জয়ন্ত ভট্টাচার্য
লেখক চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী
অক্টোবর ৫, ২০২০— ঘোষণা হল এ বছরের মেডিসিনে নোবেলজয়ী তিনজন বিজ্ঞানীর নাম। এঁরা হলেন হার্ভে জে অল্টার, মাইকেল হাউটন এবং চার্লস এম রাইস। উল্লেখপত্রে লেখা হল— This year’s Nobel Prize is awarded to three scientists who have made a decisive contribution to the fight against blood-borne hepatitis, a major global health problem that causes cirrhosis and liver cancer in people around the world. আরও বলা হল যে এই তিনজন বিজ্ঞানী “made seminal discoveries that led the identification of novel virus, Hepatitis C virus.”
সঙ্গতভাবে আমাদের প্রশ্ন থাকবে— (১) হেপাটাইটিস সি ভাইরাস কি এতটাই মারাত্মক? (২) এই তিনজন বিজ্ঞানীর নির্দিষ্ট অবদান কী যে জন্য এঁরা সম্মিলিতভাবে পেলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরষ্কার? এ বিষয়গুলোই এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।
মেডিসিনের পাঠ্যপুস্তকের জগতে “বেদ” বলে পরিচিত হ্যারিসনের টেক্সট বুক অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন জানাচ্ছে যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমণ ঘটলে ২০ বছর পরে ২০-২৫ শতাংশ আক্রান্তের লিভার ক্যান্সার হতে পারে। পরিসংখ্যানটি চমকে ওঠার মতো। এমন মারণান্তক এ সংক্রমণ। এজন্যই এ বছরের প্রাইজের এত গুরুত্ব। ১৯৭৬ সালে বারুচ ব্লুমবার্গ এবং কার্লটন গাজদুসেক হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য নোবেল জয়ী হয়েছিলেন। সে বছরেই ভিত্তি তৈরি হয়েছিল ২০২০-তে মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ জয়ের। দু-একটি কথা এই ভাইরাসের চরিত্র নিয়ে বলে নিই। আরএনএ গোত্রের এই ভাইরাসের দৈর্ঘ্য ৫০-৬০ ন্যানোমিটার এবং এতে কমবেশি ৯৬০০ নিউক্লিওটাইড থাকে। এবং এর মধ্যে থাকা বিভিন্ন চরিত্রের প্রোটিন মানুষের শরীরে কী কী বিশিষ্টতার প্রোটিন তৈরি করবে সেটা নির্ধারণ করবে কী ধরনের হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমণ হবে একজন মানুষের শরীরে। শুধু তাই নয়, ভাইরাসের ধরনের উপরে নির্ভর করে কোন ধরনের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হবে সেটা ঠিক করা হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং আশার কথা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমণের পরে এখন অতি কার্যকরী নতুন নতুন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। রোগীদেরকে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে, সুস্থ জীবন যাপন করতে পারছে এবং মৃত্যুর করাল থাবাকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। তবে ওষুধের দাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমাজের সব স্তরের মানুষের নাগালের মধ্যে এখনও ওষুধ লভ্য নয়। সমাজে আর্থিক অবস্থানের ওপরে অনেকাংশেই নির্ভর করছে বাঁচা-মরার জীয়নকাঠি।
হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের দুটি ছবি নীচে দেওয়া হল।
বিজ্ঞানী যখন ডিটেকটিভ
খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪০০ থেকে গ্রিক এবং ভারতীয় মেডিসিনে (তথা আয়ুর্বেদে) আমরা এখন জন্ডিস বলতে যা বুঝি তার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সেসময়ে যেহেতু রোগীর দেহে রক্ত দেওয়ার পদ্ধতি চালু ছিল না সেজন্য পরবর্তীতে দেখা গেছে এই জন্ডিসের আততায়ী ভাইরাস জল এবং খাদ্যবাহিত হয়। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হয় হেপাটাইটিস এ।
১৯৬০-এর দশকে বারুচ ব্লুমবার্গ নজর করেন যেসব রোগীর ক্ষেত্রে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা হচ্ছে তাদের এক বৃহৎ অংশের শরীরে জন্ডিস তৈরি হচ্ছে। পরবর্তীতে এ ভাইরাসের নামকরণ করা হয় হেপাটাইটিস বি (মূলত রক্তবাহিত)। এই আবিষ্কারের জন্য ব্লুমবার্গ এবং তাঁর সহযোগী ১৯৭৬ সালে নোবেল প্রাইজ পান। অস্ট্রেলিয়ার এক আদিম অধিবাসীর রক্তকে এ ভাইরাসের বাহক বলে প্রথম দিকে চিহ্নিত করার দরুন এর নাম “অস্ট্রেলিয়া অ্যান্টিজেন”-ও দেওয়া হয়েছিল। এটা বর্ণনাত্মক নামকরণ। যেমন হালে সার্স-কোভ-২-এর “মহামান্য বিশ্বপতি” (প্রাক্তন) ট্রাম্প নামকরণ করেছিলেন “চিনা ভাইরাস”।
১৯৭০-এর দশকে হার্ভে অল্টার (জন্ম ১৯৩৫) আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ-এ গবেষণা করছিলেন। তিনি নজর করলেন হেপাটাইটিস বি সংক্রমিত রোগীদের রক্ত দেওয়া বন্ধ করার পরেও রোগীদের শরীরে জন্ডিস দেখা দিচ্ছে। অল্টার এবং তাঁর সহগবেষকরা সিদ্ধান্তে এলেন এটা ভিন্ন কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে হচ্ছে। এই রহস্যজনক ভাইরাসের সংক্রমণের প্রাথমিক নামকরণ করা হল “non-A, non-B” হেপাটাইটিস। ১৯৭২-এ অ্যানালস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন জার্নালে এদের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এরপরে ১৯৭৫-এ বিশ্ববন্দিত নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত হল গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র (এপ্রিল ১০, ১৯৭৫)— “Transfusion-Associated Hepatitis Not Due to Viral Hepatitis Type A or B”। এখানে এঁরা পরিষ্কারভাবে জানালেন— “Twenty-two patients who had an episode of transfusion-associated hepatitis not positive for hepatitis B antigen were examined for development of antibody to hepatitis A and B antigens, cytomegalovirus and Epstein-Barr virus …. It seems likely that at least a proportion of such antigen-negative transfusion-associated hepatitis is caused by other infectious agents, not yet identified.”
