দেবাশিস্ ভট্টাচার্য
লেখক প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মী
এর আগের দুই পর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম, বিদ্যাসাগরের জীবন কর্ম ও চিন্তা কীভাবে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর জ্ঞান ও মানবতার আকাশে ডানা মেলতে পেরেছিল, এবং, তাঁর জীবনীকার ও গবেষকেরা বিষয়টিকে কীভাবে দেখেছেন। ধার্মিকেরা তাঁকে কীভাবে ধার্মিক বানাতে চেয়েছিলেন সেটা ওই আলোচনাসূত্রেই আমরা দেখেছিলাম। এবার, পরমেশ আচার্যের মত নিজেকে এলিট-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, র্যাডিক্যাল বাম হিসেবে হাজির করা গবেষকও যে কীভাবে বিদ্যাসাগরকে ধর্মাচ্ছন্ন সাব্যস্ত করার এই আশ্চর্য প্রকল্পে নিজেকে সামিল করতে পারেন, সেই মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করা যাবে।
এখানে আমরা শুধু পরমেশ আচার্য লিখিত এবং ‘অনুষ্টুপ’ প্রকাশিত “বাঙালি প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ” শীর্ষক গ্রন্থের প্রাসঙ্গিক অংশটুকুই বিবেচনা করব (৪, ‘প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ, পৃষ্ঠা ৯৩-১০৩), কারণ বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস সংক্রান্ত আলোচনা এখানেই রয়েছে। তবে, বলা দরকার, এ বইয়ে বিদ্যাসাগরের সমালোচনা শুধু এইটুকু মাত্রই নয়। বস্তুত, এ গ্রন্থে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকাটি বেশ দীর্ঘ ও গুরুতর। পরমেশ আচার্য একজন পরিচিত শিক্ষা-গবেষক, কাজেই অভিযোগগুলোর গুরুত্ব আছে। ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্নটি তো এখানে সবিস্তারে আলোচনা করবই, কাজেই সেই বিষয়টি বাদ দিয়ে বাকি অভিযোগগুলোর একটি নমুনা যদি পেশ করতে চাই, তো সেটা এই রকম হতে পারে— (১) বিদ্যাসাগর জনশিক্ষার প্রবর্তন করেননি, বরং আসলে জনশিক্ষার বিরোধিতা করেছেন। (২) তিনি এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন যাতে প্রাগৌপনিবেশিক জনশিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় এবং নবোদ্ভূত উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্তকুল (‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি) ঔপনিবেশিক প্রভুর সহযোগিতা করে সুখে কালাতিপাত করতে পারে। (৩) তিনি ‘আসল’ বাংলা থেকে লৌকিক এবং আরবি-ফারসি শব্দ তাড়িয়ে এবং তাকে সংস্কৃতগন্ধী করে তুলে বাংলার গ্রামীণ আমজনতার মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছেন। (৪) জনশিক্ষার প্রসারের বদলে তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জনশিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করা, এবং তিনি বই লিখে-ছাপিয়ে-বেচে প্রচুর টাকা করেছিলেন। (৫) তিনি বিস্তর ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছিলেন, এবং আয়কর দপ্তর পেছনে লাগলে আয়কর দপ্তরের কর্তাকে বাড়িতে ডেকে খাইয়ে দাইয়ে তোয়াজ করেছিলেন। (৬) তিনি তাঁর সরলমতি বন্ধু ও তাঁর বই ব্যবসার সহযোগী, কবি ও শিশুশিক্ষা-গ্রন্থপ্রণেতা মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ছলেবলে ব্যবসা থেকে হঠিয়ে নিজে গোটা ব্যবসাটা গিলে খেয়েছিলেন। এবং, এই রকম আরও সব। এ সব অভিযোগ প্রায় সবই দাঁড়িয়ে আছে নানা নড়বড়ে যুক্তি ও অনুমানের ওপরে, এবং অন্য অনেক লেখকই এ সব বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এর মধ্যে দুয়েকটি অভিযোগ শুনলেই কানে খট করে লাগে, বিনা পর্যালোচনাতেই।
যেমন, প্রথম দুটো অভিযোগ। বিদ্যাসাগর উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্তদেরকে বিলিতি শিক্ষায় শিক্ষিত করে ঔপনিবেশিক শাসকদের অনুগত দাসানুদাস করে তুলতে চেয়েছিলেন, এবং তিনি সে শিক্ষাকে মধ্যবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তাকে জনশিক্ষায় রূপান্তরিত হতে দিলেন না, এবং তিনিই নাকি আবার এই প্রক্রিয়ায় দেশীয় জনশিক্ষাকে ধ্বংস করে ফেললেন— এই অভিযোগগুলো একসঙ্গে উচ্চারণ করাটা বেশ অদ্ভুত নয় কি? তাঁর প্রবর্তিত শিক্ষা যদি মুষ্টিমেয় এলিটের জন্য প্রস্তুত শাসক-তোষণী শিক্ষাই হয়ে থাকে, তো সেটাকে তিনি সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়তে দেননি বলে এত হাহাকারই বা করতে হবে কেন (সে তো তাহলে একদিকে ভালোই হয়েছে), আর তাতে করে দেশীয় শিক্ষাই বা ধ্বংস হতে যাবে কেন? আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষা যদি ব্রিটিশ-সহযোগী মুষ্টিমেয় এলিটের উপযুক্ত শিক্ষাই হয়, তাহলে তাই দিয়ে তো আর গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন লেখালিখি-কেনাবেচা-জমিজমার কাজ চলবে না, কাজেই তখন তো দেশীয় আদিম শিক্ষাব্যবস্থা ভালোভাবেই টিকে থাকার কথা! অবশ্য, এর বিরুদ্ধে আইন করে পুলিশ লাগিয়ে বা গুণ্ডাবাজি করে হয়ত তা বানচাল করা সম্ভব। কিন্তু, বিদ্যাসাগরের প্ররোচনায় ব্রিটিশ পুলিশ এসে গ্রামীণ পাঠশালায় রেইড করছে, এমন আজব খবর আজ পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে জাত্যাভিমানী ইতিহাসবিদেরাও দিতে পারেননি। বস্তুত, নিছক স্বার্থের কথা ভাবলেও এমন সন্দেহ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, কারণ গ্রামীণ পাঠশালাগুলো বন্ধ হলে তাতে বিদ্যাসাগর বা ব্রিটিশ কারুরই বিশেষ কোনও লাভের সম্ভাবনা ছিল না, বরং স্বাভাবিক গ্রামজীবন ব্যাহত হলে যে অবাঞ্ছিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারত, ইংরেজরা তা না বোঝার মত নির্বোধ ছিল না। ফলত, গল্পটি সম্পূর্ণ আজগুবি, এবং ঐতিহাসিক তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত— বিদ্যাসাগরের সমসময়ে এবং তার পরেও গ্রামীণ পাঠশালাগুলো রমরম করেই চলত, যতদিন না সরকারি পয়সায় আধুনিক শিক্ষার স্কুল গ্রামে গ্রামে যথেষ্ট সংখ্যায় খোলা হয় (সে সব বিদ্যাসাগরের অনেক পরের গল্প, তবে বিদ্যাসাগরের দেখানো রাস্তাতে চলবারই গল্প)। তবু, প্রাগৌপনিবেশিক শিক্ষার ইতিহাস সংক্রান্ত অনেক বইতেই বুঝে বা না বুঝে ভারতের প্রাচীন গ্রামীণ বিদ্যালয়ের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকম বাড়িয়ে বলার একটি রীতি চালু আছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকের বাংলায় চালু গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের তরফে উইলিয়াম অ্যাডাম যে তিনটি মূল্যবান সমীক্ষা করেন ১৮৩৫ সাল থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত, তার ফলাফলের ওপরে কিছু জাত্যাভিমানী কারচুপি করে সাধারণত এই কর্মটি করা হয়, যা শ্রীআচার্য নিজেও অন্যত্র করেছেন। সে কারচুপির উন্মোচন খুবই চিত্তাকর্ষক, কিন্তু এখানে প্রাসঙ্গিক না।
শ্রীআচার্যের এই বইটির মধ্যে আরও এক আশ্চর্য ব্যাপার আছে। ঔপনিবেশিক প্রভুরা তাদের দখলদারির সুবিধের জন্য দেশীয় উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্তদেরকে বিলিতি শিক্ষা দিয়ে বশে রাখতে চেয়েছিল, এবং বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য বেশিরভাগ উনিশ শতকীয় বাঙালি শিক্ষাবিদেরা বিশ্বস্তভাবে সেই ভূমিকাই পালন করে গেছেন— এই ধারণাটিকে সামনে রেখে, এবং তথ্য-যুক্তি সহকারে এটিকেই প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে করতে, তিনি শেষে যেখানে গিয়ে পৌঁছন সেটা হল এই রকম যে, ব্রিটিশ কর্তারা বরং সরকারি পয়সায় শুধু উচ্চবর্ণদের বদলে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরাদি উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব নাকি প্রবল সংগ্রাম করে তাতে বাধা দিয়েছিলেন (শ্রীআচার্য খোদ ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষায় পরিষ্কার করে লিখেছেন, “The Bengali bhadralok fought tooth and nail against such a move”)! বেশ কথা, কিন্তু ঔপনিবেশিক প্রভুদের ষড়যন্ত্রের কাহিনির দশা তবে কী দাঁড়াল?ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী, প্রান্তিক-দরদী, সংগ্রামী শিক্ষাতত্ত্বের এই বুঝি অন্তিম দশা?
