ভাস্কর ঠাকুরিয়া
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ: বাসুদেব দাস
১৯৭৬ সনে অসমের গুয়াহাটি শহরে ভাস্কর ঠাকুরিয়ার জন্ম হয়। পেশায় চিকিৎসক শ্রী ঠাকুরিয়া বর্তমানে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স, পাটনার মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক। ‘যাত্রা’ লেখকের অন্যতম গল্প সঙ্কলন। ‘সিংহদ্বার’ উপন্যাসের জন্য শ্রী ঠাকুরিয়া মুনীন বরকটকী পুরস্কার লাভ করেন। অসমের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখকের গল্প প্রকাশিত হয়ে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
টিক টক…
অ্যান্টিক ঘড়িটার পেন্ডুলামের পূর্বনির্ধারিত আরোহন-অবরোহন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকতেই হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের কথা মনে পড়ল। আজ ২৫ বছর হল, মানুষটা গেল যে গেলই, কোনও খবর নেই। শহরে ১৪৪ ধারা চলছে। আজকাল ১৪৪ ধারায় ততটা ভয় হয় না যদিও এবারের সংঘর্ষের সঙ্গে আমাদের খবরের কাগজটি সোজাসুজি জড়িত হয়ে পড়ার জন্য সারাটা দিন বেশ চাপের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। বাড়ি এসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পেন্ডুলামের গতিতে সম্মোহিত হওয়ার সময় স্যারের কথাগুলি মনে পড়ল: পেন্ডুলামের গতির মতোই ইতিহাসেরও একটি প্যাটার্ন আছে। ভালোভাবে অনুধাবন করলে ভবিষ্যতের কোন সময়ে কী ঘটতে পারে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায়।’
এটা স্যার হারিয়ে যাবার কয়েক মাস আগের কথা। কথাটা আমি মেনে নিইনি। ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে সাহিত্য-আলোচনা ধরনের একটি সভায় স্যার বিশিষ্ট বক্তা হয়ে এসেছিলেন। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আমার মতে ইতিহাস একটি কলা বিভাগ। কথাটা বইয়ের ভাষণ বলে মনে হল যদিও তর্ক করার অভিপ্রায় আমার ছিল না। তখনকার কলেজের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না, মাইক হাতে নিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতা বা ইচ্ছাও ছিল না। তাই সভা-সমিতিতে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না। সভায় গিয়েছিলাম সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে। মানে সক্রিয় সাহিত্য সংগঠক কয়েকজন বন্ধু বহু কষ্ট করে অনুষ্ঠানটি শুরু করেছিল। রবিবারের সকালে অনুষ্ঠানটির তারিখ পড়ায় দর্শকদের উপস্থিতি খুব বেশি হবে না বলে ভেবে বন্ধুরা আমাকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য জোর করেছিল। আমি পেছনে বসে ছিলাম। আমার কাজ ছিল মিটিং দেখা এবং শেষ হলে চা-নিমকি খেয়ে হোস্টেলে ফিরে আসা। হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের ভাষণ শেষ হওয়ার পরে দর্শকদের কিছু জিজ্ঞেস করার আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হয়। উপস্থিত দর্শকদের প্রশ্নের কথা জিজ্ঞেস করতেই ভয় পেয়েছে বলে মনে হল। হয়তো অন্যেরাও আমার মতো চা-নিমকির আশায় ঝিমোচ্ছিল। আয়োজকদের লজ্জায় মুখ লুকোনোর অবস্থা হওয়ায় নীরবতা ভঙ্গ করার জন্য নাকি আমি হাত তুলে ধরলাম। একজন উদ্যোক্তা মাইকটা আমার ঠোঁটের সামনে ধরল।
–তার মানে ইতিহাস আর জ্যোতিষবিদ্যা একই জিনিস। জীবনের প্রথম জনসভায় সম্বোধনের প্রশ্ন ছিল এটি। যখন আমার কণ্ঠস্বর মাইক থেকে প্রক্ষেপিত হয়ে আমার নিজের কানে বাজল এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এটা আমারই কণ্ঠস্বর কি?
ইতিহাস জ্যোতিষবিদ্যা নয়, কিন্তু এর একটি চক্রাকার গতি আছে (Cyclic pattern) আছে একটা প্রাকৃতিক স্বভাবগত কালচক্র।
আমার প্রশ্নটি স্যারকে হয় অপ্রস্তুত না হলে বিরক্ত করেছে বলে মনে হল। কৈফিয়ৎ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন: ‘বদন বরফুকন মানের দেশে গিয়ে যে মানসেনাদের ডেকে আনলেন তার পরই অসমের ধ্বংস যাত্রা শুরু হল। এবং তার ঠিক ২০০ বছর পরে সেভাবেই যুবক ছেলেরা মানের দেশে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে একই ধ্বংস যাত্রা আরম্ভ করেছে, তখন মিঙ্গিমহাই গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন আর এখন অপারেশন বজরঙের আর্মিরা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে, এটা কি ইতিহাসের কালচক্র নয়?’
