Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফাইজারের সোহাগী টিকা ও ভারতের টিকা সংরক্ষণ প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা

স্বপন ভট্টাচার্য

 


লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

 

 

 

এই আকালের নভেম্বরে, গত ৯ তারিখ আমেরিকার ফাইজার কোম্পানি একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাদের কোভিড-১৯ টিকার ৯০ শতাংশ সাফল্যের কথা ঘোষণা করার পর থেকেই জনমানসে বেশ একটা আসিতেছে আসিতেছে ভাব। ট্রাম্প বলেছে এ বাইডেন-ফাইজার-জার্মানি মিলে একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তাকে ভোটে হারানোর জন্য। টিকার কথা ফাইজার নাকি নভেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত চেপে রেখেছিল, ফলে তার ক্রেডিট নেওয়ার কোনও অবকাশই দেয়নি তারা। কথাটা সত্যি হলে ফাইজার বিশ্বের বহু লোকের আশীর্বাদ পাবে সন্দেহ নেই তবে তাদের টিকা ধনী বিশ্বের বাইরে কতজনকে আশ্বস্ত করতে পারবে তা নিয়ে সংশয় প্রাথমিক ইউফোরিয়ার পর ক্রমবর্ধমান।

ফাইজারের যে টিকা নিয়ে এত শোরগোল তা তৈরি হয়েছে জার্মানিতে নথিভুক্ত তুর্কি রক্তের অভিবাসী দম্পতি উঘুর শাহিন এবং ওজলেম তুরেসি-র জৈব-প্রযুক্তি সংস্থা বায়োএনটেক ল্যাবে। টিকার গবেষণা তাদের আর উৎপাদন ও মার্কেটিং ফাইজারের। এই ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটটির সাঙ্কেতিক নাম হল  BNT162b2 এবং এটি একটি mRNA সঞ্জাত প্রতিরক্ষা দেহকে দান করতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়েছে। যে কোন সজীব কোষের কাজ করার ধরনে একটা প্রায় অপরিবর্তনীয় ঘটনাক্রম আছে। সেটা হল এই যে, সজীব কোষের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে জিন বা DNA, কোষের মধ্যে তা রূপান্তরিত হবে messenger RNA (mRNA) বা সংবাদবাহক RNA-এর ভাষায় এবং সে ভাষা পড়ে নিয়ে কোষ তৈরি করবে তার দরকারি প্রোটিন। DNA থেকে শুরু করে এই তিন ধাপের সংবাদ পরিবহনই হল আসলে জীবন। জীবনের কোন বৈশিষ্ট্যই এর বাইরে নয় বলে একে বলে জীবনের কেন্দ্রীয় অকাট্যতা বা সেন্ট্রাল ডগমা।

নভেল করোনাভাইরাস SARS Cov2 যার নাম, সে কিন্তু RNA ভাইরাস, সুতরাং তার গঠনগত বা কার্যগত সমস্ত খবরই তার RNA তে থাকে। নভেল করোনার যে অংশ আমাদের গলা, বুক, ফুসফুসের কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এত কাণ্ড ঘটাচ্ছে সেটাকে বলে তার স্পাইক অ্যান্টিজেন । এই হল তার পাওয়ার স্পাইক, এই হল তার তূনীরের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আয়ুধ। কোষের প্রতিরক্ষাতন্ত্র যদি তার সঙ্গে আগেই পরিচিত হত তাহলে এই অতিমারি হতই না, কিন্তু সে তো নভেল, ফলে শরীরের সঙ্গে এই তার প্রথম দেখাশোনা। ফলাফল ভয়াবহ। টিকাকরণ হল রোগ সৃষ্টি না করিয়ে এই তূণীরের সঙ্গে দেহকে পরিচিত করানোর একটা পদ্ধতি যাতে কোষ তার অসংবেদী প্রতিরক্ষাতন্ত্রকে ঘুম ভেঙে উঠে ওই স্পাইক অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে বাধ্য করতে পারে। পুরনো ফ্যাক্টরিতে নতুন মাল প্রোডাকশনের মত ব্যাপার আর কী! ফাইজার কোম্পানির ভ্যাকসিন হল একটা ল্যাবরেটারিতে তৈরি সংবাদবাহক RNA। সেটাকে একটা লিপিডের খোলকে (সাবানের ফেনার একটা অতি অতি ক্ষুদ্র বুদবুদ কল্পনা করতে পারেন) ভরে দেহকোষে চালান করে দিতে হবে ইনজেকশনের সাহায্যে। কোষের মধ্যে এই RNA বহে নিয়ে যাবে কেবলমাত্র স্পাইক প্রোটিন তৈরি করবার সংবাদটুকু। এর ফলে দেহ নভেল করোনাভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত না হয়েও তা প্রধান অস্ত্রটির সঙ্গে পরিচিত হবে এবং আশা এই যে অধিক বিলম্ব ব্যতিরেকেই রক্তরসে এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি উৎপাদিত হতে দেখা যাবে।

