অনিঙ্ক আচার্য্য
দিনাজপুর নিয়ে বিশেষ কারও মাথাব্যথা নেই। ম্যাপে আছে বটে, তবে চিন্তাভাবনায় তেমন করে নেই আমাদের দিনাজপুর। বালুরঘাট আর দক্ষিণ দিনাজপুরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। পপুলার ইমাজিনেশনে উত্তরবঙ্গের ছবিটা ওই শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আর দার্জিলিং ঘেঁষা, একটা পাহাড় আর চা-বাগান মাখা ছবি। তবে উত্তরবঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুর বলে একটা হতভাগ্য জেলা আছে সেটা অনেকেই মনে রাখে না। সেটাও খুব একটা সমস্যার না; এই ধরুন বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে মালদা, ডিগ্রি পেতে কলকাতা, কাজ পেতে দিল্লি, এগুলো স্বাভাবিক। আসল কথা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে; তাই “বাড়ি কোথায়?” কেউ জিজ্ঞাসা করলে অকপটে বলি ওই শিলিগুড়ির কাছে, কিংবা মালদার পাশে।
কয়েকদিন যাবৎ উত্তরবঙ্গের বন্যা-পরিস্থিতির কথা শুনে থাকবেন। এ নতুন কিছু নয়। প্রায়শই হয়। বালুরঘাটে বন্যা এসেছে, প্রায় সব এলাকা জলের তলায়– সড়ক আর রেলপথে যোগাযোগ কার্যত বন্ধ। তবে এতে মিডিয়ার মাথাব্যথা নেই– আমাদের এখানে মারপিট হয় না, খুন হয় না, বিরিয়ানিওয়ালা ডাকাতি করতে এলে একদিনে ধরা পড়ে– খুব একটা কিছু হয় না, খবর করার সেরকম কিছু নেই। আর থাকল মানুষের কথা– ওসব দক্ষিণে, আর পাহাড়ে অনেক আছে। আমাদের কোনও নামজাদা নেতা নেই, ফুটেজও নেই। কিন্তু দাদা, জল ওদের যেমন কাঁদায়, আমাদেরও কাঁদায়; আমাদেরও ঘর ভাঙে, স্বপ্ন ভাঙে। ভোটে আপনাদের মুখরোচক ‘বাওয়াল’ না দিতে পারলেও, ওই দু’টো সভায় দু’টো মানুষ তো পাঠাই– সেই খাতিরেই না হয় আমাদের কথা একটু বললেন।
সে কথা থাক, আমাদের কোনও অভিযোগ নেই, কোনও কালেই ছিল না, ওই যে বললাম অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে স্বাধীনতা দিবসের আশপাশ নাগাদ জানা গেল-–
- মহারাজপুরের কাছে সেতুতে ফাটল দেখা দিয়েছে, সড়ক পথে যোগাযোগ বন্ধ।
- রাতের কলকাতার ট্রেন বাতিল, হাওড়াগামী ট্রেন বুনিয়াদপুর থেকে চলবে। রেলপথেও আসা যাওয়া সম্ভব না।
- আত্রেয়ীতে চকভৃগুর দিকের বাঁধে ভাঙনের ফলে স্টেশনের রাস্তায় প্রচণ্ড জলের স্রোত, বানভাসি এলাকা।
- শহরের বেশ কয়েকটি স্লুইস-গেট ভেঙে যাওয়ায় লাগামছাড়া জল ঢুকছে শহরে।
- পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে বেশ কিছু ওয়ার্ডে।
- ওষুধের জোগানে টান পড়েছে।
- ত্রাণ পৌঁছতে সময় লাগছে, শহরে নৌকা নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে।
- সবজির দাম বেড়েছে, জোগান কম।
পরিকাঠামোর দিক থেকে আমাদের জেলা অনেকটাই পিছিয়ে। এবং তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ত্রাণ বিলি কার্যে। যদিও প্রশাসনের সীমিত কর্মকাণ্ডের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, তবে সমস্যা হল গোটা কাজটাই চলছে বালুরঘাটকে কেন্দ্র করে। এইসময় সবচেয়ে জটিল অবস্থা শহরের বাইরের প্রান্তিক গ্রামগুলোতে, স্পিড-বোট কিংবা নিদেনপক্ষে বড় নৌকা না থাকায় এই গ্রামগুলোতে কোনওভাবেই ত্রাণ পৌঁছতে পারছে না। এই মানুষগুলো আটকে পড়েছে রাজনীতি আর প্রকৃতির মাঝের টানাটানিতে। একদিকে আত্রেয়ী, অন্যদিকে বাংলাদেশ; আটক প্রাণগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে স্বাধীনতার পরিহাস। গ্রামপঞ্চায়েত থেকে মাত্র কিছু ত্রিপল এসেছিল ওখানে। বাকিটা শুধু আশ্বাস। শুধু আশ্বাসে তো আর পেট ভরে না, তাই আমরাই কিছু করবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আঠেরো তারিখ আমরা একাধিক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছে দেবার চেষ্টা করলাম। মালঞ্চার কাছে রাস্তা কেটে ফেলায় ছোট্ট গ্রামটি কার্যত সদর শহর বালুরঘাটের থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মালঞ্চার ভেতরে কিছু প্রান্তিক গ্রামে, যেখানে এখনও সড়ক পথে যোগাযোগ বন্ধ, সেখানে পৌঁছে যাওয়া। আমাদের দলের অন্যতম সদস্য পাপাই বর্মণ, মালঞ্চার ছেলে, প্রায় একা হাতে সমস্ত পরিকল্পনা করে, নিজের কিছু বন্ধুদের নিয়ে কাজে লেগে পড়ল। কিছু বন্ধুদের পাঠানো টাকা খুব তাড়াতাড়ি একজোট করে ত্রিমোহিনী থেকে চিড়ে এবং বালুরঘাট ও মালঞ্চা থেকে কলা, ডিম, কেক, গুড়, এবং প্রচুর পরিমাণে পানীয় জল জোগাড় করে মালঞ্চার আনাচেকানাচে পৌঁছে দেওয়া গেল।
এরপর ইছামতী পেরিয়ে চক বরম এবং সংলগ্ন বেশ কয়েকটা গ্রামে গেলাম আমরা। তারপর খাসপুরের দিকে। বোয়ালদা আর মাহাতো পাড়ার মাঝামাঝি বেশ কিছু জায়গায় আমরা দেখি যে ত্রাণের কোনও নামগন্ধ নেই। সেখানে কাজ করে বাসুদেব স্যারের নির্দেশে ঢুকে পড়ি ঢাহুল আর বেলাইন এলাকায়। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা, ট্রাক্টরের হেড লাইট কাজ না করায় কিছু জায়গায় প্রায় কোমর-সমান জলে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে কাজ করতে হয়।
আমরা খবর পেয়েছিলাম মোকথারপুরে কোনও রকম ত্রাণসামগ্রী ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে না। তাই ১৯-এ আগস্ট প্রথমেই আমরা ট্রাক্টর বোঝাই করে পৌঁছে যাই সেই গ্রামে। পাগলিগঞ্জ থেকে যাওয়া যায় এখানে। একদম শুরুতে গ্রামের মানুষের ক্ষোভ আর প্রত্যাশার পাহাড় ভেঙে পড়ে আমাদের ওপর; তবে আমরা বুঝি মানুষ কতটা ব্যাকুল হয়ে পড়লে ওরকম ব্যবহার করতে পারে। আমাদের পরের গন্তব্য ছিল দোগাছি অঞ্চলের কিছু গ্রাম। আমরা প্রথমে পৌঁছে যাই নলতাহার অঞ্চলের কিছু ছোট গ্রামে, যেখানে ওষুধ এবং প্রচুর খাবার জল দেবার পরে আমরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকি দক্ষিণ দোগাছির উদ্দেশ্যে। পথে অসংখ্য এলাকায় গাড়ি থামিয়ে ওষুধ বিলি করতে হয়েছে, সঙ্গে শুকনো খাবার আর পানীয় জল। দক্ষিণ দোগাছি পৌঁছতে বেশ বেগ পেতে হয়, কিছু কিছু এলাকায় এখনও প্রায় হাঁটু-সমান জল থাকায় আমাদের রাস্তা খুঁজে পেতে খানিকটা অসুবিধে হয়েছিল বটে, তবে আমাদের ট্রাক্টরচালক কাকার দৌলতে আমরা শেষে পৌঁছতে পারি আমাদের গন্তব্যে।
ইতিমধ্যে আমরা খবর পাই পলাশডাঙ্গা এবং সুলপানিপুরের মানুষ এখনও কোনও রকম ত্রাণ থেকে উপেক্ষিত। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে, জলে ডোবা কাঁচা রাস্তায় আমরা চললাম পলাশডাঙ্গার উদ্দেশ্যে, যদিও তখন সন্ধ্যা নামছে। পৌঁছে যা দেখলাম, তা দেখে চোখের জল আটকানো কঠিন হয়ে পড়ল। প্রায় এক সপ্তাহ পরেও এই গ্রামটিতে কোনও রকম ত্রাণ এসে পৌঁছায়নি। এই মানুষগুলো প্রায় এক সপ্তাহ কোনও রকম পরিষ্কার পানীয় জল আর খাবার ছাড়া ছিল। কেউ ফিরেও তাকায়নি। সামান্য হলেও কিছু খাবার আর জল তাদের দেওয়া গেল। প্রায় একই ছবি সুলপানিপুরেও।
আত্রেয়ীর জল ২০ তারিখ নাগাদ অনেকটা স্বাভাবিক। নদী শহরকে ফিরিয়ে দিচ্ছে তার হারানো মাটি। আমরা তাই ঠিক করলাম শুকনো খাবারের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে, পানীয় জল প্রচুর পরিমাণে নিয়ে যাব। প্রথমে আমরা পৌঁছলাম দোগাছি অঞ্চলের স্কুলপাড়ায়, সেখানে খুব কম গাড়ি ঢোকায় ওই এলাকাতে প্রচুর চাহিদা ছিল খাবার জল আর ওষুধের। তারপর আমরা এগোলাম মূল দোগাছির কোয়ার্টার মোড়ের দিকে, যেখানে দেখা পেলাম Red Cross-এর একটি দলের। দোগাছির কোয়ার্টার মোড় থেকে ডানদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে চকডাঙ্গার দিকে। এই অঞ্চলে এখনও জল রয়েছে, তাই সড়ক পথে যোগাযোগ কার্যত বন্ধ, একমাত্র উপায় নৌকা। এখানে আমরা Red Cross দলের সাথে যৌথভাবে একটা নৌকায় পাঠিয়ে দেই জলের বোতল আর সাবান।
এরপরে নলতাহার হয়ে ওই এলাকা থেকে বেরিয়ে আমরা যাই গফানগর মোড়ে, সেখান থেকে ডানদিকে ঢুকে আমরা পলাশডাঙ্গা, সুলপানিপুর হয়ে ঢুকে যাই গোবিন্দপুর অঞ্চলে। তবে এখানেই ঘটে বিপত্তি, রাস্তায় এক জায়গায় প্রায় এক মানুষ-সমান জল পেরোতে গিয়ে আমাদের ট্রাক্টরের ইঞ্জিনসমেত গাড়ির ভেতরে ঢুকে যায় প্রচুর জল, মাঝ পথে আটকে যায় আমাদের গাড়ি। প্রায় পঞ্চাশ মিটার মতো রাস্তা এলাকার কিছু মানুষের চেষ্টায় আমরা পার করি; প্রায় কুড়ি জন মানুষ ঠেলে পার করে দেয় আমাদের ট্রাক্টরকে। এরপর শুকনো রাস্তায় উঠে প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক করা হয়। সন্ধ্যা নামার কিছু আগে আমরা পৌঁছাই গোবিন্দপুর মোড়ে। এখানেও বন্যার প্রায় দশ দিন পরেও কোনও রকম ত্রাণ সামগ্রী এসে পৌঁছায়নি। এরপর আমরা মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় এগিয়ে যাই ধীরুহাজি (অনেকে ধীরুপুকুর বলেন) গ্রামে। তারপর সাথীহারা হয়ে সোজা বালুরঘাট।
এতদিনে বালুরঘাটের সার্বিক পরিস্থিতির প্রচুর উন্নতি হয়েছে, তবে কিছু গ্রামে এখনও ঠিকমতো পানীয় জল, ওষুধ ঢুকতে পারছে না। বন্যার জল বালুরঘাট শহরে আর নেই এখন, তবে তার ভয়াবহতা দাগ ফেলে গেছে শহরের বুকে। এই ক্ষতচিহ্ন আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে শহরের বাইরের গ্রামগুলোতে। আছে পানীয় জলের হাহাকার; যেখানে এমনি সময়েই ডাক্তার থাকে না, সেখানে বন্যার পরে ডাক্তার পাওয়া আরও বড় সমস্যা।
