাতপাঁচ ভেবে গুটিয়ে গেল শানু।

এরপর আর ডাক্তার দেখাতে অসুবিধা হয়নি। সুবল এলে তাকে প্রশ্ন করার সাহস কটা লোকের আছে? সবকিছু বরং চটপট করে হয়ে গেল। সব ব্যবস্থা করে সুবল তার দলবল নিয়ে আবার মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে হাওয়া।

ওখানে শানুর আর থাকা দরকারও ছিল না। কিন্তু খানিক আগেই পাঁজাকোলা করে গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকা ছেলেটার কথা ভুলতে পারছিল না। কতদিন কাউকে এভাবে বুকের কাছে জাপটে ধরেনি। কখনওই কি কাউকে ধরতে পেরেছিল, স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে মাথাটা দপদপ করে উঠল। একটা কষ্ট, এক সুতীব্র বেদনা ছেয়ে যাচ্ছিল শরীরে। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকা দিল শানু, যেন ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সব দুঃখগুলোকে মনের তলায় সেঁধিয়ে দেবে। তখনই ছেলেটাকে আবার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা এল। হাসপাতালের বারান্দায় থপ করে বসে পড়ল শানু। কখন যে তার কী ইচ্ছা হয় সেসবের হদিস শানুও জানে না। এইজন্যেই হয়তো লোকে তাকে পাগল বলে।

খানিক বাদে বুড়ি বেরোতে তার পিছন পিছন রওনা দিল। সুকুর হাতটা এখন স্লিং দিয়ে ঝোলানো, হা্তে মুখে জায়গায় জায়গায় গজ দিয়ে ব্যান্ডেজ করা। রক্তের ছিটেফোঁটা এদিক ওদিক।

–ওর কি হাত ভেঙেছে? এতক্ষণে ওদের পাশে এসে গেছিল শানু।
–তাতে তুমার কেন মাতাব্যাতা বাপু? যা করার সে তো করিছো, এবার বিদেয় হও না। ঝামটা দিয়ে ওঠে বুড়ি।
–ও কি তোমার নাতি?
–ওই নাতির মতুনই পেরায়। মায়ের আর সময় কুথায় ছেলের তরে? চাকরি করতে কলকেতা যেতে হয় কিনা, রাত্তির হয়ে যায় আসতে তখন আমিই দেখি।
–মাকে জানিয়েছ?
–তাইতেই তো দেরি হল। তুমি তো ছুটে পলালে। তুমার সাথে আমি ছুট্টে পারি? আমি ঘরে গিয়ে শিউলিদিদিকে ফুন কইরলাম। তাপর কি করি কি করি, এই বাবু এসি হাজির। বলে কী হয়েছে শিউলির ছেলের? কুথা থিকি  খবর গেল কি জানি। তবে ইনাদের তো চারদিকি নোক ছড়ানো। এবার চোখ গোলগোল করে ফিসফিসায়, এলাকার বড় দাদা গো, শিউলিদিদির সাথে কেমন একটা আলাপ পরিচয়ও আছে। তার সনেই তো এলাম আমি।
–আর ওর বাবা? সুকুর বাবা কোথায়?
–তুমি পোস্ন বড় বেশি করো বাপু। অত কথায় তুমার কাজ কী? একটু নরম হয়েছিল, আবার ঝাঁঝিয়ে উঠল কুমুদবুড়ি। বাবা থাকলি কি এই দুদ্দশা হয় ওদের?

শানু এবার ছেলেটাকেই জিজ্ঞেস করল, খুব ব্যাথা করছে তোর?

–না, আগে লাগছিল। এখন আর লাগছে না।
–কোথাও সেলাই করেছে?

ভেবেই ব্যাথায় মুখটা কুঁচকে উঠল সুকুর। আঙুল দিয়ে দেখাল হাঁটুর নীচে।

–তাও পড়েছে গো, শিউলিদিদির কাছে আমি মুখ দেকাই কী কইরে। ডুকরে কেঁদে চোখে আঁচলচাপা দিল কুমুদবুড়ি।

কান্নায় ব্যাস্ত ছিল বলে বুড়ি খেয়ালও করেনি যে শানু ওদের সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। খেয়াল পড়তে ধমকে ওঠে, তুমি বাপু এবার যাও, বাইরের লোক ঘরে ঢুইকলে দিদি রাগ কইরবে।

–ছেলেটার এত জোর ব্যাথা লেগেছে না? ওর সঙ্গে খেললে মনটা অন্যদিকে যাবে। তোমার দিদি কলকাতা থেকে আসবে বললে, তার তো দেরি আছে। ততক্ষণ বসে খেলি না ওর সঙ্গে? শানুর গলায় অনুনয়।