আমার মেনে নিতে দ্বিধা হল, আমার মতে যে কথা হয়ে গেছে তা শেষ হল। তারপরে আগ্রহীরা তাকে রূপকথার মতো পড়তে পারে। আগ্রহ না থাকলে নেই। কোন সনে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়েছে, হিটলার কত নিযুত ইহুদি হত্যা করেছে তা নিয়ে রোমন্থন করতে থাকলে সমাজের কোনও লাভ হয় না। সেরকমই কিছু একটা প্রত্যুত্তর দিয়েছিলাম। উপস্থিত দুই এক জন সভায় মত প্রকাশ করলেন।এককথায় আলোচনাচক্র বেশ জমে উঠল। যাই হোক না কেন অন্তত বিরক্তিকর একটি সভায় কিছু রসের জোগান হল বলে উদ্যোক্তারা সুখী হয়েছেন বলেই মনে হল। যদিও দুই একজন জন স্যার খারাপ পাবেন বলে ভয় পেয়েছিলেন। এমনিতেই দেশের অবস্থা তখন খুব একটা সুস্থির ছিল না, ৯০ সালের কথা, অপারেশন বজরং পুরো মাত্রায় চলছিল। দেশের অবস্থায় আলোচনাচক্রগুলিতে কথাকাটাকাটি বেশি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ধন্যবাদজ্ঞাপনের মাধ্যমে সভা ভঙ্গ হল এবং আমি পূর্ব পরিকল্পনানুসারে আমার ভাবনা অনুসারে চা বিস্কুট খেয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম…
হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা… তারই কয়েকদিন পরে তিনি হারিয়ে গেলেন। একদিন প্রাতঃভ্রমণের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তারপরে আর ফিরে এলেন না। অপহরণ গুপ্তহত্যার সম্ভাবনাও পুলিশ বা পরিবারের লোক নাকচ করলেন। আত্মহত্যা হতে পারে না তবুও শহরের খাল-বিল নদীর ঘাট সমস্ত তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন সূত্র পাওয়া গেল না। কলেজে কয়েকদিন এই নিয়ে আলোড়ন চলছিল যদিও কিছুদিন যাবার পরে মানুষ ভুলতে শুরু করল।
আমিও ভুলে যাচ্ছিলাম যদিও মানুষটির অন্তর্ধানের জন্য ভেতরে ভেতরে আমি নিজেকে দোষী বলে অনুভব করতে লাগলাম। হেমাঙ্গ দত্ত স্যার একজন সফল, জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন এবং সাধারণত যুক্তিপূর্ণ কথাই বলতেন। অহেতুক বিতর্কে অংশ না নিলেও যখন প্রয়োজন হত তখন উদাত্ত কণ্ঠে আওয়াজ দিতেন। অবশ্য সরকারি সভার সঙ্গে অভ্যস্থ মানুষটি এ রকম একটি ছোট ঘটনা নিয়ে বিব্রত হওয়ার কোনও দরকার নেই যদিও আমার কথায় তিনি আঘাত পেয়েছেন বলে মনে হয়েছিল। তাকে সামাজিকভাবে উপহাস করার আমার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না যদিও সেদিন সে রকম একটি ঘটনাই ঘটে গেল। কথাটা ভুলতে চাইলেও দেখছি মাঝে মাঝে মনের মধ্যে ভাবনাটা জেগে উঠে। হঠাৎ কোথা থেকে আসা একটা পাথরের টুকরো জানালার কাঁচগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আমার ঘরে ঢুকে গেল। কী হয়েছে বুঝতে পারার আগেই পুনরায় ছিটকে আসা পাথরের একটি টুকরো এন্টিক ঘড়িটার ডায়ালটা ভেঙ্গে পেন্ডুলামের অহরহ গতি স্তব্ধ করে ফেলল।
(২)
থানায় একটি পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে ভালো লাগল। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম যদিও তিন তারা যুক্ত বুকের নামফলকটা নামটা আবার মনে করিয়ে দিল বীরেন ফুকন। আমাদের কলেজের সিনিয়র ছিল। পুলিশ থানার অসহজ পরিস্থিতিতে আগে থেকে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে ভালো লাগল বলে আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। হয়তো তিনিও আমার মুখটা মনে রেখেছিলেন, সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন:
‘কটনিয়ান নয় কি?’
বন্ধুত্ব না থাকলেও মনে আছে যে আমরা একই হোস্টেলে ছিলাম। আমার থেকে দুই না তিন বছরের বড় বলে বেশিদিন পাইনি। আমি পরিচয় দিয়ে আমাদের ঘরে পাথরের ঢিল মারার কথাটা মনে করিয়ে দিলাম। খবরের কাগজের সঙ্গে জড়িত বলে তিনি আমাকে আগে থেকেই জানেন। নতুন করে শহরে বদলি হয়ে এসেছেন বলে হয়তো আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি আমাকে এজাহার লেখায় সুযোগ-সুবিধা করে দিলেন।এই আন্তরিকতা কলেজের পরিচিতির জন্যই না আমি খবরের কাগজের বিতর্কিত সাংবাদিক বলে তা বুঝতে পারলাম না। কথা বলে বীরেন ফুকন মানুষটাকে সরল বলেই মনে হল। এমনকি পরে চা বিস্কুট খেয়ে অনেকক্ষণ হোস্টেল এবং কলেজের গল্প করলেন। কথা বলতে গিয়ে পুনরায় হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের প্রসঙ্গ উঠল।
একবার স্যারের বিরুদ্ধে কলেজে হরতাল হয়েছিল। তার মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন এই আজকের ডিএসপি বীরেন ফুকন। তিনি ছাত্র একতা সভার প্রথম সারির নেতা ছিলেন এবং যে ছাত্র সংগঠনকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করছিলেন সেই দলটি ছিল সেই সময়ের অসমিয়া জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। সেটা অপারেশন বজরং এর এক বছর আগের কথা। নানা কারণে দেশে একটা বিভ্রান্তির অবস্থা চলছিল বলে মানুষের আবেগ ম্যালেরিয়ার জ্বরের মতো এই নামে এই উঠে। আমরা শুনতে পেয়েছিলাম স্যার তাঁর ক্লাসে নাকি অসমিয়া বিরোধী মন্তব্য করেছিলেন। তার জন্যই প্রতিবাদ।– ‘হেমাঙ্গ দত্ত মুর্দাবাদ’বলে ব্যানার নিয়ে চিৎকার করিনি যদিও স্যার অসমিয়া হয়ে অসম বিরোধী মন্তব্য আমারও ভালো লাগেনি।
–সমস্যাটা আমিই সৃষ্টি করেছিলাম,এখন মনে পড়লে খারাপ লাগে।‘
বীরেনদা বললেন। কিছু সময় কথা বলার পরেই সৌহার্দ্য থেকে আমি তাকে দাদা বলে সম্বোধন করতে আরম্ভ করলাম।
–আসলে কী হয়েছিল?’
