Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মহেশ রাউতের মুক্তির দাবিতে

সন্দীপ পাণ্ড্যে ও সুরভি আগরওয়াল

 

মূল ইংরাজি থেকে তর্জমা: সাগরিকা শূর

 

লেখকদ্বয় সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী

 

মহারাষ্ট্রের গঢ়চিরোলির প্রান্তিক আদিবাসীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়ে যাওয়া বছর ৩৩-এর মহেশ রাউত গত দু বছরের ওপর কারারুদ্ধ। একজন সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে তাঁর বন্ধুত্বসুলভ স্বভাব ও সংবেদনশীলতার জন্য তিনি সবসময়ই বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। ভীমা কোরেগাঁওতে উচ্চবর্ণের পেশোয়াদের হারিয়ে দলিত জনজাতির জয়ের উপলক্ষে ১লা জানুয়ারি ২০১৮-র স্মারক অনুষ্ঠানে হিংসাত্মক ঘটনার সূত্রপাতের কারণে মহেশ রাউতকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানো ও মাওবাদীদের সাথে যোগসাজশের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। এই ঘটনায় এযাবৎ গ্রেপ্তার হওয়া ১৬ জন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনিই কনিষ্ঠতম।

আমরা আদৌ কেন এই ঘটনায় মাথা ঘামাব? কারণ মহেশ আমাদের বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারের জন্য লড়ছে। তাঁর ক্ষেত্রে এবং আমাদেরও, এই অধিকার অর্জনের অর্থ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের অভিমত প্রকাশের অধিকার। আমাদের মনে হবে এতে কোনও ভুল নেই। আমরা সবার জন্যই এই সুরক্ষা দাবি করি। বর্তমান সরকার এই বিষয়টি অস্বীকার করে। তারা চায় না মহেশ গঢ়চিরোলির মানুষদের ব্যাপারে কথা বলুক।

মহেশকে সরানো হয় যাতে দিনের আলোয় বড় বড় মাইনিং কোম্পানিদের ডাকাতির বিরুদ্ধে শেষ প্রতিবন্ধকতাটুকুর অস্তিত্বও না থাকে। তারা উপজাতি অঞ্চলে মূল্যবান খনিজ লুঠ করছে যেখানে মহেশ এলাকার মানুষদের শান্তিপূর্ণভাবে যৌথ অধিকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আওয়াজ তোলা এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়া কীভাবে অন্যায় হতে পারে? আমরা, ভারতবাসীরা, আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ১৯ (এ), (বি) এবং (সি)-র সাহায্যে আমাদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছি।

ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজেদের জমি খনন করার অধিকার দিতে বাধ্য হওয়াকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে মহেশ বিচারব্যবস্থার সাহায্যে একটি পিটিশনের মাধ্যমে সহনাগরিকদের সাহায্য করতে চেয়েছিল। আমাদের সরকার যদিও কর্পোরেট প্রভুদের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর পক্ষপাতী নয়। এখন প্রায় আধডজন কর্পোরেট মাইনিং দৈত্য এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ২০১৯-২০-তে গঢ়চিরোলির মাইনিং কোম্পানিগুলি থেকে আদায়কৃত শুল্ক প্রাপ্ত আয় ৪,৭৪৫ কোটির কত টাকা স্থানীয়দের দেওয়া হয়েছে? ২০১৭-১৮ সালে এখানে জন প্রতি উপার্জন ছিল বছরে মাত্র ৭,১৪৪ টাকা। মহেশ শুধুমাত্র সমভাবাপন্ন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য লড়ছিলেন। তাঁর গ্রেপ্তারির পর ৩০০টি গ্রামসভার তাঁর সমর্থনে নেওয়া শপথ কিছুই আশ্চর্যের নয়। এই শপথ এই অঞ্চলে পঞ্চায়েত (এক্সটেনশন টু শিডিউলড এরিয়াস) অ্যাক্ট, দ্য শিডিউলড ট্রাইবস এন্ড আদার ট্রাডিশনাল ফরেস্ট ডুয়েলার্স (রেকগনিশন অফ ফরেস্ট রাইটস) অ্যাক্ট ও উপজাতিদের স্বার্থে অন্যান্য সরকারি পরিকল্পনা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি সমর্থন নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তেন্দু পাতা সংগ্রহে  মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে উপজাতিদের শোষণ তাঁর কারণেই বন্ধ হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে বলা যায় তাঁর কাজের জন্য উপজাতিদের মধ্যে একটি সাধারণ ক্ষমতায়নের মনোভাব তৈরি হয়েছিল। অন্য যে কোনও সরকারের কাছে তিনি তাঁর কাজের জন্য পুরস্কৃত হতেন।

 

