জয়দীপ রাউতের কবিতা
১৮ মে, ২০০৯
তুমি তো জানোই মা,
তোমাদের এই ঘরে এসে পড়া ছাড়া
আসলে আমার কোনও উপায়ই ছিল না
আমি তো তখন ছোট, আর দৃষ্টি আলো-আঁধারির
আমাকে দেখাল পথ আমার বড়দা শ্রী-কৃষ্ণ মুরারি
সে পথ চক্রাকার, মহাশূন্যতার
দ্যাখো মা তোমার পেটে, এখনও স্পষ্ট দাগ
রথের চাকার…
অচিন
মাঝে মাঝে পুরনো সম্পর্কগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার মাঝখানে পিঁড়ি পেতে বসি। এই পিড়িতেই আমার ঠাকুমা শ্রীলক্ষ্মী বসাতেন। ভাবি, এ জন্মের যিনি মা, যে আমার মেয়ে, পরের জন্মে হয়তো সে উঠোনের কোনটাতে পঞ্চমুখী জবা অথবা বাগানে কাঠবেড়ালিটি হয়ে দৌড়ে পালাবে তখন আমি চিনতে পারব কি? এজন্মেও তো কত ফুল কত পোকা কত মানুষের মুখোমুখি— চিনতে পারিনি৷ যে আমায় হঠাৎ মারল তাকে বলতে পারিনি তুমি বিগত জন্মের তীরে গেঁথে যাওয়া হরিণের নরম মাংস ছিলে। আমিই তোমাকে মেরেছি। এই ঠাকুরের পিঁড়ি, যার পিঠে বসে এসব ভাবছি, সেই পরজন্মের প্রজাপতি, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ কি?
অপরূপকথাখানি
এই অপরূপকথাখানি, আমি জানি
কাউকে তো দিয়ে যেতে হবে। আমি তাই পথে পথে ঘুরি,
প্রতিটি মুখের দিকে তাকাই নীরবে।
দিয়ে যেতে হবে! দিয়ে যেতে হবে। হয়
যেভাবে অঙ্গুরী
খুলে নেওয়া নয় মৃতদেহ আগুনে দেবার আগে,
সেভাবে যাওয়ার আগে দিয়ে যেতে হবে
কে তুমি, কে তুমি? তোমার আঙুলগুলি উপযুক্ত তবে?
তুমি পুণ্যবান? তুমি পাপ?
কথা দিয়ে তুমি বুঝি কথার খেলাপ? নাকি তুমি একই সঙ্গে
তীব্র বাচাল আর বাক্যহারা কবি?
পথে পথে ঘুরি আর খুঁজি
প্রতিটি মুখের মধ্যে এক আত্মপ্রতিচ্ছবি…
জল
শান্ত হও শান্ত হও শান্ত হও, মন
মুখোমুখি তুমি আর তোমার নির্জন
আর দূরে স্টিমারের আলো
যা আজ হারাল
তা কি কোনওদিন ছিল তোমার নিজের?
যে জল পেরিয়ে যাত্রা দূর স্টিমারের
তার ঢেউ এখনও উতল
শান্ত হও শান্ত হও শান্ত হও জল
কাশীমিত্রঘাট
শ্মশান ঘাটের পাশে ইতস্তত চায়ের দোকান
তারই একটিতে মাঝে মাঝে এসে বসি।
সুশান্ত আসে আর আসে সেই তন্বী মেয়েটি
যার গায়ে তামার পাতের মতো সন্ধ্যা রং। বামপাশে,
দেখি এক নতুন ভদ্রলোক আগে তাকে কখনও দেখিনি।
একটু উদ্ভ্রান্ত একটু উসকোখুসকো যেন কতদিন তার প্রাপ্য
শুশ্রূষা যেভাবে জোটেনি। চুল তার সিগারেট থেকে ছাড়া
ধোঁয়ার মতন। সমারোহ করে আরও দুএকটি ডেডবডি আসে।
আসে, ভাড়া করা কীর্তনীয়ার দল।
চল। আজ তবে উঠি। বলতেই আমার বামের সেই
অচেনা ভদ্রলোকটি ইশারায় কাছে ডাকে। বলে, বড্ড ভয় করে, ভয়।
একটু দেখুন ভাই ভিতরে পুড়ছি আমি, আমাকে
পোড়াতে আর কতক্ষণ বাকি?
পাঁজর
কাছেই গিয়েছি
অস্ত্রের যতটা কাছে গেলে হাত কেটে যায়…
ভাবি, এত কাছে আসা তাহলে সম্ভব?
সে হঠাৎ
অমোঘ আঁচল খুলে আমাকে দেখায়
তার বুকে শুয়ে থাকা সার সার
পুরুষের শব।
প্রেমপদ্য
কেন মুখে কখনও বলোনি, ভালোবাসো।
আমি অত বুঝদার নই, বিকেলে ছেলের দলে যেমত হৈ চৈ
সেভাবে জীবন কাটাতে চেয়েছি। অথচ আশ্চর্য এক
সন্ধ্যা নেমে এল। বরষার মেঘ নেমে এল পৃথিবীর আরও
কাছাকাছি। আমিও চেয়েছি, আমার আজন্ম এই
আসন্ন জলের কাছে দিয়ে যেতে৷ কারা যেন বারান্দার কোণে
খোলা আকাশের নিচে একটা বালতি রেখে গেল।
যদি ভালোবাসো, এই ধাতব পাত্র পড়ে
পুনরায় ছিটকে ওঠার মতো দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূন্য হব
বৈকালিক ছেলেদের দলে মিশে, আনত সন্ধ্যার দিকে
গড়ানো বলের মতো হব বাকি দিন…
রাগিনী
তুমি যত ব্যথা দাও, বীতশোক এই আমি তত হেসে উঠি।
তুমি যত ঘৃণা করে দু পায়ে ঠেলেছ মন, তোমার ভ্রূকুটি
আমি তার পায়ে রেখে শত,
সহস্র পদ্মের সাথে ফুটি
দূরের মন্দিরে।
যেদিকে তাকাই; দেখি, তোমার যাবার পথ শেষ হয় আমার ভিতরে
আমার ভিতরে কালো মহিষের মতো ঘোর অন্ধকার আলো হয়ে
উঠেছে প্রকাশী।
তুমি যত ব্যথা পাও, কাঁদো; তবু মন, কেন যে বোঝ না,
এই শোক, শোকাহত প্রেমের
দ্যোতনা—
তার ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা বাঁশি…
শাক্তপদাবলি
এসো আজ সেই আনন্দের কথা আর আমার মেয়ের শিশু পায়ের পাতার
ছাপ লেগে ফুটে ওঠা আলপনার কথা বলি। এই যে সামান্য ঘর
ঘরের বাইরে এই বিরাট শহর আর তার এই অত্যাশ্চর্য সব গলি—
সর্বত্র নৃত্যরত সে৷ তার সহস্র পায়ের অজস্র আঙুলগুলি বেলফুল
জুঁইফুল টগরের কুঁড়ি দিয়ে গাঁথা খণ্ড খণ্ড মালার শিল্পের মতো ঝরে…
দুঃখ দুরাশার কথা প্রায় প্রতিটি ঘরেই। তার চে আজ সেই
আনন্দের কথা বলি, যেই অপূর্ব আনন্দে রামপ্রসাদ সেন লিখে চলেছেন,
শাক্তপদাবলি…
উল্কা
আকাশের অন্ধকারে চাঁদ ডুবে যায়
তুমি প্রদীপ ধরেছ তুলে যত দেবতায়
তত অস্ত্র জ্বলে ওঠে তারায় তারায়
তত যুদ্ধ দেবতা, দানবে
এই যুদ্ধ শেষ হবে কবে!