চিত্র ১- mRNA ভ্যাকসিন তৈরির নীতি

বায়োএনটেক ও ফাইজার যৌথভাবে দাবি করেছে এই নীতি মেনে তাদের বানানো টিকা নব্বই শতাংশ সফল। তাদের অন্তিম পর্যায়ের ট্রায়ালে নথিভুক্ত স্বেচ্ছাগ্রাহীর সংখ্যা হল ৪৩৫৩৮ জন। এদের মধ্যে ৪২ শতাংশ হল বয়স, বর্ণ ও জাতির নিরিখে বিভিন্ন প্রকৃতির। এদের মধ্যে মাত্র ৯৪ জনের উপর প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সাফল্যের দাবি। এঁরা এখনও কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন নি, প্রেস কনফারেন্স করেছেন মাত্র, কিন্তু ধরে নেওয়া যায় এই ৯৪ জনের মধ্যে ৮১ জনের মধ্যেই প্রতিরোধক্ষমতা এসেছে এবং এই ফলাফল প্রকাশের আগে ২৮ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত (চিত্র -২ দেখুন)। । তাদের দাবি ছিল এখনো অবধি কারো মধ্যে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নি, কিন্তু গ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে কিন্তু অন্য ছবি পাওয়া যাচ্ছে। একেবারে প্রতিক্রয়াহীন এটা নয়।

চিত্র ২- ফাইজার কম্পানির ট্রায়ালের ফলাফল

জুলাই মাসের ২৭ তারিখে এই টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হয়েছিল। অতিমারির সময় না হলে এত তাড়াতাড়ি কোন ভ্যাকসিন ট্রায়াল থেকে ফলাফল প্রত্যাশা করার প্রশ্নই ওঠে না । সাধারণভাবে একটা টিকা পেতে পনের বছর সময় লেগে যেতে পারে। কোভিড টিকার জন্য সংগ্রামে গবেষণাগারগুলিকে প্রচুর ছাড় দেওয়া আছে। চিত্র-৩ লক্ষ করলে দেখতে পাবেন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় ওভারল্যাপিং হবার জন্য এবং প্রোডাকশন ট্রায়াল পর্যায়ে শুরু করার অনুমতি দিয়ে সেই সময়সীমা মাত্র বারো–পনেরো মাসে নামিয়ে আনা হয়েছে।

চিত্র ৩- অন্য ভ্যাকসিন গবেষণা ও কোভিড ভ্যাকসিন গবেষণার তফাৎ

যদিও ছাড় পাওয়া সময়ের কথা মাথায় রেখেও বলা যায় যে, আরো মাস ছয়েকের আগে এই ভ্যাকসিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন খুব কঠিন এবং যদিও স্যাম্পেল সাইজের (৪৩৫০০ জনেরও বেশি) তুলনায় প্রাপ্ত ফল অতি নগণ্য পরিমাণ (মাত্র ৯৪ জন) স্বেচ্ছাগ্রাহীর ক্ষেত্রেই পাওয়া যাচ্ছে, তবুও কার্যকারিতার দিক থেকে আশাবাদী হওয়াই যায়, তবে বেল পাকলে কাকের কী?  ফাইজারের টিকা যদি এখনকার অবস্থায় বাজারে আসে তাহলে তার পরিবহনের ধকলটা কেমন হতে পারে, আসুন একটু দেখে নেওয়া যাক (চিত্র ৪ দেখুন)।

