বিপুল চক্রবর্তী
কবি
প্রতি ১২ মিনিটে একজন কৃষক আত্মঘাতী হন এই দেশে। এই-ই ছিল খবর এতদিন। আমরা তা নিয়ে হা-হুতাশ করেছি। কেউ আহা-উহু মার্কা পদ্য-টদ্যও লিখেছি। কেউ বা প্রতিবাদী মিছিলেও হেঁটেছি। কটি পদ্য লিখেছি বা কটা মিছিলে হেঁটেছি, সেসব প্রশ্ন অবশ্য না-ওঠাই ভাল!
আজ, ১২ লক্ষ কৃষক দূর পঞ্জাব থেকে মাঠপাথার পেরিয়ে হাজির হয়েছেন রাজধানী দিল্লিতে, তাঁদের সঙ্গে এসেছে ৭৪ হাজার ট্রাক্টর। কেউ-কেউ অবশ্য বলছেন, ১২ নয়, ৯ লক্ষ কৃষক। তাই-ই সই। তাঁরা আবারও বলছেন, ৭৪ নয়, ট্রাক্টর প্রায় ৬৪ হাজার। বেশ, তা-ও সই। তবে, আমার এই নাতিদীর্ঘ লেখাটির বিন্যাসের কারণে আমি উল্লেখ রাখতে চাইছি যে, ১২ মিনিটে একজন কৃষকের আত্মহননের প্রতিকার চেয়ে আজ ১২ লক্ষ কৃষক জোট বেঁধে জড়ো হয়েছেন দিল্লি শহরের উপকণ্ঠে। চালচিত্র কী ভীষণ পালটে যাচ্ছে, না!
পুলিশ বা সেনা যেন তাদের অঞ্চলে ঢুকতে না-পারে, তাই এতদিন রাস্তা কেটে রাখতে দেখা গেছে বিদ্রোহীদের-বিপ্লবীদের (থুড়ি, ‘টেররিস্টদের’)। ‘ঘেঁটে-ঘণ্ট’ মাথা নিয়ে আমরা কী বলব, কী করব বুঝে উঠতে পারিনি। সোশাল মিডিয়ায় অবশ্য ‘হ্যাঁ’-‘না’, ‘হ্যাঁ’-‘না’-মার্কা (বস্তুত তা হ্যানাত্যানা) ড্রিবলিং-এই ব্যস্ত থাকতে দেখেছি অনেককে। মিছিল হয়নি? মিছিলে হাঁটেনি কেউ? না, তেমন বিশেষ কিছু মনে করতে পারছি না। যতটুকু যা হয়েছে, তা ওই বিষদাঁত-ভাঙা নকশালদের কাজ, আরবান নকশাল।
আজ, পঞ্চনদীকে পাগড়িতে বেঁধে আনা কৃষকদের যখন জলকামান কাবু করতে পারছে না, পুলিশকেই তখন রাস্তা কেটে তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। বৃথা চেষ্টা সেইসব। লক্ষ লক্ষ মানুষের খেটে-খাওয়া হাত মুহূর্তে সেই গর্ত বুজিয়ে পথচলা অব্যাহত রেখেছেন তাঁদের। চালচিত্র কীরকম উলটে যাচ্ছে, পালটে যাচ্ছে!
গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গীদের মনে আছে? আসিফা বা মনীষাদের মনে আছে নিশ্চয়! আশা করি মনে আছে, এই প্যানডেমিকের ঠিক আগেকার শাহিনবাগ আর জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীদের! হ্যাঁ, এই সবের ভিড়ে ২০১৭-য় মহারাষ্ট্রের কৃষকদের সেই লং মার্চকে যেন ভুলে না-যাই আমরা। ২০১৯-এর কৃষক-বিক্ষোভকেও যেন মনে রাখি। মনে পড়ছে, আমি সে সময় বেশকিছু লেখা লিখেছিলাম। চার লাইনের একটি পদ্যও ছিল, এইরূপ—
আসুক বান মুছুক শোক
ক্লিষ্ট নদী বহতা হোক
আমার সব ইচ্ছে আজ
তার শপথ তার বাহক(কৃষক বিক্ষোভের সমর্থনে)
আজও, এই কৃষক-আন্দোলনের সমর্থনে লিখতে বসে প্রথমদিনই লিখেছি—
জলকামান বাঁধবে কী রে
পাঁচটি নদী বেঁধেছি শিরেসঙ্গে আরও আসছে নদী
ছাড়তে হবে তোদের গদিফলায় মাঠে আহার যারা
তারাই নদী, পাহাড় তারাঅনেক হল — এবার তবে
তোদের গদি ছাড়তে হবেস্লোগান ওঠে: দিল্লি ঘেরো
কেউ যাবে না ঘরে ফেরতঘিরছে দেশ — সাগর, নদী
ছাড়তে হবে তোদের গদি(দিনের স্লোগান লিখি)
যদি মনে রাখি, যদি ভুলে না-যাই উক্ত ঘটনাক্রমকে, তা হলে কিছুতে আর কৃষকদের এই আন্দোলনকে আলটপকা মনে হবে না, বা স্বতঃস্ফূর্ততা-দুষ্টও মনে হবে না। মনে পড়বেই, শাহিনবাগের পাশে দাঁড়ানো পঞ্জাবের সেই বুলন্দ সাথীদের। শাহিনবাগের দাদি তাই আজ এই কৃষকদের সমর্থনে আবারও রাস্তায় নেমেছেন। কৃষকদের দিল্লি আসার পথে, পথ-মধ্যে তাঁদের হাতে-হাতে খাদ্য তুলে ধরেছেন শাহিনবাগের অন্যান্য সাথীরা।
অন্যরকম কিছু অসুবিধে অবশ্য হতে পারে আমাদের। যেমন, মনে হতেই পারে যে এরা তো সেই ছেঁড়া-ফাটা চেহারার মানুষগুলো নয়, যাদের আমরা এতকাল ধরে মনে-মনে জানি। স্মৃতি থেকে একটি কথা উঁকিঝুঁকি মারছে, বলেই ফেলি। শঙ্কর গুহনিয়োগীর অকালপ্রয়াণের পরে রাজহরা গিয়েছি। একটি জিপে চড়ে শ্রমিকদের মহল্লায় মহল্লায় ঘুরছি। জিপটি শ্রমিক ইউনিয়নের। জেনে কিছুটা বোকার মতোই জিজ্ঞেস করি, শ্রমিকদের জিপগাড়ি? উত্তরে শ্রমিক ইউনিয়নের এক সাথী বলেন, শ্রমিকরা গরিব কিন্তু ভিখিরি নয়, বিপুলজি!
আমাদের নিজেদেরও বুঝি বা সমূলেই বদলানোর এক সময় এসেছে। ভারতবর্ষের ভিতর থেকে মাথা তুলছে এক বিকল্প ভারতবর্ষ। অতীতের তেলেঙ্গানা বা তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে নিশ্চয়ই তার সম্পর্ক খুঁজতে হবে, কিন্তু হুবহু মিল খুঁজে বোকা হতে হবে। কেননা সবকিছুই, কেউ চাই বা না-চাই, পরিবর্তন হতে-হতেই এগিয়ে চলে। আমার মতো কেউ যেমন খাতা-কলম ছেড়ে ল্যাপটপ বা মোবাইলের নোট-এ লিখতে অভ্যস্ত হই, তেমনই মাঠে-মাঠে ট্রাক্টর বা জলের জন্য শ্যালো পাম্পে অভ্যস্ত হন কৃষকেরা, আর কম্পিউটারাইজড/সেমি-কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিকে মেনে সেই তো পাথরই ভাঙেন শ্রমিকেরা। প্রতি ১২ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেন, শ্রমিকেরা পাথর চিবোন।