এটা যে অন্য ভাইরাস সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু এর জেনেটিক চরিত্র কী? মাইকেল হাউটন তখন Chiron ফার্মাসিউটিক্যাল হাউসে কাজ করছিলেন। অত্যন্ত শ্রমসাধ্য, কঠোর, যত্নশীল এবং নিবিড় মনোযোগী একের পরে এক ল্যাবরেটরি পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এর জেনেটিক সিকোয়েন্স আবিষ্কার করলেন। দেখা গেল এ এক অভিনব আরএনএ ভাইরাস। আরেক বিশ্ববন্দিত জার্নাল সায়ান্স-এ প্রকাশিত হল (২১ এপ্রিল, ১৯৮৯) এই ফলাফল— “Isolation of a cDNA clone derived from a blood-borne non-A, non-B viral hepatitis genome” শিরোনামে। বলা হল— “A random-primed complementary DNA library was constructed from plasma containing the uncharacterized non-A, non-B hepatitis (NANBH) agent and screened with serum from a patient diagnosed with NANBH.” খেয়াল করুন, ১৯৮৯ সালেও “non-A, non-B hepatitis (NANBH)” বলা হচ্ছে। তখনও হেপাটাইটিস সি নামকরণ হয়নি। হেপাটাইটিস বি-র থেকে পৃথক করার জন্য এর নাম দেওয়া হল হেপাটাইটিস সি। এবং এটাও বোঝা গেল যে এই ভাইরাস আগের মতো ডিএনএ ভাইরাস নয়, একটি নতুন আরএনএ ভাইরাস।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল। এই ভাইরাসই যে জন্ডিসের জন্য নির্দিষ্ট আততায়ী সেটা কী করে বোঝা যাবে? আর এটা যদি না হয় তাহলে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সমস্ত গবেষণা কার্যত বৃথা। এখানে ভূমিকা চার্লস রাইসের। দেখা গেল এ ভাইরাস মানুষ ছাড়া কেবলমাত্র আরেকটি প্রাণীকে সংক্রামিত করতে পারে— শিম্পাঞ্জি। ১৯৯৭ সালে (২৫ জুলাই) সায়ান্স-এ প্রকাশিত হল রাইস এবং অন্যান্যদের যৌথ গবেষণাপত্র— “Transmission of Hepatitis C by Intrahepatic Inoculation with Transcribed RNA”। ২০০৫-এ (১৭ আগস্ট) নেচার-এর মতো জার্নালে প্রকাশিত হল লক্ষ্যভেদী গবেষণাপত্র— “Unravelling hepatitis C virus replication from genome to function”। এ গবেষণাপত্রে লিন্ডেনবাখ এবং রাইস সুনির্দিষ্টভাবে জানালেন— “Since the discovery of the hepatitis C virus over 15 years ago, scientists have raced to develop diagnostics, study the virus and find new therapies. Yet virtually every attempt to dissect this pathogen has met with roadblocks that impeded progress. Its replication was restricted to humans or experimentally infected chimpanzees, and efficient growth of the virus in cell culture failed until very recently. Nevertheless hard-fought progress has been made and the first wave of antiviral drugs is entering clinical trials.”
এই তিনজন বিজ্ঞানী— অল্টার, হাউটন এবং রাইস— হেপাটাইটিস সি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ। কিন্তু আরও অনেক সহযোগী গবেষকের নিরলস পরিশ্রমের ফসল— ১৯৭২ থেকে ২০০৫ অব্দি— ২০২০-র মেডিসিনের নোবেল প্রাইজ। বিজ্ঞান এভাবেই এগোয়। এঁদেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। এখানে কোনও জড়িবুটি, গোমূত্র জাতীয় চিকিৎসাবিধি বা দেবদেবীর স্থান নেই। একজন বিজ্ঞানী ধর্মভীরু হতে পারেন, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জগতে দেবদেবীর ভজনা করতেই পারেন। কিন্তু মানবজাতির মঙ্গলের জন্য যে কাজটি করছেন সেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা ধর্মের চৌহদ্দি ও অনুশাসনের বাইরে— সেটি কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ, যুক্তিনিষ্ঠ, তথ্যনির্ভর, নিকষ বিজ্ঞান।
শেষ কথা
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ৭ কোটির ওপরে মানুষ পৃথিবীতে হেপাটাইটিস সি রোগে মারা গেছে। ২০২০ সালের হিসেব আমাদের হাতে নেই। এ সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটেছে, অনুমান করা যায়। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এ রোগের ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। টিবি-তে (২০১৮ সালে ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে) মৃত মানুষের সংখ্যার সঙ্গে এ সংখ্যা তুলনীয়।
মানুষকে বাঁচানোর পথ, পন্থা এবং ভবিষ্যৎ গবেষণার সরণী প্রশস্ত করার স্বীকৃতি এই নোবেল প্রাইজ। এঁদেরকে কুর্নিশ!