Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

টয়লেটের সত্যি মিথ্যে

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

 


লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার

 

 

 

 

ছাত্রজীবনে ভূগোল পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন খুব কমন ছিল। ভারতের ধান উৎপাদক কিংবা গম উৎপাদক অঞ্চলগুলি দেখাও। স্যার বলতেন, সংক্ষেপে লিখে একটা ম্যাপ এঁকে দেবে। এর পরে সবুজ পেন্সিল দিয়ে ভারতবর্ষের ওই জায়গাগুলোতে করে দেবে শেড। ঠিকঠাক লেখা ও ছবি হলে দশে নয় একেবারে গ্যারান্টি। গ্রামীণ স্বচ্ছ ভারত মিশনের ওয়েবসাইট খুলে অবাক হলাম। ফচকে ছোঁড়া হলে বলতে পারতাম, দিল একেবারে গার্ডেন গার্ডেন। পুরো দেশটাই যে সবুজে সবুজ। কোথাও কোনও কালিমা নেই। মাউস নিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করার পরে মালুম হল, গ্রামীণ ভারতে শৌচাগারের কথা বলা হচ্ছে আসলে। দেশের দুটো ম্যাপ পাশাপাশি রাখা। বাঁদিকে, প্রথম মানচিত্রর উপরে তারিখ দেওয়া ২ অক্টোবর, ২০১৪। গ্রামীণ ভারতের মাত্র ৩৮.৭ শতাংশ বাড়িতে তখন শৌচাগার ছিল। সেই ম্যাপ মরুভূমির মতো। বেখাপ্পা হলুদ। ডান দিকের ম্যাপে দেখা গেল, পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২ অক্টোবরে ১০০ শতাংশ বাড়িতে শৌচাগার হয়ে গিয়েছে। তাই ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে সবুজ। ওয়েবসাইটটা খুললেই কম্পিউটার গেম-এর পয়েন্টের মতো, ব্যাঙ্কে রাখা ক্যাশ কাউন্টিং যন্ত্রের পর্দার মতো নম্বরের দৌড় শুরু হয় স্ক্রিনের বাঁ দিকে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর থেকে গ্রামে কত শৌচাগার তৈরি হয়েছে এটা তার হিসেব। স্ক্রিন উথালপাথাল করে নম্বরটা যেখানে গিয়ে থামে তা হল ১০ কোটি ৭০ লক্ষ ৪৯ হাজার ৪৫২। মানে এই বিপুল সংখ্যায় শৌচাগার তৈরি হয়ে গিয়েছে স্বচ্ছ ভারত মিশনে, গ্রাম থেকে গ্রামে। সরকারি ওয়েবসাইটের দাবি, দেশে যে ছ লক্ষের উপরে গ্রাম আছে তার কোনওটাতেই এখন কেউ উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম করেন না। আনন্দ সংবাদ।

গত বছর, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির ১৫০তম জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল টয়লেটে বসানো জুঁইফুল গন্ধের এয়ার ফ্রেশনারের মতোই শান্তিদায়ক, তরতাজা। ইংরিজিতে যাকে বলে রিফ্রেশিং। তিনি জানিয়েছিলেন, দেশের প্রতিটা গ্রাম আজকের দিনে বলতে পারে, খোলা জায়গায় শৌচকাজ তারা আর করে না। কারণ হল এই কোটি দশেক শৌচাগার। মুশকিল হল, এর কিছুদিন পরেই সংখ্যাতত্ত্বের কেন্দ্রীয় কার্যালয় (এনএসও অর্থাৎ ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস) থেকে প্রকাশিত রিপোর্ট নরেন্দ্র মোদির এই বক্তব্যের শেষে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে দিল। প্রশ্নচিহ্ন না বলে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন বললে কথাটা আরও মানানসই হয়। ধরা যাক অনলাইন সেল ধমাকায় অর্ডার দেওয়া হল একটা দামী মোবাইল ফোন। দাম মিটিয়ে দেওয়া হল আগেই। ডেলিভারি এলে, বাহারি বাক্স খুলে দেখা গেল আসলে সাজানো রয়েছে একটা ইট। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিল, এই দুটো তথ্য আত্তীকরণের অনুভূতি একই!

এনএসও বলল, ১০০ শতাংশ তো দূর কি বাত, সিকিভাগেরও বেশি গ্রামীণ লোকেদের আসলে শৌচাগারে যাওয়ারই কোনও উপায় নেই। এক লক্ষেরও বেশি বাড়িতে তারা সমীক্ষা চালিয়েছিল ওই সংস্থা। লাল দাগ পড়া মার্কশিট বলছে, গ্রামাঞ্চলের ২৮.৭ শতাংশ বাড়িতেই শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। আরও অবাক হওয়ার ব্যাপার হল, যে বাড়িতে শৌচাগার রয়েছে, অর্থাৎ ৭১.৩ শতাংশ বাড়িতে, তাদের মধ্যে আবার সাড়ে তিন শতাংশ শৌচাগার কোনওদিনই ব্যবহার করা হয়নি। শৌচাগারের এই নেই-রাজ্যে সবার উপরের জায়গাটা দখল করে ছিল আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশা। ৫০.৩ শতাংশ গ্রামীণ বাড়িতেই শৌচাগার নেই। এর ঠিক পরেই ছিল উত্তরপ্রদেশ। ৪৮ শতাংশ গ্রামীণ বাড়ি ছিল শৌচাগারহীন।