লালসু নারোতের সঙ্গে মহেশ। ছবি দি ওয়ার থেকে

পুলিশ মহেশের বিরুদ্ধে ২০,০০০ পাতার চার্জশিট পেশ করেছে। তারা তাদের নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি বজায় রাখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে যতরকম সম্ভব অভিযোগ এনেছে— ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সেকশন ৩৪, ১২১, ১২৪এ, ১৫৩, ১২১এ, ১১৭, ১২০বি এবং ৫০৫ (এ) (বি) (সেকশন ১২৪এ, “রাজদ্রোহ”, ইংরেজ আমলের আইন, একটি চিরকালীন স্বৈরাচারী পদক্ষেপ। কিন্তু মহেশ এক্ষেত্রে তিলক, গান্ধি বা অন্যান্য যাদের বিরুদ্ধে সার্বভৌম সরকার এই ধারা আরোপ করেছিল তাদের সঙ্গে একটি পবিত্র অবস্থান ভাগ করে নিচ্ছে)। আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট— ভারতের কঠোরতম আইনগুলির মধ্যে একটি ও সরকারের অন্যতম প্রিয় আইনও বটে— দ্বারা তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, যেখানে জামিন পাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।

মহেশের পাসপোর্ট ২০১৮-র অনেক আগেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং তাঁর পরিবারকে মহারাষ্ট্র ছাড়তে নিষেধ করা হয়। আদালতে বলা হয়েছিল যে মহেশ টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস, মুম্বই থেকে স্নাতকোত্তর হয়েছেন এবং দু বছরের জন্য প্রাইম মিনিস্টার রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে ফেলো ছিলেন যখন তিনি গঢ়চিরোলি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। এই ভয়ঙ্কর অতিমারির সময়ও তিনি জেলে রয়েছেন এবং তীব্র আলসারেটিভ কোলাইটিস থাকার দরুণ তাঁর শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটেছে। আদালত তবুও ইউএপিএ-র সেকশন ৪৩ডি (৫) এর অধীনে অতিরিক্ত অক্ষমতার কথা উল্লেখ করে তাঁর মুক্তির আবেদন খারিজ করে দেয় এবং তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে জানায়— অন্যান্য অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে মহেশ একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত যারা “সরকারের বিরুদ্ধে তহবিল তৈরি, কর্মী নিয়োগ এবং নীতিনির্ধারণে লিপ্ত।”

তাঁর ৭৯ জন পিএমআরডিএফ সহকর্মী এবং ভূতপূর্ব গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রামেশ মহেশের সমর্থনে একটি বিবৃতিতে সাক্ষর করেছেন এবং তাঁর আশু ও শর্তহীন মুক্তির দাবি করেছেন। এই বিবৃতিতে রাজ্যে নিপীড়িত শ্রেণির প্রতি উচ্চবর্ণের ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের পদক্ষেপকে উল্লেখ করে মহেশের বিরুদ্ধে দ্রুত পুলিশি ব্যবস্থার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

যদিও কেউ কেউ মহেশ বা মহেশের অবস্থানের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে সহমত নাও হতে পারেন। সর্বোপরি, বাকস্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হয়ে ওঠে যখন সরকার অন্য মানুষের বা সরকারের প্রতি ভিন্ন মতপ্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করে। বাকস্বাধীনতার (শান্তিপূর্ণ জমায়েত ও সংগঠনের) অধিকারের অর্থ কী, যদি সরকার শুধু তাদেরকেই সুরক্ষা দেয় যাদের মতামত সরকার বা অন্য সকলের মতের সঙ্গে মিলে যায়?

মহেশ গঢ়চিরোলি অঞ্চলের মানুষদের জীবনের উন্নয়নে নিজের জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিয়েছেন— শক্তিশালী অনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁদের উন্নতিসাধনের কথা বলেছেন। আমরা সবাই কখনও এমন অবস্থানে দাঁড়াতে পারি যখন আমাদের একটি শক্তিশালী দল বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অপ্রিয় মতামত পেশ করতে হবে। যদি আমাদের তখন জেলে ভরে দেওয়া হয়, প্রমাণ-নিরপেক্ষ অপরাধে অভিযুক্ত করা হয় এবং এরকম কোনও আইনের আওতায় ফেলা হয় যা বিনা বিচারে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে (যতক্ষণ না নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছে) এবং কেউই আমাদের হয়ে কথা না বলে?

এই দেশের মানুষের অসামরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমাদের মহেশের মতো মানুষদের সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সরকারকে বোঝাতে হবে যে তারা সাধারণ মানুষের অধিকারের প্রতি যথেচ্ছাচার করতে পারেন না। মহেশ রাউতকে এখনই ছেড়ে দিতে হবে এবং তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে।