Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

খণ্ডচিত্রে মধ্যভারতের গোণ্ড আদিবাসীদের রাজকাহিনী– এক

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 

ভূমিকা এখানে

সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে যে চিত্রলিপি পাওয়া গিয়েছে তাই নিয়ে সম্প্রতি কর্নাটক বিশ্ববিদ্যালয় সমর্থিত একটি গবেষণার মাধ্যমে তিরুমল মোতি ‘কাঙালী’ প্রতিপন্ন করেছেন যে মধ্যভারতের গোণ্ড আদিবাসীদের, তাদের টোটেম-মণ্ডিত প্রাকৃত ভাষা (যার কোনও লিপিত আকার পাওয়া যায়নি)-র ব্যবহার করে সেই লিপির অর্থ অনুধাবন করা যায়। কর্নাটকের হাম্পি ছাড়াও অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, ছত্তিসগড় ও মধ্যপ্রদেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন গুহালিপির সাথে সিন্ধুলিপির নানান সাযুজ্য থেকেও সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত দ্রাবিড় ও আদিবাসী গোণ্ড সভ্যতার নানান উত্তরাধিকার প্রকট হয়। অথচ মূলধারার ইতিহাসচর্চায় এসবের পাঠ হয় না। কারণ মূলধারা আর্যবাদী।

আসলে, ইতিহাসের সেই কোন ধূসর অনাদিতে সুরাসুরের লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়ার সুরেরা, মানে আর্যজাতি অ্যাসিরিয়ার অসুরদের পরাভূত করতে করতে ঠেলতে ঠেলতে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে এনে ফেলল, সেই থেকেই গোলযোগের শুরু। এই গোলযোগের চোটে অনেক কিছু হারিয়ে যেতে থাকল গত ৬ হাজার বছর ধরে। তার মধ্যে একটা হল মধ্যভারতের মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রে রাজ্যে রাজ্যে বিস্তীর্ণ গোণ্ডওয়ানা ভূভাগে বসবাসকারী, তাঁদের সাড়ে সাতশোটি টোটেম-নির্দিষ্ট পদবী-ধারী ‘গোণ্ড’ আদিবাসীদের ইতিহাস ও কৌমযাপন কেন্দ্রিক প্রাকৃত-প্রজ্ঞা। অথচ এক কালে গোণ্ড আদিবাসীদের রাজ্যপাট এতই বিস্তীর্ণ ছিল যে এই সেদিনও, এমনকি বছর নব্বুই আগে বিভূতিভূষণ যখন আরণ্যক লিখছেন তখনও, গোণ্ডদের বলা হত রাজগোণ্ড। সেই সূত্র ধরেই, এই লেখায় আমরা দেখে নেব গোণ্ড আদিবাসীদের বিভিন্ন প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাজা-রাণী-রাজবংশদের খতিয়ান।

সাঁওতাল আদিবাসীরা যেরকম মহিষাসুরকে তাঁদের রাজা মনে করেন, তেমনই গোণ্ড আদিবাসীরাও ভৈঁসাসুরকে রাজা মনে করে পুজো করেন। মধ্যপ্রদেশের রাহিলখণ্ডে অবস্থিত রয়েছে মহিষাসুরের প্রাচীন থান, এমনকি মাইসোর বা মহীশূর নামের পিছনেও হয়তো নিহিত রয়েছে প্রাচীন যুগের এই বীর আদিবাসী শহীদের নাম, যাকে আর্য-হিন্দুদের পুরাণও উপেক্ষা করতে পারেনি যখন মাতৃউপাসনার সাধনাকে তাঁরা একটু একটু করে ছিনিয়ে নিচ্ছিলেন বহুজন-দলিত-আদিবাসী (একত্রে ‘indigenous’ তথা মূলবাসী না মূলনিবাসী) ঔপমহাদেশিক কৌমলোক থেকে। একইরকমভাবে, যে সব নানান দস্যু ও অসুরদের বধ করে পুজো পেয়েছেন আর্য হিন্দু দেবদেবীরা, তাঁরা সকলেই বিভিন্ন মূলবাসী সমাজের দলপতি ছিলেন। বেদ ও বেদোত্তর পুরাণসমূহের অসুর ও রাক্ষসদের সময় পেরিয়ে, রাবণের সময়ে এসে দেখা যায়, আর্যাবর্ত, মানে, উত্তর-উপমহাদেশ, ঘোর সংগ্রামে লিপ্ত হচ্ছে দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় তথা দাস-দস্যু-অসুর-রাক্ষস-মূলবাসী মানুষদের সাথে। এই রাবণকে তাঁদের ঐতিহাসিক দলপতি হিসেবে আজও উপাসনা করে চলেছেন মধ্যভারতের পাহাড়-জঙ্গলের নিবিড় ছায়ায় লালিত গ্রামে গ্রামে, নারে নারে, (গোণ্ড ভাষায় গ্রামবাচক শব্দ– ‘নার’) গোণ্ড আদিবাসীরা প্রাচীন মিথষ্ক্রিয় ইতিহাসের বহতা উজানে।

সমগ্র বিন্ধ্যা-সাতপুরা (গোণ্ড আদিবাসীদের ভাষায় সাতপুরা পাহাড়শ্রেণীর নাম–- সৎপুঢ়া)-দণ্ডকারণ্যর গোণ্ড আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার একত্রনাম গোণ্ডওয়ানা। এই নামের উৎপত্তিক্রম যাই হয়ে থাকুক, এই নামের প্রভাবেই উনবিংশ শতাব্দীর ভুগোলবেত্তাদ্বয় এডুয়ার্ড সুয়েস (১৮৩১-১৯১৪) ও ওয়েগেনার (১৮৮০-১৯৩০) তাঁদের প্লেট তত্ত্বে পৃথিবীর দক্ষিণপ্লেট গোণ্ডওয়ানাল্যাণ্ডের সাথে উত্তরপ্লেট অ্যাঙ্গোরাল্যাণ্ডের টেথিস-সাগরিয়া সংঘাত-সংঘর্ষণে হিমালয় পাহাড়ের জন্মতত্ত্ব লিখে রাখলেন। কিন্তু ইউরোপ ও আলোকপ্রাপ্ত অশ্বেতাঙ্গ আর্য ইতিহাসবেত্তা, নৃবেত্তারা যা লিখে রাখলেন না তা হল এই গোণ্ডওয়ানা অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী রাজাদের নাম। অবশ্য হিন্দিভাষার আঞ্চলিক সাহিত্যে মধ্যভারতের আদিবাসী লেখক-ইতিহাসান্বেষকের কলমে ধরা পড়ল বিভিন্ন গোণ্ড রাজাদের নাম। মাঁসারাম কুমরে এবং এস বি সীডামের কলমপথ অনুসরণে সেই সব রাজাদের একটা লিস্ট দেওয়া হল।

১) বৃত্রাসুর-– প্রাগার্য তথা সিন্ধু সভ্যতার সময়কার আদিবাসী রাজা। এঁর পরম আর্য শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ঋগবৈদিক রাজা ইন্দ্রকে।

২) ভরত-– বৃত্রাসুরের পুত্র ভরত। এই ভরত রামায়ণের অথবা ‘রাজার প্রসাদভোজী রাজকবি’ কালিদাসের বর্ণিত ‘লম্পট’  রাজা দুষ্মন্তের মৃগয়াকালে ‘কপট আদরে’ গর্ভিনী শকুন্তলাপুত্র ভরত নয়। ঋগ্বেদের শ্লোক নং ৩.৩৩-এ রথ ও শকট-এর দুই স্ফীত নদী পারাপারের বর্ণনাত্মক একটি গানের মাধ্যমে আর্য-হিন্দু সভ্যতার আদিগ্রন্থ ঋগবেদ এক উপজাতি হিসেবে প্রথম নিচ্ছে ‘ভারত’ নাম। এই উপজাতির নামের পিছনে কি বৃত্রাসুরপুত্র ‘ভরত’-এর নাম উঁকি দিচ্ছে? আর এই দেশের নামচিহ্নের পিছনেই কি তবে উঁকি দিচ্ছে ভরত তথা ‘ভারত’ উপজাতির নাম?

