Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এঙ্গেলস ও ২য় আন্তর্জাতিক

সুশোভন ধর

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী, বিশ্লেষক

 

 

 

মার্কসের কাজকর্ম ও বিশেষ করে তাঁর তাত্ত্বিক অবদানের কথা ১৮৬০-৭০ থেকেই ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনে অপরিচিত ছিল না। তাঁর লেখাপড়া ও মতামত সঠিক সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব হিসাবে স্বীকৃত হলেও সকলে তা ঠিকঠাক অনুবাধন করতে পেরেছিলেন কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। এর পরবর্তী দশ-বারো বছরের মধ্যে মার্কসের চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক-সমাজতান্ত্রিক দলগুলি গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৭৯ সালে ফরাসি দেশে পার্তি উভরিয়ে ফ্রঁসে, ১৮৮১-তে ব্রিটেনে সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন, ১৮৮৩ সালে প্লেখানভ, জাসুলিচ, আক্সেলরদ প্রমুখদের উদ্যোগে রুশ ‘শ্রমিক মুক্তি গোষ্ঠী’, ১৮৮৫ সালে বেলজিয়ামে পার্তি উভরিয়ে বেলজ্‌, ১৮৮৮ সালে অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং ১৮৯২-এ ইতালীয় সমাজতান্ত্রিক পার্টি। এছাড়াও নরওয়ে, সুইডেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোশ্যালিস্ট শ্রমিক পার্টি তৈরি হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে সূত্র এবং তার বাস্তবিক ফলাফল মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া রাজনৈতিকভাবে জরুরি হয়ে ওঠে। এবং বিশেষ করে মার্কসের অবর্তমানে সেই দায়িত্বভার বর্তায় এঙ্গেলসের কাঁধে।

মার্কস থেকে মার্কসবাদ

বলাই বাহুল্য যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সূত্রায়ন এবং তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এঙ্গেলস যে দার্শনিক দিকগুলির ব্যাপারে আলোকপাত করেন তার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। মার্কসের মতামত থেকে মার্কসবাদী আদর্শে রূপান্তর এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতৃত্বের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টি করার ভিতটা এঙ্গেলস গেঁথে গেছিলেন।

তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কাউটস্কি যেমন বলছেন “অ্যান্টি-ড্যুরিং আমার ওপর যে প্রভাব ফেলেছিল, তার বিচারে অন্য কোনও বই মার্কসবাদ বোঝার পক্ষে আমার ক্ষেত্রে এতটা অবদান রাখতে পারেনি। মার্কসের ‘পুঁজি’ অবশ্যই আরও বড় কাজ। তবে কেবলমাত্র অ্যান্টি-ড্যুরিং এর মাধ্যমেই আমরা ‘পুঁজি’ বুঝতে এবং সঠিকভাবে পড়তে শিখেছি।” রিয়াজানভের মতে মার্কসবাদের ইতিহাসে অ্যান্টি-ড্যুরিং একটি যুগান্তকারী অবদান। এই বইটি থেকেই তৎকালীন তরুণ প্রজন্ম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, তার দার্শনিক অভিঘাত, তার পদ্ধতি, ইত্যাদি সঠিকভাবে বুঝতে পারে। উনিবংশ শতাব্দীর আটের দশকের গোড়ার দিকে— বার্নস্টাইন, কাউটস্কি, প্লেখানভ— যে সকল তরুণ মার্কসবাদী রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করেছিলেন তাদের সকলের জীবনেই এই বইটির অপরিসীম গুরুত্ব ছিল।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের জন্ম

এর এক দশক আগে প্যারী কম্যুনের রক্তাক্ত অবসানের পরেই প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ও নৈরাষ্ট্রবাদীদের মধ্যে দলীয় বিরোধের কারণে উঠে যায়। ১৮৮৯ সালের বাস্তিল দিবসে, ফরাসি বিপ্লবের একশো বছর পরে, বিভিন্ন শ্রমিক নেতৃত্ব আরেকবার আন্তর্জাতিক শ্রমিক সঙ্ঘ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। প্যারিসের সম্মেলন কক্ষে এক বিরাট লাল ব্যানারে সোনালী অক্ষরে লেখা ছিল ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। তার তলায় দাঁড়িয়ে মার্কসের জামাতা পল লাফার্গ চব্বিশটি দেশের প্রতিনিধিদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের উদ্বোধনী কংগ্রেসে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এর পরের ইতিহাস আমাদের অনেকের জানা। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পায় মূলত ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক অংশের শ্রমিকদের সংগঠিত করার মাধ্যমে। পুঁজিবাদী ইউরোপের হৃদয়ে লাল সূর্য উঁকি দিতে থাকে এবং ঐ মহাদেশের বিভিন্ন অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলিতে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেই সম্ভাবনা কেন বাস্তবায়িত হল না সেকথা স্বতন্ত্র এবং বর্তমান আলোচনাটিতে তা নিয়ে বিশেষ কথাবার্তা বলার বিরাট সুযোগ প্রায় নেই। তবুও একথা বলা যায় যে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের জন্মলগ্নে একথা ভাবার কার্যত কোনও অবকাশ ছিল না যে প্রতিষ্ঠার পঁচিশ বছর পরে এই আন্তর্জাতিকভুক্ত দলগুলির প্রায় সবকটাই তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আন্তর্জাতিকতাবাদকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজ নিজ দেশের শাসকশ্রেণির পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে সমর্থন করবে।

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক

এই আন্তর্জাতিকের ব্যাপারে প্রবল উদ্যোগী ছিলেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। তিনি ১৮৮৯-১৮৯৩ এর মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম তিনটি কংগ্রেসকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্যারী কম্যুনের তিরিশ বছর পরে তুলনামূলকভাবে ঝুটঝামেলা ব্যতীত পরিবেশে পুঁজিবাদ বিকশিত হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু একইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এবং তাদের মধ্যে মার্কসবাদের প্রভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বহু দেশেই সমাজতান্ত্রিক দল ও সংগঠন তৈরি হয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে।

বেশ কয়েকটি দেশে বড়সড় ধর্মঘট ও শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৮৬ সালের মার্কিন শ্রমিকদের আট ঘন্টার কর্মদিবস অর্জনের দাবিতে সংগ্রামের কথা আমাদের সকলের জানা। এর পরে ১৮৮৮ সালে ইংল্যান্ডের কয়লা-গ্যাস প্ল্যান্টের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে আট ঘন্টা কর্মদিবস ছিনিয়ে আনতে সফল হয়। আন্দোলন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হওয়ার ফলে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক দল ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়, সর্বহারাশ্রেণির আন্তর্জাতিক জোট এবং সর্বপরি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সার্বিক সংগ্রামের জন্য একটি সাধারণ সংগ্রাম প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছিল। একটি নতুন আন্তর্জাতিকের প্রয়োজন ও তার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসেবে সমসাময়িক শ্রমিক আন্দোলন তার দায়ত্বপালন করেছিল।

প্রথম আন্তর্জাতিক উঠে যাওয়ার সময় থেকেই মার্কস এবং এঙ্গেলস একটি নতুন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিমূলক কাজগুলি শুরু করেছিলেন এবং তদুপরি, প্রথম আন্তর্জাতিকের চেয়ে আরও উচ্চতর প্রত্যাশা এবং আরও দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁরা এই কাজে হাত দেন। যদিও তাঁরা দুজনেই একমত ছিলেন যে পূর্বশর্তগুলি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত একটি নতুন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করা উচিত নয়।

১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ কার্ল মার্কস মারা যান। তাঁর মৃত্যু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক তাৎক্ষণিক শূন্যতার সৃষ্টি করে। তাঁর মৃত্যুর পরে আন্তর্জাতিক শ্রম আন্দোলনের নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব এঙ্গেলসের কাঁধে চাপে। তিনি পাণ্ডুলিপি সাজিয়ে ক্যাপিট্যালের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করেন। তিনি ধৈর্য সহকারে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক পার্টিগুলির গড়ে ওঠার সময় সেগুলির পাশে থেকেছেন। এঙ্গেলসের পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে ফরাসি শ্রমিক পার্টি আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক প্রতিনিধিদের নিয়ে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সম্মেলনটি সফল করার জন্য, ৬৮ বছরের এঙ্গেলস নিজে ময়দানে নামেন।

বাস্তিল দূর্গ পতনের শতবর্ষে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক প্রতিনিধিদের নিয়ে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অংশ নেয় বাইশটি দেশের ১৯৩ জন প্রতিনিধি। ক্যাপিট্যালের তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে এঙ্গেলস সভায় উপস্থিত হতে পারেননি।

সম্মেলনের নেতৃত্বে ছিলেন জার্মান সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট লেবার পার্টির নেতা উইলহেলম লাইবনেখট্‌ এবং অগস্ট বেবেল, ফরাসি শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ পল লাফার্গ্‌ এবং জঁ জরেস প্রমুখ। ফরাসি প্রতিনিধি দলের পরামর্শে এই কংগ্রেস “পয়লা মে” উদযাপন সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব পাশ করে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রতি বছর ১ মে, অর্থাৎ ১৮৮৬ সালে শিকাগোর শ্রমিকরা যেদিন ধর্মঘটে নেমেছিলেন, সেদিনটিতে আট ঘন্টার কর্মদিবসের জন্য, আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত দেশে দেশে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে এবং এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ-সমবেশ দিবস’ হিসাবে পালন করা হবে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের উদ্যোগে এভাবেই মে দিবস বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের লড়াই উদযাপনের দিন হয়ে ওঠে। সম্মেলনটি অর্থনৈতিক সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবও পাশ করে বলেছিল যে শ্রমিকশ্রেণিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংগ্রামে সীমিত থাকা যথেষ্ট নয়, তাকে অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। সিদ্ধান্তে আরও বলা হয় যে সর্বহারাশ্রেণিকে অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে। যদিও পরবর্তীকালে অনেকে বলেছেন যে সংসদীয় সংগ্রামের একতরফা গুণগান একটি দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের লক্ষণ ছিল।

প্যারিসের এই ‘কংগ্রেস অফ ডেপুটিস’ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। কোনও কর্মসূচিও নির্ধারণ করা হয়নি। এমনকি প্রথম আন্তর্জাতিকের মতো কোনও কার্যনির্বাহী কমিটিও নির্বাচন করেনি। যাইহোক, নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিনিধিদের নিয়ে সম্মেলন করার কথা স্থির হয় এবং এই কারণে এটিকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠা সম্মেলন হিসাবে ধরে নেওয়া হয়।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক শ্রম আন্দোলনে এক নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করে। ১৮৯০ সালের “পয়লা মে” লক্ষ লক্ষ শ্রমিক প্রথমবার রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশ নেওয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নামে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ এবং বিভিন্ন শহরে বিশাল বিক্ষোভ ও মিছিল হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই ছবি দেখা যায়। ঐ বছর ইংল্যান্ডে পয়লা মে-র পরিবর্তে মাসের ৪ তারিখে শ্রমিক বিক্ষোভ সংগঠিত হয় এবং লন্ডনে ২,০০,০০০ লোক অংশ নিয়েছিল। এঙ্গেলসও এই জনসভায় ব্যক্তিগতভাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনি গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন যে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রলেতারিয়েতরা কেবল তাদের লড়াইয়ের শক্তি খুঁজে পেয়েছে। প্রথমবারের মতো একই পতাকার নীচে তারা একটি বাহিনী হিসাবে সংগঠিত হয়েছে। “বাহ কি দুর্দান্ত হত যদি মার্কস আজ নিজের চোখে এই দৃশ্যটি দেখতে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন।”

তিনি ১৮৯৩ সালে আন্তর্জাতিকের জুরিখ কংগ্রেসে অংশ নিয়েছিলেন সম্মানিত চেয়ারম্যান হিসাবে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনে এঙ্গেলসের নেতৃত্বের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম দিনগুলিতে, এঙ্গেলস সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে গেছিলেন।