একুশ তারিখ প্রচুর জলের বোতল তুলে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি কুয়ারনের উদ্দেশ্যে। এদিন আমাদের লক্ষ্য ছিল বৃহত্তর কুয়ারন অঞ্চলের অনেকটা জায়গায় যাতে পৌঁছানো যায়। তবে আমরা আটকে পড়ি প্রবল বৃষ্টিতে, সে এক আলাদা অভিজ্ঞতা। একটা ত্রিপল নিয়ে তার নিচে সবাই বসে থাকা; সাথে ওষুধ এবং সাবান থাকায় আমাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছিল কোনও ভাবেই যাতে জল গড়িয়ে ভেতরে না ঢুকে যায়। বালুরঘাট রেলস্টেশন পেরিয়ে আমরা এক জায়গায় প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকে যাই। এরপরে কুয়ারনে পৌঁছে একে একে প্রতিটা পাড়ায় জল, ওষুধ, সাবান, কয়েল আর ফিনাইল দিয়ে আমরা ঢুকে পড়ি কুয়ারনের একদম প্রান্তিক পাড়াগাঁয়। জায়গাটার নাম ধুচুপাড়া। ধুচুপাড়াকে অনেকে আদিবাসী পাড়া বলেও চেনে।
এরপর ভারিলা হয়ে ঢুকে যাই কয়রাখল এলাকার খারাডাঙ্গা গ্রামে, সেখানে ঘণ্টাখানেক আমরা আমাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখি। আশেপাশের পাড়াগুলো (সবাই আদিবাসী পাড়া বলে চেনে), যেখানে গাড়ি নিয়ে ঢোকা সম্ভব না, সেখানে খবর দেওয়া হলে প্রচুর মানুষ চলে আসেন আমাদের গাড়ির কাছে। ওষুধ যেন এই মানুষগুলোর কাছে বাড়তি পাওনার মতো, এক দিদা এসে আমাদের সকলকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। বোধহয় সেই আশীর্বাদের জোরেই রাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে কাজ করতে কোনও অসুবিধে হয়নি আমাদের। এরপর আমরা গফানগরে কিছুটা দাঁড়িয়ে বেড়িয়ে পরি, ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে।
আমরা আগে একদিন ফরিদপুর গ্রামে জল দিতে পারিনি, আমাদের মনে ছিল সেই কথা। তাই এরপর আমরা পাগলিগঞ্জের কাছে পৌঁছে যাই যেখান থেকে ডানদিকের রাস্তা চলে গেল ফরিদপুরের দিকে।
আমরা যারা ট্রাক্টরে থাকি, মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠি, প্রচুর কাজ হওয়ার পর উল্লাসে ফেটে পরি। আমরা বলি “জোশ”…মাঝে মাঝে কিছু গ্রামের মানুষও যোগ দেয়। ভালো লাগে আমাদের। আসলে আমাদের বয়স কম, আর যে কাজে নেমেছি সেটা একটু শক্ত, তাই প্রতিটা ছোট ছোট পদক্ষেপের পর আমাদের আরও সাহস যোগায় আমাদের “জোশ” দেয়।
এর মধ্যে বাইশ তারিখ এক মজার ব্যাপার হল।
বন্যার সময় আমার ঘরে হাঁটু-সমান জল ছিল, পাড়ার কাউন্সিলরের দেখা পাওয়া যায়নি। মানুষ কী করছে, কীভাবে আছে, কোনও খোঁজ নেয়নি কেউ। বাইশ তারিখ। জল নেমে গিয়েছে প্রায় চারদিন আগে, বাড়ির সামনে বন্যার গন্ধটুকুও নেই। আর এই দিন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমাদের বাড়িতে দু’টো বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে গেলেন; ওই ত্রাণকার্য আর কী!