বুড়ি মুখ খুলবার আগেই সুকু ঝাঁপিয়ে পরে, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি আসবে, আমরা খেলবো।

–দিদি আমায় মেইরে ফেইলবে। ও আমি পাইরব নাকো।
–কেন না? আমি সারাদিন একা বসে থাকি, কেউ খেলার নেই। আর আমি মাকে বলে দেব তুমি আমাকে না দেখে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাচ্ছিলে আর আমি সেই ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে গেছিলাম।
–কী শয়তান হইছে গো এই ছেলেটা, দ্যাখো দ্যাখো তুমরা। দিনভর এত করি ওর জন্যি আর এখুন ঐ আমারি লাগান ভাগান করছি গো। বুড়ি মরাকান্না জুড়ে দিলেও শানুকে আর আটকায়নি।

তখন থেকে শানু আর সুকু খেলায় মেতেছিল। ব্যথা ভুলে হাসছিল সুকু, সব ভুলে ভাসছিল শানু।

এবার দরজায় বেল পড়ল। চোখে মুখে অস্বস্তি নিয়ে দৌড়ে এল বুড়ি, এট্টু শুই পড় বাছা, খেলতি দেখলি কাণ্ড করবি তুর মা।

আবার বেল। একবার, দুবার। আসতিছি গো আসতিছি, একিবারে ঘুড়ার জিন দি এইসছে দ্যাকো। কিন্তু দরজা খুলেই বুড়ির মুখের ভাব বদলে গেল, ও আপুনি?

একরাশ সাদা পাকা চুল, বয়েস হলেও বেতের মত পাকানো চেহারা। উদ্বিগ্ন চোখ নিয়ে ঢুকল, সুকুর কী হয়েছে? শুনলাম…

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুড়ি আবার কান্না জুড়ল, দেকুন, দেকুন আমার কত্তবড় সব্বোনাশ হলু আজ। এমন দুরন্ত ছেলিকে সামলানো কি আমার কাজ? আজ দিদির কাছি কি মুক দেকাব?

সুকু চেঁচিয়ে ডাকল, কালিজেঠু এদিকে এসো। দেখো ঝিনুক থেকে কেমন সমুদ্রের আওয়াজ বের করেছে কাকুটা?

কালি হাসল, ও কিরে সুকু, তোর এত ব্যথা নিয়ে এখন খেলাধুলোয় মেতেছিস? তখনই শানুকে দেখে বুড়িকে চোখ দিয়ে প্রশ্ন করল, যেন বলছে, এ কে কুমুদ?

বুড়ি কিছু বলার আগেই শানু আগ বাড়িয়ে বলল, আমি, আমার সাইকেলের ধাক্কাতেই তো ওর এই অবস্থা।

কালিপদ অবাক হল। এমনভাবে নিজের দোষকীর্তন করতে কাউকে কখনও শোনেনি। অভিজ্ঞ চোখে জরিপ করছিল শানুকে। এলোমেলো চেহারা, বেশ নোংরা জামাকাপড়, তাতে আবার রক্তের দাগ। অবিন্যস্ত দাড়িগোঁফের জঙ্গল ঠেলে ধরা দিচ্ছে হারিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করা একজোড়া চোখ। চিনতে পেরেছে, ওই সেই প্রফেসারের পাগল ছেলে। রাস্তায় আলুঝালু ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। তবু বলল, তোমাকে তো ঠিক…

এবার একগাল হাসল শানু। সুকুর সঙ্গে খেলতে খেলতে সেই হাসি এখন নির্মল আনন্দে ভরপুর, আমি শানু, লোকে বলে শানুপাগলা।

আমি কিন্তু তোমাকে পাগলাকাকু বলব না, শুধু কাকু। কেমন?

এক অসীম কৃতজ্ঞতায় সুকুর দিকে তাকাল শানু। পরম মমতায় চোখ ছলছল করে উঠছিল বোধহয়। কালিপদ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ঠিক বলেছিস সুকু। তা না হলে আমাকেও তো পাগলাজেঠু বলে ডাকতে হবে। আরে বাবা, পাগল তো আমরা সবাই। আমার বউ তো আমাকে সেই কোনকাল থেকে পাগল ঠাউরে বসে আছে। বলে ঘরের খেয়ে যারা বনের মোষ তাড়ায়, সে লোক পাগল না তো কী?