কয়েকদিন আগে কোথায় যেন কানহাইয়ার একটি বক্তব্য শুনে ভাল লাগল। কানহাইয়া বলছিলেন, এটা ব্যালকনিতে পুদিনার চাষ নয়। ঠিক তাই। এই চাষবাস ধানের, গমের ও আরও অজস্র শস্য আর আনাজপাতির। এই চাষবাস আমাদের সকলেরই প্রাণধারণের। এই চাষবাস ভারতবর্ষকে লুটেরার হাত থেকে রক্ষা করার। এই চাষবাস বহু বর্ণের ও বহু মানুষের ভারতবর্ষকে আরও একবার নতুন করে খুঁজে পাওয়ার জন্য।
আমি কবিতাপ্রয়াসী অতি সামান্য একজন। জানি, আমার কবিতায় গাছের একটি পাতাও নড়বে না। তবু লিখি। মাটি ও মানুষ থেকে ছিন্ন, এই নাগরিক হাট-বাজারের বন্দিদশা থেকে লিখি। কখনও তা কোনও বন্ধুর উদ্দেশে, কখনও বা নিজেরই উদ্দেশে—
না থাক ও-হাতে দলীয় পতাকা
না থাক ও-হাতে হেঁসো
নেমে এসো তুমি, ভাতের দিব্যি
রাস্তায় নেমে এসোরাস্তা তোমাকে রাস্তা দেখাক–
জমে-থাকা যত শোক
রাস্তার বাঁকে খুঁজে পাক সাথি
রাস্তায় দেখা হোকনা থাক ও-মুখে শেখানো বুলিটি
হোক ভাষা হোক অন্য
মিছিলে মিলুক এই মহাদেশ–
সকলের ভাষা অন্নধানের দিব্যি– গমের দিব্যি–
নামো রাস্তায়, নামো
বণিক জানুক, মরেনি মানুষ
আছে তার সংগ্রামওপুরুত-মোল্লা-নেতারা জানুক
এ দেশ তাদের নয়
বহু বর্ণের শোণিতে ও ঘামে
আমাদের পরিচয়ধ্বংস করতে এই দেশ, যারা
উদ্যত, কাড়ে গ্রাস
বজ্রের মতো নেমে এসো, গাও
তাদের সর্বনাশ(ভাতের দিব্যি)
এইখানেই হয়তো লেখাটি শেষ করা যুক্তিযুক্ত হত। কিন্তু, ইচ্ছে করছে আরও কিছু কথা বলার! এখন অঘ্রাণ মাস। ফসলের ঘ্রাণ চারিদিকে। ফসলের লুটেরাকে রুখে দিতে পাঞ্জাবের, মহারাষ্ট্রের, রাজস্থানের, উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা ভারতবর্ষের মানচিত্রের সবদিকের সব মানুষকে জাগ্রত করে তুলেছেন ও অতন্দ্র প্রহরায় নিযুক্ত করেছেন। আমরা আর যেন ঘুমিয়ে না-পড়ি। জাগরণের আয়ূধ হিসেবে আমাদের সঙ্গে থাক বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা—
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি, সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওঙ্কার।
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।(অন্ন দেবতা)
আর, এই কবিতাটি পাঠের সঙ্গে-সঙ্গেই যে শ্লোকটি মনে পড়বে আমাদের, যার কথা উগ্রহিন্দু রাষ্ট্রনায়ক ও তার পদলেহীদের বিস্মরণে যেতে পারে, আমরা কিন্তু তাকেও আয়ূধ করে নিতে ভুলব না—
অন্নমিতি হোবাচ সর্বাণি হবা ইমানি ভূতান্নমেব
প্রতিহরমাণানি জীবন্তি সৈষা দেবতা….(ছান্দোগ্যোপনিষৎ)
ভারতবর্ষের ভিতর থেকে মাথা তুলছে এক বিকল্প ভারতবর্ষ। আমার কাছে, আমাদের কাছে, সেইটেই ভারতবর্ষের অবিকল্প, আদি প্রতিমা। সেই অপরূপ, অবিকল্প ভারতবর্ষের কাছে আমার আর একটি সামান্য পদ্য রেখে এই গদ্যের সমাপ্তি টানা যাক এইবার—
ঘুঘুতে চাষি ও চাষ
এভাবে কি করবে সাবাড়দারুণ অঘ্রাণ মাস
কৃষকেরা রাস্তায় আবারআদানি আম্বানি ঘুঘু
ঘুঘু আরও রঙবেরঙেরওপার্লামেন্টে সব ঘুঘু
তাই এই পার্লামেন্ট ঘেরোঘুঘুটি দেখেছ, তুমি
কৃষকের ফাঁদ তো দেখনিও শস্য, ও জন্মভূমি
তোর পাশে আমার লেখনী(ও শস্য, ও জন্মভূমি)