দেবাশিস সেনগুপ্ত
লেখক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী, আদ্যন্ত ক্রীড়াপ্রেমী
একটা সাদাকালো টিভির মধ্যে পায়ে পায়ে রূপকথা আমাদের শুনিয়েছিলেন পাওলো রোসি, ১৯৮২-তে। তাতে ছিল একটা স্বপ্নেও দেখা যায় না, এমন গল্প। সে গল্প ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ মানসিক কাঠিন্যের সাহচর্যে একটা আরোপিত কলঙ্কর ধু ধু শূন্যতা পেরিয়ে এসে নতুন ইতিহাস লেখার গল্প। চার বছর পরে, ১৯৮৬তে সেই সাদাকালো টিভিতেই আমরা দেখেছিলাম মারাদোনার পায়ের শিল্পকর্মের ঝড়ে সব প্রতিপক্ষের উড়ে যাওয়া। পলকে সময়ের পাল্টে যাওয়া দেখিয়েছিলেন এরা, কেউ শিল্পে, কেউ কাঠিন্যে।
১৪ দিনের ব্যবধানে মারাদোনা আর রোসি চলে গেলেন, আমাদের সত্তর-আশির সেই সাদাকালো টিভির মধ্যে একটা সাদাকালো বল পায়ে উদ্দাম একটা সাদাকালো সময়কে সঙ্গে নিয়ে। সত্তর আর আশির দশক তার ফুটবলীয় রহস্যময়তা নিয়ে আজকালকার সকালের কুয়াশার মত কালের গহ্বরে আত্মগোপন করে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। অসহায় চোখের জল মিশিয়ে সেটা দেখতে হচ্ছে আমাদের। আর সেটা দেখতে দেখতেই শুনে ফেললাম এই কথোপকথন, লিখেও ফেললাম। সেই সময়ের ফুটবল-ছু’মন্তরের সাদাকালো দিনগুলির মায়াময় রূপকথার সাদাকালো গল্পের খাতা পড়ে ফেলুন, এই কথাবার্তার মধ্যে।
৯ই ডিসেম্বর ২০২০
কৃশানু – “আপনিও এসে গেলেন রোসিদা? আর আপনি এলেন বিশ্ব ফুটবল দিবসের আগের দিনটাতেই! এই বছরটায় আমাদের এখানে ফুটবলপাড়া তো জমজমাট হয়ে গেল।”
পাওলো রোসি – “আমার চেয়ে তো মনে হয় অনেক ছোট তুমি। এত তাড়াতাড়ি … কবে এলে এখানে? আমি তো ৬৪ বছর বয়সে এলাম। তুমি কত বছরে এলে? আমার এখানে আসার খবর প্রথমে খুব হৃদয়স্পর্শীভাবে জানায় আমার স্ত্রী ফ্রেডেরিকা কাপেলেত্তি, তারপরে আমার কর্মক্ষেত্র ‘রাইস্পোর্ট’ এটা জানিয়ে দেয় বিশ্বকে। এই ‘রাইস্পোর্ট’-য়ে কাজ করতে করতেই আমার আর ফ্রেডেরিকার প্রথমবারের জন্য দেখা হয়েছিল। আধুনিক সাহিত্য, কম্যুনিকেশন সায়েন্স আর সাইকোলজির ডিগ্রিধারী ফ্রেডেরিকা খুব শান্তভাবে বলেছে আমার মিষ্টি হাসিটা খুব মিস করবে ও আর আমাদের সন্তানেরা। ও আরও বলেছে যে, মৃত্যু আমার কষ্ট লাঘব করেছে। মিস তো আমিও খুবই করব ওকে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে আমার টলোমলো জীবনে স্থিরতা আর নিশ্চয়তা ও-ই তো এনেছিল, দশ বছর আগে। হ্যাঁ ভাই, নামটা বলো তো তোমার।”
কৃশানু – “আমি কৃশানু দে, ভালবেসে রন্টু বলে সবাই। ভারতীয় ফুটবলার ছিলাম। ১৭ বছর আগে এসেছি, তখন আমি ৪১। পালমোনারি ডিজঅর্ডার হয়েছিল।”
পাওলো রোসি – “অত তাড়াতাড়ি? আমারটা দুরারোগ্য রোগ ছিল। তা এখানে ফুটবলপাড়া জমজমাট না কী সব বলছিলে … তোমার দেশ থেকে কে কে এল এ বছর? কদিন আগেই তো আর্জেন্টাইন যুবরাজও এসেছেন, জানলাম। তিনিও তো চার বছরের জুনিয়রই ছিলেন আমার থেকে।”
কৃশানু – “হ্যাঁ, ওঁর সাথেও কথা হল গত মাসের ২৫ তারিখেই। কী খেলোয়াড় ছিলেন, উফ্! আমাকে ‘ইন্ডিয়ার তিনি’ বলে ডাকতেন আমাদের ফুটবলসমাজের অনেকে। ১৯৮৬তে ২৪ বছর বয়সেই মারডেকাতে হ্যাটট্রিক করার পর থেকে। যাই হোক, এই বছরের মার্চে আমাদের দেশের এক বিখ্যাত ফুটবলার-কাম-কোচ এলেন, আমার আসার তারিখেই মানে ২০ তারিখে আর এপ্রিলের শেষ দিনে এলেন আমাদের দেশের এক অসাধারণ স্কিমার-কাম-স্কোরার শিল্পী ফুটবলার। প্রথমজন ৮৪ বছর বয়সে আর দ্বিতীয়জন ৮২ বছর বয়সে। দারুণ আছি সবার সঙ্গে এখন। আপনার কথা কিছু বলুন।