শানুকে সবাই পাগল বলে। নিজের পাড়ায় সুকুর বয়সী ছেলেরা রাস্তায় ঢিল ছোঁড়ে, পাগল বলে তাড়া করে। যত চেনা পরিচিত তারা দেখলে দূরে সরে যায়। নিজের বাবা, সেও। হঠাত একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষের সম্মান পেয়ে পাগলাশানুর মন আকুল হয়ে উঠছিল। কি এক সুখে বুকের ভেতরটা কেমন করতে থাকে, মাথার মধ্যে একটা পায়রা ছটফট করে ডানা ঝাঁপটায়।

 

শিউলি ব্যস্ত হাতের মেক আপে অনন্যা হচ্ছিল।

খুব বেশি সময় হাতে নেই, সকালে সুকুর হাত ছাড়িয়ে বেরোতে বেরোতে ট্রেনটা মিস হল। এখন যত তাড়া! চোখের কোণে কাজলে ভরাট করে তেরছা চোখে আয়নায় নিজেকে মাপছিল। সব একইরকম লাগছে তো?

তিন সপ্তাহের বেশি বাড়িতে বসা। সুকুর এমন একটা ব্যাপারের পর জীবনটা গ্রীষ্মের থম ধরা দুপুরের মত এগোতে ভুলে গিয়েছিল। ছেলেটাও এত বেশি মা-আঁকড়ি। তার ওপর কুমুদবুড়ি, সেও সময় বুঝে বেঁকে বসল। তখন কী বা করে শিউলি!

খবর পেয়েই কীভাবে যে ছুটতে ছুটতে বেরোল সেদিন! গোপালবাবুকে বুঝিয়েছিল যে তার বর হঠাত অসময়ে বাড়ি ফিরে এসেছে, তাকে তক্ষুনি তক্ষুনি যেতে হবে। ওর সামনে চরিত্র বদল করার উপায়ই ছিল না। শক্তিকে একটা ফোন করে ওই শাড়ি কাপড়েই বেরিয়ে পড়েছিল, মুখ থেকে অনন্যাকে না পুঁছেই। তখন যে বুকের মধ্যে কী ঝড় চলছিল তার। এমন কপাল কালিঘাট রোডে সেদিনই এত ভিড়! লোকে লোকারণ্য। বাস এগোচ্ছে একপা দুপা করে। পুজোর একমাসও বাকি নেই। তাই সন্ধ্যার দিকে এইসব দিকের রাস্তায় দোকানপাটে ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু তাই বলে এমন? ওর বিরক্ত মুখ দেখে লেডিজ সিটে পাশের মেয়েটা বলেছিল, মাদার চলে গেলেন আজ, তাই এত ভিড়। শিউলি একরাশ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে তাকিয়েছিল কিছু না বুঝে, অনন্যাসুলভ পালিশের তোয়াক্কা না রেখেই। অবাক মেয়েটা অস্ফুটে বলেছিল মাদার টেরিজা। আজ মারা গেলেন তো, শেষবার দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় ভেঙে পড়েছে। ততক্ষণে শিউলি সামলে নিয়ে ফের অনন্যায় কায়েম হয়েছিল। একেবারে বাড়ি ফিরে মাথায় ফেট্টি বাঁধা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তবেই অনন্যার খোলস ছুঁড়ে ফেলেছিল। বাচ্চার মন, দুপুরের সব কথা সন্ধ্যার খেলার তোড়ে কখন তলিয়ে গেছে। মার এত কান্নাকাটিতে সুকু বেশ অবাক হয়েই বলল, কেন কাঁদছ মা, কাকু তো সঙ্গেই ছিল। ক্রমশ ধাতস্থ হতে থাকা শিউলির বোধে ঘরের মধ্যে থাকা অন্য লোকেদের উপস্থিতিটা এতক্ষণে বাস্তবায়িত হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে গুরু গুরু। একটা ঘোরের মধ্যে এসেছিল, যখন বাড়িতে পৌঁছাবে তখন সেখানে যে বাইরের কেউ থাকতে পারে সেটা মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিল। না হলে সাজপোশাক আর একটু না বদলে ঘরে ঢুকত। ছেলেকে গোটা অবস্থায় দেখে একটা ভয় যেই কমল, জাগল আর একটা ত্রাস। ভিতর থেকে আর একটা বেপরোয়া শিউলি মুখ ভ্যাংচাল, বয়ে গেছে। আমায় কে দেখে, কারও খাই না পরি? ভয়ের খোলস ধরে টান দিতেই রাগের অন্দরমহলটা এক্কেবারে বাইরে। কালিদার পাশে এই লোকটা কে? এ ব্যাবসায় থেকে লোককে মেপেজুকে বোঝার ক্ষমতাটা শিউলির ভালই হয়েছে। কিন্তু এই লোকটার হিসেবে কিছু গন্ডগোল আছে। একমুখ দাড়ি, উলোঝুলো চেহারা, যত্নের অভাব স্পষ্ট। আবার কিছু একটা আছে চোখে মুখে, যাতে মনে হয় যেন অন্য একটা পরিচয় আড়াল থেকে উঁকি মারছে। শিউলির তো জানাচেনা নয় মোটেই। এরকম একটা উটকো লোককে কুমুদ কেন আসতে দিয়েছে? এইভাবে আর কাকে কাকে বাড়িতে ঢুকাচ্ছে বুড়িটা?

