Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাব্যভুবন: এক মেঘ থেকে আরেক মেঘের সাঁকো

বেবী সাউ

 

 


লেখক কবি, গদ্যকার, লোক-গবেষক

 

 

 

ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের আলাপ দূরভাষে। সেখানেই কথাবার্তা। তাঁর স্নেহ আর ভালবাসা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই যা পেয়েছি, তা ভোলার নয়। কিন্তু যখনই তাঁর প্রবন্ধ পড়তে গেছি, কবিতা পড়তে গেছি, ব্যক্তিগতভাবে চেনা যে অলোকরঞ্জনদা, তাঁকে ভুলতে চেষ্টা করতে হয়েছে। আমার একান্তই এটা ব্যক্তিগত মত, যে, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাব্য-চেতনার আকাশকে চেনার অন্তরায় তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়া, আবার এও সত্য, তাঁর স্বরমুকুল এবং ধ্বনিমাধুর্যের যে বিশ্ব তিনি রচনা করতেন, তার মধ্যে প্রবেশ করলে, কিছুটা তাঁর কাব্যব্যক্তিত্বের টুকরো টের পেতাম আমিও। হয়তো, এই অনুভূতিমালা কেবলমাত্র দূরে থাকা এক পাঠিকা ও কাব্যপ্রয়াসীর অল্প কয়েকদিনের আশীর্বাদধন্য হওয়ার ফল। ‘শিল্পিত সুষমা’ বা ‘জবাবদিহির টিলা’-র অলোকরঞ্জন এক দুরূহ রহস্যময় জগতের মানুষ। এর কারণ সম্ভবত, তাঁর নিজের বর্ণিত ‘প্রতারক প্রচ্ছদ’-এর মতো ব্যক্তিত্ব। কাব্যভাষাতেও এই প্রতারক প্রচ্ছদের মতো এক ধ্বনিমাধুর্যের প্রভাব রয়েছে বলেই মনে হয়। তাই সেই ধ্বনিমাধুর্যের অন্তরালে ডুব দিলে টের পেয়ে যাওয়া যায় তাঁর বিশ্বজনীনতা, যা বিশেষ করে আটের দশকের পরবর্তী পর্যায়ের কবিতার মধ্যে ফুটে ওঠে।

আসলে, একরৈখিকতার যে আধুনিক রূপ-কে আমরা প্রায় বিশ্বাস করে পুজো করেছি গত শতকের পঞ্চাশ বছর, তার মধ্যে, অলোকরঞ্জন প্রথম দিক থেকেই ছিলেন অন্যরকম। যখন ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতাবোধের অস্তিত্ববাদ বাংলা কবিতায় ছায়া ফেলছে অবধারিত নিয়তির মতো, তখন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সেই পথে ছেড়ে বেরিয়ে স্থান নিয়েছেন এক দুরূহ পথে। প্রাথমিকভাবে প্রকৃতির সঙ্গে অধ্যাত্মিকতার এক সূক্ষ্ম বোধের জগতে ডুব দিয়েছেন। তার পর এসেছে তাঁর রুদ্র রূপ। কিন্তু কখনওই কবিতার অপরূপ নির্মাণের মোহিনী নূপুরধ্বনি থেকে বেরিয়ে আসেননি। একটি শান্ত আবহ যেন চিরকাল বেজে উঠেছে তাঁর কবিতায় ঘন অন্ধকারের মধ্যেও। কারণ ঘন অন্ধকার চিরকাল তাঁর কাছে মিলনের প্রাককথনের মতো। এক আলোকশিখা, যত মৃদুই হোক, তাঁর কবিতার মধ্যে জ্বলে উঠেছে। যেন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও তিনি এক নীরব ভক্তের মতো মেনে নিয়েছেন ভালোবাসায় তাঁর উপাস্য দর্শনকে। তিনি জ্বালিয়েছেন একটি সামান্য মোম। কিন্তু সেই মোমের আলোও অন্ধকারে খুব প্রয়োজনীয়।

