Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পারালি: ভ্যান গুজ্জরদের আশা ও নিরাশার হাতিয়ার

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

ভ্যান গুজ্জর কমিউনিটি। উত্তর ভারতের এই যাযাবর কমিউনিটি বরাবরই পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত। রাজ্যের সীমানার মধ্যে বা প্রায়শই বাইরের রাজ্যেও পশুদের নিয়ে এদের যাতায়াত। অধিকাংশ সময়েই লক্ষ্য পশুদের খাবার জোগান। শীতে শিবালিক পাহাড়ের অরণ্যে অথবা গ্রীষ্মে হিমালয়ের উঁচু আলপাইন পরিবেশ। এটাই এতদিন পর্যন্ত ছিল। সমস্যা শুরু হয়েছে বছর দশেক আগে থেকে। পরিবেশের স্বার্থে রাজ্য সরকার থেকে নিজের নিজের রাজ্যের অরণ্য অঞ্চলগুলি বেশিরভাগই অভয়ারণ্য বা ন্যাশনাল পার্ক করে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্যই যুক্তি আছে এই কাজের পেছনে। কিন্তু ভ্যান গুজ্জররা? তাঁদের পশুরা? অরণ্যে অবাধ প্রবেশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পেটে টান পড়ছে পশুদের। এবং, কালক্রমে এই মানুষগুলোরও।

সমস্যার শুরু এখান থেকেই। আর উত্তরণের পথও এখানেই। উত্তর ভারতে শীতের ঠিক শুরুতেই অবশিষ্ট খড় পোড়ানো বা স্টাবল বার্নিং নতুন কিছু নয়। তবে গত দু তিন বছর ধরে যা অ্যালার্মিং হারে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্মগ তৈরির প্রবণতা। ভাঁজ পড়ছে সাধারণ মানুষের চোখে। দিল্লির মতো শহরের অধিবাসীরা নভেম্বর থেকে আতঙ্কে দিন গুনছেন। শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকার থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে স্টাবল বার্নিংয়ে। আদালত থেকে শাসানো হচ্ছে সরকারি আমলাদের। নিয়মিত খোঁজ রাখা হচ্ছে সরকারি উদ্যোগের উপর। আর তখন চাপ আসছে কৃষকদের উপর। স্টাবল বার্নিং তাঁদেরও তো বাধ্যতা।

এখানেই লিঙ্কিং ফ্যাক্টর ভ্যান গুজ্জররা। পশুদের খাবার হিসেবে তাঁরা চেয়ে নিচ্ছে সেসব খড়। বদলে গোবর দেওয়া হচ্ছে তাঁদের তরফ থেকে। বাঁচছে পরিবেশ। বাতাস। এই স্টাবল বা অবশিষ্ট খড় ওদের ভাষায় পরিচিত ‘পারালি’ নামে। ২০০৬-২০০৭ থেকে অরণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন জোরদার করা হলে তখন থেকেই এই পারালির ব্যবহার শুরু করে গুজ্জররা। উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশ, লালধাং, দইওলা ইত্যাদি অঞ্চলের ছোট চাষিদের থেকে এইসব স্টাবল বা পারালি নিয়ে নিতে শুরু করেন তাঁরা। আর তাছাড়া এই ধরনের খড় গবাদি পশুদের খুব কম পরিমাণে খেলেও চলে। ফলে খুব বেশি পরিমাণে যোগানেরও প্রয়োজন নেই। প্রথমদিকে খড়ের বদলে গোবর দিয়ে একধরনের বোঝাপড়া চললেও পড়ে ক্রমশ সরকার থেকে গুজ্জরদের অঞ্চল থেকে ম্যানিওর অর্থাৎ গোবর কেনায় বাধানিষেধ চালু হয়ে যায়। আর তখনই অর্থের প্রয়োজনীয়তা চলে আসে। কৃষকদের থেকে গুজ্জররা অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতে শুরু করছেন সেইসব পারালি।

শুরুর দিকে সমস্যাটা এতটা ছিল না। ২০১০ সালের কাছাকাছি হরিদ্বারের কাছাকাছি খানপুর, লাক্সার, ভগবানপুর, দানারপুর, উধোম সিং নগর ইত্যাদি গ্রামে গুজ্জররা কৃষকদের কাছে গেলে খুব সহজেই তাঁরা স্টাবল দিয়ে রাজি হয়ে যান। পরে, এর চাহিদা বেড়ে গেলে তখন অর্থের দিকটি এসে পড়ে। উত্তর প্রদেশের পশ্চিম অঞ্চল এবং গোটা উত্তরাখণ্ডেই বর্তমানে পারালির দাম বিঘা প্রতি এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা।

গোটা ঘটনাটাই একধরনের সিমবায়োসিস, যা একাধারে পরিবেশবান্ধব এবং আর্থিক স্বাবলম্বনের সাক্ষ্য বহন করছে। চাষিরা ধানের দামে এদিক ওদিক হলে পারালি বিক্রি করে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারছেন। অন্যদিকে অরণ্য সংরক্ষণের আওতায় পড়ে পশুদের খাবার যোগান কমে আসার ফলে পারিবারিক পেশা চলে যেতে বসা গুজ্জরদের কাছে পারালি কিনে নেওয়াটা অনেকটা আশার আলো দেখিয়েছে। কৃষি ও পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত দুই ধরনের মানুষই হাতে হাত মেলাচ্ছেন। ভালো থাকছে পরিবেশ। বাতাস …

অবশ্য অন্ধকারের দিকটিও আছে। আছে ভালো খবরের পরেও মাটির ছায়া পড়া দিকটা। বাধ্যতার ফলে কৃষকেরা বর্তমানে মাঝেমাঝেই পারালির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শীতে হিসেব করে দেখা গেছে, পাঁচ মাসে দেড় লক্ষ টাকা পারালি কেনার খাতে ব্যয় করতে হচ্ছে গুজ্জরদের। একশ দেড়শ কিলোমিটার দূরের গ্রামে গ্রামে গিয়ে পারালি কেনার খরচা এভাবে বেড়ে যাওয়ায় কোথাও কোথাও পোষাতে পারছেন না গুজ্জররা। আর এখানেই সরকারের দায়। এখানেই ইনসেন্টিভ দেওয়ার সুযোগ থাকছে। ভরতুকি এই অতিরিক্ত দামটা পুষিয়ে দিতে পারে। তাতে আখেরে লাভ মানুষের। পাশপাশি পরিবেশেরও।