Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমার দেবব্রত বিশ্বাস

প্রতুল মুখোপাধ্যায়

 

 

আমাদের সময়ের বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় গণসঙ্গীত শিল্পী। এখনও গান লিখছেন, বাঁধছেন, গাইছেন।

 

 

মফস্বলে আমাদের বাড়িতে রেডিও ছিল না। ক্বচিৎ কদাচিৎ দেবব্রত বিশ্বাসের গান কানে এসেছে। তবে সেই অল্প-শোনাতেই নিবিড় ভালো-লাগা জন্মেছিল– এটুকু বলাই যায়। সেই অভিজ্ঞতা ছিল অভূতপূর্ব।

সেই অভিজ্ঞতার সামনে পড়লাম কলকাতায় এসে। ১৯৫৯-৬০ সাল হবে। প্রেসিডেন্সি কলেজে গান গাইতে এলেন দেবব্রত বিশ্বাস আর সুচিত্রা মিত্র। রবীন্দ্রনাথের গান তার আগে শুনেছি ঢের। কিন্তু ওইরকম গান? নাহ, শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ‘সর্বখর্বতা’-কে দহনের আহ্বান ওইভাবে শুনিনি তার আগে কোনওদিন। ধ্রুপদী রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানকে আসন্ন বিপ্লবের অর্চনা বলে মনে করেছিলাম সেইদিন। দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠ ছিল বাস ব্যারিটোন। এ নিয়ে ওঁর একটু চিন্তাও ছিল, যে মানুষ এইরকম কণ্ঠ পছন্দ করবে কি না। অমন কণ্ঠ তো আর একটিও ছিল না সেই সময়। আইপিটিএ পেয়েছিল বটে একখানা কণ্ঠ! ওইরকম উদাত্ত, ভরাট। দেবব্রত-সুচিত্রার সেই যুগলরূপ দেখেছি পরেও। হিন্দু হস্টেলের অনুষ্ঠানে। এখনও মনে আছে-– নৃত্যের তালে তালে গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন সকলকে।

এক আকাশে তখন সূর্য দু’খানা। দেবব্রত বিশ্বাস তো ছিলেনই। আরও ছিলেন সুবিনয় রায়। মজে ছিলাম সুবিনয়েও-– যদিও সুবিনয়পন্থী ও দেবব্রতপন্থীরা তখন যেন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল। এতদিন সুবিনয়ের সামনে বিনত থাকলেও গানের আরও এক রূপদর্শন ঘটালেন দেবব্রত। সুবিনয় রায়ের গানে রবীন্দ্রনাথের ঋতু, প্রেম ও পূজা পর্যায় পেয়েছি। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের গানে পেলাম স্বদেশের কথা। সে কথা আমাদের মতন করে বলা আমাদের কথা হয়ে গিয়েছিল-– তখন আমরা কলেজপড়ুয়া।

সুবিনয় ও দেবব্রত-– আপাতদৃষ্টিতে গায়নভঙ্গীর দুই মেরুতে যেন দুজনের অবস্থান। তবে আসলে হয়ত তা নয়।

সুবিনয় রায়ের গানে অনায়াস সূক্ষ্ম তানকর্তব। দেবব্রত বিশ্বাসের গানে সহজসরল আবেদন। কিন্তু দুজনের গানই শ্রোতাকে মোহিত করে। একজন যদি মোহিত করেন তাঁর ধ্যানমগ্নতায়, অপরজনের সম্বল শ্রোতার মন পড়ে নিয়ে এমনভাবে গান গাওয়া-– যেন গানটি শ্রোতা নিজেই গেয়ে উঠলেন। দুজনেই কম্যুনিকেট করলেন শ্রোতার সঙ্গে-– তবে পদ্ধতিটা আলাদা।

গায়ক হিসাবে অল্পবিস্তর পরিচিতি আমারও হয়েছে। সেই দাবীতেই বলছি, আমার গানের যদি কোনও স্ট্রং পয়েন্ট থেকে থাকে, তবে তা কথা বলার ভঙ্গীতে গান গাওয়া। একে আমি বলি ‘গান বলা’। আমি দেবব্রত বিশ্বাসকে দেখেছি গান বলতে-– আমার কলেজের দিনগুলোতে। হয়তো তখনই মনের কোণে এই বিশ্বাসের বীজটা অঙ্কুরিত হয়েছে-– এভাবেও গান গাওয়া যায়!

আজ বলতে বাধা নেই-– কথাটা কিঞ্চিৎ বুড়োটে শোনালেও আমি বলতে বাধ্য, যে দেবব্রত বিশ্বাসের গান যারা সামনে বসে-দাঁড়িয়ে শোনেননি, তাঁরা অন্তত অর্ধেক বঞ্চিত হয়েছেন। ওইরকম গানের পরিবেশন আমি আগে, বা পরেও এতকাল হয়ে গেল-– শুনিনি। গান গাইতে গাইতে হয়তো এমন কোনও গানের অনুরোধ এল যে গান ওঁর সম্পূর্ণ মুখস্থ নেই। উনি নির্দ্বিধায় সামনের কোনও পরিচিত মানুষকে ডেকে নিয়ে বলতে পারতেন-– পাশে বসেন, মনে করায়া দেন। ওঁর গান গাইবার সময় প্রেক্ষাগৃহের আলো জ্বেলে দিতে হত। গান গাইবার সময় শ্রোতাদের মুখ না দেখতে পেলে উনি অখুশী হতেন। এই এক বাতিক আমারও রয়েছে। হয়তো আমরা দুজনেই শ্রোতাদের সঙ্গে মিলে গানটা গাইতে চাই, তাই।

গানের কথা তাঁর গানে কিভাবে মূর্ত হয়ে উঠত সে নিয়ে নতুন করে খুব কিছু বলার নেই। রসিক শ্রোতা-মাত্রেই সে বিষয়ে অবগত আছেন। তবে যেটা না বললেই নয় তা হল-– গানের ভিতরের কবিতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দেবব্রতকে কখনও গিমিকের আশ্রয় নিতে হয়নি, যা কি না পরবর্তীতে অনেক জনপ্রিয় ‘ওই ঘরানার’ গায়কের গানে শুনতে পেয়েছি। বরং, ওঁর হাঁপানি-জনিত শ্বাসকষ্টকে উনি নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন বিরতি বা ‘পজ’-এর ফর্মে, যার ফলে ওঁর গানে এক অভূতপূর্ব নাট্যকৃতীর জন্ম হয়েছিল। তবে সেটা নাট্যকৃতীই, সস্তা নাটুকেপনা নয়।

১৯৬৪-তে বিশ্বভারতী ওঁর গান রেকর্ডিং বন্ধ করে দিলে বেশ একটা আলোড়ন হয়েছিল, মনে আছে। আমি বিশ্বভারতীর ব্যানিং-এর সমর্থক নই এ কথা বলাই বাহুল্য। তবু আমি এ কথাও বলব, যে ওঁর রেকর্ড করা রবীন্দ্রনাথের কিছু গানে যন্ত্রানুসঙ্গ আমার অত্যধিক এবং মাত্রাছাড়াই মনে হয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে আমার তেমন ছুঁৎমার্গ নেই, তাও বলতে হয়-– ওই গানগুলোতে তার ব্যবহার আমার মনে ধরেনি একেবারেই। আমার মনে হয়েছে, ওইরকম কণ্ঠৈশ্বর্য নিয়ে অত বাজনার ব্যবহার করার কোনও দরকারই ছিল না। তবু, একজন সৃজনশীল মানুষ কোন পথে নিজের সৃজনশীলতাকে বাহিত করবেন সে ভাবনা সম্পূর্ণতই তাঁর।

তবে নতুনতর সৃজনের জন্য কখনও আঘাতের দরকার হয়। ভায়োলিনে ছড়ের আঘাত না হলে সুর বেরোয় না। এই আঘাতের ফলেই আমরা পেলাম ময়মনসিংহের গানের সুরে রচিত গানগুলো।

আজকাল রবীন্দ্রনাথের গানকে ‘নতুনত্ব’ ও ‘আধুনিকত্ব’ দেবার হিড়িক পড়েছে। অনেকেই ভাবছেন, রবীন্দ্রনাথ গান তেমন জানতেন না। ফলে তাঁরা তাঁর গানকে আরেকটু ঋদ্ধ না করলে বেচারীর গানগুলো সব মাঠে মারা যাবে। এ হেন আধুনিকতার ঋতুতে বরং বারবার দেবব্রত বিশ্বাসের হাসতে-হাসতে গাওয়া ‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না’ মনে পড়ে যায়।

(রচনাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে রচিত, এবং শ্রী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সম্মতিক্রমে প্রকাশিত)