এইভাবেই, উনিশ শতকীয় সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদদের কাছা খোলার অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রবল উত্তেজনায় লেখক খেয়াল করেন না যে, ইতিমধ্যে তাঁর নিজের গবেষণার কাছাটি কখন যেন খুলে ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছে। তা সে যাই হোক, এই সব কথা নিয়ে আলোচনা করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয় (হয়ত পরে কখনও এ নিয়ে লেখার সুযোগ আসবে), এখানে শুধু কথা বলতে চাই বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাসের প্রসঙ্গ নিয়ে। তবু এই অভিযোগগুলো বলে রাখা শুধু এই কারণে যে, এই সমস্ত অভিযোগগুলোর মধ্যে দিয়ে লেখকের এক বিশেষ ‘মাইন্ডসেট’ বা মানসিক স্থিতি প্রকাশ পাচ্ছে। বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন কিনা সেই বিষয়ে তাঁর মতামত যখন আমরা পর্যালোচনা করব, তখন লেখকের এই বিশেষ ‘মাইন্ডসেট’ মাথায় রাখলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হবে বলে আমার ধারণা। এই অভিযোগগুলো ছাড়াও, এই ‘মাইন্ডসেট’ বুঝতে সাহায্য করবে লেখকের অতি বিশেষ ভাষা এবং ভঙ্গিটিও। কাজেই, সেটাও আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করব।
স্বভাবতই, প্রথমে আমরা সবিস্তারে বুঝে নিতে চাইব, লেখক শ্রীআচার্য এ ব্যাপারে ঠিক কী বলতে চান। সে জন্য আমরা তাঁর ‘আর্গুমেন্ট’-কে অনুসরণ করার চেষ্টা করব পুরোপুরিভাবে তাঁরই নিজস্ব ধারাবাহিকতা ও পরম্পরা মেনে (ঠিক-বেঠিক বিচারের কথা পরে)। আগেই বলেছি গোটা আলোচনাটি রয়েছে ৯৩ থেকে ১০৩ পাতার মধ্যে, কাজেই প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা করে আর তথ্যসূত্র দেব না। তাঁর ‘বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধের ‘বিদ্যাসাগরের ঈশ্বর ও বোধোদয়’ শীর্ষক অংশে তিনি প্রথমেই বলেন, এই যে বিদ্যাসাগর আস্তিক না নাস্তিক ছিলেন এই নিয়ে তিনি আদৌ মাথা ঘামাচ্ছেন, এর কারণ হল, ‘এর সঙ্গে অনেক বড়ো একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত’ আছে, যদিও সে রাজনৈতিক প্রশ্নের মধ্যে তিনি ওই মুহূর্তে ঢুকবেন না। তার পরই তিনি বিদ্যাসাগরের অন্যতম মূল জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, বিদ্যাসাগরের আচরণ ‘না পুরোপুরি হিন্দু, না পুরোপুরি ব্রাহ্ম’ হওয়ার জন্যই তাঁর ধর্মমত নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, এবং অনেকে তাঁকে ‘নাস্তিকও ঠাওরেছিলেন’। এর পর তিনি চণ্ডীচরণ লিখিত বিদ্যাসাগর-জীবনী থেকে আরও একটি লম্বা উদ্ধৃতি দিলেন, যেখানে রয়েছে বিদ্যাসাগর লিখিত শিশুপাঠ্য সাধারণ জ্ঞানের বই ‘বোধোদয়’-তে ঈশ্বরের উল্লেখ সংক্রান্ত সেই বিখ্যাত গল্পটি। সেটা এই রকম — বন্ধু এবং ব্রাহ্মনেতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞেস করলেন, শিশুপাঠ্য ‘বোধোদয়’-তে জানবার মত সব কিছুই আছে, কিন্তু ঈশ্বরের কথা নেই কেন? তাতে নাকি বিদ্যাসাগর হেসে উত্তর দেন, ‘যাঁহারা তোমার কাছে ঐরূপ বলেন, তাঁহাদিগকে বলিও, এইবার যে বোধোদয় ছাপা হইবে তাহাতে ঈশ্বরের কথা থাকিবেক।’ [পাঠক অনুগ্রহ করে উক্তিটি ভাল করে খেয়াল করবেন এবং স্মরণে রাখবেন, পরে কাজে লাগবে] ওই জীবনীগ্রন্থের ফুটনোটে চণ্ডীচরণ লিখেছেন, তিনি স্বয়ং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মুখেই এই কথোপকথনের কথা জেনেছিলেন [লক্ষ করবেন, মূল কথোপকথনটি কবে নাগাদ হল এবং তিনিই বা কবে নাগাদ শ্রীগোস্বামীর মুখ থেকে এটা শুনলেন তার সময়কালের কোনও আন্দাজ চণ্ডীচরণ দেননি, এবং লেখক শ্রীআচার্যও সে নিয়ে খোঁজখবর জরুরি মনে করেননি]। এই গল্পটি উদ্ধৃত করেই লেখক শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলেন, “চণ্ডীচরণের এই গল্প হাল-আমলের গবেষকদের কীরকম বোকা বানিয়েছে তা ভাবলেও হাসি পায়।”
কে বোকা বনলেন? কীভাবেই বা বনলেন? এর পর লেখক সেটা বোঝাতে প্রয়াসী হন— বিনয় ঘোষ, গোপাল হালদার, বদরুদ্দিন উমর, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি হাজির করতে করতে। তারও একটা বিবরণ এখানে অপরিহার্য, কিন্তু এটা লেখকের মত করে করতে গেলে স্থান ও সময়ের অপব্যয় হতে পারে। তাই এইটুকু নিজের মত করে নিজের ভাষায় সংক্ষেপেই সারব, যদিও, এর মধ্য দিয়ে যাতে লেখকের নিজের বক্তব্য ও অভিপ্রায়টুকু অবিকৃতভাবে উঠে আসে সে জন্য সচেষ্ট ও সতর্ক থাকব। উপরোক্ত বিদ্যাসাগর-গবেষকরা বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কে কী বলেছেন সেটা যেহেতু আগে সবিস্তারে আলোচনা করেছি, অতএব এ বিষয়টিতে সরাসরি প্রবেশ করবার প্রেক্ষাপটটি প্রস্তুতই আছে, এখানে তার পুনরাবৃত্তির আর প্রয়োজন নেই।
