Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জিন-এডিটিং প্রযুক্তি নিয়ে এল ২০২০ রসায়নে নোবেল

দেবজ্যোতি চক্রবর্তী ও সুন্দরম আচার্য

 

দেবজ্যোতি দিল্লির CSIR Institute of Genomics and Integrative Biology-র সিনিয়র সায়েন্টিস্ট; সুন্দরম ওই ইনস্টিটিউটেরই বায়োলজি ল্যাবের আরএনএ  

আলোড়ন-সৃষ্টিকারী জিন-এডিটিং প্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্য এই বছর রসায়নে নোবেল প্রাপ্তি হয়েছে জার্মানির ম্যাক্স-প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ ইনফেকশন বায়োলজির বর্তমান পরিচালক ডঃ ইমানুয়েল চার্পেন্তিয়ের এবং আমেরিকার বার্কলিতে ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অধ্যাপিকা ডঃ জেনিফার দৌডনার। প্রকৃতিতে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া ও আর্কিয়া নামক অণুজীবে বর্তমান এক ধরনের সহজাত অনাক্রম্যতা তাদের ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এই প্রতিরক্ষার পিছনে রয়েছে ক্রিসপর/ক্যাস (CRISPR/Cas) নামক পদ্ধতি। এর অনুপ্রকাশই এই জিন-এডিটিং প্রযুক্তির আবিষ্কারের পিছনে।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে অনায়াসে বদলে ফেলা যায় মানব শরীরের নকশাপ্রদানকারী  ডিএনএ-কে। দৈনিক জীবনে যেভাবে কাঁচির সাহায্যে আমরা আমাদের ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করতে পারি, বৈজ্ঞানিকরা এই প্রযুক্তির সাহায্যে সেইভাবেই মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিতে পারেন ডিএনএ-র নকশা। তাই এই প্রযুক্তিকে ‘জেনেটিক কাঁচির’ সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। এই প্রযুক্তির মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনের রহস্য উন্মোচন করার শক্তি এবং একইসঙ্গে আধুনিক চিকিৎসার অঙ্গীকার।

বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ক্রিসপর (CRISPR)-এর পুরো নাম ‘ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালান্ড্রোমিক রিপিটস’। খুব সহজভাবে বলতে গেলে এটি অণুজীবের জিনোমের নিয়মিত, গুচ্ছাকারে সাজানো এক বিশেষ প্রকারের ডিএনএ-ক্রম। মানবদেহের প্রতিরোধক্ষমতার মতো এই বিশেষ ডিএনএ-ক্রম অণুজীবদের নিজস্ব প্রতিরোধক্ষমতার অংশ। এই প্রতিরোধক্ষমতা সাধারণত প্রায় সমস্ত অণুজীবের মধ্যেই পাওয়া যায়, এমনকি দই-এ উপস্থিত স্ট্রেপটোকক্সাস থার্মোফিলাস  নামক ব্যাকটেরিয়াতেও এই ক্ষমতা বর্তমান।

প্রতিরোধক্ষমতার কাজ হল শত্রুকে চিনে তার নিকাশ করা। ব্যাকটেরিয়া কোনও ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যাকটেরিয়া ক্রিসপর/ক্যাস ব্যবস্থার মাধ্যমে ভাইরাসের ডিএনএ-কে নিজের ক্রিসপর-নামক ডিএনএ-ক্রমে অংশবর্তী করে। মনে রাখা দরকার ভাইরাস নিজের ডিএনএ ব্যাকটেরিয়াতে প্রবেশ করিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে থাকে। শত্রুকে চিনে নেওয়ার এই ধাপকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজন বলা হয়। পরবর্তী crRNA বায়োজেনেসিস ধাপে, ভাইরাস ডিএনএ-যুক্ত ব্যাকটেরিয়ার ক্রিসপর-ক্রমটি একটি ক্রিসপর আরএনএ তৈরি করে এবং সংলগ্ন ক্যাস-জিন থেকে উৎপন্ন ক্যাস৯ প্রোটিনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়। একই সময় ট্রেসার-আরএনএ নামক আর এক বিশেষ প্রকার আরএনএ যুক্ত হয় ক্রিসপর আরএনএ-র সঙ্গে এবং এই নতুন সঙ্কর আরএনএ-টিকে বিজ্ঞানে কাইমেরিক আরএনএ বলা হয়ে থাকে। এই ক্রিসপর আরএনএ-তে ভাইরাল ডিএনএ-র পরিপূরক ক্রম থাকায় আক্রমণকারী ভাইরাস চিহ্নিত হয়। পরবর্তীকালে পুনরায় ওই ব্যাকটেরিয়া একইপ্রকার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত সেই ভাইরাস চিহ্নিত হয় এবং আক্রান্ত ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত ভাইরাল ডিএনএ-কে সমূলে ধ্বংস করে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে ক্রিসপর ইন্টারফেরেন্স বলা হয়।

নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র যেমনভাবে বিশেষ শত্রুশিবির চিহ্নিত করতে পারে, ক্যাস৯ প্রোটিনটিও একটি বিশেষ ডিএনএ-ক্রমের সন্ধানে থাকে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যেটি প্রটোস্প্যাসের অ্যাডজ্যাসেন্ট মোটিফ (Protospacer Adjacent Motif, PAM) নামে পরিচিত। এই বিশেষ ডিএনএ-ক্রমটিকে ক্রিসপর আরএনএ-র পরিপূরক ডিএনএ-ক্রমের ঠিক আগেই বর্তমান থাকে। ক্যাস৯ প্রোটিন ও আরএনএর কমপ্লেক্স এই প্রটোস্প্যাসের অ্যাডজ্যাসেন্ট মোটিফের সাহায্যে টার্গেট ডিএনএ-কে আক্রমণ করে সেটিকে ধ্বংস করে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই ধাপটি  ডাবল স্ট্র্যান্ড ব্রেক নামে পরিচিত। ২০১২ সালে, চার্পেন্তিয়ের ও দৌডনার সায়েন্স-নামক গবেষণা পত্রিকায় এই তথ্যগুলি প্রকাশিত করার সঙ্গে সঙ্গেই  ক্রিসপর/ক্যাস জিন-এডিটিং প্রযুক্তির সূত্রপাত হয়।

আণবিক জীববিজ্ঞান প্রযুক্তির সাহায্যে উপরে ব্যাখ্যাত পদ্ধতি ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞানী পরবর্তীকালে মানুষসহ বিভিন্ন পশুতে (বিজ্ঞানে যাদের মডেল সিস্টেম বলা হয়) কঠিন থেকে কঠিনতম জিনগত ব্যাধিকে সারাবার আশা দেখিয়েছেন ও সারাবার নিরন্তর চেষ্টা করছেন, এর সঙ্গে ক্রিসপর/ক্যাস জিন-এডিটিং প্রযুক্তিকে কৃষিবিজ্ঞানে প্রয়োগ করে বিভিন্ন খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়ানো হয়েছে, এবং বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিকে মহামারি সৃষ্টিকারক ভাইরাসকে চিহ্নিত করার কাজেও ব্যবহার করছেন, যেটির সবচেয়ে বড় নিদর্শন বর্তমানে করোনা-ভাইরাস মহামারিতেই পাওয়া গেছে।

দুই মহিলাবিজ্ঞানী চার্পেন্তিয়ের ও দৌডনা, এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ৮ বছরের মধ্যেই নোবেল দিয়ে স্বীকৃতি পেলেন। ১৯৫৩ সালে ওয়াটসন ও ক্রিক-এর ডিএনএ-এর আণবিক কাঠামো আবিষ্কার বদলে দিয়েছিল জীববিজ্ঞানের গতিপথকে, বিজ্ঞানীদের দাবি এই মহিলাযুগলের আবিষ্কার বদলে দেবে একবিংশ শতাব্দীর জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা মানবসভ্যতার মানচিত্রকে। ক্রিসপর/ক্যাস জিন-এডিটিং প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং উন্নতিতে সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও।

পরিশেষে বলতেই হয়, ক্রিসপর/ক্যাস জিন-এডিটিং প্রযুক্তির আশীর্বাদে কিছুদিন আগেও যে সম্ভাবনা শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানে সীমিত ছিল, সেটি আজ ভীষণ বাস্তব। বিজ্ঞানীরা আজ পরিকল্পিত শিশু থেকে শুরু করে সহজ প্রাণীপ্রজনন, এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার প্রকোপ কমানোর স্বপ্নও দেখছেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার আলোর পাশাপাশি অন্ধকারের দিশাও দেখিয়ে থাকে। যার উপযুক্ত নমুনা সমগ্র মানবসভ্যতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উপলদ্ধি করেছে। অতএব, ক্রিসপর/ক্যাস জিন-এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন যথাযথ নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন নৈতিক সমস্যার সমাধান। এই কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর যাই হোক না কেন, নিঃসন্দেহে আমরা বলতেই পারি, চার্পেন্তিয়ের ও দৌডনারের এই আবিষ্কার মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থেকে যাবে, সর্বোপরি তাঁদের এই সম্মান আগামীকালে মহিলাদের অণুপ্রেরণা দেবে, যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলারা ভেদাভেদের শিকার।