–স্যার ক্লাসে কিছু একটা পড়াচ্ছিলেন, তার মধ্যে বলে ফেললেন যে পাশের রাজ্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাকে রোধ করা যায় না, তোমরা যতোই জাতীয়তাবাদ কর না কেন সংস্কৃতির আদানপ্রদান চলবেই…’ কথাটা তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন বলেই আমার গায়ে লেগেছিল। আমি পার্টি অফিসে গিয়ে কথাটা বলায় সাধারণ সম্পাদকের কী হল বুঝতে পারলাম না… হৈচৈ হুলস্থুল… শ্লোগান হরতাল। পরে বুঝতে পারলাম যে তার এক মাস পরে সংঘটিত ছাত্র একতা সভার নির্বাচনে সেই আন্দোলনের জন্য আমার জনপ্রিয়তায় কাজ দিয়েছিল। যার জন্য আমি হয়তো কয়েকটা ভোট বেশি পেয়েছিলাম।‘
দত্তস্যারের সম্পর্কে আমার মতোই নিজের কর্মে অসন্তুষ্ট যেন মনে হল বীরেন ফুকনকে।
–পরে আমি ক্লাস নোট থেকে বুঝতে পেরেছিলাম স্যার কথাটা ইতিহাসের প্রসঙ্গে বলেছিলেন। সেই সময় তিনি আহোম ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন। তুমি তো সায়েন্সের ছিলে, তাই না?
–হ্যাঁ।
–স্যার অসমের স্থাপত্যকলার বিষয়ে বোঝাচ্ছিলেন যে আহোমরা পাকা ঘর বানাতে জানতেন না, হয়তো সেইসময় তার দরকারও ছিল না। তারপরে রাজা রুদ্র সিংহের দিনে রাজ পরিবারের দিক থেকে পশ্চিমের আবহাওয়ার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং তখনই বাংলাদেশের কারিগর এসে অসমে পাকা ঘর নির্মাণের পদ্ধতি স্থাপন করার ব্যবস্থা হল। ফলে অসমের ইতিহাসে রংঘর, কারেংঘর, জয়দৌল, শিবদৌল ইত্যাদির সৃষ্টি হতে পারল। মন্তব্যটা দত্তস্যার এই প্রেক্ষাপটে করেছিলেন। কিন্তু তারপরে তিনি সেই পশ্চিমের ভাবধারা আহোম ভাবধারা এবং সংস্কৃতিতে ফাটল সৃষ্টি হওয়ার কারণ হয়ে পড়েছিল তাও আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু তখন স্যারের সেই উপহাসসূচক হাসিটা মনে থাকল এবং সমস্ত কিছুর ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তারপরে ঘটনাটা বন্ধ করার ক্ষমতা আমার হাত থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। দুদিন আন্দোলনের পরে সেই ঘটনাটা মানুষ ভুলতে শুরু করল। কিন্তু এক বছর পরে যখন স্যারের হারিয়ে যাওয়ার খবরটা পেলাম তখন আমার এরকম মনে হল যেন আমার করা ভুলের জন্যই স্যার নাই হয়ে গেলেন। আমি ছাত্র একতা সভা থেকে স্যারের জন্য কিছু একটা করার কথা বলেছিলাম যদিও কেউ আমার কথায় কোনওরকম গুরুত্ব দিল না। পরে আমার পরীক্ষা এসে যাওয়ায় রাজনীতি এড়িয়ে চললাম। তারপরে যে বেরিয়ে এলাম তো বেরোলামই।
বীরেনদা এবং আমি, হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের স্মৃতিতে দুজনের পুরনো বিষয়টিতে কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। তাই আমি ইতস্তত করে বললাম- আমরা দুজনে মিলে স্যারের জন্য কিছু একটা করতে পারি নাকি? সেই আরম্ভ অধ্যাপক হেমাঙ্গ দত্ত প্রতিষ্ঠানের।স্মৃতিমূলক প্রতিষ্ঠান নয় কারণ দত্ত স্যার মৃত বলে আমাদের হাতে কোনও প্রমাণ নেই। কারণ প্রতিষ্ঠানটি আরম্ভ হওয়ার পর থেকেই সমাজ জীবন থেকে অজ্ঞাতবাসে থাকা মানুষটির উপরে সমাজে একটা নতুন দিক উত্থাপিত হয়ে আসছে আমি স্যারের সঙ্গে থাকা অভিজ্ঞতার কিছু লিখে সাধারন জনতার স্মৃতিকে কাগজের মাধ্যমে আঘাত করতে চেয়েছিলাম। কিছুদিন পরে ডিএসপি বীরেনদা কিছু কথা লেখার কিছুদিনের মধ্যে হেমাঙ্গ দত্ত মানুষটি এবং তার অন্তর্ধান অসমের ছোট বৌদ্ধিক মহলে একটা ছোটখাটো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