এখানে উপরোক্ত গবেষকদের যে সব উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলো সবই বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস বিষয়ক, তবে, এই বিশেষ ক্ষেত্রে সেগুলো সবই একটি বিশেষ টেক্সট-কে ঘিরে— সুবিখ্যাত সেই ‘বোধোদয়’— শিশুদের জন্য বিদ্যাসাগরের লেখা সাধারণ জ্ঞানের বই। আগে বলেছি, বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস বিষয়ে তাঁর জীবনীকার ও গবেষকেরা সবাই মোটেই এক সুরে রায় দেন নি। কেউ তাঁকে বলেছেন একেশ্বরবাদী (বিনয় ঘোষ), কেউ বলেছেন অজ্ঞেয়বাদী (অশোক সেন ও বদরুদ্দিন উমর), কেউ বলেছেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত অসম্ভব (গোপাল হালদার ও অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়)। তবে, সকলেই দুটো জিনিস মেনেছেন। এক, বিদ্যাসাগর কোনওমতেই এবং প্রচলিত কোনও অর্থেই সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী নন এবং ধর্ম জিনিসটা তাঁর কাছে এক নিতান্ত গৌণ ব্যাপার ছিল, এবং দুই, তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী, অর্থাৎ, ‘জীবে প্রেম’ করতে গেলে বিদ্যাসাগরের ‘সেবিছে ঈশ্বর’ জাতীয় অজুহাতের দরকার পড়ত না। কিন্তু, তিনি নাস্তিক ছিলেন কি ছিলেন না, এই প্রশ্নের খুব সহজ সরল উত্তর সম্ভব বলে কেউই মনে করেননি। আবার, কেউই প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতেও পারেননি, কারণ, মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারকের জীবন-চিন্তা-কর্ম সামগ্রিকভাবে অনুধাবন করতে গেলে তাঁর ধর্মবিশ্বাসের বিষয়টিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়াও কঠিন।
আর, এখানেই আসে ‘বোধোদয়’ বইটির প্রসঙ্গ। বইটি হল শিশুদের জন্য সাধারণ জ্ঞানের বই, সম্ভবত বাঙলা ভাষায় ওই ধরনের প্রথম বই। এখানে মনুষ্যদেহ, জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, সমাজ, অর্থনীতি, ভূগোল ইত্যাদি প্রায় সব কিছু সম্পর্কেই শিশুদের কাছে নানা তথ্য হাজির করা হয়েছে। এখানে বিদ্যাসাগর যেভাবে শিশুদের কাছে ঈশ্বরের কথা বলেছেন, সেটাই জন্ম দিয়েছে বহু প্রশ্ন ও কৌতূহলের, এবং বইটির বিভিন্ন সংস্করণে নানা বিচিত্র সংযোজন-বিয়োজন তাতে যোগ করেছে প্রবল বিভ্রান্তি। বিষয়টির মধ্যে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই জানা দরকার, বইটিতে বিদ্যাসাগর ঠিক কী লিখেছিলেন। বর্তমানে বিদ্যাসাগর রচনাবলিতে ‘বোধোদয়’ যেভাবে পাওয়া যায় (১৯, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৭), তাতে প্রথমেই আছে ‘পদার্থ’ শীর্ষক একটি ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদ, যাতে জগতের সব কিছুকেই ‘পদার্থ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, এবং তাকে মোটাদাগে ‘চেতন, অচেতন, উদ্ভিদ’ বলে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মতত্ত্বের মূলস্রোত যেখানে জগতকে ‘মায়া’ বলে মনে করে, সেখানে এ বইতে জগতের যে পদার্থময় কেজো লৌকিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা শিশুদের কাছে যে বস্তুবাদের বার্তাই বহন করে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, সমস্যার শুরু তার ঠিক পরেই, ‘ঈশ্বর’ শীর্ষক দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে। গবেষক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন (২১, পৃষ্ঠা ১৩), বর্তমানে চালু বিদ্যাসাগরের সব রচনাবলিতেই ‘বোধোদয়’ রচনাটি গ্রহণ করা হয়েছে তার ১০৫-তম সংস্করণ থেকে, এবং বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকতে ওটাই সর্বশেষ সংস্করণ। এখানে যা আছে তার পুরোটাই নিচে তুলে দিচ্ছি।
ঈশ্বর, কি চেতন, কি অচেতন, কি উদ্ভিদ, সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। এ নিমিত্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা বলে। ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্য স্বরূপ। তাঁহাকে কেহ দেখিতে পায় না; কিন্তু তিনি সর্বদা বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি, তিনি তাহা দেখিতে পান। আমরা যাহা মনে ভাবি, তিনি তাহা জানিতে পারেন। তিনি সমস্ত জীবের আহারদাতা ও রক্ষাকর্তা।
ধর্ম-অনীহ বিদ্যাসাগর ছোটদের পাঠ্যপুস্তকে এমন কথা লিখতে গেলেন কেন? তিনি কি তবে ভেতরে ভেতরে এসব বিশ্বাস করতেন, এবং কারুকে বলেন নি, কিন্তু শিশুদের কাছে ‘সত্যি’ কথাটা বলা উচিত মনে করলেন? অথবা, নিজে বিশ্বাস না করলেও, শিশুদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য ঈশ্বরবিশ্বাস অপরিহার্য মনে করলেন?অথবা মনে করলেন, ঈশ্বরপ্রসঙ্গ একটু না থাকলে শিশুপাঠ্য গ্রন্থ তার অভিভাবকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না? নাকি, অন্য কোনও ব্যাপার? এ প্রশ্ন ভাবিয়েছে অনেক গবেষককেই, এবং তাঁদের আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চণ্ডীচরণের বিদ্যাসাগর-জীবনীতে দেওয়া ওই উপরোল্লেখিত গল্পটি। তাঁরা যেভাবে গল্পটিকে ব্যাখ্যা করেছেন তা এই রকম। ‘বোধোদয়’-এর প্রথম সংস্করণে হয়ত বা বিদ্যাসাগর সত্যিই ঈশ্বর-প্রসঙ্গ রাখেন নি, কিন্তু স্নেহভাজন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন শিশুপাঠ্য বইতে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব নিয়ে অনুযোগ করলেন, তখনই তাতে সাড়া দিয়ে বিদ্যাসাগর দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ আমদানি করলেন। বিনয় ঘোষ ও বদরুদ্দিন উমর এই ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে আশ্বাস খুঁজতে চেয়েছেন এই তথ্যে যে, যখন বিদ্যাসাগর ঈশ্বর-প্রসঙ্গ আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখনও কিন্তু তিনি ‘পদার্থ’-কে ঈশ্বরের আগে রেখেছেন, যা একজন সত্যিকারের ঈশ্বরবিশ্বাসী কখনওই করবে না। গোপাল হালদার বলেছেন, ছাত্রপাঠ্য পুস্তকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ না থাকলে কর্তৃপক্ষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারত। এঁদের এইসব উক্তি উদ্ধৃত করে পরমেশ আচার্য বলতে চান, এঁরা সকলেই চণ্ডীচরণের ওই গল্পে ঠকে গেছেন। কেন? কীভাবে?