–আপনি কে?

লোকটার দাড়ি চুঁইয়ে চুঁইয়ে হাসি গড়াচ্ছিল, রাগত ভ্রূকুটিকে একটুও তোয়াক্কা না করে। বরং যেন উপভোগ করছে। রাগে গা রি রি করে না! জান নেই পহচান নেই, আমি তোর মেহমান।

–কী হল, কে আপনি? শিউলির রাগ ক্রমশ বাড়ছিল।

কিন্তু চোখ চিকচিক করে হাসছিলই শুধু লোকটা, মুখ থেকে কথা সরছিল না কিছুতেই।

এর কাছ থেকে কোন সাড়া শব্দের আশা ছেড়ে শিউলি এবার কুমুদকে নিয়ে পড়ে। কী হয়েছিল কুমুদদি? আর এই লোকটাই বা কে?

কুমুদ ভয়ে ভয়ে ছিল এতক্ষণ। একে ছেলে তার চোখ এড়িয়ে কেমন করে রাস্তায় চলে গেল, মনে মনে তার শতেক যুক্তি সাজানো। তার উপর এই পাগলা বাবুটি বাড়ির ভিতর, সেও কিনা আবার এত রাত্রে! দিদি যে এই বাবুটিকে নিয়ে রাগ করবে সে তো জানাই ছিল, ওই ছেলেই তো যেতে দিল না। নিজেকে ভুলাতে রেশনের চাল ছড়িয়ে বসেছিল কুমুদ, কাঁকড় বাছতে। শিউলির কথায় মাথা আরও গুঁজে কাঁকড় বাছতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

–কী হল, কুমুদদি তোমাকে কি বোবায় ধরল! জিজ্ঞেস করছি, কানে কথা যাচ্ছে না?
–আমি তো বারবার বননু দিদি, বাবু যাও। সন্ধ্যেবাতি জ্বলে গেছে, একা মেয়েছেলের বাসা, তুমার ইখানে থাকা সাজে না। সুকুবাবা শুনবে? যত বলি ঘাট মানি, বাবু যাও; ওদিনি বলে, না কাকু যাবে না, আমার সাথে খেইলবে।

কে এই লোকটি, কেন এই বাড়িতে এসে বসে রয়েছে তার ঠিক নেই। আবার কাকুও পাতানো হয়ে গেছে এর মধ্যেই। পাগলটা মজা পেয়ে কেমন মিটি মিটি হাসছে দেখো! রাগের স্রোতটা শিউলির শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।

মজা সত্যিই পাচ্ছিল শানু। তার প্রতিদিনকার জীবনটা বড্ড একঘেয়ে, কিছুই তো ঘটে না। একটা লোক পায় না যার সঙ্গে দুটো কথা বলবে। আর আজ সারাটা সন্ধে এত ভালো গেছে। আর এখন এই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কেমন যেন অন্যরকম, কিন্তু ভালো। নারীজগতের ধারেকাছে পাগলদের আনাযানা সম্ভব নয়, তাই মা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের এত কাছে দাঁড়িয়েও থাকা হয়নি বহুদিন। রাগের চোখেই না হয় তাকাচ্ছে, দুকথা শুনতে হবে সেই বোধও শানুর একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু ঝড়ের মুখে হাল হারানো বেপরোয়া নাবিকের মত মুহূর্ত কিনছিল শানু। কেন নয়? যা হবে দেখা যাবে, এখন তো ভালো লাগছে, ভালো লাগছে এতগুলো লোকের মধ্যে বেঁচে থাকার টক মিষ্টি ঝালে মাখামাখি হতে। ভালো লাগার আবিষ্কারটা চোখ থেকে দাড়ি বেয়ে তাই হাসি হয়ে ঝড়ছিল।

শিউলি কুমুদকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করল, তুমি সুকুর সঙ্গে থাকো নাকি আমি তোমাকে ছেলে দেখতে রেখে যাই?

