রৌহিন ব্যানার্জি
লেখক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, প্রবন্ধকার
বিগত হপ্তা দুয়েকে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য নামটা হঠাৎ রাজ্য রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনীতিতে জড়িত অথবা এ নিয়ে চর্চা করেন, দীপঙ্করের নাম তাদের কাছে অপরিচিত কিছু নয়, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের নেতা হিসাবে তাঁর কর্মকাণ্ড অনেকেরই জানা। কিন্তু আমজনতা, যাঁরা তথাকথিত “অরাজনৈতিক” এবং যাঁরা এ নিয়ে তেমন চর্চা করেন না তাঁরা চট করে দীপঙ্করকে চিনে ফেলবেন, দু হপ্তা আগেও এমন সম্ভাবনা কমই ছিল। তাহলে হঠাৎ কী এমন হল যে তিনি সরাসরি আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলেন এক বিরাট অংশের জনতার? কী এমন ঘটল যে ফেসবুক, ট্যুইটারের মত সামাজিক মাধ্যমেও তাঁর নামটা হঠাৎ “ট্রেন্ডিং” হয়ে উঠল?
গত ১১ই নভেম্বর ২০২০ বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর পরে দেখা যায় লিবারেশন মোট ১২টি আসনে জয়ী হয়েছে, বামপন্থী দলগুলি মোট ১৮টি আসন পেয়েছে। এনডিএ কে সরকার গড়া থেকে রোখা না গেলেও দেশজুড়ে বামপন্থীদের রক্তক্ষরণের মধ্যে বিহারের এই ফল অভাবনীয়ই বলা যায়। এবং এরপরেই দীপঙ্কর জানান, বিজেপিকেই বামপন্থীদের প্রধান শত্রু গণ্য করা দরকার এবং পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট দলগুলির প্রয়োজনে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করেও বিজেপিকে ঠেকানোর চেষ্টা করা উচিৎ। দীপঙ্করের এই বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পরেই রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে একটা আলোড়ন পড়ে যায় এবং সাধারণ থেকে নেতৃস্থানীয় বহু ব্যক্তি এর পক্ষে বা বিপক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেন। একদল বলেন, বিজেপি অবশ্যই প্রধান শত্রু এবং সেই কারণে যে ভাবেই হোক তাদের ঠেকানোটা আগে প্রায়োরিটি হওয়া দরকার, কারণ তারা ক্ষমতায় এলে সবার আগে মুসলিমদের ওপর এবং তারপরেই কমিউনিস্ট সহ সবরকম বামপন্থীদের ওপরেই নেমে আসবে তাদের প্রথম আক্রমণ। তাই তাদের ঠেকাতে যে কোনও পন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। অন্য পক্ষের মতে বিজেপি এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক চরিত্রে বিশেষ ফারাক নেই এবং এই মুহূর্তে বাংলার গ্রামেগঞ্জে অবস্থা যথেষ্টই খারাপ, বিজেপি এলে এর চেয়েও খারাপ হবে এমনটা তারা মনে করেন না। এঁরা এই ধরনের জোটের সম্ভাবনাকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সঙ্গে যারা সামান্যও পরিচিত, তারা অবশ্যই বুঝবেন যে এই প্রস্তাব অনেকেরই আপাতদৃষ্টিতে অ্যাবসার্ড কেন মনে হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টিগুলি, বিশেষত সিপিআই (এম) দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে তিক্ত সংগ্রামে লিপ্ত— যা বহু ক্ষেত্রেই রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে পারস্পরিক বল প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের সময়ে উভয় দলের কর্মীদের হাতে অপর দলের কর্মীরা খুন হয়েছেন, ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছেন, অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। ফলে আজ যদি হঠাৎ এদের পরস্পরের সঙ্গে জোট করতে হয়, এই কর্মীরা, যারা মারছেন এবং মার খাচ্ছেন (সর্ব অর্থে), তাঁদের বিভ্রান্ত হয়ে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। বামেদের ক্ষেত্রে তাও তাঁদের একটা অংশ যেহেতু বিজেপিকেই প্রধান শত্রু মনে করেন, তাই তাঁরা হয়তো এই জোটকে আপতকালীন বাধ্যতা বলে মেনে নেবেন, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস দলটার জন্মই হয়েছে সিপিএম বিরোধিতার আগুনে, আজ হঠাৎ যদি তাদের সঙ্গেই জোট করতে হয়, অধিকাংশ কর্মী, সমর্থকই মনে করবেন তাদের পিছন থেকে ছুরি মারা হয়েছে।
বস্তুত দীপঙ্করের কথার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া একটু খুঁটিয়ে দেখলেই এই কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। বামপন্থীরা দীপঙ্করের প্রস্তাবে দ্বিধাবিভক্ত, কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে, কেউ বা মাঝামাঝি— কিন্তু এখনও অবধি কোন তৃণমূল নেতা বা কর্মী এই জোটের পক্ষে একটি কথাও বলেননি। নরমপন্থীরা এড়িয়ে গেছেন, চরমপন্থীরা সরাসরি গালি দিয়ে সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। এবং এটা ঘটনা যে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের যে রাজনৈতিক অবস্থা, তা দেখলে তাদের এই কথা খুব অযৌক্তিক বলেও মনে হয় না। ২০১১-তে বামফ্রন্ট পরাজিত হলেও তাদের ভোট ছিল প্রায় ৪১ শতাংশ, যেখানে বিজয়ী তৃণমূলের ভোট ছিল ৩৯ শতাংশ। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোট কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩০ শতাংশে, তৃণমূল তাদের ভোট মোটামুটি ধরে রাখে, কংগ্রেসও তাই, এবং বামেদের এই হারানো ভোটের প্রায় সবটাই যায় বিজেপির পকেটে— আপাতদৃষ্টিতে। তাদের ৪ শতাংশ ভোট বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে। এরপরে ২০১৬ বিধানসভা ভোটে বিজেপি অনেকটা জমি হারিয়ে আবার ১০ শতাংশে নেমে আসে (যদিও ২০১১ বিধানসভার ফলের সঙ্গে তুলনা করলে তাদের ভোট বেড়েছে অবশ্যই), কিন্তু বামপন্থীদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকে এবং তারা নেমে আসে মাত্র ২৫ শতাংশে, ভোট বাড়িয়ে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস এবং কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে জাতীয় কংগ্রেস। আর সবশেষে লোকসভা ২০১৯, যেখানে আবার বেড়ে বিজেপি একলাফে পৌঁছে যায় ৪০ শতাংশে, তৃণমূলের ভোটও সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশে, কংগ্রেস নেমে আসে ৬ শতাংশের নীচে এবং বামেরা ৭ শতাংশে।
অর্থাৎ বামেদের ভোট যে ধারাবাহিকভাবে এবং প্রচণ্ডভাবে কমেছে সেটা বলার জন্য কাউকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে হয় না। সাধারণ পাটিগণিতের হিসাবই যথেষ্ট মনে হয়। কিন্তু এই ভোটের অঙ্ক যে সাধারণ পাটিগণিত নয়, সেটাও আমরা জানি। পাটিগণিত বলছে, বামের ভোট রামে গেছে, তাই বিজেপি বেড়েছে এবং সিপিএম সহ বামেরা কমেছে। কিন্তু অঙ্ক কি অতই সোজা? বামের ভোটের একটা অংশ যে রামে গেছে এতে কোনও সন্দেহ নেই অবশ্যই। যারা বাংলার রাজনীতির খবর রাখেন তাঁরা অবশ্যই জানেন গ্রামেগঞ্জে শাসক দলের মারের হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ যাকে পেয়েছেন, তাকেই আঁকড়ে ধরেছেন, সে খুঁটি বিজেপি হলে তাই সই। কিন্তু কথাটা হল, এই সংখ্যাটা, অ্যাবসোলিউট হিসাবেই হোক বা শতাংশের হিসাবে, ঠিক কত তা কারও জানা নেই। লক্ষণ শেঠ, ঋতব্রত ব্যানার্জী বা রিঙ্কু নস্করের মত কয়েকজন ছাড়া কোন উল্লেখযোগ্য বাম নেতা বিজেপিতে যোগ দেননি। অন্যদিকে তৃণমূলের মুকুল রায়, শঙ্কুদেব পণ্ডা, অর্জুন সিং প্রমুখ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, সাম্প্রতিক শুভেন্দু অধিকারীও সেদিকে পা বাড়িয়ে আছেন বলেই জল্পনা। এবার এরা যখন গেছেন, তখন এদের সমর্থকদের ভোটের একটা অংশও এদের সঙ্গেই যাবে এরকমই ধরে নেওয়া যায়, অথচ দেখা গেছে বিগত চারটি নির্বাচনে তৃণমূলের ভোট শতাংশ বা আসন, কোনটাই কিন্তু সেভাবে কমেনি, বরং শতাংশের হিসাবে তা অল্প হলেও বেড়েছে। এটা কী করে সম্ভব হল?