চিত্র ৪- উৎপাদিত টিকার সংরক্ষণ ও বিতরণের বিভিন্ন পর্যায়ে হিমায়নের প্রয়োজনীয়তা

ফাইজারের ভ্যাকসিনকে সংরক্ষণ করতে হবে অ্যান্টার্টিকার থেকেও ত্রিশ সেলসিয়াস নীচে, অন্ততপক্ষে শূন্যের নীচে সত্তর (-৭০C ) ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এই পদ্ধতিকে বলে ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন। এবং তা পরিবহনের প্রতিটি পর্যায়ে। ভারতের কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা আলু-পটলের টেকনোলজির খানিক উন্নত সংস্করণে এতাবৎকাল তাপসংবেদী রাসায়নিক, টিকা বা  ওষুধ-বিষুধ সংরক্ষণ করে এসেছেন। মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি পর্যন্ত সামাল দেবার মত ব্যবস্থা ভারতে আছে যদিও এই বিপুল সংখ্যক ভ্যাকসিন ডোজের (অন্তত দুটি ডোজ জনপ্রতি) তুলনায় তা অপ্রতুল। যা হোক, প্রায়োরিটি চিহ্নিত করে তা’ও না হয় করা গেল, কিন্তু মাইনাস সত্তরের টেকনোলজিই আলাদা এবং সরকারি স্তরে উদ্যোগ ছাড়া তা সম্ভব নয়।  ফলে স্টোরেজের সমস্যা না মিটলে এই আবিষ্কার যাদের জন্য, তারাই পাবে। বার্মিংহ্যাম ইউনিভার্সিটির  টোবি পিটার্স কী বলছেন শুনুন- “The new two-shot vaccine from Pfizer has to be maintained at minus 80º C – nowhere on the planet does the logistical capacity exist to distribute vaccines at this temperature,”-দুনিয়ার কোথাও এই টেকনোলজি নেই যে মাইনাস আশিতে ভ্যাকসিন স্টোর করে তা জনসাধারণে প্রয়োগ করবে। আমেরিকা অবশ্য অতিমারি শুরু হবার পর থেকেই ফ্রিজার ফার্ম তৈরি করে বা ক্ষমতা বাড়িয়ে কিছুটা তৈরি হয়েছে (চিত্র-৫)।

চিত্র ৫- উন্নত প্রযুক্তির হিমায়ন ব্যবস্থা

এমনিতে ভারতের টিকা গবেষণা বা টিকা বণ্টনের রেকর্ড খুব খারাপ নয়। বছরে প্রায় ৪০ কোটি ডোজ বিভিন্ন ভ্যাকসিন ভারত তার এখনকার ব্যবস্থায় সামলায়, কিন্তু সে ক্ষেত্রে শূন্যের নীচে ত্রিশ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা দরকার হয় নি এখনও। ভারতের কোল্ড চেন ব্যবসা টিকাকরণের সরকারি প্রোগ্রামের হাত ধরে প্রতি বছরই ফুলে ফেঁপে উঠছে। কিন্তু এবার তারা পড়েছে যথার্থ সমস্যায়। অসমর্থিত সূত্র বলছে যতগুলো টিকা পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাদের আর্ধেকের বেশিতেই মাইনাস 80º C তাপমাত্রা লাগবে। সরকারের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের বহর আমরা জানি। বেসরকারি ক্ষেত্রে ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নত করতে  পুঁজি ঢালায় সরকারি উৎসাহ কম থাকবে তা বলছি না। জিও বিশ্ববিদ্যালয় মাটিতে ইট ফেলবার আগেই একশো কোটি পেয়ে গিয়েছিল। এখানেও পরিকাঠামো বদলানো দরকার বলেই সরকার টাকা ঢালতে পারে, ঢালা উচিতও , কিন্তু তাতে এইবারের অতিমারি সামাল দেওয়া যাবে কিনা বা এটা যাবার আগেই ওটা গড়ে উঠবে কিনা সেটাই সংশয়। তদুপরি, ফাইজারের ভ্যাকসিন যদি অনুমোদিত হয়েই যায় ভারত চাইলেই তা পেয়ে যাবে তেমনও তো কথা নেই। আমেরিকা, জাপান, কানাডা, ব্রিটেন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে এখনই ফাইজারের চুক্তি ১৩০ কোটি ডোজ শুধু ২০২১-এ দেবার। তাহলে আমি আপনি কোথায় রইলাম?

