শঙ্কর সান্যাল
লেখক অর্থনীতির ছাত্র, পেশায় সাংবাদিক
ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে। এই মুহূর্তে বিহারের সবচেয়ে দুঃখী মানুষটির নাম নীতীশ কুমার। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে হতেই হচ্ছে। অথচ এই মুখ্যমন্ত্রিত্বের কোনও অর্থই নেই। একে জনমত পক্ষে নেই। অন্যদিকে জোটসঙ্গী বিজেপির হাতের পুতুল থাকতে হবে। গত দেড় দশকে ঢের দাপট দেখিয়ে নীতীশ এখন সত্যিই ফান্দে পড়া বগা। বিহার বিধানসভার ২৪৩টি আসনের মধ্যে নীতীশের জনতা দল ইউনাইটেডের ঝুলিতে মাত্র ৪৩টি। ১১৮টি আসনে প্রার্থী দিয়ে হেরেছেন ৭৫টিতে, ভোট পেয়েছেন মোটে ১৫ শতাংশ। হেরে গিয়েছেন নীতীশ কুমার। বিজেপি এই নড়বড়ে সরকারের দায়িত্ব নেবে না। তাই নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতে না হতেই বিঝেপির সভাপতি জেপি নাড্ডা সাততাড়াতাড়ি জানিয়ে দিয়েছেন নীতীশই মুখ্যমন্ত্রী। অতঃপর কাঁটার মুকুট তাঁরই মাথায়।
এ জেতাও কী জেতা! প্রবল ঢক্কানিনাদে কানপাতাই দায়। বিহারে নাকি গেরুয়া ঝড় উঠে বিরোধীদের লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। এনডিএ পেয়েছে ১২৫টি আসন। বিহারে ম্যাজিক সংখ্যা ১২২টি। কিন্তু জিতনরাম মাঝি আর মুকেশ সাহানির দলের ৮টি আসন না এলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেকটাই দূরে থাকতে হত এনডিএ-কে। অথচ ভোটের কদিন আগেও এই দুটি দল মহাজোটের সঙ্গেই ছিল, এনডিএ জোটে নয়। এখানেই খেলা রসায়নের। মানি এবং ম্যানিপুলেশনের অব্যর্থ বিক্রিয়া। আরও এক রসায়ন আসাউদ্দিন ওয়ায়েসির মজলিস এ ইত্তেহাদুল মুসলেমিনকে ঘিরে। কট্টর ইসলামি প্রচার করে সীমাঞ্চলের পাঁচটি আসনই কেবল এরা দখল করেনি, মহাজোটের কমপক্ষে এক ডজন আসনের মূল রসায়নটাই বদলে দিয়েছে। কিন্তু এত করেও প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে এনডিএ-র সঙ্গে মহাজোটের ফারাক মাত্র ১২ হাজার ভোটের। শতাংশের হিসাবে যা ০.০৩ শতাংশ। তবে এর মধ্যেও একটি সত্যি কথা হল বিজেপির আসনসংখ্যা ২০১৫ সালের থেকে বেড়েছে। বিজেপি পেয়েছে ১৯.৪৮ শতাংশ ভোট। বিধানসভায় ৭৪টি আসন পেয়েও মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি ছেড়ে দেওয়া দায়হীন ক্ষমতা ভোগের একটি নতুন রণকৌশল বিজেপির। বস্তুতপক্ষে তারাই সরকার চালাবে কিন্তু কোনও দায় নেবে না।
গত লোকসভা নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় জনতা দলকে আক্ষরিক অর্থেই শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল লড়াইয়ের ময়দান থেকে। ঠিক এক বছর পরে বিধানসভা নির্বাচনে তেজস্বী যাদবের দল বিহার বিধানসভায় একক বৃহত্তম দল। আরজেডির ঝুলিতে রয়েছে ৭৫টি আসন। শতাংশের হিসাবে ভোটপ্রাপ্তিও সবচেয়ে বেশি— ২৩.