৩) শম্বর-– ভরতপুত্র শম্বরের নাম ভয়াল ‘দানব’ হিসেবে ঋগবেদে বার বিশেক উল্লেখযোগ্যতা পেয়েছে। সেই দেখে মনে হয় হয়তো বুঝি সেই দিনের নবাগত আর্যরাষ্ট্রের ব্রাহ্মণদের থরথরি কম্পমান করেছিলেন এই শম্বর। রাহুল সংকৃত্যায়ন আর্যবাহিনীর সাথে শম্বরের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করছেন হিমাচল প্রদেশের ‘কাঙড়া ভ্যালি’ অঞ্চলকে। আর্য দিবোদাস ও ইন্দ্রের সাথে লড়াই করে শম্বর ও তাঁর বীর জেনারেল শূন্য, বগৃদ, করঞ্জ, পর্ণজ, পিপ্রু এবং ওয়ার্চিরা সেই শম্বরের ৯১টি দুর্গ রক্ষা করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, চল্লিশ বছরের লম্বা লড়াইয়ে বিজেতা হন আর্যবাহিনীর দিবোদাস। শাম্বাসুরের এই কাহিনী ডকুমেণ্ট করেছে ঋগবেদ।

৪) বাণাসুর-– বৃত্রাসুরের এই বংশধর রাজা আর্যশক্তির লুঠে নেওয়া কিছু অঞ্চলকে, সামান্যকালের জন্য হলেও, প্রাগার্য কৌমের কাছে ফেরৎ আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৫) মহিষাসুর-– সম্ভবতঃ ছোটনাগপুর অথবা মধ্যভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের রাজা মহিষাসুরকে ঘিরে আদিবাসী-অনাদিবাসী মহলে নানান পূজাপাঠ, রীতিরেওয়াজ জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। সন্থাল আদিবাসীরা দশমীর দিন ‘হুদুর দুর্গা’র পুজো করেন। সাদা পোষাক পরে, সাদা কাপড়ে অস্ত্রশস্ত্র মুড়ে, ট্র্যাজিক গানে গানে খুঁজে ফেরে তাঁদের হেরে যাওয়া রাজা মহিষাসুরকে। গানের মর্মভাঁজে থাকে আর্তি-– হারিয়ে যাওয়া, লুকিয়ে থাকা রাজা মহিষাসুরের প্রতি, থাকে সেই রাজার ফেরত আসবার ইঙ্গিত। আর সেই ইঙ্গিতেই আবার লুকোনো অস্ত্র বের করে কৌমে কৌমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আর্যদ্রোহী অঙ্গীকার। আবার বস্তারের গোণ্ড আদিবাসীদের পরমপূজ্য ভৈঁসাসুরও এই মহিষরাজারই নামান্তর। বিজিতের ‘বিজয়া’ দশমীর সময়ে দান্তেশ্বরী মন্দির কেন্দ্র করে রাজারাজরাদের রথমেলার ধূম, তাঁর পিছনেও হয়তো সেই রথে চেপে আসা আর্যরা, যারা ওড়িশার শবর বা সৌর/সরো আদিবাসীদের থেকে কেড়ে নিয়েছিল জগন্নাথ আর সূর্য্যদেবের মন্দিরগুলি। যুদ্ধকালীন ইতিহাসের ইঙ্গিত।