রিপোর্টে রিপোর্টে এত তফাৎ দেখলে চোখ কপালে ওঠে। কার কথা বিশ্বাস করব ভাবতে বসলে বিস্ময় হয়। একই সময়ের অন্য একটা সরকারি রিপোর্ট অবশ্য দাবি করেছিল, গ্রামীণ ভারতে ৯৩.৩ শতাংশ বাড়ির নিজস্ব শৌচাগার রয়েছে। সামাজিক ব্যবস্থা তলিয়ে দেখেন যাঁরা, তাঁদের এক বড় অংশ বলেন, সরকার যদি মনে করে শৌচাগার গড়ে দিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়, তা হলে এক মস্ত ভুল করা হবে। ইলেক্ট্রনিক জিনিসের সঙ্গে যেমন আসে ইউজার ম্যানুয়াল, শৌচাগার গড়ে দেওয়ার পরেও এমন একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি। ব্যবহারের এই নির্দেশিকা কাগজের উপরে কালিতে ছাপানোর দরকার নেই, ছাপ রাখার দরকার আছে প্রান্তিক অঞ্চলে থাকা মানুষদের মনে। এত দিনের মন্দ অভ্যেসটা কেন ত্যাগ করা দরকার, আর গড়ে দেওয়া শৌচাগার ব্যবহার করলে লাভ আসলে কী, এগুলো যুক্তি দিয়ে বোঝানো জরুরি। সেটাই হচ্ছে না।

গ্রামাঞ্চলে যে সংস্থাগুলো সমীক্ষা করে, প্রান্তিক মানুষেরা কেমন আছেন তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে, তারা কিছু অদ্ভুত তথ্যের সন্ধান পেয়েছে। দেখা গিয়েছে, শৌচাগার হয়েছে, কিন্তু ব্যবহার করার জল অমিল। রাজস্থান, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশের বহু গ্রামে এমনই অবস্থা। জল না থাকার ফলে যা হওয়ার ছিল, তাই হয়েছে। শৌচাগারগুলো হয়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম্যবাড়ির স্টোর রুম, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। দিনের পর দিন অব্যবহৃত জিনিস ডাঁই করা হচ্ছে ওই ঘরগুলোতে। ছিটকিনির বাইরে ঝুলছে সস্তার তালা। ‘বদ্ধ ঘরে প্রকৃতির ডাকে মজা নেই’, ‘ভোরবেলা কাজ সারতে বেরোলে গাঁয়ের চারটে লোকের সঙ্গে কথাও তো হয়’, ‘বাড়ির মধ্যেই বাথরুম হলে বাড়ি অপবিত্র হয়ে যায়’— এমন নানা ধারণার কথা জানতে পারা গিয়েছে এমন কিছু সমীক্ষায়। মজার কথা হল, ‘কাজ করে দিয়েছি’ বলে ওয়েবসাইটে তথ্য ঢেলে দিতে দরকার হয় কয়েকটা মাত্র ক্লিক। ফর্মুলা বসানো মানচিত্রে হলুদ কিংবা লাল রাজ্য সবুজ হয়ে যায় পলকে। অথচ যে কাজ করলাম তা আদৌ ‘কাজের কাজ’ হল কি না, অর্থাৎ ব্যবহারের উপযোগী হল কি না তা মূল্যায়নের জন্য আমাদের হাতে কোনও রাষ্ট্রীয় মাপকাঠি নেই। নির্ভর করে থাকতে হয় বেসরকারি কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উপরে। সরকার সেই রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে। কিন্তু দিনের শেষে প্রান্তিক মানুষদের জীবনে কোনও বদল আসে না। সুস্থ, পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যেসটাও থেকে যায় সেই তিমিরেই।

পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যেস গড়ে তোলার জন্য সরকারি ভাবে উদ্যোগ কতটা? প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও লজঝড়ে ল্যাম্পপোস্টেও লাগানো থাকতে দেখেছি পুজোয় পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদান পাওয়ার বিরাট ফ্লেক্স। দেখেছি সিলিন্ডারে ভর্তুকি দেওয়ার বিশাল প্ল্যাকার্ড। পরিচ্ছন্নতা বিধি মেনে চলা নিয়ে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম করার বিপদআপদ নিয়ে বার্তা সেভাবে চোখে পড়ে না। ভিন রাজ্যের ছবিতে দেখেছি, গ্রামের রাস্তার মুখে লেখা ‘এটি একটি উন্মুক্ত শৌচকর্মমুক্ত গ্রাম’। গ্রামের শেষ টয়লেটটি গড়ে দেওয়ার পরে তা লাগিয়ে হয়তো চলে গিয়েছিলেন সরকারি কর্মীরা। তার পরে আসল চিত্রটার খোঁজ নিতে প্রশাসকের অবশ্য বয়েই গিয়েছে।