কারণ, শ্রীআচার্য আবিষ্কার করেছেন, আসলে ‘বোধোদয়’-এর প্রথম (১৮৫১) ও দ্বিতীয় (১৮৫২) দুটি সংস্করণেই ঈশ্বর হাজির ছিলেন পুরোমাত্রায়। সেখানে ‘পদার্থ’ নয়, ঈশ্বরই এসেছেন আগে, এবং শিশুদের জন্য রয়েছে ইশ্বরকে ভক্তি, স্তব ও প্রণাম করার উপদেশও। কাজেই, লেখক পরমেশ আচার্যের সিদ্ধান্ত, বিদ্যাসাগর নাস্তিক বা সংশয়বাদী হলে কিছুতেই এমন কথা বলতে পারতেন না। নাটকীয় মোচড়, সন্দেহ নেই। কিন্তু, তাহলে কি চণ্ডীচরণ বা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মধ্যে কেউ একজন ভিত্তিহীন বাজে গল্প রটিয়েছিলেন? উঁহু, ব্যাপার অতটাও সোজা নয়! এ কাহিনির দ্বিতীয় মোচড়টি হল, বইটির পঞ্চম সংস্করণে (১৮৫৬) ঈশ্বর-প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ চলে যায়, এবং অন্তত নবম সংস্করণ (১৮৫৭) পর্যন্ত সে অনৈশ্বরিক রূপ অক্ষুণ্ণ ছিল! পরবর্তীকালের ৯৬-তম সংস্করণে (১৮৬৮) এবং ১০৫-তম সংস্করণে (১৮৮৯) দেখা যায়, ঈশ্বর ফিরে এসেছেন, তবে তাঁর স্থান ‘পদার্থ’-এর পরে, এবং ঈশ্বরকে ভক্তি-স্তব-প্রণাম করার উপদেশও উধাও। সবই বিদ্যাসাগরের জীবিতকালে, কাজেই তিনি স্বয়ং এইসব পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। ঠিক কোন সংস্করণ থেকে ঈশ্বর ফেরত এলেন, সেটা কোনও গবেষকই এখনও জানাতে পারেননি।
কাজেই, লেখকের সিদ্ধান্ত, বিদ্যাসাগর একজন পরমবিশ্বাসী মানুষ হিসেবেই তাঁর বইতে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ রেখেছিলেন, কিন্তু শিক্ষা সংক্রান্ত তৎকালীন দুই গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘উড’স ডেসপ্যাচ’ (১৮৫৪) এবং ‘স্ট্যানলি ডেসপ্যাচ’ (১৮৫৯) অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নেওয়ায়, বইখানি সরকারি রোষে পড়তে পারে এই ভয়ে তিনি ওখান থেকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ প্রত্যাহার করেন। ব্রিটিশ সরকারের এই নীতি যেহেতু সিপাহী বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে (“বিদ্রোহের সঙ্গে ধর্মীয় প্রশ্ন জুড়ে যাওয়ায়”), অতএব বিদ্রোহ কেটে যাবার অনেক পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে এলে আবার যথাসময়ে ঈশ্বর শিশুপাঠ্যে ঢুকে যান। এবার তাহলে পরের সিদ্ধান্তটুকু স্বয়ংক্রিয়— বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বিজয়কৃষ্ণের কথোপকথনটি হয়েছিল ঠিক এই সময় নাগাদই, আর চণ্ডীচরণ তা বিজয়কৃষ্ণের কাছে শুনেছিলেন আরও পরে কোনও এক সময়ে। কিন্তু বিদ্যাসাগর যদি ঈশ্বরেই বিশ্বাস করবেন, তো তবে বেদান্ত-সাংখ্য-নব্যন্যায়ের মত হিন্দু দর্শনের নানা ধারাকে অসার ও অপদার্থ বলে ঘোষণা করলেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু মিশন-ঘনিষ্ঠ ধার্মিক গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং প্রান্তিক-দরদী বাম-র্যাডিক্যাল পরমেশ আচার্যের কাছে হুবহু একই— ওগুলোতে অবিশ্বাস করেও কেউ ঈশ্বরবিশ্বাসী হতে পারেন। কিন্তু কীভাবে? এর পেছনে যে ব্যাখ্যা শ্রীবসু দিয়েছিলেন তার দশা আমরা আগে দেখেছি, আর এ প্রশ্নে শ্রীআচার্যের আশ্চর্য আচরণ একটু পরেই দেখব। কিন্তু তার আগে বলা দরকার, বিদ্যাসাগরের ‘ঈশ্বরবিশ্বাস’-এর এই নিদর্শন কিন্তু শ্রীআচার্যের মনে কোনও সন্দেহ বা সংশয় বা বিস্ময়ের জন্ম দেয়নি, কারণ বিদ্যাসাগরের চরিত্র তিনি নিজে যা বোঝেন তার সঙ্গে এর কোনও অসঙ্গতি নেই। “গলায় পৈতা, শাস্ত্র মেনে বাপ-মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি করা, হিন্দুর অভক্ষ্য না খাওয়া, চিঠিপত্রের মাথায় ঠাকুর দেবতার নাম”— এইসব যাঁর কাজ, তাঁর তো ঈশ্বরবিশ্বাসী হবারই কথা, শ্রীআচার্যের বক্তব্যটা এই রকম। বরং, গোপাল হালদার এবং বদরুদ্দিন উমর যেভাবে এগুলোকে বিদ্যাসাগরের সামগ্রিক জীবন ও কর্মের সাপেক্ষে তুচ্ছ বিষয় বলে মনে করেছেন, তাতে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তিনি মনে করেন, আজকের যে কমিউনিস্টরা মুখে নাস্তিক কিন্তু কাজে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তাঁরা বিদ্যাসাগরেরই উত্তরাধিকারী। তাঁর কথা নিচে হুবহু উদ্ধৃত করছি।
এ, এক অদ্ভুত বিচার। আচার–আচরণটা কিছু নয়, বড়ো হল মুখে কি বলেছে বা কে কোথায় কি বলেছে তাও সবই পরের মুখে ঝাল খাওয়া। আজকেও অনেক গলায় পৈতে, মুখে নাস্তিক কমিউনিস্ট দেখা যায়। তাদের আর দোষ কি! তারা তো একই উত্তরাধিকার বয়ে চলেছে।
বিদ্যাসাগরের ঈশ্বরবিশ্বাস বিষয়ে পরমেশ আচার্য কী বলতে চান, সেটা বোধহয় মোটামুটি অবিকৃতভাবে বিবৃত করা গেল। এখন, এর ঠিক-বেঠিকের বিচারে যাবার আগে একটু ভাল করে দেখে নিই, শ্রীআচার্য ঠিক কী ধরনের ভাষা ও ভঙ্গিতে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে সেটাও খুব প্রাসঙ্গিক, আগে বলেছি। কাজেই, এখন কয়েকটি ছোট-বড় উদ্ধৃতি দেবার দরকার পড়বে। অন্যান্য খ্যাতিমান বিদ্যাসাগর-গবেষকদের সম্পর্কে তিনি যে ধরনের কড়া ভাষা প্রয়োগ করেছেন, তা একই সঙ্গে বিস্ময় এবং কৌতুক জাগিয়ে তোলে। তার কিছু নমুনা এখানে রাখা যাক।
হাল–আমলের নামকরা বিদ্যাসাগর–গবেষকরা বিদ্যাসাগরের ধর্মমতের আপাতরহস্যে হাবুডুবু খেয়ে শেষ পর্যন্ত চণ্ডীচরণের এই গল্পে হালে পানি পেয়েছেন। বিনয় ঘোষ এদের অন্যতম। বদরুদ্দিন উমরও বিনয় ঘোষের পেছন পেছন একই নাও–এ ঠাঁই নিয়েছেন। চালাক বটে গোপাল হালদার, তিনিও শেষ পর্যন্ত বিনয় ঘোষের নৌকাতেই উঠেছেন, তবে জল ছোঁননি।
.
কেন যে এরা নিজেদের নামী নাম সব জায়গায় ধার দেন! সে কি শুধু নামের মোহ!
.
তথ্যের ভিত কাঁচা থাকলে তত্ত্বের ফানুস ফুটো হতে কতক্ষণ। বাঙালি বুদ্ধিজীবী বিশেষ করে প্রগতিশীল বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বের আস্ফালন বড়ো বেশি, সেই তুলনায় তথ্যের তহবিলদারির ক্ষমতা বড়ো কম।
.
বিদ্যাসাগর নাস্তিক হলে এইসব গবেষকদের ছকে বড়ো ভাল মানাত। তাই টেনেহিঁচড়ে নাস্তিক না–হোক সংশয়বাদী, নিদেনপক্ষে রিয়ালিস্ট না বানালে চলে না যে! কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের পর যিনি বিদ্যাসাগরকে পুরোপুরি নাস্তিক বলেছেন তিনি রাধারমণ মিত্র। অশোক সেন অতটা সাহস করেন নি, ‘অ্যাগনস্টিক’ বা সংশয়বাদী বলে ছেড়ে দিয়েছেন।
বোঝা যায়, ভাষা ও ভঙ্গির মধ্যে অগবেষকোচিত কিছু বাড়তি উৎসাহ আছে, কখনও যা প্রায় উন্মত্ততার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। সে উন্মত্ততাকে বেশ বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়, যখন এ আলোচনার শেষের দিকে এসে লেখক অভিযোগ করেন যে, বিদ্যাসাগরকে প্রগতিশীল বানাবার তীব্র তাড়নায় নাকি প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যাসাগরের শিশুপাঠ্য দুটি বই ‘বর্ণপরিচয়’ এবং ‘বোধোদয়’-এর পুরোনো সংস্করণগুলো ইচ্ছে করেই খুঁজে বার করছেন না, এবং এমন কি, যেখানে পুরোনো সংস্করণ আছে সেখানে বইয়ের পাতাও ছিঁড়ে দিচ্ছেন!