আমরা বরং অন্য ভ্যাকসিন দাবিদারদের প্রগতি নজরে রাখতে পারি। ফাইজারের mRNA ভ্যাকসিন প্রযুক্তি ছাড়াও আরো অন্তত সাত আটটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভ্যাকসিন গবেষণা চলছে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায়। নীচের চিত্রটি (চিত্র -৬) দেখলে তা বোঝা যাবে।

 

চিত্র ৬- প্রধান প্রধান যে সব পথে টিকা গবেষণা চলছে এখন

শোনা যাচ্ছে, জনসন এন্ড জনসন কোম্পানির টিকা এবং নোভাভ্যাক্স টিকা মাইনাস ১০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সক্রিয়তা দেখাচ্ছে। জনসন এন্ড জনসনের টিকা হল জীনপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য কম সংক্রামক ভাইরাসকে কোভিড অ্যান্টিজেন তৈরির কাজে সক্ষম করে তোলার প্রযুক্তি। তারা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে ৬০০০০ স্বেচ্ছাগ্রাহীর উপর এটা প্রয়োগ করেছে। ফলাফলের অপেক্ষায় থাকা অবস্থাতেই তারা প্রতি সপ্তাহে দশ লক্ষ ডোজ সাপ্লাই দিতে ইউরোপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। নোভাভ্যাক্স কম্পানির NVX-CoV2373  হল জীনপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ভাইরাস নয় বরং তার প্রোটিন অ্যান্টিজেনকে টিকা হিসাবে ব্যবহারের প্রযুক্তি। এটি ফাস্ট ট্র্যাক অনুমোদন লাভ করেছে আমেরিকাতে এবং তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে। সাধারণ ফ্রীজারে এই টিকা সংরক্ষণ করা যাবে বলে জানা গেছে।

যদি টিকা আসার অপেক্ষায় থাকতেই হয় তাহলে এইসব কম সোহাগী টিকার উপরেই ভরসা করতে হবে। সংরক্ষণে ঝামেলা কম বলে এগুলোর দামও কম হবার কথা। কিন্তু সব থেকে বড় বিবেচ্য বিষয় আদৌ কোন টিকা কোভিড অতিমারি খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি না! মানুষ বা সরকার হয়ত কিছু খচ্চা পাতি করবে, এ পকেটে ও পকেটে কিছু টাকা যাবে, কোন কোন রাষ্ট্রনায়ক দাবি করবে –আমি ছিলুম। তাই না হল, তবে নিশ্চিত সুরক্ষা ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রেও হয় নি, এক্ষেত্রেও হবে না। কেন না এগুলি হল অতিমাত্রায় ধরন বদলানো ভাইরাস। তার একটা প্রকরণ ধরে টিকা বানানো হয়ে যখন দেবার তোড়জোড় চলছে তখন হয়ত সে মিউটেশন করে রূপ বদলে ফেলেছে। করোনার অন্য জাতভাইদের জন্য টিকা লাগেনি, আশা করা যায় এটিও একসময় নিজেই তাঁবু গুটিয়ে নিয়ে ঘুমোতে যাবে।


তথ্য:

  1. https://www.fiercepharma.com/vaccines/amid-cold-chain-blues-pfizer-looks-to-powder-vaccine-formula-2021-report
  2. https://www.businesswire.com/news/home/20201109005539/en/
  3. https://science.thewire.in/health/covid-19-with-scant-power-or-freezers-pfizer-vaccine-brings-little-cheer-to-india/
  4. https://www.jnj.com/johnson-johnson-announces-a-lead-vaccine-candidate-for-covid-19-landmark-new-partnership-with-u-s-department-of-health-human-services-and-commitment-to-supply-one-billion-vaccines-worldwide-for-emergency-pandemic-use
  5. https://ir.novavax.com/news-releases/news-release-details/novavax-covid-19-vaccine-granted-fast-track-designation-us-fda