Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন তোলার আগে একটু ভাবা যাক বরং

চার্বাক মিত্র

 

লেখক রাজনৈতিক ভাষ্যকার

 

ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষার যে সার্বভৌম ক্ষমতা ভারতের গণতান্ত্রিক সংবিধান… ন্যস্ত করেছে, যার ভিত্তিতেই আইন রচিত, সেই আইনের সীমানা আইনের রক্ষকেরাও যদি লঙ্ঘন করেন, তবে আইনের চোখে তাঁরাও অপরাধী‌।… নাগরিকদের অধিকার রক্ষার্থেই আইন ভাঙার অধিকার, তা সে মাও-সে-তুঙের নামেই হোক বা ভি ভি গিরির নামেই হোক, কাউকেই দেওয়া হয়নি।

কথাগুলো ‘রূপদর্শী’-র, বা গৌরকিশোর ঘোষের। মাও সে তুং আর ভি ভি গিরিকে মিলিয়ে ব্যালান্সিংয়ের খেলা কেন খেলেছেন সে প্রশ্ন থাক। গৌরকিশোর ঘোষ নমস্য সাংবাদিক। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানে একমত না হওয়ার অনেক সূত্র থাকতে পারে। সেসব নাড়াঘাঁটা না করে ওঁর এই বক্তব্য থেকে সারটুকু তুলে আনা যাক। সোজা কথা, আইনের অধিকার, মৌলিক অধিকার রক্ষার দায় একটি সর্বাত্মক বিষয়। দলমতনির্বিশেষে, আইনরক্ষক ও নাগরিক নির্বিশেষে। সেজন্যই ‘দেশব্রতী’-তে হিংসার প্রচার দেখে তা নিষিদ্ধ করতে গৌরকিশোর ঘোষ যেমন সরব হয়েছেন, তেমনই আবার ‘দেশব্রতী’-র অফিসে পুলিশি হামলাকে ঘৃণা সহকারে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

যদি সত্যিই মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার বা বাকস্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতে হয়, তাহলে তো এমন দাবি করা যেতেই পারে। কেউ তাকে লিবারেল প্রয়াস বলতে পারেন, প্রগতিশীল ওপরচালাকিও বলতে পারেন। কিন্তু একটি বিষয় অন্তত এ বক্তব্য থেকে পরিষ্কার। ক্ষেত্রবিশেষে চুপ থাকাকে পক্ষ নেওয়া বলে না, বলে সিলেক্টিভ মিউটিজম বা অ্যামনেশিয়া। আপনি হয় বলবেন, ‘দেশব্রতী’-র অফিসে হামলা সমর্থন করিনি, কিন্তু আনন্দবাজার অফিস রেড করলে একশোভাগ সমর্থন করতাম, নইলে আপনি দুটোরই বিরোধিতা করবেন।

এ সন্দর্ভটিতে ফিরব খন। আগে একটু বর্তমানে ঘাই মারি।

রাষ্ট্রের ব্লু-আইড বয় অর্ণব গোস্বামীর গ্রেফতারিতে সুশান্ত-মৃত্যু পরবর্তী হারাকিরি, বলিউড নিয়ে খুঁচিয়ে ঘা করা বা উদ্ধব ঠাকরেকে স্টুডিওতে বসে হাতা গুটিয়ে আয় তোর মুন্ডুটা দেখি বলে হুমকি দেওয়া ইত্যাদি টকঝাল ইতিহাসের অবদান থাকতেই পারে, তবে খাতায়কলমে এই গ্রেফতারের কারণ দু বছর আগের একটি আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা। নইলে ঐ রিপাবলিকেরই আরেক মহামতি সাংবাদিক প্রদীপ ভান্ডারিকে তুলে নিয়ে গিয়ে হুড়কো দিতে গিয়েও পুলিশ ফেল মেরেছিল। এবারে কিন্তু হাইকোর্ট গোস্বামী মহাশয়কে ১৪ দিনের জুডিশিয়াল কাস্টডিতে পাঠিয়েছেন। এর সঙ্গে সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি আড়ালে আড়ালে জড়িত থাকতেই পারে। কিন্তু ওপর ওপর এটি একটি সাদা ফৌজদারি মামলা, এবং বিশেষ মিথ্যে মামলা বলেও মনে হচ্ছে না।

কিন্তু এসব থাক, আসল কথা হল এই গ্রেফতারের পরেই স্মৃতি ইরানি থেকে রবিশঙ্কর প্রসাদ, প্রকাশ জাভড়েকর থেকে পীযূষ গোয়েল, মায় অমিত শাহ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসলেন। ভাবুন দিকি! কঙ্গনা মোটামুটি বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে আছেন এদিকে।

আচ্ছা এ তো না হয় গেল অর্ণবপন্থীদের কথা, ঘোষিত অর্ণববিরোধীদের একাংশও কিন্তু ‘অর্ণবকে পছন্দ নয়, কিন্তু এইভাবে গ্রেফতারি ঠিক হয়নি’ বলে আপত্তি করছেন।

