Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লগ্নতা: স্মৃতি ও আবেগ

লগ্নতা: স্মৃতি ও আবেগ -- অঙ্গনা

অঙ্গনা

 

 

 

এটা সেই সময়ের গল্প যখন সেক্যুলারিজম, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় হিংসা/বিদ্বেষ এইসব শব্দগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেনি। ‘গল্প’ বলছি বটে তবে এসবের এক কণাও বানানো না, বরং আমার যাপিত অভিজ্ঞতার অংশ। তবু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই পেরিয়ে আসা সময়টাকে গল্পের মতোই মনে হয়।

জন্মের পর থেকে আমার জীবনের প্রথম কুড়ি বছর যে বাড়িতে কেটেছিল সেই বাড়িটি উত্তর কলকাতার যে গলির ভেতর অবস্থিত ছিল সেই গলির মোড়ে ছিল একটা মসজিদ। স্থানীয় মানুষজনের কাছে ‘মসজিদওয়ালা গলি’ নামেই পরিচিত ছিল আমাদের সেই সঙ্কীর্ণ গলিপথটি। আমার জীবনের শৈশব-কৈশোরের নানা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে-জাপটে ছিল মসজিদটি: দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে নানা উৎসবে, পার্বণে— রথের দিন হোক বা দুর্গাপুজোর ভাসান! আমার মেয়েবেলার প্রত্যেক দুর্গোৎসবের সমাপ্তিতে মসজিদটি থেকেছে নীরব সাক্ষী হয়ে। দুর্গা দশমীর সন্ধেবেলা সাধারণত আমাদের পাড়ার ঠাকুর ভাসান যেত। পাড়া বলতে তো ওই সরু গলি। এতই অপ্রশস্ত ছিল সে গলি যে বড় লরি ঢোকার উপায় ছিল না। লরি দাঁড়িয়ে থাকত গলির মুখে, মসজিদের ঠিক সামনে। গলির ভেতরের প্যান্ডেল থেকে প্রতিমাগুলো বাঁশে বেঁধে পাড়ার অনেকে মিলে কাঁধে করে বয়ে আনতেন লরি পর্যন্ত। তারপর দুর্গা এবং তাঁর সন্তানসন্ততিদের লরিতে তোলা হত।

আমরা পাড়ার কচি-কুচোর দল ওই মসজিদের দরজার সামনে এই পুরো পর্বটা দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়তাম ‘পজিশন’ নিয়ে। বিসর্জন যাওয়ার আগে দুগ্গাঠাকুরকে সে বছরের মতো শেষবার দেখার জন্যে আমাদের সে কী আকুতি! লরিতে ঠাকুর তোলার পর্ব মিটে গেলে শুরু হত ধুনুচি নাচ; তারপর ঠাকুরের সঙ্গে লরিতে কে কে যাবে আর কারা যাবে লরির পেছন পেছন হেঁটে সেই বিষয়টি ফয়সালা হবার পরে গড়াতে শুরু করত লরির চাকা। লরিতে উঠে ভাসানে যাওয়ার কী যে অদম্য ইচ্ছে আমার মনে তখন আকুলিবিকুলি করত সে আর কী বলব! জানতাম এই ধরনের ইচ্ছে মুখে উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ। মসজিদের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে শুধু চাক্ষুষ করে যেতাম যা কিছু ঘটে চলত সব। আর মনে মনে ঠাকুরকে বলতাম, আরও একটু থেকে যাও না, আর কিছুক্ষণ পরে রওনা দাও না, ঠাকুর! প্রাণপণে চাইতাম, আরও প্রলম্বিত হোক উৎসবের আমেজ। কিন্তু এত প্রার্থনা সত্ত্বেও সেই চরম মুহূর্তটা এক সময় এসেই পড়ত। লরি দুর্গাঠাকুরকে নিয়ে যাত্রা শুরু করত আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বোবা শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে নিত। বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যেত, গত কয়েকদিনের সব মজা, আনন্দের আবেশ যেন এক লহমায় অতীত হয়ে যেত। লরি ক্রমশ দূরে সরে যেত, দৃষ্টির বাইরে চলে যেত একে একে ঠাকুরের মুকুটের চুড়ো, হাতের মুঠি… চেষ্টা চালিয়ে যেতাম আমার নজর আরও দূর পর্যন্ত যাতে নাগাল পায়, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ডিঙি মেরে নিজের উচ্চতা একটু হলেও বাড়িয়ে নিতাম আরও খানিকক্ষণ লরিটা দেখতে পাবার দুরাশায়। ঠাকুরসহ লরি পুরোপুরি দৃষ্টির আড়াল হলেই যে পড়তে হবে এক অপার শূন্যতার গহ্বরে! এই আশঙ্কা বুকে চেপে এবার বাড়ি ফেরার পালা। আনমনা হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর জন্যে যেই না পেছন ফিরতাম অমনি চোখের দৃষ্টি ধাক্কা খেত মসজিদের আধ খোলা দরজায়। সে যেন অভিমানী দুঃখী মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে চাইত— ‘নাই বা থাকল দুগ্গাঠাকুর সারা বছর, আমি তো আছি! আগলে রাখব, চিন্তা কিসের!’ (সত্যিই কত বিচিত্র রকমের প্রশ্রয় ওই মসজিদ থেকে বালিকা আর কিশোরীবেলায় যে পেয়েছিলাম সে গল্প পরে কখনও হবে। পরিণত বয়সেও সে আমাকে দিয়েছে মানসিক আশ্রয়। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা ঘটনাপরম্পরায় মসজিদটি আমার জীবন-কাহিনির এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে উঠেছে আমারই অজান্তে।) এভাবেই আমার স্মৃতিতে, আমার মননে দুর্গা ভাসানের দৃশ্যের পটভূমি হয়ে মসজিদটি অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে। এই ছবিকে ছিঁড়েখুঁড়ে টুকরো করতে পারবে এমন সাধ্য কোনও তাবড় বিভেদকামীরও নেই!!

Conflation— A nostalgic emotion!

 

একটি অন্তরঙ্গ অন্বেষা

আমার বালিকাবেলার স্মৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে একটি মসজিদের অনুষঙ্গ। মসজিদটির লাগোয়া তিনতলা যে বাড়িটা সেখানে প্রায় দিনই বিকেলে খেলতে যেতাম। ওই বাড়ির ছোট মেয়ে ছিল আমার জ্যাঠতুতো দিদির খেলার সাথী। আমি দিদির ল্যাংবোট হয়ে ওদের দলে ভিড়ে যেতাম। বাড়িটার উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল ছাদ ছিল আমাদের খেলার ময়দান। পাঁচিলের গায়ে ছিল ইটের জাফরি, সেই জাফরিতে পা দিয়ে উঠে ঝুঁকে দেখলে মসজিদের গোটা চত্বরটা নজরে আসত। খেলতে খেলতে সুযোগ পেলেই ঝুঁকি দিতাম আর দেখতে পেতাম, উঠোনে রয়েছে বড় বড় দুটো চৌবাচ্চা আর অনেক রকমের গাছ। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটা। মসজিদের চৌহদ্দির মুখে লোহার কোলাপসিবল গেটটা বেশিরভাগ সময় অল্প ফাঁক রেখে টানা থাকত। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা ইচ্ছেমতো উঁকিঝুঁকি দিত। আমিও থাকতাম তাদের দলে। মসজিদের উঠোনে ছিল হরেকরকম ফুল, ফল, বাহারি পাতার গাছ। ওই গাছগুলো থেকে ফুল-পাতা নিজেদের প্রয়োজনে সংগ্রহ করা পাড়ার বাচ্চাদের মধ্যে প্রায় একটা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কখনও ফুল বা পাতার দরকার হলে আমরা মসজিদের গেটের ফাঁকে মাথা গলিয়ে উঁকি দিতাম, ভেতরে কেউ নজরে এলে অনুমতি চাইবার জন্যে। চোখের ইশারায় অনুমতি মিলতেই সদলবলে ভেতরে ঢুকে ইচ্ছেমতো পাতা-ফুল ছিঁড়ে নিয়ে আসতাম। প্রায় প্রত্যেক রথের দিনেই নিজেদের রথ সাজানোর বাহারিপাতা জোগাড় করতে মসজিদের গাছগুলোই ছিল আমাদের ভরসা। ওইদিনটা মসজিদের চত্বরে আমাদের প্রবেশ ছিল বাধাহীন। মসজিদের সামনের ফুটপাথে বিকেল হলেই ভেঁপু বাজিয়ে রথ টানার ধুম পড়ে যেত। আর ছিল একটা মস্ত আমগাছ যার ঝাঁকড়া ডালপালার অনেকটাই মসজিদের পাঁচিল ছাপিয়ে বাইরে ছড়িয়ে থাকত। গরমকালে সেই গাছে আম ধরলে পাড়ার কিছু ছেলে ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়ত। আমি অবশ্য কখনও তাদের সঙ্গে সামিল হতে পারিনি বাড়ির শাসনের কারণে।

এছাড়া দেখতাম প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার বিকেলে মসজিদের সামনে অনেক দূর দূর থেকে মানুষ এসে জমা হত, অনেক লম্বা লাইন পড়ত, বাচ্চা কাঁখে মহিলা, বয়স্ক মানুষ। তারা সবাই ‘জল-পড়া’ মানে মসজিদের ইমামের মন্ত্র পড়া জল নিতে আসত। তাদের বিশ্বাস, সেই ‘জল-পড়া’ খেলেকঠিন থেকেকঠিন অসুখ সেরে যায়। ডাক্তার-হাকিমের যা অসাধ্য ওই মন্ত্রপুত জলের সেই ক্ষমতায় আস্থা রেখে ছুটে আসত তারা।

ওই মসজিদের প্রতি অদ্ভুত একটা ভয়মিশ্রিত আকর্ষণ কাজ করত সেই কাঁচা বয়সে। শুনেছিলাম, মসজিদের মূল নির্মাণের ভেতরে নাকি মেয়েদের যাওয়া বারণ। এমনকি মসজিদের চত্বরে পর্যন্ত ঢুকতে পাড়ার বড়রা নিষেধ করতেন— আমরা ছোটরা মসজিদের চৌহদ্দিতে পা দিলেই নাকি ভেতরে যেসব টুপি-লুঙ্গি পরা, দাড়িওয়ালা বিধর্মের মানুষজন থাকে তারা আমাদের মসজিদের ভেতরে আটকে রাখবে, এই বলে ভয় দেখাতেন। কিন্তু আমার কিছুতেই সে কথা বিশ্বাস হত না। বরং ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হত, মসজিদের ভেতরে কী আছে না আছে সেসব জানতে আগ্রহ হত। আমি তখন নিতান্ত বালিকা, তার ওপর খুবই মুখচোরা ছিলাম। তাই আমি আগ বাড়িয়ে কথা শুরু করব বা ওই মানুষগুলো আমাকে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করবেন, এর কোনওটাই বাস্তবে হয়ে ওঠেনি। মসজিদের অদূরে একটা শাল-কাপড় রিফু ও ধোলাইয়ের দোকান ছিল। সেই দোকানের কারিগররা অতি সূক্ষ্ম ছুঁচের ফোঁড় তুলে যে নিখুঁত রিফুর কাজ করতেন তার খ্যাতি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। দূর দূর থেকে মানুষজন আসতেন সেখানে। ওই দোকানের কর্মীদের অনেকে ওই মসজিদের ভেতরে থাকতেন। মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যখন কাপড়-জামা-শাল কাচতে বা রিফু করতে দেওয়ার জন্যে ওই দোকানে যেতেন তখন আরও একটু কাছ থেকে দেখতে পেতাম দাড়িওয়ালা লুঙ্গি-টুপি পরা মানুষগুলোকে। কেউ কেউ বসে কাপড়ে রিফু করছেন, কেউ খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলছেন মোলায়েম সুরে। আমি মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ভাবতাম, এরা আবার আমাকে মসজিদে আটক রাখবেন কি! যত সব আজগুবি কথা!! আমার মনে ভয় উদ্রেককারী কোনও উপাদানই তাদের মধ্যে আমি খুঁজে পেতাম না ওই বয়সেও। কাজেই ভয় তাদের আমি কোনওদিনই পাইনি। তবে মসজিদের ভেতরে যাবার অদম্য কৌতূহল এবং বাসনা যখন নিষেধের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরত এসেছিল তখন অল্প বয়সের অবুঝ মন খুব দমে গেছিল। বুঝতে পেরেছিল, অবাধ চলাচলের ক্ষেত্র এটা নয়। কেন নয় সেটা ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। সামাজিকভাবে দূরত্ব গড়ে তোলা এবং বজায় রাখার নানা প্রচেষ্টা ও প্রকরণ সত্ত্বেও ‘ওই’ মানুষগুলোকে জানার, তাদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত আদানপ্রদানের আকাঙ্ক্ষা কিন্তু পরবর্তী সময়েও মনের মধ্যে থেকেই যায়। পরিণত বয়সে সেই বাসনা পূরণ করার সুযোগ খুঁজে নিতে এবং তার সদ্ব্যবহার করতে স্বভাবতই আমি কোনও ত্রুটি রাখিনি। আজ ভাবতে বসে প্রশ্ন জাগে, সেই আকাঙ্ক্ষা এবং তার চরিতার্থের নেপথ্যে কী ছিল— অজানাকে জানার ইচ্ছে, নিষিদ্ধকে জয় করার বাসনা নাকি ‘সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধনে’র সামাজিক দায়বদ্ধতা? সঠিক জানি না।

 

স্মৃতির আশ্রয়

আমি যখন সদ্য যুবতী তখন উত্তর কলকাতার ‘মসজিদওয়ালা গলি’র বাড়ি থেকে আমার ঠিকানা বদল হয় আধুনিক উপনগরীর প্রশস্ত রাস্তায়। হারিয়ে যাওয়া দিনের স্মৃতির অংশ হয়ে থেকে যায় মসজিদটি। নিজস্ব বোধ ও মতামত গড়ে ওঠার পর থেকেই কোনওরকম ধর্মাচরণ থেকে আমি সুচিন্তিতভাবে বিরত থাকি। পারতপক্ষে কোনও ধর্মস্থানে যাই না। অথচ মসজিদের বেলায় বিষয়টা অন্য রকম। নিজের মনের এই ব্যাভিচারী চলন নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছে, আসলে ‘মসজিদ’ কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ বা মাহাত্ম্য আমার কাছে বহন করে না, বরং তা আমার স্মৃতিপটে থেকে গেছে আবেগ হিসেবে যা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় জীবনের সকালবেলায়।

বহু বছর পরে পরিণত বয়সে হঠাৎ একদিন হাজির হই পুরনো কলকাতার সেই গলির সামনে। ওই তো রাস্তার ওপর গলির মুখে মসজিদটা! সময়ের ব্যবধানে কেমন মলিন আর বিবর্ণ দেখাচ্ছে ওর দেওয়ালগুলো। বাইরের পাঁচিলের গায়ে ইতি-উতি উঁকি মারছে বট-অশ্বত্থের চারা। মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। মনে পড়তে থাকে, এক সময় আমার জীবনের কত না মুহূর্তের সে সাক্ষী থেকেছে— রথযাত্রা থেকে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের বুক খালি করা সন্ধ্যায় এই মসজিদই থেকে গেছে পশ্চাৎপট হয়ে। গলির মুখে মসজিদকে ফেলে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি আমার এক সময়ের বাসভবনের উদ্দেশে। স্মৃতির আবেশে আমার হৃদয়-মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে। তবু মনকে শক্ত করে বেঁধে রাখার চেষ্টা করতে থাকি, দৃপ্ত পদচারণায় আবেগের চোরাস্রোত সামলাতে থাকি। কঠোর যুক্তির চেতাবনি মেনে নিয়ে মনকে প্রস্তুত করি যাতে সে পুরনো বাড়ির জীর্ণ দশা, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে মুষড়ে না পড়ে। তবু মন আশা ছাড়ে না— রং-রূপে না-ই মিলুক, রেখায় তো মিলবে অতীত আর বর্তমানের ছবি!

গলিপথের যে জায়গাতে আমার অতীতের মুখোমুখি হবার কথা সেখানে পৌঁছে দেখি একটা উঁচু লোহার গেট। কিন্তু এখানে তো থাকার কথা ছিল একটা বড় পুরনো কাঠের সদর দরজা! তাহলে কি ভুল বাড়িতে এসে পড়েছি? দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানই কি তবে এই ভুলের জন্যে দায়ী? মনের দ্বন্দ্ব কাটানোর জন্যে বাড়ির বাইরের দেওয়ালে লাগানো নাম–ঠিকানা লেখা ফলকটার দিকে তাকিয়ে দেখি ভালো করে। হ্যাঁ, সঠিক ঠিকানাতেই তো এসেছি। তাহলে বাড়িটা বদলে গেল কী করে! বাড়ির মালিকানা বদল হয়েছে সেটা অবশ্য স্পষ্ট। লোহার গেটের বাঁ ধারে কলিং বেলের সুইচ চোখে পড়তেই আগুপিছু না ভেবেই আঙুল রাখি। মিনিট দুয়েকের মধ্যে গেট খুলে যায়— কাকে চাই? জানতে চান একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। আমি এবার একটু বেকায়দায়ই পড়ে যাই। সত্যি কাকে বা কী চাই আমি? দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দ্বিধা-সঙ্কোচ কাটিয়ে শান্ত স্বরে জানাই আমার আসার উদ্দেশ্য। এত দিন পরে এত দূর থেকে এসেই যখন পড়েছি তখন বাড়ির ভেতরে যাবার সুযোগটা হাতছাড়া করতে মন চায় না। এক সময় এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলাম শুনে বর্তমান গৃহকর্তা আমাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে অনুরোধ জানালেন। ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে লোহার গেটের ওপারে পা রাখলাম। সঙ্গে সঙ্গে সব উত্তেজনা, নস্টালজিয়া দপ করে নিবে গেল। ভেতরে ঢুকে যে নির্মাণের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি তার সঙ্গে আমার এত বছর ধরে স্মৃতিতে লালন করে চলা নির্মাণের কোনও মিল নেই। ঠিকানা এক থাকলেও আগের আলয় আর নেই— আমি তো আগেই এ আশ্রয় ছেড়ে গেছি, আজ আমার স্মৃতির আশ্রয়টুকুও হারাল। গৃহকর্তা বলে চলেছেন, হাত বদল হবার পর কত বিপুল অর্থ ব্যয়ে তিনি পুরনো নির্মাণ ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছেন এই বাড়ি। জীর্ণ, পলেস্তারা খসে পড়া, রংচটা দেওয়ালের বদলে আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর্থিক স্বাচ্ছল্যের ছটায় উদ্ভাসিত একটি অট্টালিকাসম বাড়ি। আমার ভেতরে যেন ধ্বস নামল। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটকে পড়ল আমারই সামনে আমার অতীত। পরম মমতায় টুকরোগুলো জড়ো করে কুড়িয়ে নিই, তারপর কোনও ক্রমে গৃহকর্তার কাছে বিদায় নিয়ে দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়াই গলির মোড়ে, মসজিদের সামনে। সেখানে পৌঁছে নিজেকে আবার ফিরে পেলাম। তখন হাওয়ায় ভাসছে আসরের (বিকেলের) আজান। বিকেলের আজান আজ বড় বেশি করুণ আর মায়াময় হয়ে কানে বাজছে। মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে সেই সুরে আচ্ছন্ন হতে হতে কয়েক মুহূর্ত আগের তছনছ হয়ে যাওয়া অতীত স্মৃতির অংশগুলো আবার একে একে জোরা লাগালাম। মনে হল, আমার রূপ-শব্দ-গন্ধময় নস্টালজিয়া যেন গচ্ছিত আছে এই মসজিদেই। আমার শৈশব-কৈশোর জীবনের একমাত্র সাক্ষী হয়ে সে-ই কেবল আজও অটুট।

 

বিভেদ নাকি প্রভেদ!

এ বছরের (২০২০) শুরুর দিকের কথা। পার্কসার্কাস ময়দান তখন কলকাতার ‘শাহিনবাগ’। সেখানে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন বয়সের মহিলারা জড়ো হয়েছেন। শিশুসন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যোগ দিয়েছেন মায়েরাও। সবাই মিলে অবস্থান আন্দোলন করছেন রাতদিন। এদেশে সদ্য বলবত হওয়া নাগরিক সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রত্যাহারের দাবিতে এই আন্দোলন। ভারতবর্ষের অখণ্ডতা অটুট রাখার দাবিতে এই সমাবেশ। যেসব মহিলা এখানে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করছেন তাঁরা ছাড়াও দিনের বিভিন্ন সময়ে আরও অনেকেই আসছেন এই জমায়েতে। কেউ কেউ গান করছেন, কেউ কবিতা পড়ছেন, কেউ আবার বক্তব্য রাখছেন এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে। দিল্লির শাহিনবাগেরই ঢঙে।

এক শনিবার বিকেলের দিকে আমি সেই অবস্থানে সামিল হব বলে গেছি, বসে আছি ঘেরাটোপের ভেতর মাটিতে বিছিয়ে রাখা ত্রিপলের ওপর। জমায়েতের মাঝখানে মাইক হাতে নানা জনে নানা কিছু বলছেন। আশেপাশে বসে আছেন যারা তাদের সঙ্গে কথা বলে জানার ও বোঝার চেষ্টা করছি এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি এবং আগামী কর্মসূচি। হঠাৎ দেখলাম একজন ‘পুরুষ’ এই জমায়েতের মাঝখানে উপস্থিত হয়ে মাইক হাতে উদাত্ত কণ্ঠে গান গেয়ে উপস্থিত সকলকে উদ্দীপিত করছেন। গান শেষে তিনি বললেন, “আমি আন্তরিকভাবে কামনা করি আপনাদের এই আন্দোলন সফল হোক, আপনাদের সব দাবি যেন গ্রাহ্য হয়।” সত্যিই খুব আন্তরিকভাবেই বললেন তিনি কথাগুলো। কিন্তু ‘আপনাদের দাবি’ কথাটা কেমন কানে বাজল!

এই জমায়েতে যেসব মেয়েরা, মায়েরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ময়দানের খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টি, ঠান্ডা আবহাওয়া আগ্রহ্য করে অবস্থান করছেন এই দাবিগুলি কি কেবল তাঁদের? আজ দেশ জুড়ে যে সঙ্কট উপস্থিত তা কি শুধু তাঁদের সঙ্কট? এ কি সারা দেশের সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেওয়া যায় যে সিএএ বা এনআরসি এ দেশে বসবাসকারী সব মানুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, অতএব এগুলি লাগু হওয়ায় কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীই কেবল সঙ্কটাপন্ন, তাই এটি আপামর ভারতবাসীর সমস্যা নয়, তবু কথা থেকে যায়। একটি দেশে বা সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের একাংশ যদি সঙ্কটে পড়ে তাহলে তা কি সামগ্রিক একটি সমস্যা নয়?

অবশ্য আমরা তো সেভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। ‘মেয়েদের’ সমস্যা, ‘ট্রান্স-দের’ সমস্যা, ‘দলিতের’ সমস্যা, ‘সংখ্যালঘুর’ সমস্যা, ‘শ্রমিকের’ সমস্যা, ‘কৃষকের’ সমস্যা, ‘শিক্ষকদের’ সমস্যা, ‘কাশ্মিরের’ সমস্যা; এরকম আরও কত সমস্যা এবং সেই অনুসারে প্রত্যেক গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা দাবি। এভাবেই আমরা নিজেদের দাবি এবং সমস্যার নিরিখে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক পৃথক আন্দোলনে নামি বা সরব হই। কখনও বড় জোর অপরের দাবির প্রতি আমরা সমর্থন জানাই, সহানুভূতিশীল হই। কিন্তু সব দাবিকেই আমাদের প্রত্যেকের নিজের দাবি বলে স্বীকৃতি দিতে পারি না, কারণ সেই সব দাবির নেপথ্যে থাকা সঙ্কটকে আমাদের প্রত্যেকে নিজের সঙ্কট বলে ভাবতে পারি না বা শিখি না। এভাবেই আমরা যত বেশি নিজেদের মধ্যে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতাকে লালনপালন করি ততই আসলে মুষ্টিমেয় কিছু বিভেদকামী ক্ষমতাগোষ্ঠীকে সুযোগ করে দিই তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের। সহযোগিতা করে চলি তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। সমাজে প্রত্যেক মানুষ অপরের থেকে আলাদা, পৃথক— নানাভাবে, নানা দিক থেকে। আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের থেকে নানা দিক থেকে আলাদা বা ভিন্ন। দুজন ব্যক্তির মধ্যে কোনও বিষয়ে যেসব ভেদ বা ভিন্নতা থাকে তা প্রেক্ষিতসাপেক্ষে ‘বিভেদ’ এবং ‘প্রভেদ’ হিসেবে দেখা যায়। ‘বিভেদ’ নেতিবাচক আর ‘প্রভেদ’ ইতিবাচক প্রেক্ষিতের দ্যোতক। সমাজকে নানা ভাগে বিভক্ত করে রাখলে যাদের সুবিধে তারা ভিন্নতাকে ‘বিভেদ’ হিসেবে দেখে এবং প্রচার করে। ‘বিভেদ’ আর ‘প্রভেদ’কে তারা গুলিয়ে দেয় নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে। কিন্তু ইতিবাচক, একতাকামী প্রেক্ষিত থেকে পারস্পরিক ভিন্নতাকে দেখা যেতে পারে ‘প্রভেদ’ হিসেবে যা আমাদের নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করে ভেতর থেকে শক্তি জোগাতে পারে। পারস্পরিক প্রভেদ বিষয়ে সচেতন থেকে বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। এবং আজকের ভারতবর্ষে তা জরুরিও বটে। প্রকাশ্য পরিসরে জনপ্রতিরোধের পাশাপাশি অন্তরঙ্গ, ব্যক্তিক পরিসরেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা বিশেষ দরকার যাতে কেউ সুকৌশলে আমাদের পারস্পরিক পার্থক্যগুলোকে ‘বিভেদ’ নির্মাণের হাতিয়ার করে তুলতে না পারে।