Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাজধানীর বুকে আজকের কিছু ঠোস বাতচিত

অশোক মুখোপাধ্যায়

 





প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

আধিকারিকরা জানিয়েছে, সরকার নাকি বলেছে, তারা এমএসপি (minimum support price)-এর বিষয়টা খতিয়ে দেখবে, আন্দোলনকারী কৃষকরা তাহলে এবার ঘরে ফিরে যাক। প্রতিনিধি কৃষক নেতারা এর উত্তরে মৌনাবস্থায় দুটো প্লাকার্ড উঁচিয়ে ধরেছেন। একটাতে লেখা— হ্যাঁ (yes); আর একটাতে লেখা— না (no)।

কিসে হ্যাঁ, আর কিসে না?

না, ওরকম ব্যাপার নয়। নেতারা বলতে চেয়েছেন, সরকার তার খতরনাক কৃষি আইন বাতিল করার প্রশ্নে সবাইকে খোলাখুলি জানাক— হ্যাঁ কিংবা না। বাতিলে রাজি হয়ে গেলে, লোকসভার অধিবেশন ডেকে নতুন বিল এনে এটাকে বাতিল বলে ঘোষণা করে দিক। ল্যাঠা চুকে যায়। আন্দোলনকারীরা ঘরে ফিরে যাবে। আর, বাতিলে রাজি না হলে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আধিকারিকরা দপ্তরে ফিরে গিয়ে সরকার বাহাদুরকে জানিয়ে দিক, আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে অটল। তারা অবস্থান তুলছে না। তারা অনির্দিষ্ট কাল ধরে দিল্লির বুকে বসে থাকবে।

পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল।

এরকমই জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল গত বছর ঠিক এই সময় এনার্সির মুদ্দা নিয়ে। বাঙালি মুসলমানের দিকে এবং সেই সুবাদে সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে তাক করা সেই দুর্বিনীত দস্যুপনার বিরুদ্ধে গোটা দেশের অবাঙালি এবং অমুসলমানরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। মুসলমান সমাজও এককাট্টা হয়ে এর বিরুদ্ধে শাহিনবাগ পার্কসার্কাস হয়ে সারা ভারতের কোণে কোণে দিনরাত ব্যাপী লাগাতার জমায়েত ও অবস্থান শুরু করেছিল, যাতে সামিল হচ্ছিল সারা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু সেবার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এসে মোদি সরকারকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধের স্বার্থেই সেই সব অবস্থান বিক্ষোভের কর্মসূচি তুলে নিতে হয়েছিল। মোদিও তড়িঘড়ি লকডাউন ঘোষণা করে স্বাভাবিক জনজীবনকে যতটা পারা যায় স্তব্ধ ও অসুস্থ করে দিয়েছিল।

এবারে করোনা পিছু হঠছে। ঠান্ডাতেও খুব বেশি রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। লকডাউনের প্রায় সমস্ত বিধিনিষেধই আলগা হয়ে গেছে। আন্দোলনকারী কৃষকদের নাকে মুখে সেই মুখোশ দেখাই যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় বিক্ষোভ তোলার জন্য কী করা যায়?

এরকম সমস্যায় নরেন মোদির সরকার আগে পড়েনি। গত প্রায় সাত বছর ধরে সরকারি ক্ষমতার জোরে যা খুশি করে যাচ্ছিল। সারা দেশের মানুষকে পাগলা কুকুরের মতো রাস্তায় রাস্তায় নাচিয়েছে, ভালো নোট বাতিল করে এক বছর ধরে ব্যাঙ্কের দরজায় দরজায় লাইনে দাঁড় করিয়ে মেরেছে, সতেরো লক্ষ লোকের চাকরি চলে গেছে শুধু বাজারে নগদের অভাবে। পঞ্চাশ শতাংশ বিদ্যুৎবঞ্চিত এবং তিরাশি শতাংশ স্মার্টফোনবঞ্চিত মানুষদের কাছে ডিজিট্যাল লেনদেনের ভাষণ দিয়েছে আর দেশের অর্থনীতি টাল খেয়ে গেছে। জিএসটি চালু করে সমস্ত অর্থ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা করে রেখে রাজ্যগুলির প্রাপ্ত অর্থ না দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে অর্থনীতি এবং জনজীবনকে বিপর্যযস্ত করে চলেছে। প্রতিবাদের রাস্তা খুঁজে না পেয়ে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রাজ্যে ভোটে এদের সরিয়ে দিয়েছে। তখন এরা টাকার থলে নিয়ে বেরিয়ে বিধায়ক কিনে কিনে এক একটা আস্ত সরকার গিলে ফেলেছে।