(৩)
হেমাঙ্গ দত্ত আত্মগ্লানি ক্লাবের একজন অপ্রত্যাশিত সদস্য হলেন রকিবুল হক। সে আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী। কিন্তু সে যে আমার ক্লাসেরই ছাত্র সেটা আমি অনেকদিন পরে খেয়াল করেছিলাম। চর অঞ্চলের ছেলে, কথা বলার সময় ‘ফ’এবং ‘স’এর সঠিক ব্যবহার শেখেনি বলে তার সঙ্গে আমরা ইতর প্রাণীর মতো ব্যবহার করেছিলাম যা নিয়ে আমরা এখন দুঃখিত। কখনও ক্লাসে আসে কখনও আসে না। এলেও কোনও ধরনের বার্তালাপ হয় না কারণ আমরা নিজের মধ্যে থাকা জনপ্রিয়তাকে নিয়েই সুখী। এই অবস্থায় একদিন তাকে পুলিশ নিয়ে গেল— জানতে পারলাম সে কোনও এক বামপন্থী দলের সভ্য। আমাদের তাতে কিছুই করার ছিল না। ডান বাম রাজনীতির বিষয়ে ভাবার মত সময় নেই, অবকাশ নেই। দেশের বিষয় যদি ভাবতে হয়, তাহলে অসম এবং অসমিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবব। তবুও যতটুকু জানি তাতে মনে হয়েছিল যে রকিবুল এবং হেমাঙ্গ দত্ত দুজনেই কমিউনিস্ট। আলফা, স্বাধীন অসম, বড়োলেন্ড, হিন্দি আগ্রাসন এতগুলি সমস্যার আড়ালে কমিউনিস্ট কী তা ভাবার মতো আমাদের হাতে সময় ছিল না। হেমাঙ্গ দত্ত স্যার কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না যদিও সমস্ত কাজকর্মেই নিয়ম না মানা কমিউনিস্টের লক্ষণ। তিনি নিশ্চয়ই কমিউনিটি হবেন বলে ধরে নিয়েছিলাম। সেবার মহাবিদ্যালয় সপ্তাহের তর্কসভায় রকিবুল আক্ষরিক অর্থে আলোড়ন সৃষ্টি করল… তর্ক প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল— ‘সামাজিক ন্যায়ের জন্য কখনও হিংসার প্রয়োজন হয়’। পক্ষ, বিপক্ষ দুই পক্ষই যথেষ্ট আবেগ ঢেলে বক্তৃতা করেছিল। কিন্তু রকিবুলের আগের বক্তৃতাগুলির বিষয়বস্তু জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অস্ত্র তুলে নিতে হবে কি হবে না তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদ রক্ষার নামে রিক্সাচালককে দুটো চড়, মাছের ব্যাপারিকে পয়সা না দেওয়া প্রবৃত্তি থেকে, শ্রেণি কোঠায় অসমিয়া ভাষার সঠিক উচ্চারণ না হওয়ার জন্য ঠাট্টা— সমস্ত ধরনের হিংসাকে তিরষ্কার করে সে আহ্বান জানিয়েছিল এই ধরনের পরাধীনতার ভয় প্রবেশ করার প্রবৃত্তি শেষ করার জন্যই শোষিতদের একত্রীকরণ হওয়া উচিত এবং তার জন্য দরকার হলে হিংসার ব্যবহার করে একটি সুষম সমাজ গড়ে তুলতে হবে বলে এক সফল রাজনৈতিক ভাষণ দিয়ে দিল। সেই প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসনে ছিলেন হেমাঙ্গ দত্ত স্যার। সেবার প্রতিযোগিতার নিয়মাবলিতে বিচারকের প্রশ্ন বলে একটা অধ্যায় ছিল।
দত্ত স্যার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: মনে করো এরকম একটি সুষম সমাজের আহ্বানে শোভাযাত্রার দল শহরের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। তখনই একজন মানুষ সেই শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে রাস্তা পার হতে চাইছে এবং তখনই শোভাযাত্রার দলটি মানুষটির উপরে মারপিট করতে শুরু করে। সেই হিংসাকে কী বলে ভাববে? সিউডো হিংসা না প্রকৃত হিংসা?’
