Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিহার নির্বাচনের রায় এবং বামেদের পুনরুত্থানের রাজনৈতিক তাৎপর্য

সৌভিক ঘোষাল

 


লেখক প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এবং এনডিএ গোটা দেশে এবং বিহারে চমকপ্রদ ফল করে। এই জয় এবং প্রধান বিরোধী দল আরজেডির মুখ্য নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের কারাবাসজনিত বিহারের রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে অনেকেই একসময় ভেবেছিলেন ২০২০-র বিহার বিধানসভা নির্বাচন হবে একপেশে। কোভিড-১৯ ও লকডাউনকেও এনডিএ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। ক্ষমতায় ফিরলে বিহারের জনগণকে বিনামূল্যে কোভিড টিকাদানের প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের সব মানুষের ন্যায্য অধিকারকে একটি রাজ্য নির্বাচন জয়ের তাস হিসেবে ব্যবহার করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা।

কিন্তু একতরফা নির্বাচন সম্পর্কে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতামতের বিপরীত বাস্তবতা সামনে আসতে শুরু করে মহাজোটের ঐক্যবদ্ধ চেহারাটি সামনে আসার সময় থেকেই। বিশেষ করে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন সহ বাম দলগুলির উপস্থিতি ও নিজস্ব অ্যাজেন্ডা গোটা পরিস্থিতিকে দ্রুত পালটে দিতে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে এনডিএ সরকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের হামলা ও দমনপীড়নের বিরুদ্ধে লিবারেশন সহ বামেদের নাছোড় মাটিকামড়ানো কঠিন রাস্তার লড়াইগুলি নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে ঝড় তোলে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের জন্য জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করে। লকডাউনের ফলে অভিবাসী শ্রমিকেরা সহ বিহারের যে গরীব জনগণ সীমাহীন যন্ত্রণা ও অবমাননার মুখোমুখি হন, সিপিআই (এম-এল)-এর কর্মীরা প্রাণপণে তাদের পাশে দাঁড়ান ও নানা ধরনের সাহায্য, সহযোগিতা ও আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাদের ভরসার জায়গা ও কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন।

পরিস্থিতির এই দ্রুত পরিবর্তন বিজেপি ও এনডিএ-কে সন্ত্রস্ত করে তোলে। বিজেপি সভাপতি থেকে শুরু করে তাদের তাবড় নেতারা সিপিআই (এম-এল)-কে সুনির্দিষ্টভাবে আক্রমণের বর্শামুখ করে তোলেন। লিবারেশন সম্পর্কে অলীক মিথ্যা নানা প্রচার বিহারের বুকে সিপিআই (এম-এল) রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে চর্চাকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে।

১৯৮০-র শেষদিকে সিপিআই (এমএল) প্রথমে আইপিএফ-এর মঞ্চ থেকে ও তারপর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পার্টি পরিচিতি নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে। বুথ-দখল রুখে দেওয়া এবং ভূমিহীন দরিদ্র ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত দলিতদের তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সিপিআই (এম-এল)-এর রাজনীতি তাদের ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ ও দলিতদের ক্ষমতায়নের দল হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। ভোজপুরে সিপিআই (এম-এল)-এর পক্ষে ভোট দেবার জন্য দলিতদের গণহত্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু তারা ১৯৮৯ সালে প্রথম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাংসদ হিসাবে কমরেড রামেশ্বর প্রসাদকে সংসদে পাঠাতে সফল হয়।

পরবর্তীকালে সাহার থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জয়ী হন ভোজপুরের প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রাম নরেশ রাম। বিহারের রাজ্য সরকারি কর্মচারী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কমরেড যোগেশ্বর গোপকে জনগণ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিধানসভায় পাঠান। প্রথমে বিহারে ও তারপর রাজ্য ভাগের পর ঝাড়খণ্ডের জনগণের সবচেয়ে দুঃসাহসী কণ্ঠ, কমরেড মহেন্দ্র সিং একাধিকবার নির্বাচনে বিজয়ী হন। রাজনীতির ময়দান থেকে সরানোর জন্য ২০০৫ সালের নির্বাচনের মনোনয়ন পেশের ঠিক পরেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও বিহারের মানুষ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন চন্দ্রদীপ সিং, অমরনাথ যাদব, অরুণ সিং, সুদামা প্রসাদ ও রাজরাম সিংয়ের মতো প্রখ্যাত কৃষক নেতাদের। কৃষিমজুর নেতা সত্যদেব রাম, সীমাঞ্চলের জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা মেহেবুব আলম, বিনোদ সিং ও রাজকুমার যাদবের মতো ঝাড়খণ্ডের জনপ্রিয় নেতারা বিহার ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় সিপিআই (এম-এল) বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