তোমাকে পাবার অছিলায়
কালপুরুষের
ধনুকের অদৃশ্য ছিলায়
বারবার টান পড়ে
বারবার উল্কা খসে যায়
জয়দীপ রাউতের কবিতা: ‘অপরূপকথাখানি’
মণিশংকর বিশ্বাস
যেহেতু আমিও একটু-আধটু কবিতা লিখি, তাই যখন কোনও কবিতার মুখোমুখি হই, যে প্রশ্নটি প্রায়শই আমাকে আলোড়িত বা কিঞ্চিৎ উত্তেজিতও করে, তা হল, কবিতাটি আমি কোন প্রান্ত থেকে পড়ব— পাঠক না কবি-র? আমার ধারণা কবিতা আজও খুব বেশি পাঠক পড়েন না। কতজন কবিতা পড়েন? যত সংখ্যক কবি কবিতা লেখেন তার চেয়ে সামান্যই কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ নিয়মিত কবিতা পড়েন। অর্থাৎ কবিতার মনোযোগী পাঠক মাত্রেই কবিতা লেখেন, এরকমটা না হলেও অধিকাংশ পাঠক অবশ্যই নিজেরাও কবিতা লিখে থাকেন। এই যে এতজন কবি কবিতা লেখেন, স্বভাবতই বহু কবিতা, কাব্যগ্রন্থ অপঠিত থেকে যায়, পাঠক-সমাজের অগোচরে থেকে যায় অধিকাংশ কবিতা। কিছুদিন আগে আমি একটা পত্রিকা দেখেছিলাম, যার ‘আত্মপ্রকাশ’ সংখ্যায় একশো জন কবির কবিতা ছাপা হয়েছিল। একশো কবি! এখন এই পত্রিকায় যাদের কবিতা ছাপা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই যদি এই পত্রিকায় ছাপা-হওয়া প্রতিটি কবিতা পড়েন, তাহলেই এক একটি কবিতার ভাগ্যে ১০০ জন পাঠক জুটে যাবার কথা। পত্রিকার অন্য পাঠকদের কথা ছেড়েই দিলাম। আমার ধারণা, একটি কবিতা যদি ১০০ জন পাঠকও পড়েন, তবুও বলতে হয় কবিতাটির পাঠক-ভাগ্য ভালোই। কিন্তু কমবেশি আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি, একটি পত্রিকায় যাদের কবিতা ছাপা হয়, এমনকি তাঁরাও, ওই পত্রিকার ওই সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিটি কবিতা পড়েন না। (বস্তুত ১০০টি কবিতা পড়া মানে দুটি প্রমাণ-সাইজের কাব্যগ্রন্থ পড়া।)
কিন্তু কেন? প্রায় ২৫ বছর কবিতা-প্রচেষ্টার পর আজ যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, একজন কবির ‘বুলস আই’ কী? আমার স্পষ্ট উত্তর হবে, যা অনেকেরই পছন্দ হবে না, পাঠককে দিয়ে কবিতা পড়িয়ে নেওয়া। যদি কেউ মনে করেন আমি পপুলারিস্টিক কবিতার জয়গান করছি বা বলতে চাইছি জনপ্রিয় কবিতা মাত্রেই ভালো কবিতা, তা একদমই ঠিক নয়। কিন্তু তুমুল বিদ্যা-বুদ্ধির কবিতা থেকে অনেক জলের মতো গদ্য-কবিতা, খুব সরল বাক্যবিন্যাসে লেখা কবিতা, এমন-কি নিখুঁত ছন্দ ও অন্ত্যমিল দিয়ে লেখা কবিতাও আমি লক্ষ করে দেখেছি, দু-একটি পড়বার পর বিকর্ষণ করতে শুরু করেছে। অনেক ‘ভালো’ বা মেধাবী কবিতা শুধু নয়, দুরন্ত ছন্দে লেখা কবিতাও আমাকে অনেক সময়ই ক্লান্ত করে। অবশ্য আমি নিজেও পাঠক-হিসেবে নিজেকে খুব একটা নাম্বার দিই না। কিন্তু যদি নিজেকে টেনেটুনে পাশ-মার্কও দিই, সেই পাশ-মার্ক পাবার যোগ্যতা থেকেই বুঝি, কবিতার মেরিট ছাড়াও কবিতার “অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে” অন্য এক কবিতা-কুশলতা, যা কোনও কবিতাকে বা কোনও কবিকে পড়িয়ে নেয়, আর যার অভাব কোনও কবিতাকে বা কবিকে দূরে ঠেলে দেয়। জয়দীপ রাউতের কবিতা প্রসঙ্গে বলতে চেয়ে, কিছুটা অনাবশ্যক দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা হয়ে গেল কি? বস্তুত সোশ্যাল-মিডিয়া শাসিত বাংলা-কবিতার, সংখ্যার প্রাচুর্যের যুগে এসে, যখন কবিতা-পাঠকের পাঠ-অভিজ্ঞতার কৌমার্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, কবি জয়দীপ রাউতের কবিতা আমাকে মোমের আলোর মতো এক স্নিগ্ধতা ও শুশ্রূষার দিকে নিয়ে যায়। হ্যাঁ, জয়দীপের কবিতা ছেড়ে আসা যায় না। এই কবিতাগুলি সতত যেন আশ্রয় চাইছে পাঠকের বুকে, হৃদয়ে। আর এই নিরাভরণ কোমলতাই, জয়দীপের কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি। ফলে জয়দীপের কবিতা, কবি ও পাঠক দুদিক থেকেই বারম্বার পাঠ করতে হয়।