২৮ শতাংশ। আসনসংখ্যা নিশ্চিতভাবেই আরও বৃদ্ধি পেত যদি তেজস্বীর দল তথা মহাজোট আসাউদ্দিন ওয়ায়েসির মিম-এর মোকাবিলা করতে পারতেন। পশ্চিমবঙ্গ ঘেঁষা সীমাঞ্চলের পাঁচটি আসন জেতা ছাড়াও ডজন খানেক আসনে সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসিয়ে মিম আরজেডির মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। বস্তুতপক্ষে মিম-রসায়ন কাজ না করলে ওই ডজন খানেক আসনে এনডিএ-র জেতার কোনও গল্পই ছিল না। তখন পাটলিপুত্রের সিংহাসনও দূর অস্ত্ হয়ে যেত। গোটা নির্বাচনী প্রচার পর্ব জুড়ে নীতীশ কুমার থেকে বিজেপির ছোট রড় মাঝারি নেতারা, এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত বিহারে দেড় দশক ধরে চলা লালুপ্রসাদ যাদব এবং রাবড়ি দেবীর তথাকথিত “জঙ্গলরাজ”-উল্লেখ ছাড়া আর প্রায় কিছুই বলেননি। তবু বিহারী ভোটারদের প্রায় এক চতুর্থাংশই আরজেডিকে ভোট দিয়েছেন। তেজস্বী এটা প্রমাণ করথে পেরেছেন যে, ধর্ম, জাতপাত এবং প্রতিশ্রুতির গিমিকের বাইরে গিয়ে আর্থ-সামাজিক ইস্যুগুলিকে সামনে এনে ফেললে মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়।
কংগ্রেস যে কেবল ভারেই আছে, ধারে নেই, তা আবার প্রমাণিত হয়ে গেল বিহার বিধানসভা নির্বাচনে। ভোট ঘোষণার পরে ১০ নম্বর জনপথ বিহারের মানুষের মেজাজটাই বুঝতে পারেনি। এই বোঝার জন্য যতটা রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার প্রয়োজন তা রাহুল গান্ধি অ্যান্ড কোম্পানির নেই, সেটাও প্রমাণিত হয়ে গেল। আসলে কংগ্রেস দল হিসাবে ভারতীয়দের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আগেই তার নিজস্ব ভিত্তিভূমি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গিয়েছে। ১৮৮৫ সালে জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেসের ভিত্তি ছিল উদীয়মান ভারতীয় ধনতন্ত্র। স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের যাবতীয় প্রগতিশীল পদক্ষেপ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা বিদেশনীতি, নির্জোট ভূমিকা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র গড়ে রাষ্ট্রীয় পুঁজি নির্মাণের প্রচেষ্টা— সবটাই ছিল ভারতীয় পুঁজিবাদের প্রয়োজনে এবং ইচ্ছায়। একদা যে কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বাইরে সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র গড়ে তুলেছিল, সেই কংগ্রেসই গত শতকের আটের দশকের শেষ থেকে উদার অর্থনৈতিক নীতির সামনে নতজানু হয়ে গেল। আর কংগ্রেসের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হল সেটি কোনও রেজিমেন্টেড পার্টি নয়। ফলে তাদের পুঁজিবাদের পক্ষে, গোটা অর্থনীতির কর্পোরেটায়নের পক্ষে উলঙ্গ নৃত্য করা সম্ভব নয়। ২০১৬ সালে কংগ্রেসি মন্ত্রী জয়রাম রমেশ অরণ্যের অধিকার আইন পাশ করিয়ে ভারতের জঙ্গলমহলে অবাধ কর্পোরেট লুটের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। এই কংগ্রেসকে ভারতীয় পুঁজির আর প্রয়োজন নেই। তাদের প্রয়োজন আরও বড় পাহারাদার। যে ফার্ম বিল ২০২০ প্রণয়ন এবং শ্রম আইন সংশোধনের মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে। এটা কংগ্রেসের মতো প্ল্যাটফর্ম মার্কা দলের পক্ষে সম্ভব নয়, এর জন্য বিজেপির মতো রেজিমেন্টেড পার্টি প্রয়োজন। তাই ভিত্তিভূমি থেকেই প্রত্যাখ্যাত কংগ্রেস। অন্যদিকে জনগণের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যানের কারণ, বিজেপি আজ যে সমস্ত চূড়ান্ত জনবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলি বস্তুতপক্ষে কংগ্রেসেরই ফেলে যাওয়া জুতো। পা গলানোর আগে বিজেপি সেগুলিই একটু সেলাই, একটু পালিশ করে নিচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান জ্বলন্ত ইস্যুগুলি নিয়ে কংগ্রেসের কিছুই বলার নেই। আক্ষরিক অর্থেই বিজেপির বিরুদ্ধে, বিশেষ করে তাদের অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে বলার মতো কথা কংগ্রেস খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বিহারের মতো রাজ্যে ৭০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে কংগ্রেসকে মাত্র ১৯টি আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ভোট জোটে সাকুল্যে সাড়ে ৯ শতাংশ।
বিহার নির্বাচনে বামপন্থীদের ভূমিকা এবং মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে ২০১১ সালের পর থেকে যখন গোটা দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে বামপন্থীরা প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছিলেন, তখন বিহার নির্বাচনের ফলাফল কেবল তাদের অক্সিজেনই দিল না, ফ্যাসিস্ট বিজেপির দোর্দণ্ড দাপটের বিরুদ্ধে বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতাও ফিরিয়ে আনল। বস্তুতপক্ষে বিহার নির্বাচনে মহাজোট যে প্রচারের রণকৌশল নিয়েছিল, তা বামপন্থীদেরই তৈরি করা। বিহারের রাজনীতি স্বাধীনতার পর থেকেই ধর্ম এবং জাতপাতভিত্তিক। ধর্ম এবং জাতপাতের ভিত্তিতেই প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু প্রচার কৌশল, সবই নিয়ন্ত্রিত হত। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে এনডিএ তথা বিজেপিকে রাম রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি মহাজোট। মূলত লকডডাউন পরবর্তী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যুগুলির সওয়াল-জবাবের মধ্যেই ভোটপ্রচারকে বেঁধে দিতে সক্ষম হয়েছিল মহাজোট। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বিজেপির রণকৌশল বিহারে পর্যদুস্ত হয়ে গিয়েছে। বামপন্থীরা মাত্র ২৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৬টি আসনে জয়লাভ করেছে। বিহারের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব স্ট্রাইকিং রেট— ৫৫.১৭ শতাংশ। ভোট গণনার আগে সিপিআই (এমএল)-এর পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণাণের ধারণা ছিল, তাঁর পার্টি ১০টি আসন পেতে পারে। ফল প্রকাশে দেখা গেল, তাঁরা ১২টি আসন পেয়েছেন। সিপিআই এবং সিপিএম দুটি করে। এই ফল বাম নেতাদের কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল, লকডাউন ভারতীয় অর্থনীতির করুণ চেহারাটি বেআব্রু করে দিয়েছে। মানুষের পিঠ দেওয়ালে লেগে গিয়েছে। একমাত্র বামপন্থীরাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর প্রতিবাদ করছেন। ফলও তাঁরা হাতেনাতে পেয়ে গিয়েছেন। এই পরিস্থিতিকে ধরে রাখতে গেলে বামপন্থীদের এবং বামপন্থীদেরই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এর বাইরে আর কোনও বিকল্প রাস্তা নেই। কংগ্রেস ক্রমশই ভারতীয় রাজনীতিতে একটি বোঝা হয়ে উঠছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে একদিন সে নির্মূল হয়ে যাবে। ভারতীয় বুর্জোয়াদের মধ্যে কখনও কোনও প্রগতিশীল অংশ ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। দ্বান্দ্বিকতার এই নিয়মটি না মানলে বিপদ বামপন্থীদেরই।