তার দিব্য দুই হাতে আমাকে ছুঁয়েছে কালরাতে,
স্পর্শের অনলে কেঁপে পুণ্য হল আমার শরীর ;
অগ্নিদেব শুধালেন; ‘ হাত রাখ আমার দুহাতে,
মানুষের নামে বল এই গাঢ় শীতশর্বরীর
আড়াল যে- প্রাণজ্যোতি, তুমি তাঁর বিতন্ত্রিত বীণা
তোমার জীবনে নিয়ে এ বিশ্বে বিকীর্ণ হবে কিনা?
রাগিনীর বৃষ্টি হয়ে খরশর জৈষ্ঠের জ্বালায়
প্রান্তরে ছড়াবে নাকি প্রাণভরা পুবালিদখিনা,
রূপান্তর দেবে তাকে হেমন্তের হিরণ্যথালায়…

আটের দশকের পর থেকে বিশ্বব্যাপী এক ভাঙন দেখা দিল। একদিকে এল কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলিতে প্রবল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ, অন্যদিকে শুরু হল শরণার্থী সমস্যা। সার্ব-ক্রোটদের মধ্যে যুদ্ধ, যুগোশ্লাভিয়ায় অশান্তি, সোভিয়েত ভেঙে যাওয়া, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ইরাকে আমেরিকার হানা, সমস্ত কিছুই অলোকরঞ্জনের কবিতায় ছায়া ফেলতে শুরু করল। পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে যে কোল্ড ওয়ার শুরু হল, তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতিতে শুরু হল মানুষের তাণ্ডব। ওদিকে ধনতন্ত্রও তখন বেকায়দায়। ধনতন্ত্র নিজেকে বাঁচানোর জন্য গ্লোবালাইজেশন নামক বিষের জন্ম দিল। বার্লিন ওয়াল ভাঙল। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন-সিরিয়া-লেবানন-মিশর জুড়ে শুরু হল আন্তর্জাতিক অশান্তি। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। মৃত্যুর পর মৃত্যু। ভারতবর্ষেও বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে গেছে তখন অবিশ্বাস আর ভাঙনের লুকোচুরি খেলা। আর আমরা? তখন জন্ম নিচ্ছি। জন্ম নিচ্ছি একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিশ্বে। বড় হচ্ছি একটা সম্পূর্ণ আলাদা বিশ্বে। কে না অস্বীকার করবে এখন, যে, সোভিয়েত ভেঙে যাওয়া, কমিউনিজমের পতন এবং গ্লোবালাইজেশনের উত্থানের পরে যে পৃথিবীতে আমরা বড় হয়েছি, তা তার আগের দশকগুলির থেকে একদম আলাদা?

আর এই আলাদা বিশ্বের প্রতিধ্বনি কি পাওয়া যাবে না অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতায়? পরিবর্তিত হয়ে গেল তাঁর কাব্যভুবন। সহজিয়া, মরমিয়া, নীচু গলায় আত্মানুসন্ধানী কবি নিজের ভালোবাসাতে মেনে নিলেন ঈশ্বরকে। বন্ধুদের বিদ্রূপকে অস্বীকার করেই। একদিকে বুকের মধ্যে লালন করলেন হাইনের রোমান্টিকতা। অন্যদিকে মাথায় তুলে নিলেন ব্রেশটের ব্যক্তিত্ব এবং দর্শন। যেন পাউল সেলান এবং লোরকা একইসঙ্গে কথা বলে উঠলেন। এই ব্যক্তিত্ব কি অনেকটা শেলীর মতো? যে শেলী ওড টু দ্য ওয়েস্টউইন্ড লিখছেন, তিনিই লিখছেন প্রমিথিয়াস আনবাউন্ড। বিশ্বকে নিজের করে নিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এক সংযুক্ত বিশ্বের জন্ম হল তাঁর কবিতায়। সেই সংযুক্ত পৃথিবীতে মাথা তুলল সংস্কৃত সাহিত্য, হিন্দি, উর্দু সাহিত্য, স্প্যানিশ, ফরাসি এবং জার্মান সাহিত্যের বিপুল সংসার। যেমন ক্লাসিক এবং মধ্যযুগের সাহিত্য তাঁকে পুষ্ট করেছে, তেমন পুষ্ট করেছে তাঁকে লোকায়ত শিল্প, লোকায়ত গান এবং কাহিনি। তিনি সমস্ত শিল্পকেই নিজের করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এবং র্যাঁবোকে মিলিয়ে দিয়েছেন। রিলকে এবং জীবনানন্দের মধ্যে বিবাহ ঘটিয়েছেন। তিনি বারবার বলতেন, ভাষাই হচ্ছে তাঁর দেশ। তিনি সেই ‘ভাষা’ নামক দেশের বাসিন্দা, যে দেশের কাঁটাতার নেই। বাংলা ডায়াস্পোরাকে যদি কোনও বাঙালি কবি সার্থকভাবে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন, তবে তিনি কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।