কুমুদের সটান জবাব, পারবনি দিদি, আমি আর পারবনি। আমার ট্যাকা কটা দিয়ে দাও দিনি, আমি এ বাড়ি থেকে বিদেয় হই। এ বুড়ো হাড়ে আমার এই যন্তন্না সহ্যি হবেনি। বলে কুমুদবুড়ির চোখে আঁচলচাপা পড়ল।

কুমুদের এই মোক্ষম চালে শিউলি বুঝল দানটা বড় কঠিন জায়গায় চলে গেছে। তাই ঝপ করে গলায় সন্ধির সুর এনে বলল, ছাড়ো এসব, অনেক রাত হয়েছে। তুমি আগে এই চালের কাঁড়ি মেঝে থেকে তুলে জায়গাটা খালি করো দেখি।

–কী হল, বললেন না তো আপনি কে? নিজের গলায় অনন্যার থেকে ধার করা পালিশ লাগায় শিউলি। দেখেছে এতে কাজ হয়।
–আমি শানু, সায়ন্তন। নিজের ভাল নামের আস্তরণটা বহুদিন বাদে নিজের উপর চড়িয়েছিল লোকটা।
–ওটা একটা ভালো কাকু মা, আমার সাথে খেলছিল এতক্ষণ।

তার সম্বন্ধে ভালো বিশেষণটা এত কম ব্যাবহার হয়, যে আত্মসচেতনতায় আক্রান্ত হয়ে শানু এবার হুড়ুমতাল জুড়ল। এতক্ষণ এখান থেকে নড়তে পা সরছিল না, এখন ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলার ভয়ে তাড়িত হল। বড্ড দেরি হয়ে গেছে, আমি আজ যাই।

–কাকু, কালকে আসবে কিন্তু। আমি স্কুল থেকে দুটোর সময় এসে যাই, তখন আমি আর তুমি উড়নছুপ খেলব।

লোকটাও মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে হন হন করে বেরিয়ে গেছিল। ও কে, থাকে কোথায় এসব কিছু শিউলিকে না জানিয়েই।

কিন্তু ওর পরিচয়টা আরেকটু জানা গেল কালিদার কাছে। ভালো বাড়ির ছেলে, মাথাটা একটু বিগড়ে গিয়ে কেমন একটা হয়ে গেছে। সেরকম পাগল নয়, তবে খেপে গেলে নাকি সাঙ্ঘাতিক। একে একদিন রাস্তায় ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে মারপিট করতেও নাকি দেখেছে কালিদা।

সেটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার! এরকম একটা লোকের সঙ্গে ছিল সুকু এতক্ষণ?

শিউলির চোখমুখের অবস্থা দেখে কালিদা শুধরে নিয়ে বলেছিল, হয়তো দোষ বাচ্চাগুলোরই। পাগলা, পাগলা বলে ইটপাটকেল ছুড়ে থাকবে। পাগলের কথা আর কে শুনছে। কিন্তু এই নিয়ে বেশ জলঘোলা হয়, কাউন্সিলর গিয়ে ওর বাড়িতে কথাও বলেছিল।

কালিদা যতই এই পাগলাটার দিকে টেনে কথা বলুক, মেনে নিতে পারল না শিউলি। বুঝলাম বাচ্চাদের কোনও দোষ থাকতে পারে। কিন্তু বাচ্চা বাচ্চাদের মত করবে, তুমি বুড়োধাড়ি কেন তাদের ধরে মারবে? তার মানেই তো তুমি পাগল। সুকু যাই বলুক, একে আর ঘরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।