কাশ্মিরের জন্য সংবিধানের প্রতিশ্রুত ৩৭০ ধারা তুলে দিতে গিয়ে এরা একটা গোটা রাজ্যকে তিন টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করেছে (টুকরে টুকরে গ্যাং)। এক দেশ এক আইনের কথা বলে এই বিশ্বাসঘাতকতা করা হলেও সংবিধানের ৩৭১ ধারার গায়ে এরা হাত ঠেকায়নি, যেখানে আরও এগারোটি রাজ্যকে কাশ্মিরের মতোই কিছু বাড়তি সুরক্ষার গ্যারান্টি দেওয়া আছে। শাহিনবাগের প্রতিবাদী অবস্থান অনেকরকম কুৎসা করে ভাঙতে না পেরে এবং দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়ে রাগে জ্বলুনিতে এরা দিল্লিতে গুজরাত মডেলে মুসলিম গণহত্যা ঘরবাড়ি ধ্বংস লুঠতরাজ অগ্নিসংযোগ ও দাঙ্গাহাঙ্গামা চালিয়েছে। দিল্লি হাইকোর্টের যে বিচারপতি দাঙ্গার মূল নায়ক কপিল মিশ্রকে ধরবার জন্য পুলিশকে ধমক দিয়েছিলেন, তাঁকে সেদিনই রাত বারোটায় চণ্ডীগড়ে বদলির আদেশ ধরিয়ে দেওয়া হয়।

দেশের অসংখ্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী চরিত্রকে— তাঁদের মধ্যে সাংবাদিক, উকিল, মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, কবি, পাদ্রি, প্রমুখ আছেন— স্রেফ বিনা বিচারে আটক করা হয়েছে এবং তাদের মামলা শুরু করার কোনও ইচ্ছাই সরকারের বা তার প্রশাসনের কোনও স্তরে দেখা যাচ্ছে না। আশি বছর বয়স্ক কবি ভারভারা রাও, স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত, হৃদ্‌যন্ত্র বিকল, কোভিদ সংক্রমিত হওয়ার পরেও তাঁকে জামিন দেওয়া হল না। ফাদার স্ট্যান পার্কিন্সন্স রোগী, জেলের গারদে জল খাওয়ার জন্য উকিলের মাধ্যমে একটা প্লাস্টিকের নল পেতে চেয়েছিলেন। আদালত নিজেই তা অনুমোদন করতে পারত, না করে এনএসএ-মহাধ্যক্ষের পরামর্শ চেয়ে বসল। সেও কুড়ি দিন অনেক ভাবনাচিন্তা করে আদালতকে জানাল, দেওয়া যাবে না।

ব্যাঙ্ক লুট করে বিজয় মাল্য নীরব মোদি মেহুল চোকসিরা নিশ্চিন্তে আধার লিঙ্ক করে দেশ ছেড়ে বিলেতে চলে যায়, তাদের গ্রেপ্তার করে দেশে ধরে আনার কোনও সামান্য চেষ্টাই এই সরকার করে না। কিন্তু নির্দোষ প্রতিবাদীদের ধরে বিনা বিচারে বছরের পর বছর ফেলে রাখতে পারে। এই অবস্থাকেই নীতি কমিশনের সিইও অমিতাভ কান্ত বলেছে too much of democracy!