হিন্দুদের শাক্ত উপাসনায় শক্তির নারীরূপকের আবরণের সঙ্গে পেট্রিয়ার্কির সংঘাত-অভিঘাত গভীরে গিয়েছে। লোকবিশ্বাসের এক দর্শন দিচ্ছে দুর্গা দ্বারা মহিষাসুরকে সিডিউস তথা হানি-ট্র্যাপ করে বধ করার কাহিনী। এই কাহিনী দিচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক প্রেক্ষণের কূটাভাস। আবার অপর তথা হিন্দুপক্ষ, দুর্গা-মহিষাসুর যুদ্ধের কাহিনীর পাঠে উচ্চবর্ণের দুর্গাকে জিতিয়ে দিচ্ছে যারা, তাঁদের পরম ভক্তির আগার দুর্গাপুজোর প্রচলনের মাধ্যমে পলাশী-যুদ্ধোত্তর ইতিহাসের পালাবদল পর্বে যখন নবাবদের হারিয়ে দেওয়া সেলিব্রেট করছেন অ্যাঙলো-হিন্দু আর্যসমাজের প্রধান ক্লাইভ, নবকৃষ্ণ, কৃষ্ণচন্দ্রাদি রাজা, তখন তাঁদের শ্রেণীস্বার্থ, বর্ণস্বার্থ সব একাকার হয়েছে বর্ণবিদ্বেষী অসুরদলনী উদযাপনে। এই হিন্দুকাহিনী তাই দিচ্ছে বর্ণযুদ্ধ বিজয়ের অসুররক্তস্বাদ। আদিবাসী নানান রীতিপ্রথা, যেমন মহিলাদের রজঃক্ষরণকালে আলাদা কক্ষে থাকার এবং পবিত্র অঞ্চলে না যাওয়ার বিধান, গোটূলের মেয়ে বা মেটিয়ারিদের গোটূলঘর সাফসুতরো রাখার আর ছেলে বা চেলিকদের জন্য হান্টিং, কাঠ-সংগ্রহাদি আউটডোর অ্যাক্টিভিটিস-এর শ্রমবণ্টনের মাধ্যমে দেখা যায় পুরুষ-নারীর পেট্রিয়ার্কড বিভাজন। এসবের মতোই আরেকটা পেট্রিয়ার্কাল হিসেব দুর্গাকে দেহব্যবসায়ী রমণী হিসেবে দেখা। আবার অপরদিকে দুর্গাপুজো করা হিন্দুদের রাজা মহিষাসুর ও তাঁর প্রজাদের গত ৬ হাজার বছর ধরে করে আসা আদিবাসী ও লোকায়ত সম্প্রদায়সমূহের প্রতি করে আসা সীমাহীন অবজ্ঞা বিভিন্ন বর্ণবাদী আঘাতের এক অংশ। ২০১৬তেও দান্তেওয়াড়ার দান্তেশ্বরী মন্দিরের হিন্দু ম্যানেজিং কমিটির জোগাড় করা কিছু গোণ্ডগ্রামের ভীতচকিত মাঁঝিরা ছত্তিসগড় পুলিশের হিন্দু-সামাজিক চাপে বলে উঠল যে দুর্গা তথা শক্তি তথা দান্তেশ্বরী নাকি আদিবাসীদেরই আপন দেবী, রাক্ষস মহিষাসুর নাকি আদিবাসীদের পূজ্য নয়। এই কথন উঁকি মারল বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে। আবার দুর্গামূর্তি বানানোর বিষয়ে হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত উৎকট পেট্রিয়ার্কাল কাহিনী আছে যে মূর্তির প্রথম মাটি নিতে হয় কোনও আদিতম জীবিকা-যাপিনীর উঠোন থেকে। সেই বিষয়ে হোয়াটস্যাপে পোস্ট করে বস্তারের হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর রোষে পড়লেন সি-পি-আই পার্টির আদিবাসী মহাসভা মঞ্চের সর্বভারতীয় নেতা মনীষ কুঞ্জাম। আবার পেট্রিয়ার্কিকেই এক পোঁচ এগিয়ে নিয়ে ফেসবুকে ‘দুর্গা রেন্ডি হ্যায়’ আপডেট করে জেলে গেলেন বালুদ জেলার তরুণ বিবেক। উত্তর ছত্তিসগড়ের এক আদিবাসী স্কলারও এই বিষয়ে চর্চা করার ঘোর ধর্মদ্রোহের কারণে নিক্ষিপ্ত হলেন হিন্দুরাষ্ট্রের কারাগারে।

এরপর …রাজকাহিনী — দুই