মুশকিল হল, তাহলে প্রশ্ন জাগে, অলোকরঞ্জন তবে কেন অধিক পঠিত নয়? কেন তিনি অধিক জনপ্রিয় নন? তিনি তো সময়কে আক্ষরিকভাবেই ধারণ করেছেন তাঁর কবিতায়। এর কারণ কবিতা নামক যে ছাঁচটিকে আমরা ধারণ এবং লালন করেছি্, অলোকরঞ্জন চিরকাল সেই ছাঁচের মধ্যে ভ্রমণ করেও অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছেন। তিনি লঘু ছন্দে এমন সব অসাধারণ কবিতা লিখেছেন, যা সাধারণভাবে কল্পনাই করা যেত না। যেখানে মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্তে লেখা হচ্ছে এলিয়ে পড়া প্রেমের কবিতা, সেখানে, অলোকরঞ্জন সেই ছন্দকেই ব্যবহার করে লিখছেন তীব্র শ্লেষ অথবা গভীর রাজনৈতিক বোধের কবিতা। ভাষা এবং আঙ্গিক বদলেছেন বারবার। ধ্বনিমাধুর্য অক্ষুণ্ণ থেকেছে। হয়তো, আমার মতো সাধারণ পাঠকের এই অভিযোগ আছে, যে তাঁকে পড়তে কখনও অভিধান সঙ্গে নিয়ে বসতে হয়। কিন্তু তার কারণ তাঁর অপারগতা নয়। বরং বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে পাঠকের অজ্ঞানতা। কারণ সময়কে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ভাস্করের মতো ছেনি হাতুড়ি দিয়ে খোদাই করে রাখা সত্ত্বেও, আমাদের সময়ের পাঠক ও কবিরা যদি তাঁকে না পড়ে তাঁর প্রথম দিককার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ নিয়েই আলোচনা করে তৃপ্ত থাকতে ভালবাসে, তাহলে, অলোকরঞ্জনের যে কাব্য-অভিপ্রায়, তাকেই অস্বীকার করা হল বলে ধরে নিতে হবে। কে যেন পাঠকদের কানে কানে বলে দিয়েছে, তুমি তোমার ধারণার বাইরে বেরিওনা। তুমি যাকে ছাঁচ ভাব, তার বাইরে বেরোলে তোমার বিপদ হতে পারে। যেমন লিখতে শুরু করেছিলে জীবনের প্রথম দশায়, তেমন টুকে যাও আজীবন। নিজের আঙ্গিক, নিজের ভাষা, নিজের ভাবনাকে বদলিও না। তুমি নিরাপদে কবি হয়ে থাকো। কবিতা আর লিখতে হবে না।

ছাঁচের মধ্যে বদ্ধ অবস্থায় মরে যাওয়ার চেয়ে অলোকরঞ্জনের মতো কবি বারবার চেয়েছেন নতুন করে জন্ম নিতে। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে তিনি শেষের দিকে কবিতা লিখেছেন। সেই কবিতাগুলি ছোট ছোট বিষয়ের মধ্যে দিয়েই হয়ে উঠেছে বড় বিষয়। প্রকৃত শিল্পীর মতো সামান্য কিছু কথার টানে তিনি সেই কবিতাকে করে তুলেছেন তাঁর কাব্য-অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি।

যে বাঁশের সাঁকোর অভিমানের কথা তিনি বলেছিলেন এক সময়ে, তার চেয়ে অনেক দূরে সরে গিয়ে তিনি প্রকৃতই রচনা করতে চেয়েছিলেন এক অন্য সাঁকো। সেই কাজ ফুরোয়নি।

কিন্তু, তিনিই চলে গেলেন।

এক মেঘ থেকে আরেক মেঘের সাঁকো
গাঁথতে গেলেন, কিন্তু নিথর শূন্যে
মিলিয়ে গেলেন নশ্বর ঈশ্বর

তাঁর কাব্যভুবনের দিকে তাকালে দেখতে পাই সেই সব অসমাপ্ত কাজ, যাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বাকি।