উত্তর কলকাতায় আমাদের বাড়িতে গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করতে এসেছিল নামখানা অঞ্চলের এক যুবক। পিরুদা। প্রায় আড়াই দশক আগের কথা। আমাদের নতুন ফ্ল্যাটের সবকিছুকে পরমাত্মীয় বলে মনে করলেও বাথরুমটা ওর মন কাড়তে পারেনি কোনওদিন। প্রকৃতির ডাক এলেই পিরুদা বলত, ‘ফাঁকায় যাব’। গলায় একটা গামছা ঝুলিয়ে আর হাতে একটা মগ নিয়ে ও চলে যেত বাড়ি থেকে প্রায় শতিনেক মিটার দূরে একটা নির্জন পুকুরধারে। পুকুরপাড়টা জঙ্গলময় ছিল। বছরখানেক কাজ করার পরে ও দেশে ফিরে যায়। গত মাসে ওর সঙ্গে হঠাৎ দেখা নিউটাউনের এক বিরাট হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট রুমে। কালো টি শার্ট কালো জিন্স। শার্টের পিছনে লেখা ক্লিনার। এ কথা ও কথার পরে জানতে পারলাম, সরকার থেকে ওর বাড়িতেও করে দেওয়া হয়েছে শৌচাগার। ওখানে মাছ ধরার জাল রাখা হয়। আর পাঁচতারা হোটেলে কাজ করলেও ও আজও ‘ফাঁকায়’ যায়। হোটেলের পিছনের দরজা দিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই নাকি একটা বিরাট ঝিল রয়েছে!

নাকে রুমাল চেপে মহাগনরীও ছুঁয়ে যাই একটু। অন্ধকার সামান্য গাঢ় হতেই শহরাঞ্চলের সুলভ শৌচালয়ের দেওয়ালে প্রস্রাব করার সারিবদ্ধ মিছিল দেখেছি বহুবার। শৌচাগারের ভিতরের যাওয়ার থেকে বাইরে কাজ সারতেই অনেকে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ, এই আজকের দিনেও। ‘দেওয়াল নোংরা করছেন কেন?’ জিজ্ঞেস করায় আমার দিকে একবার উড়ে এসেছিল, ‘ছোট কাজ করতে দুটাকা। বড় হলে পাঁচ টাকা। মাসে পাঁচশো টাকার বাথরুম খরচা আপনি দেবেন?’ জেনেছিলাম, পাশেই ওঁর পান-বিড়ির গুমটি রয়েছে।

উন্মুক্ত শৌচকর্মহীন তকমা পাওয়ার প্রচলিত রীতিটি বেশ মজার। এত তাড়াতাড়ি ম্যাপের সবুজায়ন দেখে মনে হয়, মার্কশিট তৈরি হয়ে যাওয়ার পরেই বুঝি পরীক্ষা দিতে বসেছে পরীক্ষার্থী। প্রতিটা বাড়িতে শৌচাগার গড়ে ওঠার পরে গ্রামপ্রধান তা জেলাশাসককে জানান। জেলাশাসক পরিদর্শক দল পাঠান। অনুসন্ধান চালানোর সময় তাঁরা যদি কাউকে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ না করতে দেখেন, রাস্তায় যদি মানুষের বর্জ্য ছড়িয়ে না থাকতে দেখেন, তা হলেই ওডিএফ (ওপেন ডিফিকেশন ফ্রি)-এর মুকুট টুক করে পরে ফেলে ওই গ্রাম। কেন্দ্র নাকি এই তকমা দেওয়ার আগে তৃতীয় পক্ষকে দিকে অডিট করিয়ে নেয় শুনেছি। প্রধান পরীক্ষকের থেকে মাধ্যমিকের খাতা নেওয়ার আগে শিক্ষকেরাও তো শুনে থাকেন আকছার, ‘নম্বর কাটা যাবে না একদম।’ এটা অনুরোধ না হুমকি বুঝতে অসুবিধা হয় না।

করোনা ঠেকাতে নয়, হাসিটা যেন না দেখা যায় তার জন্য মাস্কটা পড়ে নিলাম এইমাত্র। কদিন পর, ১৯ নভেম্বর নাকি ওয়ার্ল্ড টয়লেট ডে। বিশ্ব শৌচাগার দিবস। ২০১৩ সালে নিউ ইয়র্কে, জাতিসঙ্ঘের ৬৭তম সংস্করণে, বিশ্বের ১২২টা দেশ এই দিনটাকে মেনে নেয়। দুনিয়াজুড়ে পরিচ্ছন্ন অভ্যেস গড়ে তোলার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত, এমন দিন।

এক রিপোর্ট প্রাণে খুশির তুফান ওঠার কথা বলে। আর অন্য রিপোর্ট গুমরে বলে, আমি কাঁদি সাহারায়।