এখন, লেখক পরমেশ আচার্যের বক্তব্য-ভাষা-ভঙ্গি সবকিছুর বিবরণ দেবার পরে, এবার হয়ত আমরা তার ঠিক-বেঠিকের বিচারে অগ্রসর হতে পারি। এখানে প্রথমেই দুটো জিনিস লক্ষ করবার আছে। এক, লেখক শ্রীআচার্যের অভিপ্রায়টি, যেখানে অন্য গবেষকদের সঙ্গে তাঁর এক মৌলিক পার্থক্য আছে। অন্যরা যেখানে বিদ্যাসাগরের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাকে মেনে নিয়ে তাঁর ধর্মবিশ্বাসটিকে তাঁর কথাবার্তা আচার আচরণ কাজকর্ম থেকে ছেনে বার করতে চান (এবং কখনও বা তার অসম্ভাব্যতা জ্ঞাপন করতে চান), সেখানে শ্রীআচার্য তাঁর নাস্তিকতার দাবিকে নস্যাৎ করতে চান তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করবার উদ্দেশ্যেই। অন্যদের কাছে বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাসের স্বরূপ নির্ণয় একটি দার্শনিক ‘টাস্ক’, এবং সেইহেতু অনেকটাই টেকনিক্যাল, কিন্তু শ্রীআচার্যের কাছে তা বিদ্যাসাগরের ধর্মনিরপেক্ষ মানবাতাবাদী ভাবমূর্তিকে নস্যাৎ করবার রাজনৈতিক হাতিয়ারমাত্র। এবং দুই, এখানে এভাবেই বোঝা যায়, কেন তিনি এ আলোচনার শুরুতেই বিদ্যাসাগরের নাস্তিকতার প্রশ্নটিকে রাজনৈতিক বলে ভেবেছেন (যদিও ব্যাখ্যায় প্রবেশ করতে চাননি)। ওপরে দেওয়া শেষ উদ্ধৃতিটি আবারও স্মরণ করুন, “বিদ্যাসাগর নাস্তিক হলে এইসব গবেষকদের ছকে বড়ো ভাল মানাত। তাই টেনেহিঁচড়ে নাস্তিক না–হোক সংশয়বাদী, নিদেনপক্ষে রিয়ালিস্ট না বানালে চলে না যে!” তিনি বলেছেন, সব বিদ্যাসাগর-গবেষকেরই একটি ছক আছে যার খুঁটিনাটি আলাদা কিন্তু মোদ্দা গড়নটি একই — “এই ছকগুলির গড়ন অনেকটা ‘অন্ধকার হতে আলোর পথযাত্রী’ গোছের”। বোঝা যায়, বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাসের কোনও নিখুঁত দার্শনিক সূত্রায়ন আদৌ তাঁর অভীষ্ট নয়, তিনি চান‘অন্ধকার হতে আলোর পথযাত্রী’ ছকটিকেই নস্যাৎ করতে। বলা বাহুল্য, একে তিনি এক ধরনের রাজনীতি হিসেবেই দেখছেন, এবং তার বিরোধিতা করে একটি পাল্টা রাজনৈতিক অবস্থান নিতে চাইছেন। মিশন-ঘনিষ্ঠ ধার্মিক বুদ্ধিজীবী শঙ্করীপ্রসাদ বসুর বিদ্যাসাগর-চর্চার মধ্যেও এ ধরনের ‘রাজনীতি’-র আভাস চোখে পড়ে, কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ ব্যাপারে শ্রীআচার্য ও তিনি একা নন। ‘আরএসএস’-এর বাংলা মুখপত্র ‘স্বস্তিকা’-ও একই কারণে, এবং এই একই যুক্তিতে, বিদ্যাসাগরের অধার্মিক নির্মাণের ‘পরিকল্পিত মিথ্যাচার’-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছে (২২)। তার তথ্য-যুক্তি বা বাংলা বানান বা বাক্যগঠনের বহর ওই ধরনের পত্রিকায় যেমনটি হওয়া উচিত ঠিক তেমনই, কাজেই সে নিয়ে বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন নেই (লেখকের নামের আগে ‘ডঃ’ আছে, বলা বাহুল্য)। কিন্তু লক্ষণীয়, বিদ্যাসাগরের অধার্মিক নির্মাণের ‘পরিকল্পিত মিথ্যাচার’-এর বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াতে চান যে যে যুক্তির ওপর ভর করে, সেগুলোর থেকে শ্রীআচার্য বা শ্রীবসুর যুক্তিগুলো মোটেই খুব দূরে নয়। ‘বোধোদয়’-এ ঈশ্বর-প্রসঙ্গ, সাংখ্য-বেদান্ত অস্বীকারের মধ্যেও ঐশ্বরিক সম্ভাবনা টিঁকে থাকা, ইত্যাদি।
এ যদি শ্রীআচার্যের ‘রাজনৈতিক’ অভিপ্রায় হয়, তো এবার তাঁর যুক্তি-তর্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করা যাক। ‘বোধোদয়’-এর প্রথম দুটি সংস্করণে যে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ ভালভাবেই ছিল, তাঁর তরফে এ সত্য উদ্ঘাটন মূল্যবান বইকি (কোথা থেকে ওই অতি বিরল সংস্করণ দুটি পেলেন সে সূত্র তিনি উদ্ঘাটন না করলেও, অন্য কোনও গবেষক এখনও পর্যন্ত এর প্রতিবাদ করেননি)। কিন্তু, এ নিয়ে পূর্ববর্তী গবেষকদের ভুলকে তাচ্ছিল্যভরা বিদ্রূপে ভরিয়ে দেবার পরে, তিনি নিজে এ থেকে যে সিদ্ধান্তে এলেন, সেটাই বা কতদূর যৌক্তিক? একটু খতিয়ে দেখা যাক।
‘বোধোদয়’-এ ঈশ্বরের আসা, যাওয়া এবং আবার ফিরে আসার কোনও বিকল্প ব্যাখ্যা হতে পারে কি? গবেষক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রামাণ্য প্রকাশনার সূত্রনির্দেশ করে দেখিয়েছেন (২১, পৃষ্ঠা ১৩), ‘বোধোদয়’-এর শুরুতে ঈশ্বর সংক্রান্ত বাক্যগুলো আসলে ১৮৩৮ সালে ইংল্যান্ড থেকে ‘চেম্বার্স’ নামক সংস্থা দ্বারা প্রকাশিত ‘দ্য রুডিমেন্ট্স্ অফ নলেজ’ বইয়ের কতিপয় বাক্যের অনুবাদ মাত্র। ‘বোধোদয়’-এর মালমশলা নানা জায়গা থেকে সংকলন করা হয়েছিল, এটি তারই অন্যতম। অতএব, এমন হতে পারে যে, বিদ্যাসাগরের মত ব্যস্ত মানুষ বহু পরিশ্রমে নানা জায়গা থেকে বিস্তর বাছাবাছি করে উপযুক্ত মালমশলা সংগ্রহ, সঙ্কলন ও তার শিশুবোধ্য অনুবাদ খাড়া করার পর সময়ের দাবিতে তা দ্রুত প্রকাশ করে দিয়েছিলেন, তাতে ঈশ্বর থাকলেন কি গেলেন সে নিয়ে আর মাথা ঘামানোর সময় পাননি। তবে কয়েকটি সংস্করণ বেরিয়ে যাবার পরে, এক ফাঁকে হাতে কিছুটা সময় পেলে হয়ত তিনি একে সম্পাদনা করে আরও ধর্মমুক্ত ও বৈজ্ঞানিক রূপদান করতে চেয়েছিলেন, এবং সেই সময়েই ঈশ্বর-প্রসঙ্গ পুরোপুরি বাদ দিয়েছিলেন, এবং তা চলেও ছিল বেশ কিছুদিন। এভাবে ভাবলে দেখা যায়, ‘বোধোদয়’-এ ঈশ্বরের যাওয়া এবং আসার বিকল্প ব্যাখ্যা সম্ভব অবশ্যই।