কিন্তু শিউলি নিজের এই সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারল কই? সুকুর জেদের কাছে হার মানতেই হয়েছিল। ওর ভালোকাকুকে চাই। পরদিন ওই দাড়িওলাও ঠিক দুপুর দুটোয় হাজির, স্কুলের ভ্যান থেকে নামতে নামতেই। যেন ধারেকাছে কোথাও ওঁত পেতে ছিল। শিউলি কিছু বলার আগেই সুকু ব্যাগটা মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল লোকটাকে। এক চোখ চিকচিকে আনন্দে ছলকানো উন্মুখ মুখটা শিউলির দিকে ফিরিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় ছিল তবুও। কী বলবে শিউলি? তার মনের হিসাব, মুখে কি সবসময়ে বলা যায়? বিশেষ করে সুকুরই যখন এত উৎসাহ। কিন্তু সারাটা দুপুর ঘুরে ঘুরে পাহারায় রইল। এইতো দু কামরার ঘর, না চাইলেও কী কথা হচ্ছে সবই কানে আসে। দেখল কি অসীম আনন্দ আর ধৈর্যর সঙ্গে খেলছে ছেলেটার সঙ্গে। আর কতরকম জ্ঞানের কথা। সুকুর নানানরকম প্রশ্নের উত্তর হাসতে হাসতে দিয়ে যাচ্ছে। এত কিছু জানে শোনে, একে কেন লোকে তবে পাগল বলে? পাগল হলেও সেয়ানা পাগল, শিউলি এই সিদ্ধান্তে এসে গেছিল খুব শিগগির। কীরকম একটা মায়াও ঘাই মারছিল বুকের কোনায়। এত জানে বোঝে, অথচ পাগল বদনামে ঘুরছে। আহা রে!

সপ্তাহ কয়েক চোখের সামনে দেখল, তবুও দোনামনা ছিল। শত হলেও লোকে যা বলে তার এক আনাও যদি সত্যি হয়, ছেলেকে এর কাছে ছেড়ে অত দূর যাওয়া, বুক তো কাঁপবেই। লোকটা একদিন স্বপনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, এই কি সুকুর বাবা?

শিউলি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই লোকটা বলল, ওকে আমি ছোটবেলায় চিনতাম।

–চিনতে? কেমন করে?
–সেটাই তো মনে করতে পারছি না। অথচ খুব যেন চেনা।

শিউলি অবাক হয়েছিল। কে জানে, হবেও বা। ভালোই হল বাবার মত একটা লোক সুকুর সঙ্গে খেলবে, শুধু তাই নয় কত কিছু যে শিখছে ছেলেটা! ফড়ফড় করে ইংরেজিও বলে লোকটা, অত খারাপ কী আর হবে! নিজের মধ্যে এমনি অনেক বোঝাপড়া করে শানুর আসাটা কায়েম রেখেছিল শিউলি। কিন্তু একটা শর্ত, দাড়িটা কাটতে হবে।

কেন জানি না, ওই অবিন্যস্ত দাড়িতে লোকটাকে বেশি পাগল পাগল মনে হয়। আর সত্যি বলতে কি, কথায় বার্তায় যতই বিদ্যে জাহির হোক, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় বড্ড ঢিলে।

–দাড়ি কাটেন না কেন? ওটা না থাকলে তো লোকে আর পাগল বলে না।
–সেলুনে গেলে ওরা আমার দাড়ি কাটতে চায় না যে। গোবেচারা মুখ করে বলেছিল লোকটা।

ওর এরকম ন্যাকামিতে খুব বিরক্ত হয়েছিল শিউলি। কোথাকার খাঞ্জা খাঁ এসেছেন, নিজে দাড়ি কাটতে কী হয়? কাঁচুমাচু মুখ করে তখন নিজের অক্ষমতা জানিয়েছিল। আসলে আমার একটু নার্ভের অসুখ আছে, হাত কাঁপে। বেশ কয়েকবার বড্ড করে কেটে গিয়েছিল বলে…

আচ্ছা, তবে নিয়ে আসবেন দাড়ি কামাবার যন্ত্রপাতি, আমিই কেটে দেবো না হয়। ঝট করে বলে দিয়েই মনে মনে শিউলি জিভ কেটেছিল। এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল? কতটুকু জানে এই লোকটাকে? কিন্তু তার পরেই ফিক করে হেসেছিল মনের ফাজিল শিউলিটা। বা রে, এই যে গোপাল রায়, গুণদীপ এদের সঙ্গে শুস, একটা সুতোরও তো আড়াল থাকে না। কতটুকু জানিস ওই লোকগুলোকে? কথাটা ঠিক, শক্তি খোঁজখবর নিয়ে রাখে, সে তো নয়। তবু শোয় তো। তাহলে এর দাড়ি কাটার জন্য অত পরিচয়ের দরকারটা কোথায় শুনি? তাছাড়া এখানে প্রয়োজনটা তার নিজের। এত দাড়িগোঁফের জঙ্গল বোঝাই করে উকুন বয়ে আনবে, ছড়াবে সুকুর উপরে। শুধু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, লোকটা যেন এর উল্টো মানে না করে বসে। পাগলের চিন্তা কখন কোনদিকে দৌড়ায়, তার হদিস তো শিউলির জানা নেই।