কথাটা নিয়ে অনেক কথা চালাচালি কাটাকাটি হচ্ছে। কিন্তু আসলে কান্ত সাহেব বোধ হয় আমাদের দেশি প্রথায় সত্য কথাটা বলে ফেলেছে। ঘরে ভাত করার মতো চাল না থাকলে আমরা সাধারণত বলি, “চাল বাড়ন্ত”। লোকের বিশ্বাস, চাল নেই বলতে নেই। কান্তও গণতন্ত্র যে নেই এটা বোঝাতেই বলেছে, দেশে এখন গণতন্ত্র বাড়ন্ত। এটা অবশ্য আমার একান্তই ব্যক্তিগত ধারণা। ভুলও হতে পারে।

শ্রেণি এবং রাষ্ট্রের গায়ে ধাক্কা লাগলে কীরকম ফোস্কা পড়ে, আমরা বইতে পড়েছি। তাত্ত্বিকভাবে জেনেছি। এখন মোদিরাজ সেই সব সত্য চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছে। এই যেমন বিপিন রাওয়াত, সেনাপ্রধান, যার চাকরিগত শর্তই হল রাজনীতির দৈনন্দিন কূটকচালি থেকে দূরে থাকা, সে এখন পরামর্শ দিচ্ছে, সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের পেনশন কমিয়ে দেওয়া হোক (কদিন বাদে ওকেও যে প্রাক্তন হতে হবে, সে খেয়াল বোধহয় নেই; অথবা, নিশ্চিন্ত, বিচারক গগৈয়ের মতো অবসরোত্তর ভাড়া খাটার চাকরি পেয়ে যাবে)। কেন না, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে প্রচুর লোকজন আছে যারা এককালে সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে।

গোটা দেশে একটা সর্বনাশা শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতি তৈরি করেও মোদির সরকার এত দিন যেভাবে বিনা বাধায় স্টিম রোলার চালাচ্ছিল, কৃষকদের এই বিক্ষোভ অবস্থানের এই কর্মসূচি তাকে এক ধাক্কায় যেন দিল্লির সদর দরজায় আটকে দিয়েছে। পাঞ্জাব হরিয়ানা রাজস্থান ইউপি হিমাচল প্রদেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ চাষিকে ব্যারিকেড দিয়ে বা জলকামান থেকে ঠান্ডা জলের তোড়ে আটকানো যায়নি। তারা দিল্লি শহরের উপান্তে এসে বসে গেছে।

কৃষি আইন, কৃষকদেরই স্বার্থে নাকি এই মসীকৃষ্ণ আইন। আর তাকেই কিনা কৃষকরা বিরোধিতা করছে, বলছে, একে সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। ওদিকে সংবাদে প্রকাশ, আদানি অ্যাগ্রোফার্ম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার খানেক বিশাল বিশাল হিমঘর নির্মাণ করে ফেলছে। কৃষি আইন চালু হলেই তারা চুক্তিচাষ করে চাষিদের থেকে সস্তায় ফসল কিনবে আর কিছু দিন গুদামজাত করে বিরূপ ঋতুতে বিক্রি করে বিপুল লাভ করতে থাকবে। যে (নির্ঘাত দু-পয়সার) সাংবাদিক— আকর্ষণ উপল— খবরটা সংগ্রহ করে বাইরে ফাঁস করে দিয়েছেন, তাকে আদানি এবং/অথবা তার ফ্যান ক্লাবের সদস্যরা গুন্ডা লেলিয়ে আক্রমণ করে এমন মারাত্মকভাবে জখম করেছে যে তিনি এখন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে। মোদির কৃষি বিলের চরিত্র এই একটি ঘটনাতেই আজ উলঙ্গ সত্যের চেহারায় প্রকাশিত।