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যাখ্যা কি শ্রীআচার্যের ব্যাখ্যার থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য? হ্যাঁ, আমার মতে তাইই। কারণ, প্রথমত, আমার ব্যাখ্যাটি অপেক্ষাকৃত সরল। এবং দ্বিতীয়ত, এর চেয়েও অনেক বড় কথাটা হচ্ছে, শ্রীআচার্যের ব্যাখ্যাটি একান্ত উদ্ভট ও অসম্ভব। বিদ্যাসাগরের মত তেজস্বী ব্যক্তি রাজরোষের ভয়ে ওইভাবে বইয়ের বিষয়বস্তু পাল্টাতে আদৌ রাজি হতেন কিনা সে প্রশ্ন যদি বাদও দিই, তাতেও থেকে যায় আরও মোক্ষম সব প্রশ্ন। প্রথমত, ১৮৫৯ সালের ‘স্ট্যানলি ডেসপ্যাচ’-এর প্রসঙ্গটিই এখানে সম্পূর্ণ অবান্তর, যেহেতু ১৮৫৯ সালের নির্দেশিকা কিছুতেই ১৮৫৬ সালের একটি বইয়ের বিষয়বস্তু-পরিবর্তনের কারণ হতে পারেনা। দ্বিতীয়ত, ১৮৫৪ সালের ‘উড্’স্ ডেসপ্যাচ’ যদি বা ১৮৫৬ সালের ‘বোধোদয়’ সংস্করণের বিষয়বস্তু-পরিবর্তনের কারণ হলেও হতে পারে, কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের চাপে ১৮৫৪ সালের শিক্ষা-দলিল কিছুতেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি নিতে পারেনা। বোঝা যায়, হুঁশিয়ার তথ্য-তবিলদারের চোখে ওই সময়ে একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। কিন্তু, এর পরেও যে আবার গোলমাল! ‘উড্’স্ ডেসপ্যাচ’-এ কি বাস্তবিকই ধর্মনিরপেক্ষতার এতটাই বাড়াবাড়ি ছিল, যাতে শিশুদের প্রতি ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ ঈশ্বরকে ভক্তি ও স্তব করার উপদেশ দিলে তার ঠেলায় পাঠ্যপুস্তক বাতিল হয়ে যেতে পারে? বলা বাহুল্য, এও এক আদ্যন্ত উদ্ভট যুক্তি। ঈশ্বর সম্পর্কে এই ধরনের প্রাথমিক কথাবার্তার সঙ্গে তো হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান কারুরই সেভাবে কোনও বিরোধ হবে না, তাতে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত বোধ করতে যাবে কেন খামোখা? এখানে শিক্ষাবিদ আচার্য মহাশয় একটি রেফারেন্স দিয়েছেন, সেটিও বেশ গোলমেলে (৪, পৃষ্ঠা ১১৫, টীকা নং ৩০ দ্রষ্টব্য)। এই একই টীকায় একাধিক গোলমাল আছে, কিন্তু এখানে শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক গোলমালটার কথাই বলব। তিনি প্রাসঙ্গিক আলোচনা আছে এ রকম একটি বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছেন, যার লেখকের নামটি ভুল। বইটির নাম ‘Vernacular Education in Bengal from 1813 to 1912’, লেখকের নামটি তিনি দিয়েছেন H. A. Stak, যদিও আসলে হবে H. A. Stark। এ ধরনের ভুলকে সাধারণত ছাপার ভুল বলে ধরে নেওয়াই উচিত, কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, গোলমাল শুধু এখানে না। বইয়ের যে পৃষ্ঠাটি তিনি নির্দেশ করেছেন সেখানে আছে ১৮৫৯-এর ‘স্ট্যানলি ডেসপ্যাচ’ নিয়ে আলোচনা। ১৮৫৯-এর শিক্ষানীতির ফলে ১৮৫৬-তে কোনও বইয়ের বিষয়বস্তু বদলাতে পারেনা, বলাই বাহুল্য। ফলত, ১৮৫৬ সালে ‘বোধোদয়’-এর পঞ্চম সংস্করণে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ কেন বাদ গেল সে ব্যাপারে এই রেফারেন্স সম্পূর্ণ অবান্তর। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ জিনিসটা ‘উড্’স্ ডেসপ্যাচ’-এ (১৮৫৪) ছিল বটে, তবে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার কোনও প্রামাণ্য ইতিহাসেই একে ওই দলিলের খুব গুরুত্বপূর্ণ বা প্রধান বিষয় বলে দাবি করা হয়নি। এই দলিলকে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ‘ম্যাগনা কার্টা’ নাম দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, কিন্তু সেটা তার ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য নয়। পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা, সরকারি শিক্ষাদপ্তর স্থাপন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, সর্বজনীন শিক্ষা, নারীর শিক্ষা এইসব কারণে একে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু, শিশুপাঠ্য বইতে যৎসামান্য ঈশ্বর-প্রসঙ্গ থাকলেই সে বই বাতিল করে দেওয়া হবে, এতবড় ভয়ঙ্কর ধর্মনিরপেক্ষতা মোটেই ব্রিটিশ প্রশাসনের ছিল না।
এবং, সমস্যার এখানেও শেষ নয়। যিনি ১৮৫০ সাল থেকে হিন্দু ধর্মতত্ত্বের অসারতা এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা-কর্তাদের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে আসছেন, তাঁর আবার ঈশ্বরবর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ শিশুপাঠ্য গ্রন্থ লেখার জন্য ১৮৫৪ সালের ‘উড্’স্ ডেসপ্যাচ’-এর নির্দেশিকা আদৌ লাগবে কেন? তিনি শিশুদের জন্য ঈশ্বরবর্জিত বই লিখবেন, এটাই তো স্বাভাবিক! এ প্রশ্নের সামনে পড়ে শিক্ষাবিদ পরমেশ আচার্য জানান, সাংখ্য আর বেদান্তকে মিথ্যে মনে করলেও নাকি ঈশ্বরবিশ্বাসী হওয়া যায়। কীভাবে? এ যুক্তি শঙ্করীপ্রসাদ বসুও দিয়েছিলেন, এবং তিনি অন্তত তার সপক্ষে একটি নড়বড়ে তর্ক খাড়া করেছিলেন, আমরা আগে দেখেছি। আর, এই একই প্রশ্নের সামনে পড়ে শ্রীআচার্য করলেন এক আশ্চর্য কীর্তি। তিনি এখানে শব্দের গায়ে ওপর দিক ঘেঁষে ছোট্ট একটি নম্বর সেঁটে প্রশ্নটিকে পাঠিয়ে দিলেন ফুটনোটে (৪, পৃষ্ঠা ১১৪, টীকা নং ২৮ দ্রষ্টব্য)। ভাবখানা এইরকম, এ সব তুচ্ছ কথা এখানে আর কী বলব, ওখানে গিয়ে দেখে নাও বরং। আর, ফুটনোটে লেখা রইল—“বিদ্যাসাগর কোন প্রসঙ্গে কেন সাংখ্য বেদান্তকে ভ্রান্ত বলেছিলেন এবং এ কথার গুরুত্ব কতখানি সে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। এ–বিষয়ে আলাদা প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে। আমার ধারণা এযাবৎ যেভাবে এ উক্তিটিকে দেখা হয়েছে তা ঠিক নয়।” বুঝহ গুণিজন, যে জান সন্ধান!
