সুপর্ণা সেনগুপ্ত
লেখক অধ্যাপক, অনুবাদক
নোবেল কমিটির সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধির সাক্ষাৎকারে লুইস গ্লাককে জিজ্ঞেস করা হয়, নোবেল বিজয়ী হয়ে তার কী অনুভূতি। কবির উত্তর—
“একটি বাড়ি কিনতে চাইছিলাম বেশ কিছুদিন… এবার কিনতে পারব…”
এরকমি প্রাত্যহিক চিন্তা, অবস্থান এবং প্রসঙ্গ লুইস গ্লাকের লেখা ও মননকে আকার দেয়।
বাড়ি কিনতে পারাটা একজন কবির চিন্তাভাবনার অঙ্গ হতে পারে, সেটা ভাবতে গেলেই ধাক্কা লাগে। কবি তো তিনি যাকে প্লেটো বলেছেন সমাজবহির্ভূত। সমাজে থাকলে তিনি ক্ষতিই করেন, কারণ কবির যা চিন্তাশক্তি তা সমাজের প্রাত্যহিক কাজেকর্মে লাগে না। অথবা কবি হবেন এমন, যিনি ভবিষ্যতদ্রষ্টা— কবি আবার বাড়ি কেনাকাটি করেন নাকি।
“I’m concerned with the preservation of daily life”— একই সাক্ষাৎকারে উনি বলেছেন। লুইস গ্লাককে নোবেল স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে আমাদের প্রাত্যহিক বৈষয়িক আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাই সেই পুরস্কার বাবদ পাওয়া টাকা দিয়ে বাড়ি কিনতে চাওয়াটা আমাদেরই স্বপ্ন পূরণ যেন।
রোজকার নিউজপেপার পড়ার মতোই সহজ, ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, অথচ প্রব্লেম্যাটিক ওঁর কবিতা লেখার আঙ্গিক:
We were leaving to deliver
Christmas presents when the tire blew
Last year. Above the dead valves pines pared
Down by a storm stood, limbs bared . . .
I want you.
প্রথম দিকের কাব্যিক জীবন থেকে এই লাইনগুলো উঠে আসে ওঁর লেখা ‘Early December in Croton-on Huson’ (1968) কবিতায়। ক্রিসমাসের উপহার, টায়ার পাঙ্কচার, ঝড়ে ধসে যাওয়া পাইন গাছ অনায়াসে মিশে গেল poetic voice-এর সঙ্গে— I want you— ভালবাসার উদ্বেগ যেন বাকি জিনিসগুলোর মতোই বাস্তব এবং সর্বস্ব।
অথবা দেখা যাক “The Untrustworthy Speaker” (1990) থেকে এই পঙক্তিগুলো:
Don’t listen to me; my heart’s been broken.
I don’t see anything objectively.I know myself; I’ve learned to hear like a psychiatrist.
When I speak passionately,
that’s when I’m least to be trusted.
সত্যটা কীভাবে কার উদ্দেশ্যে বোঝা দায়।
কবি নিজেই নিজের কাব্যিক কণ্ঠ ও ভাষার নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্ন করছেন। কারণ? সেই প্রাত্যহিক ব্যাথাবেদনা, ভালবাসার ছন্দপতন, পদার্থিক জীবনের বৈষম্য। ভাষা এখানে এতটাই আড়ম্বরহীন, অ-কাব্যিক, যেন নিশানা মেপে তীরন্দাজের তীর। গ্লাকের লেখার বিশেষত্ব বোধহয় এখানেই— ডাক্তার প্রয়োজন বুঝে যেমন প্রেসক্রিপশন লেখেন, গ্লাক অপ্রয়োজনীয় কোনও শব্দ অপচয় করেন না।
ওঁর বহুচর্চিত কবিতা Averno (2006) থেকে কিছু লাইন দেখি:
You die when your spirit dies.
Otherwise, you live.
You may not do a good job of it, but you go on—
Something you have no choice about.
ভাষার politics এবং তার aesthetics মিলে মিশে একাকার— কবি যেমন বলছেন সত্যি তেমনি, অথবা নাও হতে পারে— স্রষ্টা এবং পাঠকের “choice” নেই— কবিতা, ভাষা, জীবন— নিজের মতোই বয়ে চলে— আমাদের এজেন্সি আদৌ আছে কি? Averno কবিতা সঙ্কলনে গ্রিক মাইথলজি-র পেরসেফনের ক্যারেক্টারটিকে device হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন— কিন্তু বক্তব্য সেই দৈনন্দিন জীবনাবস্থান, মা ও মেয়ের টানাপড়েন, বয়ঃসন্ধির উদ্বেগ। পুরাণকথা ও মাইথলজি আধুনিক মানুষের অ-নায়কোচিত গাথা হয়ে রয়ে যায়।
আত্মজৈবনিক অনেক কিছুই ছায়ার মতো ঘনিয়ে আসে ওঁর লেখায়। কৈশোরে ওঁর আনরেক্সিয়া নারভসা রোগ হয়েছিল। বহুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। নিজের এই রোগ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, গ্লাক লিখেছেন রোগের কারণ তাঁর স্বাধীন সত্তার খোঁজ এবং মায়ের বিরুদ্ধাচারণ। আরেক জায়গায় লিখেছেন, যে বড় দিদির আকস্মিক মৃত্যু তাকে অসম্ভব ধাক্কা দেয়। স্কুলে থাকতেই ওঁর psychoanalytic treatment শুরু হয়। একাকিত্ব, দুঃখ, সম্পর্কের ওঠাপড়া, রোজনামচা অকথিত উদ্বেগ— trauma হয়ে ভাষায় ও কবিতায় রূপ নেয়।
This is the barrenness
of harvest or pestilence.