কিন্তু এই যে বিশাল জমায়েত— এটাই আজ মোদি জুলুমরাজের বিরুদ্ধে একটা প্রবল বাধা হিসাবে এসে হাজির হয়েছে। অমিতাভ কান্তর দুঃখ সত্ত্বেও বলতেই হচ্ছে, গণতন্ত্র নয়, একে ভারভারা রাও বা সুধা ভরদ্বাজের মতো প্রশাসনিক সাঁড়াশি দিয়ে যে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না তার কারণ গণতন্ত্রের প্রতি নরেন সরকারের শ্রদ্ধাভক্তি বা দায়বদ্ধতাও নয়, সেটা তার আদৌ নেই, এর একমাত্র অসুবিধা হচ্ছে স্রেফ জমায়েতির সংখ্যা এবং শরীরী ভাষা। কয়েক লক্ষ লোককে লাঠিগুলি কামান বন্দুক দিয়ে হামলা করে তাড়াতে গেলে বিপদ হতে পারে। ভয়ের অস্ত্রে যদি মানুষ ভয় না পায়, তার অর্থ যে কী, এককালে মোদি গ্যাং-এর পূর্বপুরুষদের পরম পূজ্য ব্রিটিশ রাজ টের পেয়েছিল। আজ এরাও টের পেতে চলেছে।

আরও বড় সমস্যা হল— কান্ত বা রাওয়াত এতেও দুঃখ পাবে— এই অবস্থানে যোগ দিতে আসা কৃষকদের সকলেই হয় হিন্দু নয়ত শিখ। ফলে কোনওভাবেই হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় একে পাকিস্তান এবং কাসভ-দাউদ আফজল গুরুর সঙ্গে ট্যাগ করে দিতে পারছে না। ফলে, অন্য সময়, বিশেষ করে শাহিনবাগের সময়, মুসলিম ছবি ব্যবহার করে ওরা বৃহত্তর হিন্দু সমাজের মধ্যে যে খানিকটা চিত্তদোলা তৈরি করতে পেরেছিল, সেই সুযোগ এবার হাতছাড়া। শুধু তাই নয়, বিজেপি মাঝে মাঝেই যে দেশপ্রেমের তরজা শুনিয়ে মানুষের ভাতকাপড়ের ক্ষোভ প্রশমিত করার উদ্যোগ নেয়, এবং তার জন্য সীমান্তে সেনাসদস্যদের তকলিফগীতি শোনায়, এখানে এই জমায়েতে সেরকম অনেক প্রাক্তন সেনানী এবং/তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত। বর্তমান উপলক্ষে খেপে গিয়ে তাদের গালমন্দ করতে গেলে একটা স্থায়ী লব্জাস্ত্র ভবিষ্যতে আর ব্যবহার করা যাবে না। শক্তিশালী(?) হাতিয়ার হাতছাড়া হলে যে যুদ্ধমাঠে কর্ণদশায় নিমজ্জিত হতে হয়, সে কথা বিজেপি-দের থেকে আর কারা ভালো জানে!

তৃতীয় মুসিবত হচ্ছে, পাঞ্জাবের এক গুচ্ছ খেলোয়াড় সরকার থেকে পাওয়া পুরস্কার ফেরত দিতে শুরু করেছেন। যে সরকারি পুরস্কার সেই চাচা নেহরুর আমল থেকেই ব্যবহার হচ্ছে শাসক দলের দালাল কেনার অন্যতম বিনিয়োগ হিসাবে, বিজেপিও যাতে ভালোরকম হাত পাকিয়ে ফেলেছে, তা যদি ক্রেতা না নেয়, ফেরত দিয়ে ফেলে, তখন সেই দালাল বণিকের যে কী দুর্গতি হয়, বলার নয়। এই সব ঘটনা যখন গণ হারে ঘটতে থাকে, তখন তা রাজনৈতিক লুডোর চালচিত্রে শাসকের মনোবলকে সাপের মুখে নিয়ে যায়; আর আমজনতার উদ্দীপনাকে দেয় মইয়ের নিম্নধাপের সন্ধান! ইতিমধ্যেই একজন বিজ্ঞানীও তাঁর পুরস্কার নিতে এসে নেননি। এই সংখ্যাটা কালে দিনে বাড়বে বলেই দিল্লির আবহবিদরা আশঙ্কা করছেন।

হিটলারি কায়দাকানুন শিখে তার ব্যবহার দিব্যি ভালোই চলছিল, তাতে যে এমন ভাবে বাগড়া পড়বে কে জানত!

[আরও কিছু কথা পরে হবে]