মাধবীলতার নাম আমি আজ
মাধবীবিহ্বলতা রাখি
মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা ডালডালে বসা বাতাসের পাখি
(মাধবী)
আজ এতদিন পর, আরও একটা কথা আমার মনে হয়, শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির সামনে আমরা যখন দাঁড়াই, তখন আমরা নগ্ন হয়ে দাঁড়াই। এই নগ্নতা প্রাপ্তবয়স্কের নগ্নতা নয়, এই নগ্নতা শিশুর। অর্থাৎ আমাদের যে বোঝাবুঝি জগত, বিশেষত কবিতার সঙ্গে এবং অদ্যাবধি যে সব কবিতা পড়েছি, সেই পাঠলব্ধ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ইত্যাদি একপাশে সরিয়ে রেখে, নির্জ্ঞান শিশুর মতো যে কবিতার মুখোমুখি আমরা দাঁড়াই বা বসি, প্রশ্ন করি না কোনও, বরং আমাদের আন্তরিক কোলাহলগুলি ক্রমে স্তব্ধ হতে থাকে, সেই কবিতাই আমার মতে শ্রেষ্ঠ কবিতা।
তুমি অপরূপ আলপনা
উঠোন পেরিয়ে আর
কোথাও যাব না
বস্তুত জয়দীপের কবিতাভূবন এক কাকচক্ষু সরোবর। সেখানে কবিতা-পাঠকের মন শান্ত ও সুনিবিড় হয়ে আসে।
অতিধীর চাঁদ ভেসে চলে
যেন দেবী তাঁর
কর্ণলতিকার
ফুল ফেলে গিয়েছেন জলে(দশমী)
জয়দীপের কবিতার আর একটা বিশেষ চরিত্র-লক্ষণ হল, মনে হয় জয়দীপ একটিই কবিতা লিখে চলেছেন। এই দীর্ঘসূত্রিতা পাঠকের মন দীর্ঘ-আবিষ্ট করে রাখে।
এবার এসেছি ছেড়ে সমারোহ;
পেয়ে যে হারায় সব, তাকেই প্রত্যহ
দুটো হাত পেতে দিতে হয়।(কবি)
এই কবিতা জয়দীপের প্রথম কাব্যগ্রন্থ না শেষ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া, বলে না দিলে বোঝবার কোনো উপায় নেই। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমার নিজেরও তা মনে পড়ছে না। অর্থাৎ জয়দীপ ওঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই একটি সবিশেষ ভাষা আয়ত্ত করেছেন, যা শুধু ঈর্ষণীয় নয়, একান্তই ওঁর নিজস্ব।
একটু দেখুন ভাই, ভিতরে পুড়ছি আমি, আমাকে
পোড়াতে আর কতক্ষণ বাকি?(কাশীমিত্রঘাট)
পাঠককে এই অসহায় পুড়ে-যাওয়াটুকু দিয়ে সম্পূর্ণ জারিত করে ফেলেন জয়দীপ। অধ্যাপক তপোব্রত ঘোষ একটা লেখায় বলেছিলেন, “জয়দীপ সম্বন্ধে কিছুই জানিনে, অথচ কবিতাগুলি পড়ে ওর জন্য মায়া হয়।” আবার আমরা অনেকেই জানি গদ্যকার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ওঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “গল্পলেখকের দায়বদ্ধতা হল গল্পের ক্ষতস্থানটি ব্যান্ডেজ খুলে পাঠককে দেখানো। একই দায়বদ্ধতা কবির। চিত্রশিল্পীর।” (সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি, ১১ মার্চ ২০০০)
কবি হিসেবে জয়দীপ এই কাজটিই অত্যন্ত সুচারু ভাবে করেন। কবিকে তাই আমরা মনে মনে ভালোবেসে ফেলি এবং তাঁর জন্য ‘মায়া হয়’। মনে রাখতে হবে, কাউকে ভালোবাসলে তবেই তাঁর জন্য মায়া হয়। অর্থাৎ ‘মায়া হয়’— আক্ষরিক ও রূপক, দুই অর্থেই। কবির কবি-জন্ম ও জন্মান্তর গেঁথে যায় একই তীরে।
যে আমায় মারল তাকে বলতে পারিনি তুমি বিগত জন্মের তীরে গেঁথে যাওয়া হরিণের নরম মাংস ছিলে। আমিই তোমাকে মেরেছি।
(অচিন)
২.