And the wife leaning out the window
with her hand extended, as in payment,
and the seeds
distinct, gold, calling
Come here
Come here, little oneAnd the soul creeps out of the tree.
‘All Hallows’ (1968) কবিতা থেকে নেওয়া এই পঙক্তিগুলি বারে বারে মনে করিয়ে দেয় রোজকার মানসিক barenness, pestilence— অনুর্বর দশা। গাছে ঝুলে থাকা প্রেতাত্মার মতো, কবির আত্মাও পালিয়ে যেতে চায়।
মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে কলেজের পোশাকি ডিগ্রি নেওয়া হয়নি ওঁর—
…my emotional condition, my extreme rigidity of behavior and frantic dependence on ritual made other forms of education impossible.
কবিতা ভাবা এবং কবিতা লেখাই হয়ে উঠল লুইস গ্লাকের পঠনপাঠন। বিচ্ছেদ, মৃত্যু, জরা একদিকে আঁচড় কেটেছে তাঁর মননে, অন্যদিকে জীবনশক্তি, আশা, পুনর্জন্ম ভাষা পেয়েছে তাঁর চেতনায়। নিজের নানান সঙ্কলনে উনি কখনও বা গ্রিক দেবদেবী, আবার কখনও বাগানের ফুল হয়ে কথা বলেছেন (The Wild Iris, 1992)।
‘Archaic Fragment’ (2006) কবিতায় লিখেছেন:
I was trying to love matter.
I taped a sign over the mirror:
You cannot hate matter and love form.It was a beautiful day, though cold.
This was, for me, an extravagantly emotional gesture.
পাশ্চাত্যের অস্তিত্ববাদী চিন্তায় পদার্থ আগে, মর্ম তার পরে। Existence আর essence, matter আর form নিয়ে চিরাচরিত কাব্যিক দ্বন্দ্ব ওঁর লেখার হৃদযন্ত্রের মতো। মনের বেগ আর ভাষার বেগ একসঙ্গেই যেন ওঠাপড়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চেকোস্লোভাকিয়ায় কবিরা নানান ছদ্মবেশি কায়দায় কবিতা লিখতেন স্তালিনীয় আইডিওলজি থেকে তাঁদের সৃষ্টিকে আগলে রাখতে। ‘Poetry of the Everyday’ এরমই এক ছদ্ধবেশি পন্থা। প্রাত্যহিক ভাষা ও বৈষয়িক বস্তুর মধ্যে লুকিয়ে থাকত ক্ষমতা, শাসন, স্বাধীনতা, আত্মচেতনা, রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন। সেগুলোর বাইরের রূপ হত পাহাড়, নদী, লেক, শিশু, বৃদ্ধ-ভেতরে থাকত কবিতার সামাজিক ভূমিকা ও কর্তব্য নিয়ে টানাপোড়েন। গ্লাকের লেখা একইভাবে অহরহ বস্তুসর্বস্ব জীবনকে দত্তক নেয় কবিতার matter এবং form-এর জন্য।
লুইস গ্লাকের লেখাকে কোনও শ্রেণিবদ্ধ বিভাগ বা লেবেল দিয়ে মাপা যাবে না। নানান দৃষ্টিকোণ ও পন্থা দিয়ে ওঁর লেখার প্রতি অগ্রসর করা যায়। উনবিংশ শতকে ওঁর ইহুদি পূর্বপুরুষরা রাশিয়া এবং হাঙ্গারি থেকে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে চলে আসেন। নিউ ইয়র্ক শহরে ব্যবসা শুরু করেন। এমত বহিরাগত অবস্থান থেকে লুইস গ্লাক জীবনকে চিন্তে শিখেছেন। ওঁর লেখনী-জীবনের সমান্তরাল চলেছে বিশ্বায়নের জীবনী। যার মূল কর্তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রোজনামচা জীবনে বিশ্বায়নের তালে তালে, মানুষের ভাবাবেগের যুদ্ধে লুইস গ্লাক-ই কর্তা।
You know, he said, our work is difficult: we confront
much sorrow and disappointment.
He gazed at me with increasing frankness.
I was like you once, he added, in love with turbulence.–‘Aboriginal Landscape’(2013)