আসনপিঁড়ি করে বসেছিল লোকটা। চোখে মুখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি। স্বপন যেদিন ওর দলের তিন সাগরেদকে নিয়ে এসেছিল তার হাতে ভাইফোঁটা দেওয়াতে, ওমনি আলো ঝলকাতে দেখছিল ওই ভাঙাচোরা মুখগুলোতে।

দেখবেন, যদি কোথাও লাগিয়ে দিই বলবেন কিন্তু। আস্তে আস্তে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে মুখটা ফুটে বেরোচ্ছিল। পাগলদের মুখ কি নরম থাকে, বয়সের ছাপ চামড়ায় দাগ বসায় কম? কলেজের ছেলে বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। বললও সেটা। দাড়ির আড়াল অনেকটা সরে গেছে, তাই হাসিটা অনেক স্পষ্ট করে বোঝা যায়। কিন্তু লোকটা চোখদুটো বুজেই বসেছিল। তাই চোখের ধারগুলো কুঁচকালেও হাসি চোখ জুড়ে ভাসাতে পারল না। গুমগুমে হাসিটা কথায় ছড়িয়ে গেল। ভালোই তো, ওই কাজটা করা বাকি আছে, এবার তাহলে কলেজের ডিগ্রিটা পাওয়ার চেষ্টা দেখি।

কিন্তু আপনি চোখ বন্ধ করে বসে আছেন কেন? মনে হচ্ছে যেন পূজোয় বসেছেন। হাসতে হাসতেই বলেছিল শিউলি। কিন্তু উত্তর শুনেই বুঝেছিল কেন লোকটাকে সবাই পাগল বলে। পাগল না হলে কেউ বলতে পারে, আসলে আপনি এত সুন্দর দেখতে তো, এত কাছে আসলে কেমন গা ছমছম করতে থাকে।

–গা ছমছম করবে কেন? আমি কি ভূত না পেত্নী? শানুর অকপট স্বীকারোক্তিতে খুব বেশি রেগে উঠতে পারেনি শিউলি।
–না, আপনাকে কাছে থেকে দেখলে যদি ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করে। তারপর তো আপনি আর এই বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না।

গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! কথা যেদিকে যাচ্ছে দেখে শিউলি আর বেশি ঘাঁটায়ওনি। এর মুখের আগল নেই, বোধহয় পাগলরা শিশুর মত অকপট হয়। পাগল পুরোপুরি না হলেও একটু ছিট তো আছেই মাথায়, কী কথায় কী বলে ফেলে জানা নেই। গোঁফদাড়ির জঙ্গল সাফাইয়ের পর লোকটার মুখ দেখে ভয়টা সত্যিই অনেক কমে গিয়েছিল শিউলির। কদিনের মধ্যেই কুমুদবুড়ি ছাড়া শানুদাও ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও কালিদার কাছ থেকে শোনা ওই বাচ্চাদের সঙ্গে মারপিটের কথাটা মাথায় রয়েছে, কিন্তু সামনে থেকে যা নিজে দেখেছে অত কিছু আর ভয় থাকেনি শিউলির। বরং শানুদার সঙ্গে ছেলেটা আছে জেনে অনেক বলভরসায় আজ। এমনকি গোপাল রায়ের দিঘা যাবার প্রস্তাবটাও ভেবে দেখতে শুরু করেছে, অনেকগুলো টাকা এক লপ্তে এসে যাবে!

আজকে আসার সময় সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে শানুদাকে। কোনও আসুবিধা হলে, সুকু কথা না শুনলে আমায় ফোন করবে। ওকে বাইরে যেতে দেবে না কিন্তু।

সুবোধ বালকের মত সব কথায় ঘাড় নেড়েছে শানু।

কী মনে হয়েছিল, বাইরে পা রেখে আবার ফিরে বলেছিল, শানুদা আজ রাতে চাট্টি খেয়ে যেও।

শানুদাকে ফোন করতে বলায় কী ভুল যে হয়েছিল, আস্তানায় পৌঁছোতে না পৌঁছতে ফোন। শক্তির ফোন আসে এই সময়ে। সেই ভেবে তুলেই শানুর গলা শুনে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল শিউলির। কী হল রে বাবা, ছেলেটার তো এখনও স্কুল থেকেও ফেরার সময় হয়নি। তাহলে কিসের ফোন?

