Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চলুন ওঁদের পাশে দাঁড়াই, দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে সামিল হই

কৌশিক বিশ্বাস

 


লেখক শিক্ষক ও গবেষক

 

 

 

অ্যারিস্টটল মনে করতেন ‘মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই রাজনৈতিক প্রাণি’। যদিও ভারতীয় মিডিয়া বা সমাজের বড় অংশের মানুষ একথাকে ‘পারফেক্ট রং’ বলে মনে করে থাকেন। এই মুহূর্তে দিল্লির সীমানা পেরিয়ে গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কৃষক আন্দোলন (বিদ্রোহ) – একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বা ঘটনা। কারণ ভারত সরকার প্রণীত নয়া কৃষি আইন ২০২০ একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবনা। সমস্ত কৃষক বিভিন্ন সংগঠনের পতাকা নিয়েই এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। শাসকের পক্ষ থেকে কৃষকদের খালিস্তানি তকমা দেওয়া হয়েছে, যা আসলে প্রমাণ করে এই আন্দোলন রাজনৈতিক।

একজন যুবা কৃষক পুলিশের লাঠির সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভীক গলায় বলেন ‘এটাই রেভলুশন’, এবং সেই মুহূর্তে ভেঙে পড়ে শাসক ও বেনিয়াদের দেওয়া ব্যারিকেড। জলকামান, কাঁদানে গ্যাস আর দিল্লির কাঁপানো ঠান্ডাকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে দিল্লি-লাগোয়া বর্ডার সিংহু অঞ্চলের দখল নেন ভারতীয় কৃষকরা। ততক্ষণে গোটা দেশের কৃষকরা সংহতি জানিয়ে মিছিলে-স্লোগানে পালন করলেন ভারত বন্ধ। চলছে দেশ জুড়ে কৃষক আন্দোলন।

কিন্তু কেন কৃষকদের এই মরিয়া মনোভাব? কারণ যে নয়া কৃষি আইন বর্তমান সরকার প্রবর্তন করেছেন তা এককথায় কর্পোরেটমুখী ও কৃষকবিরোধী। কৃষকরা বুঝছেন যে তাঁদের আজীবনের এই করুণ পরিণতির কারণ সরকারি নীতি। বিগত ২০ বছরে তিন লক্ষ ১০ হাজারেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। প্রতি ৩২ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেন এদেশে। মনে করিয়ে দিই যে বর্তমান সরকার কৃষক আত্মহত্যার রিপোর্ট তৈরি করা বন্ধ করেছেন। অবশ্য শাসকের রাজনীতি চলে কৃষক ও কৃষকের মৃত্যু নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে কারা কৃষক? সরকার জানায় যাঁদের জমি আছে এবং চাষ করেন। অর্থাৎ বাদ পড়েন সেই কৃষক যাঁদের জমি নেই অথচ অন্যের জমিতে চাষ করেন বা কৃষিকাজে নিযুক্ত। বাদ পড়েন লাখো মহিলা কৃষক। সরকারি নীতি তৈরি করে বৈষম্য। ছোট কৃষক বা প্রান্তিক কৃষকরা পরিণত হন মুমূর্ষু রোগীতে। কৃষির মৌলিক সমস্যার সমাধান আজও অধরা। এর সাথে কৃষকরা মুখোমুখি হন প্রকৃতির। বৃষ্টি বা খরা প্রতি বছর নষ্ট করে ফসল. অধরা শস্যবীমা। ফসলের উৎপাদন কমে বাড়ে বিভিন্ন কারণে। ওঠানামা করে ফসলের দাম। এই পরিবর্তনশীলতা কৃষকের জীবনে বয়ে আনে চরম দুর্দশা। যে কৃষক আত্মহত্যা করেননি তাঁরা ভোগেন অনিশ্চয়তায় এবং লড়তে থাকেন বেঁচে থাকার জন্য। এই মুহূর্তে কৃষকের গড় আয় ৬০০০-১০০০০ হাজার টাকা। কিভাবে বাঁচবেন কৃষক? এ-প্রশ্ন আলোচনা হয় না পার্লামেন্ট-এ।

২০০৪ সালে তৈরি হয় স্বামীনাথন কমিশন। কমিশন জানায় ভূমি সংস্কারের অভাব, পর্যাপ্ত কৃষি ঋণের অভাব, প্রযুক্তির প্রয়োগের অভাব, ফসল বিক্রির নিশ্চয়তার অভাব ইত্যাদি দায়ী ভারতের কৃষি সংকটের জন্য। এই কমিশন নিদান দেয় মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস যা কিনা আসল খরচ ও তার ৫০ পার্সেন্ট হিসেবে দিতে হবে কৃষকদের। মোদি সরকার ২০১৪-তে জানায় যে তারা ক্ষমতায় আসার ১২ মাসের মধ্যেই এই নিয়ম চালু করবে। গোটা দেশের আন্দোলনরত কৃষকরা লড়াই করছেন এই মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস আদায়ের দাবিতে। নতুন কৃষি আইন পরিকল্পনা-মাফিক চুপ থাকে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস দেওয়ার ব্যাপারে। এই আইন ধোঁয়াশা রাখে ফসল বিক্রি ও কিষান মান্ডির ব্যাপারে। সরকার এক অদৃশ্য বেড়াজাল তৈরি করে দেশের অন্নদাতাদের ঘিরে। মোদিজি নির্ধারিত ভঙ্গিতে হাত নেড়ে জানান এই আইন নাকি স্বাধীনতা দিল কৃষকদের। কৃষকরা স্বাধীনভাবে বিক্রি করবেন ফসল। অপূর্ব দাবি। ভারতের কৃষকদের উন্মুক্ত করে দেওয়া হল কর্পোরেট আগ্রাসনের মুখে। কারণ এই আইন যে ব্যবস্থা চালু করতে চায় তা হল, যে কোনও কর্পোরেট শক্তি যুক্ত হতে পারবেন কৃষি ব্যবস্থায়, কিনতে পারবেন ফসল, মজুত করতে পারবেন ফসল। কর্পোরেট সংস্থা কৃষকের জমিতে নিজের শর্তে চাষ করবেন, কৃষককে অর্থ দেবেন নিজের শর্ত অনুযায়ী। প্রমাদ গুনতে শুরু করেন সিঁদুরে-মেঘ-দেখা ভারতীয় কৃষকরা। এই চুক্তি হল নয়া উদার অর্থনীতিক নীতির মারণফাঁদ, যেখানে কৃষককে আত্মসমর্পণ করতেই হবে পুঁজিপতিদের কাছে। আমরা জানি কয়েক বছর আগে একটি কর্পোরেট সংস্থা গুজরাটের কয়েকজন চাষির বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকার মামলা করে। অসহায় কৃষক বুঝতে পারেন না কী করবেন, কোথায় যাবেন। এই আইন অবাক করে কেড়ে নেয় কৃষকের কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধে কোর্টে যাওয়ার অধিকার। অর্থাৎ মোদি যে স্বাধীনতার কথা বলেন তা আসলে কর্পোরেট স্বাধীনতা।

আমরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেসরকারিকরণের ফল প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি, আর অনুভব করছি অসহায়তা। ফলত, কৃষির বেসরকারিকরণ এই সরকারের নীতি। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী একটি সাদা পাতায় স্বাক্ষর করেছেন আর আইন তৈরি করেছেন তাঁর মিত্র মুকেশ আম্বানি, আদানি প্রভৃতিরা। বিখ্যাত সাংবাদিক পি. সাইনাথ যিনি গ্রামীণ ভারত নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে আসছেন, বলছিলেন গোটা দেশ বিক্রি করা হচ্ছে আম্বানিদের কাছে। কৃষকরাও বুঝেছেন, তাই তো সিংহু বর্ডারে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচু করে কোনও এক কৃষক বলেন ‘আম্বানিদের হাত থেকে বাঁচতে, শেষ লড়াই চালাব আমরা’। সুর বেঁধেই দেন লড়াইয়ের। তাই তো বিহারের এক ১৬ বছরের যুবক বলেন ‘মোদি দেশ বিক্রি করছেন, তাই আমিও ১৬ বছর বয়েসেই রাস্তায় নেমেছি। আসফাকুল্লা নেমেছিল দেশ স্বাধীন করতে, আমিও নেমেছি দেশ বাঁচাতে’। বোঝা যায় মোদি তাঁর আদর্শ মেনেই কৃষকদের ফসল তুলে দিতে চান কর্পোরেটে শক্তির হাতে, গোটা কৃষি ব্যবস্থা আম্বানিদের হাতে তুলে দিতে চান. তাই এই জান কবুল লড়াই।

এ কৃষি ব্যবস্থার সাথে খাদ্যসংকটও জড়িত। এখন মোদি সরকার কৃষিকে ক্যাশ ক্রপে পরিণত করতে চান, তা এই আইন দেখলেই বোঝা যায়। অর্থাৎ কর্পোরেটরা সেই ফসল ফলাবেন যা বিত্তবানরা সকাল-সন্ধেয় খান, অথবা বিভিন্ন ফুড কোম্পানি যে খাবার প্যাকেট করে বিক্রি করেন অথবা যে ফসল বেচে ওই সংস্থা বেশি লাভ পাবেন। এই ব্যবস্থা নিশ্চিতভাবেই তৈরি করবে খাদ্য সংকট। কারণ গরিব বা মধ্যবিত্তের ভাত-রুটি–ডাল তখন হয়ত বাজারে অমিল থাকবে। এই আইন সোজাসাপ্টা ভাবেই কর্পোরেটদের শর্তে তৈরি হওয়া বিল। এই আইন কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষকদের উন্মুক্ত করে দেয় বড় কর্পোরেট শক্তির হাতেই। সরকার আগেই বীজ তৈরি করার ক্ষেত্রে নিজস্ব দায় ঝেড়ে ফেলেছে এবং মনসান্টোর মতো কোম্পানি এখন এই কাজ করছে ভারতে। ফলত চাষিরা মোদির ‘মন কি বাতেলা’ বুঝেছেন। এবং সামিল হয়েছেন সংঘর্ষ-লড়াইয়ে।

এই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া একদিনে তৈরি হয়নি. আমরা কয়েক বছর আগেই দেখেছি মহারাষ্ট্রে লাখো কৃষক মিছিলে হেঁটেছিলেন তাদের দাবিতে। আমরা দেখেছি গোটা দেশেই চাষিরা ছোট ছোট আকারে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। এ-তাঁদের অধিকারের লড়াই। এ-লড়াই শুধু কৃষি বা কৃষকের? আমার মনে হয়, এ-লড়াই সমাজ-সভ্যতার। কারণ নিরন্ন অসহায় কৃষকরা যে লড়াই লড়ছেন তা আসলে গোটা দেশকে বাঁচানোর লড়াই, সভ্যতাকে বাঁচানোর সংগ্রাম। নরেন্দ্র মোদি যে অর্থনীতি প্রবর্তন করতে চাইছেন তা অচিরে আমাদেরও রাস্তায় নামাবে। বোধহয় এটাই সময়, চলুন গোটা দেশের কৃষকদের পাশে দাঁড়াই। চলুন দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে সামিল হই।