তাহলে আমাদের এবার যেতে হয় পরের অবধারিত প্রশ্নে— ঈশ্বর মহাশয় তবে ‘বোধোদয়’ থেকে বাদ পড়েও আবার ঢুকলেন কীভাবে? ঠিক কবে যে ঢুকলেন, সেটা জানতে পারলে এর উত্তরটা খুঁজতে সুবিধে হত নিশ্চয়ই, কিন্তু তা যখন জানা নেই তখন অনুমান ছাড়া উপায়ও নেই। চণ্ডীচরণের বিখ্যাত গল্পটি পড়ে সবাই যা বোঝেন, সেটা সহজ সরল হলেও, নিশ্চিতভাবে ভুল। কেউ একজন আবদার করলেই বা বিদ্যাসাগরের মত মানুষ হঠাৎ তাঁর বইয়ের বিষয়বস্তু পালটে দেবেন কেন, সে যতই স্নেহভাজন হোক! বিজয়কৃষ্ণ এসে বললেন আর বিদ্যাসাগর সঙ্গে সঙ্গে তাই করে ফেললেন, এ একদমই অসম্ভব। কিন্তু সেই জন্যে আবার অনেকে যেমন ঘটনাটিই সন্দেহজনক বলে উড়িয়ে দেন, আমি তা অনিবার্য বলে মনে করিনা। বরং আমার মনে হয়, বিজয়কৃষ্ণ ও চণ্ডীচরণ উভয়েই প্রকৃত ঘটনা নিখুঁতভাবে বিবৃত করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ঠিক যা বলেছিলেন সেটা স্মরণ করলে এক অদ্ভুত তাৎপর্যের আভাস পাওয়া যায়। তিনি যদি বিজয়কৃষ্ণকে বলতেন, আচ্ছা তাই করে দেব, বা ঠিক আছে বাপু ভেবে দেখব, তাহলে ওটা একটি তুচ্ছ ও মামুলি কথামাত্র হত। কিন্তু তিনি বললেন, “যাঁহারা তোমার কাছে ঐরূপ বলেন, তাঁহাদিগকে বলিও, এইবার যে বোধোদয় ছাপা হইবে তাহাতে ঈশ্বরের কথা থাকিবেক।” এবং, তা কাজেও করে ফেললেন। এমনটা ঘটতে পারে, একমাত্র যদি বিদ্যাসাগর এ ব্যাপারে আগে থেকে মনস্থির করে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি তা করবেন, আদৌ? এর সম্ভাব্য উত্তর হয়ত বা আছে ওই “যাঁহারা তোমার কাছে ঐরূপ বলেন, তাঁহাদিগকে বলিও” কথাংশটির মধ্যেই। এর অর্থ হচ্ছে, বিদ্যাসাগর মনে করছেন, এ কেবল বিজয়কৃষ্ণের ব্যক্তিগত আবদার নয়, এর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে ‘বোধোদয়’-এর নিরীশ্বরতা বিষয়ে কোনও প্রভাবশালী চক্রের অসন্তোষ। তিনি তাঁর উত্তরের মধ্য দিয়ে হয়ত বলছেন, আমি জানি যে কারা এ সব বলছে, কিন্তু তারা আমার আধুনিক শিক্ষা গড়বার বিরাট স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না, কারণ তাদের মুখ কীভাবে বন্ধ করতে হয় সে আমি জানি। তারা কারা, আজ আর তা নির্দিষ্টভাবে জানার উপায় নেই, তবে অনুমান তো চলেই। শোনা যায়, ‘বোধোদয়’-তে ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ ঈশ্বরের উপস্থিতিও নাকি গোঁড়া হিন্দুদের খুশি করতে পারেনি। স্বয়ং বিবেকানন্দ এ নিয়ে বিদ্রূপ করেছিলেন, এবং এ সব বই শিশুশিক্ষায় কাজে লাগবে না বলে মত প্রকাশ করেছিলেন (সেটা যদিও অনেক পরবর্তীকালের ব্যাপার, তবু তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিদের মনোভাব তাতে ঠিকঠাকই প্রতিফলিত হওয়ার কথা)। ওই যৎসামান্য ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ ঈশ্বর-টুকুও বর্জিত হলে যে হিন্দু সমাজপতিরা ওর চেয়ে বেশি খুশি হবেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এ ছাড়াও, সমস্যা ছিল আর এক দিক থেকেও। জন মার্ডক বলে একজন খ্রিস্টান মিশনারি ‘বোধোদয়’-এর নিরীশ্বরবাদিতাকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, এবং এ ধরনের নাস্তিক বই শিশুদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করবে অতএব এগুলোকে বাতিল করা উচিত, এই মর্মে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রবলভাবে দরবার করেছিলেন (বিস্তারিত আলোচনার জন্য রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘বিদ্যাসাগরের ‘চূড়ান্ত বস্তুবাদ’ আর না-ধর্মীয় ভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধ দেখুন, ৯, পৃষ্ঠা ১৫-২৩)। তিনি তাঁর প্রচার পুস্তকগুলো লেখেন ১৮৭২ সাল নাগাদ, অতএব ১৮৫৬ থেকে শুরু হয়ে ‘বোধোদয়’-এর নাস্তিক সংস্করণগুলো ওই সময় পর্যন্ত বাজারে ছিল এ অনুমান করা যেতে পারে, যেটা মোটেই তামাশার ব্যাপার নয়। তিনি ব্যর্থ হন, কারণ কর্তৃপক্ষ মনে করেছিলেন, তিনি বোধহয় আসলে নিজের নিকৃষ্ট শিশুপাঠ্যগুলো চালাতে চান বলে বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু, তিনি ব্যর্থ হলেও, এর জের হিসেবে মিশনারি মহলের অন্দর থেকে কোনও গোপন চাপ প্রভাবশালী কোনও ব্রিটিশ কর্তার হাতফেরতা হয়ে বিদ্যাসাগরের কাছে পৌঁছেছিল কিনা, এ সম্ভাবনাকে আজ পুরোপুরি স্বীকার বা অস্বীকার কোনওটাই করা অসম্ভব। ফলত, চাপের সম্মুুখীন হয়ে বিদ্যাসাগর ঈশ্বরকে আবার ফিরিয়ে আনলেন, কিন্তু তাকে ‘পদার্থ’ অনুচ্ছেদের পরে বসালেন, এবং স্তব ও ভক্তির উপদেশ বাদ দিয়ে দিলেন– এ অনুমান হয়ত খুুুব অযৌক্তিক নয়।
এত কিছুর পরেও এটা অনস্বীকার্য যে, পরমেশ আচার্যের অবস্থানের অযৌক্তিকতা ও অসম্ভাব্যতা প্রতিপন্ন করা গেলেও, এতেও বিদ্যাসাগরের ধর্মমত সংক্রান্ত সব তথ্যের ব্যাখ্যা হল এমন দাবি অসম্ভব (সে প্রচেষ্টা এখানে করছিও না, গোড়াতেই বলে নিয়েছি)। এর পরেও বিদ্যাসাগর লিখিত বিভিন্ন শিশুপাঠ্যে নানা গৌণ স্থানে ঈশ্বরের নানা টুকরো উপস্থিতি পাওয়া যাবে, নানা উক্তি-আচরণ-স্মৃতিকে এর সঙ্গে মসৃণভাবে জোড়া যাবে না, সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না, এবং হয়ত, নতুন তথ্য বা নথি আবিষ্কৃত হয়ে বর্তমানের সব ধ্যানধারণাই ওলটপালট করে দেবে। ইতিহাস তো আমাদের কাছে এই অনিশ্চয়তা ও অজ্ঞেয়তাটুকু সব সময়েই দাবি করে, তবু সৎ অনুসন্ধানটা চালিয়ে যেতে হয় ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়েই। বিদ্যাসাগরের ধর্মমত যেটুকু নিশ্ছিদ্র তথ্য-যুক্তি দিয়ে নির্মাণ করতে পারব, এটুকু তো অন্তত বলতে পারব যে, আমি এখন পর্যন্ত এইটুকু জেনেছি। যেখানে অসঙ্গতি পাওয়া যাবে, সেখানে তথ্যের উৎস-সন্ধান ও যুক্তিবিচারের তীব্রতা বাড়িয়ে তার মোকাবিলা করতে হবে। যেখানে অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও অসঙ্গতি দূর করতে পারা গেল না, সেখানে স্বীকার করতে হবে, সমস্যা আছে। হয়ত তথ্যের অভাব, বা আমারই যুক্তি-প্রয়োগের সমস্যা, বা তাঁর নিজেরই কোনও অসঙ্গতি। যে উত্তর পেয়েছি সেটা বলব, যেটা পাইনি সেটা বলব, যেখানে ধোঁয়াশা সেটাও বলব। কিন্তু, নিজেকে র্যাডিক্যাল প্রান্তিক-দরদী সাজাবার জন্য হাবিজাবি যাহোক একটা যুক্তি খাড়া করে বিদ্যাসাগরকে রক্ষণশীল বামুন পুরুত সাজাতে হবে, এ এক অতি নিকৃষ্ট প্রকল্প।