বাইশ তারিখ ট্রাক্টর জুটল না। বালুরঘাটের কালেক্টরেট অফিসের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত শুধু দৌড়ে গেলাম পাগলের মতো প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে, কোন লাভ হল না। এদিকে আমরা রোজ সকালে গিয়ে মাল তুলে নেই– সেগুলো রাখা আছে; চিন্তায়, রাগে, যখন প্রায় নাজেহাল অবস্থা, তখন প্রায় জেদ করেই ফোন করলাম এক ছোট গাড়িকে। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে চলে এল Bolero গাড়ি। কাকা হাজির। ফটাফট গাড়ি বোঝাই করে আমরা প্রথমে পৌঁছাই দোগাছি পার করে শিলিগুড়ি মোড় বলে একটা জায়গায়। সেখানে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি প্রায় তিনঘণ্টা, আশেপাশের গ্রামে খবর পাঠানো হয়। বিশেষ করে বাসুদেবপুর আর চক সাথীহারা অঞ্চলের প্রায় হাজারখানেক মানুষ এসে জড়ো হয় আমাদের গাড়ির কাছে।
এরপর আমরা তপন হয়ে ঢুকে যাই গঙ্গারামপুরে। মহারাজপুর পার হয়ে আমরা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি ভক্তিনগরে। এই জায়গায় তখনও অবধি পৌঁছায়নি ওষুধ। পানীয় জলের অভাবটাও খুব চোখে লাগছিল।
তেইশে আমরা পৌঁছে যাই গঙ্গারামপুর ব্লকের মহারাজপুর থেকে সুকদেবপুর যাবার রাস্তায় পাটন গ্রামে। আমরা এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রায় চার ঘণ্টা, যে সময়ে প্রায় চার-পাঁচ হাজার মানুষ আমাদের কাছে ছুটে আসে। দেওয়া হয় ওষুধ; প্রেশার মাপার ব্যবস্থা ছিল আমাদের কাছে। এরপর আমরা পৌঁছে যাই চাম্পাতুলি।
পরের দিন আমাদের শুরু হয় কালেক্টরেট অফিসের দৌড়ঝাঁপ দিয়ে। তবে কিছু মানুষের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার দৃঢ় মানসিকতা আমাদের কাজটা একটু সহজ করে দেয়। আগের দিন একটা ট্রাক্টরের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়। এদিন আমরা সবার আগে পৌঁছে যাই বালুরঘাট থানার IC-র কাছে। উনি আমাদের সব কথা শোনার পরে আমাদের ADM(LR) সাহেবের কাছে যেতে বলেন। ঠিক ৫ মিনিট লাগে ADM সাহেবের আমাদের ব্যাপার বুঝতে, একটা চিঠি করার সাথে সাথে আমরা প্রশাসনের থেকে ট্রাক্টর পেয়ে যাই।
গাড়ি বোঝাই করে প্রথমে পৌঁছে যাই চাম্পাতুলির ভেতরে দামোদরপুর গ্রামে। চাম্পাতুলি থেকে ভেতরে ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হয় আমাদের, প্রায় প্রতিটি বাঁকে আমাদের গাড়ি আটকায় গ্রামবাসীরা, মাথা ঠাণ্ডা রেখে আমরা এগোতে থাকি। সবাইকে কথা দিতে থাকি আমরা ফেরার পথে দাঁড়াব। দামোদরপুর বটতলায় পৌঁছে আমরা নেমে যাই কাজে। এরপর ওই রাস্তার সবক’টি গ্রামে আমরা জিনিস পৌঁছে বেড়িয়ে আসি চাম্পাতুলি মোড়ে।
ঢুকে পড়ি চাম্পাতুলির আদিবাসী পাড়ায়। তারপর কাজ শেষ করে আবার বেরিয়ে পরি বুনিয়াদপুরের দিকে। বংশীহারির কিছু আগে থেকে আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তার ধারের শিবিরগুলোতে পৌঁছে দেই ওষুধ, জল আর নিত্যপ্ৰয়োজনীয় কিছু জিনিস।
জল এখন অনেক কম। তবে এখনও বহু মানুষ ঘরছাড়া, সম্পত্তিহারা, অসুস্থ, ক্ষুধার্ত। এখনও অনেকদিন লাগবে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। যে ক’টা দিন পারি তাদের সঙ্গেই থাকব বিপদে-আপদে।
আপনারা সঙ্গে আছেন, সেটাই আমাদের জোর।