এটা বুঝতে হলে আমাদের সাধারণ পাটিগণিত ছেড়ে একটু বাইরে আসতে হবে। এর আসল কারণটা সম্ভবত এই যে দীপঙ্কর যে কথা আজ প্রকাশ্যে বলেছেন, বামপন্থীদের একাংশ তা অনেকটা আগেই ভেবেছেন এবং বামেদের জয়ের সম্ভাবনা যত কমেছে, তত তাদের ভোট তৃণমূলমুখী হয়েছে। অর্থাৎ বামেদের কমে যাওয়া ভোটের একটা অংশ বিজেপি পেলেও, বৃহত্তর অংশটা ইতিমধ্যেই পেয়েছে তৃণমূল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তৃণমূলের মোট ভোট তেমন বাড়েনি, কারণ তাদের ভোটের একটা বড় অংশ চলে গেছে বিজেপির দিকে— তাদের নেতাদের হাত ধরে। এর বাইরেও বাম এবং তৃণমূল উভয় দলের অপেক্ষাকৃত ধর্মসচেতন (পড়ুন সাম্প্রদায়িক) সমর্থকরা অনেকে স্বাভাবিক চয়েসেই বিজেপির দিকে ঝুঁকেছেন, এটাও অনস্বীকার্য। এর ফলে যে ভোটটা বিজেপি বাড়তি টেনেছে, তার সিংহভাগ তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে এলেও তৃণমূলের মোট ভোটসংখ্যায় সেভাবে টান পড়েনি কারণ বাম ভোটের একটা অংশ তাদের ঘরে এসে ঢুকেছে, যা বিজেপি না থাকলে হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় ঢুকত না কোনওদিনই।
অতএব দেখা যাচ্ছে, দীপঙ্কর খুব নতুন কথা কিছু বলেননি— বাংলার মানুষের একাংশের মনের কথাই তিনি বলেছেন। কিন্তু তার মানে এও নয় যে এটাই দেওয়ালের লিখন। বাংলার রাজনীতি শুধু বহুদলীয়ই নয়, তার অনেকগুলি আলাদা আলাদা স্তরভাগ আছে, গুপ্ত বর্ণভেদ সমর্থন, ক্রমশ প্রকাশ্যে আসতে থাকা সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণিবৈষম্য, লুম্পেন প্রলেতারিয়েত ফ্যাক্টর, অপারেশন বর্গার দীর্ঘমেয়াদি ফল, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ— ইত্যাদি বহু বিচিত্র বিষয় বাংলার রাজনীতিকে প্রভাবিত করে যে যার মত করে— ফলে কারও পক্ষেই এখানে শেষ কথা বলা সম্ভব নয়। তবে রাজনীতি যদিও সম্ভাবনার শিল্প এবং এখানে অসম্ভব বলে কিছু হয় না, তবুও অন্তত বর্তমানের প্রেক্ষিতে দেখলে একটা কথা বলা যেতেই পারে যে দীপঙ্করের প্রস্তাব যৌক্তিক হোক বা অযৌক্তিক, এই মুহূর্তে তা বাস্তবসম্মত নয়, এবং এইরকম কোনও জোট যে ২০২১-এ অন্তত হচ্ছে না, এটা এখনই লিখে দেওয়া যায়। ২০২১-এ ত্রিমুখী লড়াই হচ্ছেই, যদি অধিকারী মশাই নতুন দল খুলে লড়াইটাকে ইতিমধ্যে চতুর্মুখী না করে দেন। তারপর কী হবে তা আপাতত শ্যামলালেরও জানা নাই।