শেষে হয়ত আবারও ঘুরে আসবে সেই একঘেয়ে প্রশ্নটাই— এত কথার শেষে ঠিক কী দাঁড়াল তবে, বিদ্যাসাগর আস্তিক ছিলেন না নাস্তিক ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর এক একজন গবেষক একেকরকমভাবে দিয়েছেন। একটু আগেই যা বলেছি তার প্রায় পুনরাবৃত্তি করে বলি, কেউ তাঁকে বলেছেন পুরোপুরি আস্তিক, কেউ ব্যক্তিগত একেশ্বরবাদী, কেউ বলেছেন অজ্ঞেয়বাদী, কেউ বলেছেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত অসম্ভব, আবার কেউ বলেছেন, “আস্তিক আর নাস্তিক-এর মধ্যে এক ধূসর এলাকায় তাঁর অবস্থান” (২০, পৃষ্ঠা ১৯৪, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘বোধোদয়-এ ঈশ্বর’ শীর্ষক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। তবে, প্রায় সকলেই দুটো জিনিস মেনেছেন। এক, বিদ্যাসাগর কোনওমতেই এবং প্রচলিত কোনও অর্থেই সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী নন এবং ধর্ম জিনিসটা তাঁর কাছে এক নিতান্ত গৌণ ব্যাপার ছিল, এবং দুই, তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী, অর্থাৎ, ‘জীবে প্রেম’ করতে গেলে বিদ্যাসাগরের ‘সেবিছে ঈশ্বর’ জাতীয় অজুহাতের দরকার পড়ত না (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘বিদ্যাসাগর : ধর্ম ও রাজনীতি’, ২৩, পৃষ্ঠা ৩০-৪৪)। কিন্তু, তিনি নাস্তিক ছিলেন কি ছিলেন না, এই প্রশ্নের খুব সহজ সরল উত্তর সম্ভব বলে কেউই মনে করেন নি। তবু, আমার মত তুচ্ছ লেখকের মতামত খুব মূল্যবান নয় জেনেও বলি, এর পরেও বিদ্যাসাগরীয় নাস্তিকতার অন্তত একটি যৌক্তিক সম্ভাবনা খোলা থাকে। যিনি নিজের দেশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ধর্মতত্ত্বকে সরকারি চিঠিতে নির্মমভাবে নাকচ করতে পারেন, নিজে কোনও পুজো-আর্চা করেন না, বাড়ির পুজো বন্ধ করে দেন, নিজের উইলে ধর্মকর্মের জন্য একটুও অর্থবরাদ্দ করেন না, উচ্চবর্ণের কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়েন, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী শিক্ষা চালু করার জন্য প্রকাণ্ড এক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যাপৃত করেন, সাওঁতাল-মুসলমান-নিচুজাতের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করেন, তাঁর ভেতরে কোনও কুসংস্কার লুকিয়ে বসে ছিল এটা ভাবতে বেশ একটু অস্বস্তিই হয় আমার। তাই ভাবি, এমন হতে পারে কিনা যে, তিনি যখন উপবীত বজায় রাখেন বা চিঠির ওপরে দেবতার নাম লেখেন, তখন তিনি নিজেকে এক কাম্যুফ্লাজের আড়ালে রাখতে চান কিনা, এবং নিজের সামাজিক প্রিভিলেজের কিছু চিহ্ন বজায় রেখেই, এবং তাকে ব্যবহার করেই, তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডকে অবাধ রাখতে চান কিনা (বাবা-মার পারলৌকিক ক্রিয়ার ব্যাপারটা হয়ত আলাদা, ওটা হয়ত তাঁদের প্রতি বিদ্যাসাগরের অসাধারণ ব্যক্তিগত কমিটমেন্টের ফল)।
কিন্তু, এত কিছুর পরেও কি সব অঙ্ক মিলবে? উঁহু, তা সম্ভব না। আবারও আগের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলি, ইতিহাস তো আমাদের কাছে এই অনিশ্চয়তা ও অজ্ঞেয়তাটুকু সব সময়েই দাবি করে। তবু সৎ অনুসন্ধানটা চালিয়ে যেতে হয়— ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়েই!
[এখানে যে সব তথ্য ব্যবহার করেছি সে সবই বিদ্যাসাগর-চর্চা প্রসঙ্গে সুবিদিত, কাজেই বিস্তারিত সূত্র-নির্দেশের প্রয়োজন সেভাবে বোধ করিনি, অল্প দুয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও ‘ক্রিটিক্যাল’ ক্ষেত্র ছাড়া। নিচে যে সমস্ত বই ও প্রবন্ধের উল্লেখ করেছি, এখানে ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব তথ্যই তাতে পাওয়া যাবে। বইয়ের নামগুলো বোল্ড এবং লেখকের নামগুলো ইটালিক্সে রাখলাম, আশা করি তাতে পাঠকের পড়তে সুবিধে হবে।]
তথ্যসূত্র
- ১। করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্রমিত্র, আনন্দ, ২০০৭
- ২। বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১
- ৩। রসসাগর বিদ্যাসাগর, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯২
- ৪। বাঙালি প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫ (মূলত পৃষ্ঠা ৯৩-১০৩)
- ৫। সমকালে বিদ্যাসাগর, স্বপন বসু, বাংলার মুখ, ২০১৯
- ৬। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, অর্ণব নাগ (সম্পাদনা), অক্ষর প্রকাশনী, ২০২০
- ৭। রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গ দর্শন, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, পুনশ্চ, ২০১৯
- ৮। উনিশ শতকের বাঙালিজীবন ও সংস্কৃতি, স্বপন বসু ও ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী (সম্পা), পুস্তক বিপণি, ২০১৯
- ৯। ‘সংবর্তক’ পত্রিকা, কলকাতা, বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা বইমেলা ২০২০
- ১০। ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকা, কলকাতা, বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা, একত্রিংশ বর্ষ, ২০১৩-১৪, তৃতীয়-চতুর্থ সংখ্যা
- ১১। Iswar Chandra Vidyasagar & His Elusive Milestones, Asok Sen, Permanent Black, 2016
- ১২। বিদ্যাসাগর :নানা প্রসঙ্গ,রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১
- ১৩। জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক (সম্পা), আনন্দ, ২০২০
- ১৪। বিদ্যাসাগর কি সত্যিই আস্তিক ছিলেন ?, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য(আন্তর্জাল ঠিকানা ‘academia.edu’ থেকে প্রাপ্ত)
- ১৫। ভদ্রলোকী যুক্তিবাদের দক্ষিণাবর্ত, আশীষ লাহিড়ী, ঋতাক্ষর, ২০১৭
- ১৬। Ballantyne-Vidyasagar Controversy : A Re-view, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগর কলেজ : স্মৃতিধন্য একশ পঁচিশ বছর(আন্তর্জাল ঠিকানা ‘academia.edu’ থেকে প্রাপ্ত)
- ১৭। নির্বাচিত প্রবন্ধ,রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৯
- ১৮। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ, বদরুদ্দিন উমর, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪
- ১৯। বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭২
- ২০। শুভকরী : পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বিশত জন্মবর্ষ স্মারকগ্রন্থ, বিদ্যাসাগর কলেজ ফর উইমেন, ২০২০
- ২১। নিরীশ্বর বোধোদয়, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকা, জানুয়ারি-মার্চ ২০২০
- ২২। বিদ্যাসাগর–নির্মাণ : পরিকল্পিত মিথ্যাচার,ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস, ‘স্বস্তিকা’ পত্রিকা, ২০ জানুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ১০-১২
- ২৩। বাঙালির আত্মপরিচয় : সমাজসংস্কার থেকে স্বাধীনতা, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অবভাস, ২০০৫
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার : আশীষ লাহিড়ী, কনিষ্ক চৌধুরী, সিদ্ধার্থ দত্ত, প্রদীপ দে ]