ফোনের অন্যপ্রান্তে শানুদা। কী হল, কিছু গণ্ডগোল হল নাকি? হ্যালো, হ্যালো বলে চলেছে এদিক থেকে, ওদিক থেকে কী বলছে কিছু আওয়াজই আসছে না। কী বলছ শানুদা? আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না যে। একটু জোরে বলো।

একটু হাঁকাহাঁকি করার পর শানুর গলা ফুটল, শিউলি সেদিন থেকে তোমাকে একটা কথা বলব বলব ভাবছি।

–উফ, তো বলোনি কেন, এখনই কি বলবার সময় পেলে।
–আচ্ছা, আচ্ছা, তাহলে কি পরে বলব? ইতস্তত করে শানু।

বিরক্ত হাতে ফোন ধরে শিউলি তাড়াতাড়ি কথা শেষ করার চেষ্টা করেছে, করে যখন ফেলেছ, তাহলে চট করে বলে ফেলো।

–না, বলছিলাম কি, আমার দাড়িগোঁফ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। একটু বেড়ে গেলে তুমি কি আবার কেটে দেবে?

এরকম একটা কথার জন্য তৈরি ছিল না শিউলি, হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, আমি কেটে দেব। কিন্তু শানুদা আমার কাজের সময় ফোন আসলে খুব অসুবিধা হয় কাজে। একান্ত জরুরি না হলে আমায় ফোন কোরো না আর।

এবার খুব রাগ করল শানু, ছেলেমানুষি রাগে গরগরানো গলায় বলল, তোমরা সবাই এক। যে দুএকজনের সঙ্গে কথা বললে আমার মনে একটু শান্তি আসে, তারা সবাই ব্যস্ত, ফোনের জন্য সময় নেই। যেমন হীরক, তেমনি তুমি। ঠিক আছে, আমি মরে গেলেও আর ফোন করব না।

শানু ফোন রেখে দিল। শিউলির চোখে ভ্রুকুটি রেখে গেল। পাগল লোকটা তার প্রেমে পড়ে গেল নাকি? তার জীবন বড্ড আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে সারাটা জীবন। যেভাবে যা চেয়েছে কিছুই হয়নি, এখন নিজের মত করে একটু বাঁচতে চায় ও। ছেলের দায়িত্ব হাসিমুখে নেবে সে, কিন্তু পরের পাগল ছেলের নয়। বলেই মনে হল, ইস, কিরকম স্বার্থপরের মত ভাবছে। লোকটাকে ছেলের পাহারায় বসিয়ে আসছে বিনিমাগনা, আর ওর দুটো কথা শোনার ধৈর্য নেই? কিন্তু জীবনের কাছে অনেক ঠকেছে, ঠেকেছে, শিখেছে। উটকো ঝামেলার মধ্যে পড়তে চায় না শিউলি।

ফোন রেখে দিলেও এই চিন্তার স্রোত তার পিছু ছাড়েনি, বিনবিন করছিল মাথার মধ্যে। ভাবতে ভাবতে কখন নিজের অজান্তে হাত থেমে গেছিল। এখন ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠল শিউলি, এই রে গুণদীপের আসার প্রায় সময় হয়ে গেছে। মেক আপ হয়ে গেছিল, চট করে অনন্যার শাড়িতে নিজেকে জড়াতে থাকে শিউলি। লাল, নীল আর হলুদে ঝলমলানো শিফন, জাঁকজমক গুণদীপের খুব পছন্দের। হবে না, সিনেমার জগতের লোক যে।

শাড়ি পরতে পরতেই বেল বাজল, বারবার তিনবার। গুণদীপ। লোকটা অপেক্ষা করতে জানে না, কখনওই অপেক্ষা করতে চায় না। দরজা খুলতেই গুণদীপ তার বলশালী দুই হাতে শিউলির কোমর ধরে হাওয়ায় তুলে দিল। গায়ের রংদার শিফনটা মেঘের মত তার শরীর ছেড়ে হাওয়ায় ভাসল। হাওয়ার থেকে গুণদীপের বুকে নিজের শরীরটাকে ছাড়তে ছাড়তে শিউলি বুঝতে পারল তার খুব ভালো লাগছে, যেন কতদিন বাদে নিজের নীড়ে ফিরে এসেছে আবার। ভাবনাটা হয়তো বেঠিক, কিন্তু কী যায় আসে তাতে? নিজের ভাবনার জালে জড়িয়ে ছটফটাতে চাইল না শিউলি। বরং দুহাতে গুণদীপের গলা জড়িয়ে টেনে নিল নিজের কাছে।

 

(চলবে)


সমস্ত পর্বের জন্য ক্লিক করুন: ছায়াপাখি – বিশ্বদীপ চক্রবর্তী