এই লড়াই আন্দোলনের ঐতিহ্যের সঙ্গে সমন্বিত হয় শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র ক্ষোভের সমকালীন বাস্তব। সুশাসন ও উন্নয়নের রেটরিকগুলির আড়ালে নীতীশ সরকারের আমলে বিহারের বাস্তব অবস্থাটি নির্বাচনী প্রচারে প্রবলভাবে সামনে আসে।

নীতীশ কুমারের প্রশাসনিক মডেলে প্রথম থেকেই ছড়ি ঘুরিয়েছে আমলাতন্ত্র এবং তাতে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তেমন কোনও ভূমিকাই থাকেনি। জনগণের নানান অংশের বৈধ দাবি ও আন্দোলনগুলোর প্রতি কোনও সম্মানও দেখানো হয়নি। বছর-বছর ধরে চলা এই আমলাতন্ত্র-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা ক্রমেই আরও বেশি স্বেচ্ছাচারী ও অনির্ভরযোগ্য হয়ে দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন বিভাগ ও অঞ্চলে চক্রগুলোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে; যে সমস্ত অফিসার নির্দেশ মতো চলেননি, প্রধান্যকারী নেতা ও স্বার্থের প্রতি অনুগত না হওয়ায় তাদের হেনস্থা ঘটানো ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নীতীশ কুমারের ‘সুশাসন’-এর আষাঢ়ে কাহিনি সৃজন-এর মতো দুর্নীতিতে কালিমালিপ্ত, মুজাফফরপুরের নারী আবাসে ধর্ষণ ও মেয়েদের হত্যা এবং ছাপরা থেকে মাধেপুরা, ঔরগঙ্গাবাদ থেকে জাহানাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে দাঙ্গার মতো রাষ্ট্রচালিত ভয়াবহ অপরাধগুলোর কলঙ্কে কলঙ্কিত। শিক্ষার বিকাশের ক্ষেত্রে নীতীশ সরকারের ব্যর্থতা বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে সামনে আসে এবং এই প্রেক্ষাপটেই সাম্প্রতিক সময়ে বিহারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অভিনব ধারার সৃজনশীল আন্দোলন ‘সড়ক পর স্কুল’। বিহারে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের দাবিতে নতুন ধারার আন্দোলনগুলির কাণ্ডারি তরুণেরা নির্বাচনে প্রার্থী হবার ফলে সমাজে এক নতুন ধরনের উৎসাহের সঞ্চার হয়।

বিজেপি নীতীশ কুমারকে তাদের মুখ হিসাবে কাজে লাগিয়ে বিহারে নিজেদের অনুপ্রবেশকে গভীরতর এবং নিয়ন্ত্রণকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তুলেছে। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে সে সমস্ত ক্ষমতাকে আত্মসাৎ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষমতার এই সংহতকরণ ও কেন্দ্রীভবন মোদি সরকারের বৈশিষ্ট্য রূপে দেশের নানা জায়গাতেই আত্মপ্রকাশ করেছে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের জোট ক্ষমতার সমীকরণের এই নতুন বিন্যাস সৃষ্টির চেষ্টার মুখেই ভেঙে গেছে। বিহারেও লোক জনশক্তি পার্টিকে তারা নীতীশকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হিসেবে আড়াল থেকে মদত দিয়েছে, এমনটা অনেকেই মনে করেছেন।

বিজেপি যে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে রাশিকৃত করছে, ভারতের কৃষক ও শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে তার সমস্তটাকেই তারা কাজে লাগাচ্ছে আদানি-আম্বানি সাম্রাজ্যের সুবিধার স্বার্থে। বিভিন্ন আইন ও নীতির মধ্যে দিয়ে এটা এত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কোথাও কোথাও এর পরিপ্রেক্ষিতে এনডিএ শরিকেরা জনগণ ও কৃষক শ্রমিকদের আন্দোলনের স্বার্থে এনডিএ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। সাম্প্রতিক কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাঞ্জাবের আকালি দলের মোদি সরকার থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনায় যা আত্মপ্রকাশ করেছে।

