Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জো বাইডেন ও ভরসার হাত

বর্ণিল ভট্টাচার্য

 


লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

 

 

 

এই শতকে পঞ্চমবার আমেরিকার একজন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন না। নির্বাচনের তিক্ত লড়াইয়ের পর, মেরুবিভাজিত আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বদলে জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে আসবেন ছেচল্লিশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে, ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কালের জন্য।

ইউএস কংগ্রেসের বিভাজনের কারণে (সেনেট রিপাবলিকানদের দখলে থাকতে পারে) রাষ্ট্রপতি বাইডেনের হয়ত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য থাকবে না৷ কিন্তু ইউএস-এর সংবিধান প্রেসিডেন্টকে অনেক বেশি ক্ষমতা দেয় বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে। বাইডেন কীভাবে তাকে কাজে লাগাবেন? তার ফলই বা কী হবে বিশ্বজুড়ে?

আসন্ন কিছু পরিবর্তন খুবই পরিষ্কার। আমরা আমেরিকাকে ট্রাম্পের ‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’ নীতি থেকে সরে আসা দেখব, কারণ বাইডেনের মতে তা ‘আমেরিকাকে একা করে দিয়েছে।’ তার পরিবর্তে নতুন রাষ্ট্রপতি আমেরিকার নেতৃত্বের নবীকরণে জোর দেবেন। তিনি কূটনীতিকে প্রাথমিক আশ্রয় ধরবেন। বাইডেন ন্যাটো বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গড়ে ওঠা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী সংগঠনগুলিতে আস্থা রাখেন। জানুয়ারি ২০২১-এ দায়িত্বগ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যেই বাইডেন তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ করবেন। প্যারিস পরিবেশ অ্যাকর্ডে আস্থাজ্ঞাপন করবেন,  রাষ্ট্রসঙ্ঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু-পরিবর্তন প্যানেলে আবার অর্থ পাঠাবেন। ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের বিষয়ে এমন যোদ্ধা মনোভাব থাকবে না। ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যের উপর যেমন-খুশি করও হয়ত বসবে না।

বাইডেনের অ্যাজেন্ডার অন্য বিষয়গুলোর সমাধান জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এর মধ্যে আছে ইরানের সঙ্গে নিউক্লিয়ার চুক্তি (প্রথম যার চেষ্টা শুরু হয়েছিল ওবামার আমলে, ২০১৫ সালে), তথা বিশ্ববাণিজ্য চুক্তি বা ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপে আবার অংশগ্রহণ।

অন্যদিকে ট্রাম্প স্বেচ্ছাচারী শাসকদের, যেমন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন বা তুর্কির এরদোগানের খুবই প্রশংসা করতেন, ‘অসামান্য’ বলতেন তাঁদের। বাইডেন তাঁদের সঙ্গে কঠোরতর আচরণ করবেন। তিনি সেই স্বেচ্ছাচারীদের দ্বারা অত্যাচারিত দুর্বলতর দেশগুলিকেই সমর্থন করবেন, যেমন ইউক্রেন, তথা সৌদি আরবের রাজপুত্র মহম্মদ বিন সলমনের মতো দুর্বৃত্তদের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক রাখবেন না।

অন্য বিষয়ে বাইডেন-প্রশাসন আগের রাষ্ট্রপতির নীতি অনুসারেই চলবে সম্ভবত। যেমন, বাইডেন আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্য কমিয়ে ড্রোন আক্রমণ বজায় রাখবেন। আল কায়দা, ইসলামিক স্টেট, বা পূর্ব আফ্রিকার আল শাবাবের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলিকে বায়ুপথে ধ্বংস করাই তাঁর লক্ষ্য হবে, মাটিতে বুটের প্রতিধ্বনি তোলার চেয়ে। ভেনিজুয়েলার নিকলাস মাদুরাও বা উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন-দের দুর্নীতিপরায়ণ সরকারকে অর্থনৈতিক অনুমোদন দেওয়ার বিরোধিতা বজায় থাকবে।

কিন্তু এ-বিষয়ে কোনও ভ্রান্তি না থাকাই ভালো যে, ট্রাম্প ক্ষমতায় না থাকলেও ট্রাম্পবাদ থাকবেই। মনে রাখতে হবে যে, ট্রাম্প নির্বাচনে যা আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে ভালোই ফল করেছেন। সাত কোটি দশ লক্ষ ভোট তিনি পেয়েছেন। বাইডেন তাঁর চেয়ে মাত্র চল্লিশ লক্ষ ভোট বেশি পেয়েছেন। এই প্রলম্বিত ট্রাম্পবাদ কী অর্থ বহন করে বিশ্বের কাছে?

এর উত্তর কেবল রাষ্ট্রপতি বাইডেনের শাসনকালেই পাওয়া যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজের বিদেশনীতির কোনও সুউচ্চ লক্ষ্য ছিল না। তা ছিল আদানপ্রদাননির্ভর, একমুখী, তাঁর নিজের বিচারবুদ্ধিনির্ভর, তাতে কোনও সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল না।

এরকম অদম্য আচরণ বাইডেনের রাষ্ট্রপতিত্বে পাওয়া যাবে না। কিন্তু রিপাবলিকান বিরোধীরা আন্তর্দেশীয় সংগঠন ও বহুমুখী চুক্তিগুলি নিয়ে সন্দিগ্ধই থেকে যাবে। সুতরাং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদেশনীতির সব ভুল বাইডেনের কলমের এক খোঁচায় চলে যাবে, এমন ভাবার কারণ নেই।

এটাও মনে রাখা দরকার যে আমেরিকার সঙ্গীরাও বিগত চার বছরে কিছু শিক্ষা নিয়েছে। তারা বুঝেছে যে অকার্যকর ও মেরুবিভাজিত রাজনৈতিক অবস্থায় নিজেই রয়েছে যে আমেরিকা, সে আমেরিকা নির্ভর‍যোগ্য সাথী নয়৷ তারা হয়ত অপেক্ষাকৃত বন্ধুত্বপূর্ণ বাইডেনকে সাদরে গ্রহণ করবে, কিন্তু অবিচ্যুত আমেরিকার ধারণা শেষ।

যেমন অনেক ইওরোপীয় কূটনীতিকই এখন আমেরিকায় আস্থা রাখার চেয়ে বরং পরস্পরনির্ভর, স্বাধীন ইওরোপীয় নীতি চাইছেন। শক্তিশালী ইওরোপ কিন্তু চিন বা পরিবেশ দূষণ রোধে আমেরিকার সহায় হতে পারত। আমেরিকা কি নিজের ন্যাটো যোগ দৃঢ় করবে আবার অনেক টাকা ঢেলে? জার্মানিতে কি আবার সেনা মোতায়েন করা হবে যা ট্রাম্প তুলে নিয়েছিলেন? এসব এখনই অনুমান করা কঠিন। কিন্তু আশা করা যায়, ন্যাটো বা অনুরূপ আঁতাতগুলিতে বেশি অংশগ্রহণের জন্য আমেরিকা ইওরোপীয় দেশগুলির উপর চাপ বজায় রাখবে। কিন্তু আবার, ইওরোপীয় সঙ্গীদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করতে যতটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তা এখন আমেরিকার পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়।

সবথেকে বড় কথা, রাষ্ট্রপতি বাইডেনকে চিনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নীতি নিতে হবে— আমেরিকার সাধারণ কিন্তু পরস্পরবিরোধী স্বার্থগুলিকে মাথায় রেখে। ট্রাম্প প্রশাসনের আক্রমণাত্মক প্রযুক্তি নীতি দিশাহীন ও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় সুরক্ষার নামে চিনের প্রযুক্তির উপর রপ্তানি-নিয়ন্ত্রণ জারি করা, অথবা টিকটক বা উইচ্যাটের মতো মোবাইল অ্যাপে নিষেধাজ্ঞা জারি করা কিন্তু এই কোম্পানিগুলির জনপ্রিয়তা ও কলেবর হ্রাস করতে আদৌ কাজে আসেনি। বাইডেনের প্রশাসনকে এই ভুলগুলো শোধরাতে হবে এবং এই সত্য মেনে নিতে হবে যে চিন প্রযুক্তিতে এক দানবিক শক্তি।

তবুও, আশা করা যায় ট্রাম্প যেভাবে মানবাধিকার বিষয়ে নিশ্চুপ ছিল, তা না করে বাইডেন হংকং, তাইওয়ান আর উইঘুরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিষয়ে সোচ্চার হবেন। একই নীতি নেওয়া হবে ইয়েমেনে, যেখানে সৌদি দেশ যুদ্ধের মাধ্যমে হিংসা ছড়াচ্ছে।

এবং বাইডেনের প্রশাসন যখন, ধরা যাক চিনের সঙ্গে কৌশলগত শত্রুতার জন্য,  নতুন সঙ্গীর খোঁজ করবে, তখন ভারত তাদের প্রথম পছন্দ হবে না বলেই আশা করা যায়। নতুন উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিস নিজে আধা-ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও মোদির প্রতি কোনও ভালোবাসা দেখাননি। গতবছর তিনি ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্করের প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেন, যখন তিনি ইউএস-এ কূটনৈতিক সফরে এসেছিলেন, কারণ তিনি ইউএস প্রতিনিধি প্রমীলা জয়পালের সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিত থাকতে চাননি। প্রমীলা কাশ্মিরে হাউজ অফ রেপ্রেসেনটেটিভ-এর এক রেজোলিউশনের দায়িত্বে ছিলেন ইন্দো-আমেরিকান হিসেবে, যেটি ভারতের নীতির বিরোধী।

বাইডেন ‘গণতান্ত্রিক অধিবেশন’ ডাকবেন বলেছেন রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথম বছরেই, যাতে পৃথিবীর সব গণতন্ত্রগুলি একসঙ্গে আসে ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি শক্তপোক্ত হয়, যেসব রাষ্ট্র পিছু হঠছে  তাদের মুখোমুখি হওয়া যায় এবং সাধারণ অ্যাজেন্ডা তৈরি করা যায়। এমনটাই লিখেছেন প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি বিদেশনীতি বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধে। দুর্নীতি, মানবাধিকার ও স্বৈরাচার-বিরোধিতা হবে মূল লক্ষ্য।

সবশেষে, অবশ্যই বাইডেনকে অভ্যন্তরীণ অ্যাজেন্ডাগুলির মুখোমুখি হতে হবে, যথা করোনাভাইরাস অতিমারি, বেকারত্ব, জাতিবিদ্বেষ ও অসাম্য, যেগুলি হয়ত বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তাঁর উচ্চাশাকে নিয়ন্ত্রণ করবে৷ উপরন্তু, বাইডেনকে একটা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। যে উপদেষ্টারা ওবামার নীতিগুলিই বহাল রাখতে চান তাঁদের কথা শুনবেন, নাকি যাঁরা একবিংশ শতকের নতুন বিদেশনীতি চান তাঁদের কথা শুনবেন? এই বিতর্কের উত্তর পাওয়া যাবে আগামী বছরগুলিতে। এটুকু হয়ত নিশ্চিতভাবেই আশা করা যায় যে ইউএস আর পৃথিবীর পুলিশি করবে না। চিনের সামরিক সেনাপতি সান জু একবার বলেছিলেন, বন্ধুদের পাশে রাখুন, শত্রুদের রাখুন আরও কাছে— বর্তমানের আমেরিকাকে দেখে অনেক দেশই সেকথা স্মরণ করবে।