জয়দীপ তাঁর দ্বিতীয় বই গুঞ্জাগাথার বিভাবে লেখেন:
তুমি চাবুক চালালে
ঘোড়ার খুরের নিচে ধুলোর ঘূর্ণির মতো
জীবন কাটল…
মহাজীবনের অসহায়তার এমন শিল্পিত অথচ সংক্ষিপ্ত রূপ, বাংলা কবিতায় আমি অন্তত দেখিনি বললেই চলে। এই তিনটি লাইন পড়লে আরেকটা কথা স্পষ্ট বোঝা যায়, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ব্যক্তিজীবনের যন্ত্রণাগুলি নিয়ে কবি তেমন কোনও অনুযোগ জানান না। বরং জয়দীপের কবিতার পরতে পরতে আধ্যাত্মিকতার যে ঐশ্বর্য, তা যদি আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, তবে কিছুতেই পাঠক হিসেবে আমরা জয়দীপের কবিতা-বিশ্বে প্রবেশাধিকার পাব না।
…দুঃখ দুরাশার কথা প্রায় প্রতিটি ঘরেই। তার চে’ আজ সেই
আনন্দের কথা বলি, যেই অপূর্ব আনন্দে শ্রীরামপ্রসাদ সেন লিখে চলেছেন,
শাক্তপদাবলি…(শাক্তপদাবলি)
আমরা তো দেখেছি কত কত কবি, শুধুমাত্র দারিদ্র নিয়ে কবিতা করে কী বিপুল হাততালি ও বাহবা পেয়েছেন বা পেয়ে চলেছেন, লিটল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাংলাবাজারের সবচেয়ে মহিমান্বিত ও প্রতাপশালী পত্রিকা-গোষ্ঠীর জনপ্রিয় পত্রিকার পাঠক সমাজের কাছ থেকে! কিন্তু কবির স্বাভাবিক আধ্যাত্মিকতা জয়দীপকে এই জনপ্রিয়-ফাঁদে পা দিতে দেয় না, অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক ও অনুত্তেজিত ভঙ্গিতে জয়দীপ লেখেন,
যে তার সিংহ দরজার
সকল কেশর খুলে দিলআমি তার
রাতের খাবার(তার)
যে কোনও শক্তিশালী কবির মতোই জয়দীপ, চির-চেনাকে সামান্য মোচড়ে অচেনা করে ফেলতে পারেন, তার মুহুর্মুহু উদাহরণ আছে জয়দীপের কবিতায়।
আমি তো তখন ছোট, আর দৃষ্টি আলো-আঁধারির
আমাকে দেখালো পথ আমার বড়দা শ্রী-কৃষ্ণ মুরারীসে পথ চক্রাকার, মহাশূন্যতার
দ্যাখো মা তোমার পেটে, এখনো স্পষ্ট দাগরথের চাকার…
(১৮মে, ২০০৯)
উপসংহারের দিকে যেতে যেতে আর একটা কথা বলি, হয়তো একটু অপ্রাসঙ্গিক শোনাবে। যে কোনও কবিতা-আলোচনা, আলোচকের কবিতা ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়। শেষ করব এরকমই একটা প্রসঙ্গ দিয়ে। আমার মতে, কোনও শ্রেষ্ঠ কবিই অস্পষ্ট নন। শ্রেষ্ঠ কবিরা হতে পারেন রহস্যময়, দুর্বোধ্য, কিন্তু অস্পষ্ট নন। দুর্বোধ্য কবি বলে যদি কাউকে আমরা চিহ্নিতও করি, তবে আমার কাছে তিনি এমন একজন কবি, যার কবিতা কিছুদূর যাবার পর কুয়াশা কাটিয়ে ডানা মেলে। অর্থাৎ কিছু দূর গিয়ে তারপর বোধ্য। কিন্তু এরকম হতে পারে না যে, একজন শ্রেষ্ঠ কবির রচনা এমনই, যে দীক্ষিত পাঠকের সঙ্গেও তা দুর্লঙ্ঘ্য এক দূরত্ব রচনা করে এবং ওই দূরত্বের ফলেই ক্রমে পাঠকের সঙ্গে বোঝাপড়া সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। না, এমন কোনও উদাহরণ আমি অন্তত জানি না। কবি জয়দীপ রাউত স্বভাবতই রহস্যময় এক কবি। অনেকসময়ই তার কবিতা এক অতিলৌকিক বা অতীন্দ্রিয় জগতের কথা বলে। কিন্তু জয়দীপ রাউত একজন শ্রেষ্ঠ কবি এবং তার কবিতা অস্পষ্টতার দোষে দুষ্ট নয়। জয়দীপের কবিতাভুবন, আবহমান বাংলাকবিতার স্পষ্ট জয় সূচিত করে।