অর্ণবের গ্রেফতারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। হ্যাঁ, তাঁকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ বললে বোধহয় আদতেই অত্যুক্তি হবে না। হ্যাঁ, স্পটে ছিলেন এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট শচীন ভাজে, তাকে দেখে আঁতকে উঠে অর্ণব প্রশ্ন করেছিলেন ‘হোয়াই শচীন ইজ হিয়ার?’ অর্ণবের গ্রেফতার যে মামলার ভিত্তিতে, তাতে কিন্তু এই গ্রেফতার সাদা চোখে অন্যায় নয়। যাঁরা এতে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শুনছেন, বিশেষত যেসব প্রগতিশীলরা, তাঁদের জন্য গৌরকিশোর ঘোষের বক্তব্যটা খুবই উপযুক্ত। এই মন্ত্রীসান্ত্রীদের মতো এই প্রগতিশীলরাও যদি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান কখনও, দেখতে পাবেন, মৌলিক অধিকার খর্বের বিরুদ্ধে মুখ খোলার অভ্যাস তাঁদের আদৌ এতটা জোরালো নয়। আর জোরালো হলেও, গৌরকিশোর ঘোষের এই বক্তব্যের ভেতরে যে লিবারেল নাগরিক অধিকারবাদ রয়েছে, যে সন্দর্ভের কথা প্রথমেই বলছিলাম, তার ভেতরের মস্ত ফ্যালাসি নিয়েও মুখ খোলা দরকার।

বাঁদিকে ওপর থেকে নিচে রাঘব, পুন্যপ্রসূন এবং প্রশান্ত; ডানদিকের ওপরে মাসরাত, নিচে গুরমেহর

বছর দেড়েক আগে ‘দ্য হিন্দু’-তে জি সম্পথ একটি লঘুচালের লেখা লিখেছিলেন, শিরোনাম ছিল ‘ইওর বাইলাইনস আর নাম্বারড’। সেই লেখার গোড়াতেই বলা হয়েছিল, ‘Even people who don’t own a media platform are firing journalists. They simply use guns. Either journalists are getting killed or their jobs are. If not killed, they’re getting arrested for things like tweeting, cracking jokes, or taking their job seriously enough to actually do it.’ এই সহজ কথার দৃষ্টান্তও তো নেহাত কম নয়! গুরমেহর কৌর ছিলেন হিন্দুস্তান টাইমসের ডেটা জার্নালিস্ট। ভারতের হেট ক্রাইম নিয়ে একটি ডেটা স্টোরি তিনি করেন, যা প্রচণ্ড বিরক্ত করে অমিত শাহকে। পরের দিন, ঠিক পরের দিন, গুরমেহর কৌরের চাকরি চলে যায়। পুন্যপ্রসূন বাজপেয়ির সঙ্গে কী হয়েছিল আমরা নিশ্চয় ভুলে যাইনি। ‘দ্য ওয়্যার’-এর প্রশান্ত কানোজিয়ার গ্রেফতারি বা কুইন্ট-এর রাঘব বহেলের বাড়িতে ইনকামট্যাক্স হানা— কবে মুখ খুলেছিলেন এঁরা? কাশ্মিরের চিত্রসাংবাদিক মাসরাত জাহরাকে ইউএপিএ-তে গ্রেফতারের সময় মুখ খুলেছিলেন?

না। আমি বিজেপির কথা বলছি না। বিজেপির কারও কারও এমারজেন্সি মনে পড়ছে, কেউ বলছেন ফ্যাসিবাদ, কারণ অর্ণব ওদের লোক। ওরা অবশ্যই উপরিউক্ত ক্ষেত্রে চুপ থাকবেন, নয় সেগুলোকে সমর্থন করবেন। কিন্তু যাঁরা গৌরকিশোর ঘোষের মতোই সর্বাত্মক প্রতিবাদ চাইছেন, তাঁদের কথাটা ভাবা যাক। তাঁরা রাষ্ট্রের এইসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন তো?

আর যদি করেও থাকেন, তাহলে সেখানেও, ওই যে বললাম, ফ্যালাসি। মস্ত ফ্যালাসি। আর সেখানেই এই লেখার ইতি টানব।

তা হল— অর্ণব কখনওই রাষ্ট্রদ্রোহের প্রতিভূ হতে পারেন না। গৌরী লঙ্কেশের খুন থেকে কাফিল খানের গ্রেফতারি, উমর খলিদ থেকে ভীমা কোরেগাঁও, জেএনইউ-র সেই ২০১৬-র গোলমাল থেকে এএমইউ-তে ভাঙচুর- সর্বত্র তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার আস্ফালনের পক্ষেই কথা বলে এসেছেন। ওয়্যার-এ এক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘আমি সাংবাদিক, তাই অর্ণবের পক্ষে নই।’ এই ফ্যালাসিটা মাথায় রেখে মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন তুললে ভাল হত না? সাফুরা জারগর বা ভারভারা রাওদের কাস্টডিয়াল নির্যাতনের পক্ষে যে সাংবাদিক, তার পিঠে মুম্বই পুলিশ দু ঘা দিলে আমার মৌলিক অধিকারের বোধ অন্তত একচুল খর্ব হয় না। সেদিন শচীন ভাজেকে দেখে যে ভূত অর্ণব দেখেছেন, তাতে কি তাঁর চৈতন্য হবে? তিনি কি বুঝবেন, কাদের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন এতদিন, নির্লজ্জভাবে?