দত্ত স্যারের প্রশ্নে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কারণ কয়েকদিন আগে পুলিশ তাকে নিয়ে যাওয়ার আড়ালের কারণটা সেটাই ছিল।
–সেটা হিংস্র নয়, সেটা শোষিতদের ক্ষোভ প্রকাশ, সমাজব্যবস্থা যখন এত চাপের মধ্যে শোষিতদের রাখে, তখন এই ধরনের বিক্ষিপ্ত ঘটনা প্রেসার কুকারের হুইসেলের মতো বেজে ওঠে, চাপ নিবারণের জন্য। আইনের ভাষায় সঠিক না হলেও সামাজিক পরিভাষায় সেটা একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।’
–কিন্তু মনে করা হল সেই মানুষটি একজন চিকিৎসক এবং যথাসময়ে চিকিৎসালয়ে না পৌঁছাতে পারলে রোগীদের অসুবিধা হবে। তাকে তো নির্দিষ্ট সময় ঘর থেকে বের হতে হয়েছিল। শোভাযাত্রা পথ অবরোধের জন্য পনেরো মিনিট দেরি হবে বলে তিনি পথটা পার হতে চেয়ে ছিলেন। এখন বলো তার দোষ কোথায়? আর যদি দোষ নেই তাহলে এই ধরনের হিংসা এবং জাতীয়তাবাদের নামে রিকশাওয়ালাকে দেওয়া চড়চাপড়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায় থাকল?
দত্ত স্যার রকিবুলকে জিজ্ঞেস করেছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত দর্শকরা হাততালিতে স্বাগত জানিয়েছিল। এতক্ষণ রকিবুলের বাকপটুতার জন্য তার ভাষণের প্রতি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে তা নিয়ে দর্শকদের মনে সন্দেহ ছিল যদিও রকিবুলের ভাষণের মূল কথা অনেককে ক্ষুণ্ণ করেছিল। দত্ত স্যারের প্রশ্ন সেই সন্দেহ দূর করে। রকিবুলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার দিন কোথায় কী হয়েছিল সেটা দত্ত স্যার ভালোভাবেই জানতেন কারণ যখন পুলিশ স্টেশন থেকে খবর এসেছিল তাকে বের করে নেবার জন্য কলেজের দিক থেকে দত্ত স্যার পুলিশ থানায় গিয়েছিলেন। হাততালি শেষ হওয়ার পরে তার উত্তরে রকিবুল বলেছিল ‘পানবাজারের সরকারি আবাসে বাস করে, সরকারের কাছ থেকে মোটা টাকা বেতন নিয়ে শোষিতদের দুঃখে কুম্ভীরের অশ্রু বিসর্জন করা মানুষ শোষিতদের মনের কথা বুঝতে পারবে না।’
উত্তরের পরেই তর্ক সভায় একেবারে উত্তপ্ত অবস্থা… কয়েকজন রকিবুলকে মারার জন্য দৌড়ে গেল। কোনওমতে পরিস্থিতি সামলানোর পরে যখন প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা হল তখন রকিবুল তৃতীয় হয়েছিল।
এখন রকিবুল একটি বামপন্থী দলের নেতা। আমরা যখন খবরের কাগজে হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের বিষয়ে লেখা প্রকাশ করতে লাগলাম তখন রকিবুল একটি আবেগী চিঠিতে ঘটনাটা স্মরণ করে এভাবে লিখল— ‘তখন আমরা কলেজের অপ্রতিষ্ঠ ছাত্র, পুরস্কারটার জন্য আমার বড় আগ্রহ ছিল। বামপন্থী এবং দাদু বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে এসেছিল বলে ঠাট্টামশকরা, চড়চাপড় ছোটবেলা থেকেই খেয়ে আসছি। তাতে আমার ভ্রূক্ষেপ ছিল না, কিন্তু যেদিন অত্যন্ত সফল ভাষণের পরেও আমি তৃ্তীয় পুরস্কার পাওয়ার দুঃখ পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল সমাজ সত্যি সত্যি পক্ষপাতদুষ্ট। আমি ভাবতে লাগলাম হেমাঙ্গ দত্ত স্যার বাইরে একটা নিরপেক্ষ সাম্যবাদী মুখোশ পরেন। সেদিন তার বিরুদ্ধে বলার জন্যই আমাকে প্রথম স্থান থেকে পিছিয়ে রেখেছিলেন। সেদিন আমাকে মারধোর করা আয়োজকদের দুই-একজন এখন আমার ভালো বন্ধু। তারই একজনের সঙ্গে সেই প্রতিযোগিতাটির বিষয়ে কথা বলার সময় জানতে পেরেছিলাম যে সেইদিন দত্ত স্যার আমাকে প্রথম বলে নাম্বার দিয়েছিলেন, অন্য দুজন বিচারক কম নাম্বার দেওয়ার জন্যই আমি তৃতীয় হলাম। সেদিন প্রতিযোগিতায় আমায় করা ব্যক্তিগত আক্রমণে বড় একটা সভ্য ভাষা ব্যবহার হয়নি বলে মনে হয়। আমি বলেছিলাম— পানবাজারে বাস করে সরকারি চাকরি করে শোষিতদের জন্য কুম্ভীরের অশ্রু বিসর্জন করা… কে জানে আমার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার জন্যই স্যার হয়তো সমাজ ত্যাগ করলেন! সেই ভাবনা তখন থেকে আমাকে ব্যথিত করে চলেছে।
(৪)
অবশেষে আমরা তিনজন একত্রিত হলাম।
আমি ডিএসপি বীরেন ফুকন এবং রকিবুল। উদ্দেশ্য হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের বিষয়ে একটি বই প্রকাশ করা। অনেকখানি তথ্য জোগাড় হয়ে গেছে। কিছুটা আমাদের খবরের কাগজে স্যারের বিষয়ে লেখা এবং কিছু আমরা খুঁজে খুঁজে বের করেছিলাম। স্যারের ঘরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সেখান থেকেও স্যারের হাতে লেখা প্রবন্ধগুলি জোগাড় করা হয়েছিল। যে কোনও সরকারি কাজে কয়েকজন মূল পরিচালকের প্রয়োজন হয়। এই কাজে আমরা তিন পাপী প্রায়শ্চিত্তের উপায় হিসেবে মনেপ্রাণে খাটতে লাগলাম। তাই তিনজনের আজকাল ঘন ঘন দেখা হয়।
–স্যার কোথায় যেতে পারেন?
–আত্মহত্যা করলেন?
–গুপ্তহত্যা হল?
–কোনও উগ্রপন্থী সংগঠন কোনও কারণে অপহরণ করাল এবং তারপরে কোনও কারণে তার মৃত্যু হলে নদীতে ফেলে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল?
–না হলে রকিবুলের ভাবনার মতো স্যার সুরক্ষিত অবস্থা থেকে সরে গিয়ে শোষিতদের কাছে পরিস্থিতি বোঝার জন্য চলে গেলেন নাকি গৌতম বুদ্ধের মতো?
রবিবার না হলে কখনও অবসরের সময় আমরা তিনজন বসি। বইটির অধ্যায়ের পর অধ্যায় সম্পাদনা করে একমত হই, কখনও মতানৈক্য হয়, পরে বোঝাবুঝি হয়। বইয়ের কাজ ছাড়াও বাকি বিষয়ে কথা হয়। একদিন স্যারের লেখাগুলির মধ্যে ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এবং ভবিষ্যৎ দর্শন’ নামে একটি লেখা পাওয়া গেল। তার মূল কথা ছিল সেই তখনকার দিনে স্যারের দেওয়া ভাষণ যার প্রতিবাদে আমি কথা বলেছিলাম। নিজেই এক ইতিহাসে পরিণত হতে চলেছি যদিও প্রকৃত ইতিহাসকে নিয়ে আমি এখনও খুব একটা সচেতন নই, সচেতন হতে হবে কেন তা নিয়েও আমি নিজেই সন্দিহান।
আমার কথাটা তখনও হজম হয়নি, এখনও নয়… ব্রিটিশ এসেছিল চলে গেল, পুনরায় উপনিবেশ স্থাপন করার মতো ওদের ক্ষমতা নেই, তাহলে? হিটলার ছিল ইহুদিদের হত্যা করল, কাহিনি খতম… পুরনো ক্ষত চুলকিয়ে কী লাভ হবে?
হেমাঙ্গ দত্ত স্যারের সেই লেখাটা নিয়ে আমি মত প্রকাশ করার সময় ইতিহাসের প্রাক্তন ছাত্র বীরেনদা বললেন— ‘কাহিনির কোনও আরম্ভ বা শেষ নেই বন্ধু… কোথায় পড়েছিলাম ভুলে গিয়েছি, কিন্তু কথাটা সত্যি। বর্তমানকালে ঘটতে থাকা প্রতিটি ঘটনা অনুধাবন করে দেখ ওদের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখতে পাবে। আর তার সঙ্গে দেখতে পাবে একটি অনুরূপ তরঙ্গ পরিক্রমা।’
‘অনুরূপ তরঙ্গ পরিক্রমা।’
বীরেন ফূকণের বাক্যটা ভালো লাগল। পেশায় সাংবাদিক হলেও মনের ভেতরের মানুষটি হয়তো এখনও বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে আছে। ‘ইতিহাসকে ভুলে যেও না’ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে দেখতে পাব ইত্যাদি বাক্য আমাদের খবরের কাগজে বহুব্যবহৃত যদিও আমি কখনও সেই বাক্যগুলির ভেতরে ঢুকতে পারি না। যখনই বীরেন ফুকন বললেন বর্তমান ইতিহাসের তরঙ্গ পরিক্রমা তখনই ইতিহাসের গতিকেও সেই পদার্থ বিজ্ঞানের তরঙ্গের মতো মনে হল। তবুও গভীরভাবে ভাবার সময় পাইনি। মনে মনে সন্দেহ হয়েছিল— ইতিহাসের ছাত্র, তাই ইতিহাসকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেই।
(৫)
বইটি সম্পাদনার কাজে পরেরবার আমাদের বাড়িতে দেখা হয়েছিল, এবার কথাটা আরও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য হলাম। কাজ শেষ করে কিছুক্ষণ এমনিতেই চা খেতে খেতে কথাবার্তা বলছিলাম। সামনের টিভিতে আন্তরাষ্ট্রীয় খবরগুলির জন্য বিদেশি চ্যানেলেগুলি চলছিল। মাঝেমধ্যে বীরেন ফুকন টিভি রিমোট নিয়ে খেলছিলেন। সিএনএনে আলোচনার বিষয় ছিল— চিনের সমর্থনের জন্য উত্তর কোরিয়ার বিশ্বধ্বংসী দাম্ভিকতা কীভাবে বেঁচে আছে আর এই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির চিন্তাহীন উক্তি আণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার বাড়িয়ে তুলল কিনা। বিবিসিতে সিরিয়ায় কীভাবে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের জন্য শান্তি ঘুরে আসেনি। আলজাজিরা চ্যানেলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশসমূহের মধ্যে কীভাবে অতি জাতীয়তাবাদ দেখা দিয়ে দেওয়ার ফলে প্রায় প্রথম মহাসমরের প্রাকক্ষণের মতোই সময় ফিরে এসেছে সেই বিষয়ে আলোচনা চলছিল।
‘মিস্টার বিজ্ঞান’ বীরেনদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘এই কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন…. হেমাঙ্গ দত্ত স্যার ঠিক এমনই একটি ইতিহাসের পুনর্ঘটনার কথা বলতে চেয়েছিলেন।
–মানে?
–মানে দেখুন… এই যে বর্তমানে প্রত্যেকটি দেশেই একটি উগ্র জাতীয়তাবাদ ফিরে আসছে, ইতিহাসে এর আগে কখনও সেরকম হয়েছিল কি?
–ইতিহাসে আমি অত্যন্ত কাঁচা…
–প্রথম মহাসমরের আগে ঠিক এমনই এক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। এদিকে রাশিয়ান জাপানি আর জার্মান জাতীয়তাবাদ অন্যদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতা এবং শক্তিশালী মার্কিন বন্ধুত্ব। দুই ধরনের শক্তির সম্প্রসারণের ফলে প্রতিটি দেশই নিজের জাতীয় ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য কিছু হিংসার প্রয়োজন আছে বলে ভাবতে শুরু করেছিল। সবাই চেয়েছিল একটি ফাইনাল সলিউশন, যার ফলে দুটি বিশ্বযুদ্ধ হল… অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হওয়ার পরেও সেই সমাধান খুঁজে পাওয়া গেল না… যদিও আরও একশো একটি নতুন ঐতিহাসিক ক্ষতের সৃষ্টি হল… আজ তার প্রায় ১০০ বছর পরে প্রায় একই ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়নি কি?
–তার মানে দত্ত স্যারের মতবাদ ব্যবহার করে আপনি বলতে চাইছেন যে এই আধুনিক পৃথিবীর কোলাহলে অতি শীঘ্রই আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ হওয়া স্পষ্ট হয়ে পড়েছে?
রকিবুল জিজ্ঞেস করল।
–অলমোস্ট… কিন্তু এইবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে আমরা কেউ থাকব না, এটা আমার বিশ্বাস…’
নিজের কফি কাপে চুমুক দিয়ে বীরেনদা বললেন।
কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধতা… এমনকি রকিবুলও কোনও কথা বলছে না… সে বিশ্বাস করে রাজনৈতিক মতাদর্শ মতে এই জাতীয়তাবাদের বা ধর্মীয় বিভাজন কৃত্রিম সত্তা। মানবপ্রজাতি দুটি ভাগে বিভক্ত— শোষক আর শোষিত। শোষিতদের নিজের অধিকার সাব্যস্ত করার জন্য একত্রিত হতে হবে এবং তার পরই হিংসা কে জানে হয়তো এনে দেবে সেই শেষ সমাধান। হয়তো রকিবুল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, না হলে সে উচিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই সে মনে মনে রিমোট নিয়ে চ্যানেল বদলে নিল। এইবার একটা জার্মান খবরের চেনেলে এসে রিমোটটা স্থির করল। অনুষ্ঠানটিতে জার্মানিতে পুনরায় একবার নিউ নাজির মতি অনৈতিক অতি দেশপ্রেম যাতে জাগ্রত না হয় তার জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কয়টি কীভাবে কাজ করে চলেছে তাই দেখানো হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে সিরিয়া থেকে আসা রিফিউজিরা কীভাবে জার্মানির জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে পারে তা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা কিছু দেখানো হচ্ছিল।
–যদি সেই আপনার কথা সত্যি, তাহলে জার্মানিতে তো দেখছি এখন নাজিবাদের পুনরুত্থান হওয়া হওয়া উচিত ছিল, সেটা তো হয়নি… রকিবুল জিজ্ঞেস করল।
–সেই কথাটাই তো দত্তস্যার বোঝাতে চেয়েছিলেন… কিছু লোক দেখে শিখে, কিছু লোক ঠকে শেখে আর কিছু লোক শিখবে না বলেই শেখে না… আমাদের সমাজ এই ধরনের সমাজ। জার্মান সমাজ ঠকে শেখা সমাজ, জাতীয়তাবাদের নামে একবার একটি ভুল করেছে, আত্মবিশ্লেষণ হল, সামাজিকভাবে সেই ভুল মেনে নিল এবং পরবর্তীকালে নাজিবাদ এবং জার্মান জাতীয়তাবাদকে একাকার হতে না দিয়ে জাতীয় অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে হবে তা দেখিয়ে দিল। আজকের দিনেও সেখানে হেইল হিটলার বলে সম্বোধন করলে মানুষের জেল হতে পারে। নাজিবাদী কর্মকাণ্ড কেউ করতে চাইলেও সেই বিভ্রান্তদের ঐতিহাসিক সত্যে ফিরিয়ে আনার জন্য মনোবৈজ্ঞানিক পরামর্শ দেওয়া হয়, ইতিহাসের কুটিল পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য এরকম এক সামগ্রিক প্রতিরোধ খুব প্রয়োজন।
তিনি কথাগুলি ফুকন স্যারের মতোই সরল ভাষায় বলছিলেন যদিও আমি সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারছিলাম না্, সমস্ত কথায় সাহেবের সঙ্গে তুলনা করে হীনম্মন্যতায় ভোগা কি উচিত? হ্যাঁ, অসমে বারবার ঐতিহাসিক ভুলগুলির জন্য পুনরাবৃত্তি দেখে আসছি, সে দিক থেকে দত্তস্যারের সেই ভবিষ্যৎ দর্শন মেনে নিয়েছি আজকের দিনে। অসমিয়া জাতীয় জীবন তো ইতিহাসের পূণরাবৃত্তি রোধ করার জন্য একটা সর্বস্বীকৃত প্রতিরোধের খুব প্রয়োজন কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?
(৬)
পেন্ডুলাম ঘড়িটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, স্তব্ধ হয়ে বেশ কয়েকদিন ঘরের এক কোণে পড়েছিল। অফিস, ঘর আর বইটির কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে সময়ই বের করতে পারছিলাম না। মাঝখানে একদিন একটা ব্যাগে ভরিয়ে ঘড়ির দোকান একটিতে ঠিক করতে দিলাম কিন্তু ফিরিয়ে আনার জন্য পুনরায় সময়ের অভাব। ঘটনাটির ছয় মাস পরে অনেক কষ্টের পরে আমাদের বইটির প্রকাশিত হয়ে প্রেস থেকে বেরোনোর দিনের কথা। প্রেসে দেওয়া সময়মতে আমরা তিনজন বইটি সংগ্রহ করার জন্য গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। প্রেসের ছেলেরা আরও ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে বলল। তখনই ঘড়িটির কথা মনে পড়ল। ঘড়ি ঠিক করার দোকান প্রেসের সামনে ছিল বলে তিনজন গিয়ে ঘড়িটা সংগ্রহ করলাম। কারিগরের হাতের স্পর্শে সে পুনরায় একবার ঠিক সময় দেখিয়ে টিকটিক করে ঘুরছিল। তখনই আমার ঘরে শিলা বর্ষণ হওয়ার কথাটা পুনরায় উত্থাপিত হল। ঘটনাটা রকিবুল জানত না।
শিলা বর্ষণের আড়ালে আসল ঘটনাটি এই ধরনের— আমি কাজ করা খবরের কাগজে দুটি সংগঠনের কিছু উগ্রবাদী কার্যকলাপের বিরোধিতা করার জন্যই ছিল এই শিলাবর্ষণ এটাই আমার সন্দেহ। কিন্তু বুঝতে পারলাম না পাথরটা কে ছুঁড়েছিল।
আমার সন্দেহ দুটো দলের ওপরে— একটি উত্তর ভারতীয় ভাবধারায় প্রভাবিত ধর্মীয় সংগঠন অন্যদিকে অপরটি হল নতুন করে শরীরে শক্তি অনুভব করা নতুন অসমিয়ার দল। দুটো দল থেকেই হুমকি এসেছিল। হয়তো বীরেন ফুকন কে কাজটা করেছে সেটা জানত। কিন্তু আমাকে খুলে বলেনি। অবশ্য এই ভরসা দিয়েছে যে ভবিষ্যতে আর কোনও সংগঠনের ছেলে আমাকে বিরক্ত করবে না… এটাও হয়তো এক ধরনের রাজনৈতিক বোঝাবুঝি। রকিবুল কে কাজটি করতে পারে, তা পাকেপ্রকারে তার মুখ থেকে বের করার চেষ্টায় বীরেনদা কিছুক্ষণ অ্যান্টিক ঘড়িটা আকাশের দিকে তুলে ধরে তাকিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন: ইতিহাসের পেন্ডুলাম ভাই… ইতিহাসের পেন্ডুলাম। এই কারবারটিতে নতুনত্ব কিছুই নেই, ভাষা আন্দোলনেও হয়েছিল, অগপ-আলফার দিনেও হয়েছিল, এখনও হচ্ছে। দুদিন আগে দুর্বল হয়ে থাকা সবাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, পাথর ছোঁড়ার মৌলিক অধিকার পেয়েছে, করতে দাও। এই স্লোগান দেওয়া এবং পাথর ছোঁড়ার সময় আমরা মূল লক্ষ্যটার কথাই ভুলে যাই, সেটাই দুঃখজনক।
হাতে পেন্ডুলামের ঘড়িটা নিয়ে মুহূর্তটা এরকম মনে হল যেন হ্যামলেট নাটকের হ্যামলেট চরিত্র হাতে মাথার খুলিটা নিয়ে করুণ বিলাপ করছে।
পেন্ডুলামের কাটা টিক টিক করে ঘুরছিল। একবার ডান দিকে একবার বাঁদিকে একবার মধ্যম। আমরা একদৃষ্টিতে তাই দেখতে থাকলাম। সামগ্রিকভাবে কথাটা অদ্ভুতভাবে মেটাফর বলে মনে হল আমার। বীরেনদা একসময়ের ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী। রবিকুল সর্বকালের বামপন্থী। আর আমি? কলেজের কোনও দিকে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ ছিলাম না।
হেমাঙ্গ দত্ত স্যার আমাদের জীবনে ফিরে এসে ইতিহাসের একঘেয়েমির গতিতে এক আশাবাদী ধাক্কা দিতে চেষ্টা করছেন নাকি?