এবারের বিহারের নির্বাচনের যে জনরায় সামনে এল, তাতে এনডিএ কান ঘেঁষে সরকার গঠন করতে সমর্থ হলেও জনগণের ক্ষোভ অস্পষ্ট থাকেনি। বিহারের সীমান্ত অঞ্চলে বিরোধী ভোটের অনভিপ্রেত বিভাজন আটকানো গেলে বা মহাজোটে বামেদের অংশভাগের ন্যায়সঙ্গত অধিক প্রতিনিধিত্ব থাকলে বিহারের মানুষের মেজাজটি সরকার গঠনে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হতে পারত। তা সত্ত্বেও ১২ জন সিপিআই (এম-এল) প্রার্থী সহ ১৬টি আসনে বামেদের জয় যথেষ্ট সম্ভাবনাপূর্ণ বিষয় হিসেবে গোটা দেশেই চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনে বামেদের হতাশাজনক ফলের বিপরীতে বিহারে লিবারেশন সহ বামেদের এই সাফল্য গোটা দেশের বাম গণতান্ত্রিক মহলের কাছে উৎসাহব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে।

বিহার ১৯৭০-এর দশকে গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন হয়ে দেখা দিয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের পথপ্রদর্শনে ১৯৭৪ এর ছাত্র আন্দোলন গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে এবং জরুরি অবস্থার অবসানে প্রবল ভূমিকা পালন করেছিল। বিহার আরও একবার ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সংঘ বাহিনীর সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল। নির্বাচনী ফলাফল থেকে ইতিবাচক শক্তি সংগ্রহ করে বিহারকে আজ আবার তার সমস্ত শক্তি, উদ্যম ও অঙ্গীকারের সম্মিলন ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদী বুলডোজারকে রুখে দিতে হবে, সংবিধানকে বাঁচাতে, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে এবং জনগণের জন্য অধিকার অর্জন করতে হবে।  বিহারের রাজনীতি যে বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের নতুন দিনকালে প্রবেশ করল এবং তাতে যে সিপিআই (এম-এল) সহ বামেদের এক বিরাট ভূমিকা থাকবে, ২০২০ র বিহার বিধানসভা নির্বাচনের রায় থেকে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

পশ্চিমবঙ্গ সহ যে সব জায়গায় আগামীদিনে যে সব নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেগুলির জন্য বিহার নির্বাচন কোনও বার্তা দিচ্ছে কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশেষভাবে মনে হয় বিজেপিকে বিভিন্ন সময়ে যতটা অপরাজেয় মনে হয়, আসলে সে যে তা নয়, এটাই বিরোধী শক্তির জন্য এই নির্বাচনের প্রধান ইতিবাচক বার্তা। বিজেপি জোটের পক্ষে যথেষ্ট একপেশে হবার সম্ভাবনা হিসেবে যে নির্বাচনকে দেখা হচ্ছিল, সেটাই ক্রমশ এক গণ আন্দোলনের চেহারা গ্রহণ করে বিজেপি জোটকে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিল। ফ্যাসিবাদী জমানার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের প্রমাণ মিলেছে বিহার নির্বাচন থেকে। মোদি সরকারের বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক নীতিমালার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক গণ আন্দোলনের গুরুত্বকেও বিহার নির্বাচন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। সিপিআই (এম-এল) সহ বামেদের বিধানসভার ভেতরে উপস্থিতি ছিল সামান্যই। গত লোকসভা ভোটের বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলেও বিজেপি বিরোধীরা খুবই কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। কিন্তু গণ আন্দোলনের ময়দানে ও মানুষের রোজকার সমস্যায় তাদের সক্রিয় উপস্থিতি বিধানসভার ভেতরের বিন্যাসকে এবার অনেকটাই বদলে দিয়েছে। সিপিআই (এম-এল) সহ বামেরা তিন থেকে আসন সংখ্যাকে ষোলতে নিয়ে যেতে পেরেছে, সিপিআই ও সিপিএম বিহার বিধানসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব ফিরে পেয়েছে। প্রথমবারের জন্য সিপিআই (এম-এল) এর একডজন প্রার্থী বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে গোটা দেশেই বামেদের আবার আলোচনার মধ্যে ফিরিয়ে এনেছেন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বামেরা আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে। বিহার নির্বাচনের এইসমস্ত ইতিবাচক বার্তা থেকে পশ্চিমবঙ্গ সহ নানা রাজ্যের বাম গণতান্ত্রিক শক্তিই উৎসাহের রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারেন।