ইমতিয়াজ আলম খান
লেখক পেশায় বাস্তুকার। ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় উনি ঢাকার বিহারি মহল্লার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর এই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর স্মৃতিচারণটি ডন পত্রিকায় ২০১৯-এর ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। লেখাটি আমরা অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম। অনুবাদ করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। শেষ অবধি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অস্ত্র নামিয়ে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এর মাঝে হাজার হাজার নির্দোষ নাগরিকের প্রাণহানি হয়। দিনটি আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। কারণ আমি মনে করি যে পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জন্যে দেশপ্রেমিকেরা নিজেদের জীবন দিয়েছেন, তার থেকে যেন আমরা ভবিষ্যতে একই ধরনের ভুল না করবার শিক্ষা পাই। সেই অর্থে, পূর্ব পাকিস্তানের ‘৪৯তম মৃত্যু দিবস’ উপলক্ষে কিছু ঘটনার কথা বলব, ঢাকার একদা নাগরিক হিসেবে যা আমি এই গৃহযুদ্ধে প্রত্যক্ষ করেছি।
আমার বাবা-মা ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহার প্রদেশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ঢাকাতেই আমার জন্ম এবং সেখানেই আমি বড় হই। তখন ঢাকাকে বলা হত ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী’। আমার বাবা ছিলেন পাকিস্তান ডাকবিভাগের এক কর্মী। যে পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ কলোনিতে আমরা থাকতাম, সেখানে পাঁচিল-ঘেরা জায়গাটিতে অনেকগুলি তিনতলা অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। জনসংখ্যার নিরিখে এখানে ৯০ শতাংশ বাঙালি আর ১০ শতাংশ অবাঙালি বসবাস করতেন, যাদের ‘বিহারি’ বলা হত।
পশ্চিমবঙ্গে শয়ে শয়ে শিক্ষাশিবির খুলেছে ভারত, যেখানে মুক্তিবাহিনীর জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি তরুণদের অস্ত্রপ্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ১৯৭১-এর নভেম্বরের মাঝামাঝি পরিস্থিতি ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে কারণ ভারতের দিকের বাংলা থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় মুক্তিবাহিনী যোদ্ধারা এসে পৌঁছাচ্ছে। সীমান্তে হাতাহাতির ঘটনাগুলিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘায়েল হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। শেষ অবধি ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১-এ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল।
পরের দিন আমার চোখে পড়ল কয়েকজন মানুষ জড়ো হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। উত্তেজনায় তাঁদের শরীর কাঁপছে। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকাই। দেখি বিন্যাস মেনে বেশ কয়েকটি সাদা ফুটকি এগিয়ে আসছে। ভারতের মিগ-২১ আর এসইউ-৭ বিমানগুলি ঢাকার আকাশে চক্কর দিচ্ছে। অনেকটা উঁচুতে ওরা উড়ছে যাতে নিচ থেকে ওদের গুলি করে নামানো সম্ভব নয়। ওরা ঢাকা বিমানবন্দর আর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বোমা ফেলছিল। কিন্তু অতটা উঁচু থেকে ফেলার কারণে বোমাগুলি তাদের লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারেনি।
ঠিক পরের দিন ভারতীয় বিমান বাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর আক্রমণ করে। মিগ আর হান্টারগুলি ঢেউয়ের মতো এসে বিমানবন্দরে ভারি বোমাবর্ষণ চালায়। জমিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের বন্দুকধারীরা সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে অনেকগুলি শত্রু বিমান নামায়। কিন্তু ভারতের দিক থেকে এত বেশি বিমান আক্রমণ চালানো হয়েছিল, যে বিমানবন্দরের রানওয়ে নষ্ট হয়ে যায়। কোনও বিমান সেখান থেকে উড়তে পারেনি।
সীমান্ত এলাকাগুলি ছাড়াও যশোর, খুলনা, নাটোর, কুষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট শহরগুলিতেও যুদ্ধ চলছিল। দেশের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত ঢাকা শহরটিকে ঘিরে রেখেছে গঙ্গা (পদ্মা), মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্র। সেভাবে ঢাকা বা তার কাছাকাছি এলাকাগুলিতে মুক্তিবাহিনী বা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনও চিহ্ন তখনও দেখা যায়নি। শুধু শহরের উপর ভারতীয় বিমানগুলি অনবরত চক্কর দেওয়া আর রাতে বাধ্যতামূলক ব্ল্যাকআউটগুলি থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে যুদ্ধ চলছে।
আমাদের তি-তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি দিয়ে মাঝেমাঝে দেখতে পাচ্ছিলাম ভারতীয় বিমানগুলি গভর্নর হাউসের দিকে গোত্তা খেয়ে রকেট ছুঁড়ছে। বিমান থেকে নির্গত আগুনের রেখাগুলি গভর্নর হাউসের পূর্বদিকের ডোমে আছড়ে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে মাটি থেকে বিমান লক্ষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছোঁড়া বন্দুকের গুলি আকাশে একের পর এক ফাটছে।
সেই সময়ে গভর্নর হাউসে কেউ নেই। রাজ্যপাল আবদুল মালিক এবং তাঁর স্টাফদের ইতিমধ্যেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজটি সহজ ছিল না। কারণ, নদীর উপর সেতুগুলি ততক্ষণে ধ্বংস। শহরে তখন অস্বস্তিকর এক নীরবতা। পরিবেশ চাপা উত্তেজনায় থরথর করছে। ভয় আর আশঙ্কা ক্রমশ শহরবাসীদের আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরছে। এমন দমচাপা অবস্থার মধ্যেই ১৬ই ডিসেম্বরের ভোর এল।
মর্মভেদী সেই দিনটাতে, ফজরের নামাজের পরেই আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় টোকার শব্দ। দেখলাম আমাদের বাঙালি প্রতিবেশী মাল্লুভাই। ওনার নাম মুহম্মদ আলি খান, কিন্তু ভালোবেসে সবাই ডাকনামটাই ব্যবহার করে। উনি এবং ওনার পরিবার আমাদের ফ্ল্যাটের উপরতলাতে থাকতেন। এমনিতে শান্তশিষ্ট সুপুরুষ এই মানুষটিকে সেদিন যথেষ্ট উত্তেজিত দেখি। চোখগুলি চকচক করছে, গালদুটি লাল আর কণ্ঠস্বর তীব্র।
“ইমতিয়াজ, বড় খবর শুনেছ? আকাশবাণী বলছে পাক আর্মি আজ আত্মসমর্পণ করবে।”
আমি জোরে হাসলাম (তখন জানতাম না, অনেকদিন আর হাসতেই পারব না), “আরে মাল্লুভাই ছাড়েন তো। সব ছেড়ে আপনি বিশ্বাস করলেন আকাশবাণীকে?”
গোধূলির পর সন্ধ্যা নামতেই আমরা বাইরে বড় একটা হট্টগোলের শব্দ পেলাম। ব্যালকনিতে গিয়ে যা দেখলাম তাতে ভয়ে আমার পা ওখানেই জমে গেল। দেখলাম বিশৃঙ্খল একটা জনস্রোত লাঠিসোঁটা হাতে আর চামড়ার চাবুক নাচাতে নাচাতে আমাদের বিল্ডিং-এর দিকে এগিয়ে আসছে। ঘৃণা আর রাগে ওদের সবার মুখ বিকৃত। পাগলের মতো চিৎকার করে বলছে, “জয় বাংলা, বিহারিগুলোকে মার, বেইমানদের কেটে ফ্যাল!”
মাল্লুভাই বললেন, “না, আপনি বুঝতে পারছেন না। এবার ওরা একটা পরীক্ষা করে দেখছে ওদের ঘোষণা কতটা সত্যি। ওরা বলছে আমাদের প্লেনগুলি মাটির কাছেই এবার ঊড়বে, কিন্তু কেউ ওদের দিকে গুলি তাক করতে পারবে না। পাক সেনার সব অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান চুপ থাকবে।”
শুনতেই বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে বললাম, “একবার ভেবে দেখুন মাল্লুভাই, এটা কী করে সম্ভব? ভারতীয় সেনা এখনও ঢাকা পৌঁছায়নি। এখনও ওরা দূরে আছে। তাহলে জেনারেল নিয়াজি কেন আত্মসমর্পণ করবেন? এবং কার কাছেই বা করবেন?”
আমার এই কথাগুলি শুনে মাল্লুভাইয়ের উত্তেজনা প্রশমিত হল। নিজের ঘরে ফিরে যাবার পথে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, “আচ্ছা বেশ, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আসল সত্যিটা জানতে পারব।”
যতই সাহস দেখাই, আমি কিন্তু ভয় পেয়ে পেছিলাম। কাঁপতে কাঁপতে নিজের ফ্ল্যাটের ভিতরে গিয়ে পরিবারকে খবরটা দিলাম। তারপর কেউ না কেউ একবার করে ব্যালকনিতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে আসছে ভারতীয় বিমান এল কি না।
তারপর যা ভাবিনি ঘটবে, তাইই ঘটল।
সকাল দশটা নাগাদ ভারতীয় বিমানগুলি এল। প্রথম কয়েকটি সর্টি বেশ উঁচুতেই হল। অচিরেই ওরা নিচু দিয়ে উড়তে শুরু করল। এতটা নীচু যে আমরা পাইলটদের দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আগের দিনের মতো কেউ জমি থেকে ওদের দিকে গুলি ছুঁড়ছিল না। তার বদলে প্লেনগুলি থেকে প্রচুর প্যামফ্লেট ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তাতে ইংরেজি, বাংলা আর উর্দু ভাষায় ছাপানো আছে যে জনসাধারণকে সেদিন বিকেলে রমনা রেসকোর্সে পাক সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ প্রত্যক্ষ করবার জন্যে নিমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
আশান্বিত অবাক বাঙালিরা দলে দলে রেসকোর্সের দিকে ভিড় জমাতে শুরু করল। সেখানে লাখ লাখ বাঙালির তোলা ‘জয় বাংলা’ আর ‘জয় হিন্দ’ শ্লোগানের মধ্যে জেনারেল নিয়াজি ইনস্ট্রুমেন্ট অফ সারেন্ডার সাক্ষর করলেন এবং নিজের পিস্তল জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার হাতে দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটল, জন্ম নিল বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানের শেষে যে বিশাল জনস্রোত যখন রেসকোর্স গ্রাউন্ড থেকে বার হয়ে আসছে, তার আবেগ বাঁধনহারা। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসে আর প্রবল উত্তেজনায় ভিড় মারমুখী হয়ে উঠছে। ‘জয় বাংলা’ চিৎকারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ‘পাকিস্তানিদের কাট’।
তবে কেউই পাক সেনাবাহিনীর গায়ে হাত তোলেনি। তাদের অধিকাংশের হাতে তখনও অস্ত্র রয়েছে। তাই খুনি উন্মাদনায় শহরে ছড়িয়ে পড়ল ভিড়। পাকিস্তান এবং পাক সেনাবাহিনীর সমর্থক যারা, সেই বিহারিদের উপর লুঠতরাজ শুরু হল। স্বাধীনতার কী বিচিত্র উদযাপন!
ঢাকায় হিসেবমতো তখন তিন লাখ বিহারির বাস। শাজাহানপুর, কমলাপুর, মতিঝিল, পুরানা পল্টন, নবাবপুর রোড, নবাববাড়ি, ঠঠেরি বাজার, মৌলবি বাজার, আরমানি টোলা, ইসলামপুর, আজিমপুর, সদর ঘাট, এস্কাতান, ধানমন্ডি, ঢাকেশ্বরী, নীলখেত ইত্যাদি শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এই সব এলাকায় অধ্যুষিত জনসংখ্যার ৫ থেকে ৭ শতাংশ বিহারিরা সংখ্যালঘু হিসেবেই চিহ্নিত।
সেই রাতে প্রত্যেক এলাকার বিহারিদের উপরে উন্মত্ত জনতা আক্রমণ করে। লুঠপাট, আগুন জ্বালানোর পাশাপাশি মানুষদের মেরে ফেলতে থাকে ওরা। মতিঝিলে পি অ্যান্ড টি কলোনিতে আমার ফ্ল্যাটের উপরতলায় থাকতেন ইয়াহিয়া নামে এক বিহারি। হিংস্র জনতা সোজা তার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দরজা ভেঙে ওর স্ত্রী এবং বাচ্চাদের একটা ঘরে বন্দি করে। তারপর ইয়াহিয়াকে টেনে বার করে নিষ্ঠুরভাবে মারে এবং সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে ফেলে দেয়। তারপর ভিড় নেমে আসে রাস্তায়। রক্তাক্ত ইয়াহিয়া পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। উনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। জনতা ওকে ফুটবলের মতো লাথি মেরে মেরে রাস্তা থেকে কলোনির ধারের ঘাসজমিতে ফেলে দিল। তারপরেও লাথি আর মার বন্ধ হয়নি, যতক্ষণ না উনি মারা যান। কয়েকজন ওর মৃত শরীরটার উপর উঠে লাফালাফি করতে থাকল। তারপর রক্ত ঠান্ডা করে দেওয়া প্রবল এক চিৎকারের পর ভিড়টা আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল।
এসব দেখে ভয় পেয়ে তখন আমি কাঁদছি। আমার বাবা রেগে গালে জোরে এক থাপ্পড় মেরে বলেন, “কাঁদবি না। আমি চাই না আমার ছেলে একটা কাপুরুষের মতো মরুক। যদি আমাদের মরতেই হয় আমরা সাহসের সঙ্গে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াব। তোর গায়ে হাত দেওয়ার আগে আমাকে মারতে হবে ওদের। আল্লাকে মদতের জন্যে ডাক। পারলে উনিই আমাদের বাঁচাতে পারবেন।”
ক্রমশ আওয়াজ বাড়ছে। সিঁড়িতে হুঙ্কার, দরজা ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার আর আর্তনাদের প্রতিধ্বনি শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে এবার বধির হয়ে যাব। আমাদের সবার নজর দরজার দিকে। মনে হচ্ছে, যে কোনও সময়ে ওটা ভেঙে পড়বে। সেই সময়ে মা বললেন, “এবার ওরা মুজিবদের ফ্ল্যাটে ঢুকেছে।”
মুজিব সাহেব তাঁর পরিবার নিয়ে দোতলায় থাকতেন, মাল্লুভাইদের ঠিক নিচে। উন্মত্ত ভিড় ওনাদের দরজা ভেঙে ঢুকে স্ত্রী এবং শিশুদের একটি ঘরে বন্ধ করেছে। তারপর অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে মুজিবভাইকে বেধড়ক মারছে, চাবুক চালাচ্ছে। মুজিব সাহেবের আর্তনাদের সঙ্গে আক্রমণকারীদের হাসি আর বিদ্রুপ ভেসে আসছে। ভিতরের ঘরে ওনার স্ত্রী এবং বাচ্চারা হাউহাউ করে কাঁদছে শুনতে পাচ্ছি। যতক্ষণ মুজিব সাহেবের জ্ঞান ছিল, ততক্ষণ এই অত্যাচার চলেছে।
পরে যখন আমার বাবা ওনাকে দেখতে গেলেন, তখন তিনি মৃতপ্রায়। সারা শরীর রক্তাক্ত, হাত পা আর পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। অমানুষিক যন্ত্রণায় মারা যাওয়ার জন্যে উন্মত্ত জনতা ওনাকে ফেলে রেখে গেছে।
আর কিছু সিঁড়ি ভেঙে ওরা আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটে ঢুকতেই পারত। কিন্তু তখনই অলৌকিক ঘটনাটি ঘটে। ওরা যে কেন নিচে নেমে বিল্ডিং ছেড়ে লাঠি, রড আর চাবুক নাচাতে নাচাতে কলোনির অন্য অংশে মারধর করতে গেল জানি না। সম্ভবত বাবার অনড় বিশ্বাসের জন্যে আল্লা ওনাকে পুরস্কার দিলেন।
সেই রাতে চারপাশের শূন্যতায় আমি কয়েকজন বাঙালি মহিলাদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, “কী বিহারিরা, শুনতে পাচ্ছ? তোমাদের যারা সহায়, সেই পেয়ারের পাক সেনাদের ডাকছ না কেন? কেন ওরা এসে তোমাদের বাঁচাচ্ছে না? কোথায় ওরা? মরবার জন্যে এখানে ফেলে গেছে তোমাদের। আমরা তোমাদের সবাইকে শেষ করব।” ওদের বিদ্রুপ রাতের হাওয়ায় অনেকটা সময় ধরে ভেসে ছিল। আমাদের দুর্দশা আর হতাশা বাড়িয়ে।
পরের দিন দুপুরে অটোম্যাটিক বন্দুকের গুলি চলছে শুনতে পেলাম। নতুন করে ভয় পাচ্ছি আমরা। কিছুক্ষণ পরে আমাদের দরজায় টোকা। বাবা দরজা খুলে দেখলেন আমাদের বাঙালি প্রতিবেশী মান্নান সাহেব এসেছেন। উনি বাবাকে ফিসফিস করে জানালেন মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন এসে সব বিহারিদের গ্রেপ্তার করছে। উনি আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। নিজের বাড়িতে আমাদের লুকিয়ে রেখে আমাদের গ্রেপ্তারি থেকে বাঁচাবেন। আমরা ওনার বাড়িতে গেলাম। ওনার পরিবার আমাদের ভালোভাবে দেখাশুনা করলেন। রাতে যতক্ষণ না মুক্তিবাহিনী ওখান থেকে গেল, ততক্ষণ আমরা ওখানেই ছিলাম। তারপর নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে জানলাম মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আরেক প্রতিবেশী হাজি আবদুল বারি-র সঙ্গে দরজা ভেঙে আমাদের গ্রেপ্তার করতে ঘরে ঢুকেছিল।
ছেলেদের বাড়িতে না পেয়ে হাজি তো ক্ষেপে লাল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা সেই সুযোগে ঘর তছনছ করে হাতের কাছে যা টাকাপয়সা, গয়না আর মূল্যবান যা কিছু পেয়েছে, নিয়ে গেছে। সেদিন ৪০০ জন পুরুষ এবং ছেলেদের ধরে নিয়ে গেছিল মুক্তিবাহিনী। এমনকি, ৫ বছরের বাচ্চাকেও ওরা ছাড়েনি। ওদেরকে রমনা পুলিশ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকজন ‘আসামী’ চার-পাঁচ দিনে ফিরে আসে। কিন্তু অনেকে ফেরে না। ওদেরকে জেলবন্দি করা হয়েছে না মেরে ফেলা হয়েছে কেউ জানে না।
ঢাকার উপকণ্ঠে মহম্মদপুর আর মীরপুর কলোনি। সম্ভবত এগুলিতেই পূর্ব পাকিস্তানে বাস করা বিহারিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুক্তিবাহিনীর প্রথম কয়েকটি ইউনিট ১৭ই ডিসেম্বর ভোরবেলায় মীরপুরে পৌঁছায়। যথেষ্ট পরিমাণে মর্টার, মেশিনগান আর রাইফেল নিয়ে। মীরপুর ব্রিজে ওদের পথ আটকায় বিহারী রাজাকারেরা। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ওরা ওখানে পাহারা দিচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা জানত ওখানে আর পাক সেনাদের কেউ নেই। তাই রাজাকারদের ওরা বারবার ব্রিজের পথ ছেড়ে আত্মসমর্পণ করতে বলে। কিন্তু যতক্ষণ শেষ রাজাকারের দেহে প্রাণ ছিল, সেই তিন ঘণ্টা ধরে ওরা মুক্তিবাহিনীকে ঢুকতে দেয়নি।
তারপর মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা মীরপুর ১ আর ২-এ ঢুকে বাড়িগুলি লক্ষ করে ফিল্ড গান চালাতে থাকে। প্রায় ৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পরে ওরা ঘোষণা করে বাঁচতে হলে সবাই যেন ঈদগাহ-র ময়দানে চলে যায়। ওরা সব বাড়ি পুড়িয়ে দেবে। অন্য কোনও উপায় না থাকায় সবাই দৌড়ে ময়দানে পৌঁছায়। পুরুষ, মহিলা আর শিশুদের ভিড়ে ময়দান যখন ঠাঁসা, তখন ওরা চারপাশ দিয়ে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে।
সেই ভয়ঙ্কর সময়ে যে অসংখ্য হত্যালীলা সংগঠিত হয়, এটি তাদেরই একটি।
বিকেল নাগাদ ভারতীয় সেনার একটি ইউনিট মীরপুরে পৌঁছায়। সেই ভয়ানক দৃশ্য দেখে তারা সবাই শিহরিত। ময়দান জুড়ে হাজার হাজার মৃতদেহ পড়ে আছে। ঘাস আর সবুজ নেই, রক্তে টকটকে লাল। অবস্থা দেখে ওরা রিইনফোর্সমেন্ট চেয়ে পাঠায় এবং মহম্মদপুর ও মীরপুরের দখল নেয়।
সত্যি বলতে, একটা বা দুটো জায়গাতেই ধ্বংসলীলা চলেনি। অবাঙালি উর্দুভাষী সেইসব মানুষ যাদের সবাই ‘বিহারি’ বলে— তাদের গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছিল। ১৯৪৭ থেকে এই মানুষগুলি পূর্ব পাকিস্তানে আছে। অনেকে এর আগে থেকেই বসবাস করছিল। বাঙালিদের সঙ্গে মিলেমিশে ভাইয়ের মতো এতদিন ধরে ছিল। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে ওদের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে ঘৃণার এমন স্রোত এসে পড়ে? কারণটা কিন্তু সোজা।
শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামি লিগ ১৯৭০-এ পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জেতে। সরকার গঠন করে পাকিস্তান শাসনের অধিকার অর্জন করে তারা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক কর্তারা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা মিলে আওয়ামি লিগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। এতে শুধু আওয়ামি লিগ নয়, পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষরাও ক্ষেপে যায়। আওয়ামি লিগ ঘোষণা করে এই অকথ্য অবিচারের প্রতিবাদে ২৩শে মার্চ (পাকিস্তান দিবস) প্রদেশের কোথাও কোনও উদযাপন হবে না। এবং সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলিত হবে। যদি কেউ পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে, তাহলে তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে কড়া শাস্তি দেওয়া হবে। বিশেষ করে, বিহারি সম্প্রদায়কে বলা হয় বাঙালিদের সঙ্গে সংহতি দেখিয়ে তারা যেন পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন না করে। কারণ, তাদের মনে হয়েছিল এমনটা করলে ধরে নেওয়া হবে তারা বাঙালির শত্রু।
বিহারিরা পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলে যে তারা পাকিস্তানি। পাকিস্তানের জন্যেই তারা মুলুক ছেড়ে এখানে এসেছে। পাক সেনার উপরে তাদের আস্থা ছিল। তারা বিশ্বাস করত পাক সেনাবাহিনী ওদের রক্ষা করে যথাশীঘ্র পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেবে। তাই আওয়ামি লিগের সতর্কতায় তারা কান দেয়নি। মীরপুরে জলের ট্যাঙ্কের উপরে তারা এত বড় একটা পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করে যে এক মাইল দূর থেকে দেখা যায়।
পতাকাটি বাঙালিদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে বিহারিরা পাকিস্তানভক্ত এবং পাকিস্তান থেকে নিজেদের আলাদা করবার লড়াইয়ে বিহারিদের সাহায্য পাওয়া যাবে না। বিভেদের রেখা এভাবেই টানা হয় যার রক্তাক্ত পরিণাম ইতিহাস থেকে আর মুছবে না।
ফলত, বিহারি সম্প্রদায়ের বড় একটা সংখ্যার মানুষ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়। যারা বেঁচে যায়, তাদের এক অংশ পশ্চিম পাকিস্তানে পালাতে পারে। আর যেসব দুর্ভাগা পারেনি, তারা ঢাকার শরণার্থী শিবিরগুলিতে অবর্ণনীয় দুর্দশায় এখনও দিন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এই হতদরিদ্র বিহারিদের পাকিস্তানি হিসেবেই দেখে আসছে। এবং পাকিস্তান সরকারকে বলছে এদেরকে নিয়ে যাও। আজ অবধি পাকিস্তান সরকার এই মানুষগুলির প্রত্যাবাসনের দাবি অস্বীকার করছে, যারা নিজেদের আত্মীয়পরিজন ত্যাগ করে সর্বস্ব হারিয়েছে এবং নিঃস্ব হয়েও পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসায় নিজেদের জাতীয়তা পাল্টায়নি।