পাওলো রোসি – “ইতালির টাস্কানি অঞ্চলের প্রাটোতে আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৫৬-র ২৩শে সেপ্টেম্বর। অত্যন্ত রোগা আর দুর্বল ছিলাম ছোটবেলায়, কিন্তু প্রচুর গোল করে গোলমেশিন আখ্যা পেয়েছিলাম ছোটদের মধ্যে। অতএব ১৭ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে তুরিনের জুভেন্টাসে যাই। সেই ১৯৭৩-য়েই ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে রাণার্স হওয়া ছাড়াও খেলেছিলাম কোপা ইটালিয়াতে। চোটআঘাত ঘিরে ফেলে শুরু থেকেই। তিন বছরে তিনটি ম্যাচ খেলি কোপা ইটালিয়াতে, কোনও গোল পাইনি। আর ঠিক তিনবার অপারেশন করাতে হলো হাঁটুতে। আমাকে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য লোম্বার্ডি-র কোমো ক্লাবে পাঠানো হয়। সেই লোম্বার্ডি, যেখানে এই বছর কোভিডের প্রকোপ ছিল ইতালিতে সর্বোচ্চ। সেখানেই সিরি এ-তে প্রথম খেলি ১৯৭৫-৭৬য়ে, রাইট উইঙ্গার হিসেবে। রোগা আর দুর্বল হওয়াটা এখানে বাধা হয়নি। সেখান থেকে ওই বছরেই লোনে সিরি বি-র ভিসেঞ্জা ক্লাবে যাই আর কোচ ফ্যাব্রি আমাকে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলান, নিয়মিত সেন্টার ফরোয়ার্ড আহত থাকায়। ১৯৭৫-৭৬-য়ে সিরি বি-তে মোট ২১ গোল দিই আর সিরি বি গোল্ডেন বুট পাই। আর পরের বছর ২৪ গোল লেখা হয়েছিল আমার নামে। ১৯৭৬-৭৭-য়ে সিরি বি চ্যাম্পিয়ন হয় ভিসেঞ্জা ক্লাব আর কোপা ইটালিয়াতে দ্বিতীয় রাউন্ডের গ্রুপ স্টেজে পৌঁছেছিল তারা, আবার সর্বোচ্চ গোলদাতা আমি। পরের বছর ১৯৭৭-৭৮-য়ে সিরি এ-র সর্বোচ্চ গোলদাতা হই আর টিম হয় সিরি এ-র দ্বিতীয়, প্রমোট হয়েই। এবং আমার নাম জাতীয় কোচ আন্দ্রে বেয়ারজোতের নোটবুকে ওঠে ১৯৭৮ বিশ্বকাপের জন্য।”
কৃশানু – “তারপরে? খেললেন ১৯৭৮-য়ের বিশ্বকাপে?”
পাওলো রোসি – “তা খেললাম বইকি। ওজনের উন্নতি ঘটালাম কিছুটা। ফ্রান্স, হাঙ্গেরি আর অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি করে গোলও দিলাম। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে করা গোলটাই ছিল আমার প্রথম গোল, ইতালির হয়ে, তাও বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপে চতুর্থ হয় ইতালি। তারপরে ১৯৭৮-৭৯-তে ভিসেঞ্জার হয়ে উয়েফা কাপে খেলি, পুরো মরশুমে ১৫ গোল করি আর অনেকবার চোট পাই। সিরি বি-তে নেমে যায় ভিসেঞ্জা। পেরুজিয়াতে লোনে আসি, সিরি এ খেলার জন্য। ১৯৭৯-৮০-তে পেরুজিয়ার হয়ে ১৩ গোল করি, উয়েফা কাপের ১৬-র রাউন্ডে যাই। তারপরেই আসে সেই দূঃসহ ১৯৮০। তার আগে তোমার কথা একটু বলো এবার, রণ্টু।”
কৃশানু – “১৯৮০ মানে সেই বেটিংয়ের এপিসোড, তাই না? এটা মনে আছে, আবছা আবছা। ততদিনে আমিও একটু একটু করে সেট হয়ে যাচ্ছি বড় টিমে। ডিফেন্স, হাফ আর ফরোয়ার্ডে তিন/চারজন সিনিয়ার ছাড়া বাকি সব সিনিয়ার সেবার এশিয়াড ক্যাম্পে। প্রথম দিকে সবাই বল পেলেই সিনিয়ারদের দিতে বলতো। তার পরে অবশ্য সবাই বল পেলে আমাকেই দিয়ে দিত। কাটাতাম ভালো, স্কিম করতাম, থ্রু পাশ দিতাম কিন্তু গোল করার দিকে অত নজর দিতাম না। ওটা আসে আপনাকে দেখে, ওই বছর। যাক, আপনি কন্টিনিউ করুন ১৯৮০-র কথা”।
পাওলো রোসি – “ওটার পোশাকি নাম ছিল টোটোনেরো ১৯৮০। সিরি এ আর সিরি বি মিলিয়ে বেটিংয়ের অভিযোগ ওঠে। দু’জন রোমান ব্যবসায়ী, ট্রিঙ্কা আর ক্রুসিয়ানি-র অভিযোগের সূত্রে ২৩শে মার্চ ১৯৮০ তারিখে এই চক্র উন্মুক্ত হয়, ওটা করেছিল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি গার্দিয়া ডি ফিনাঞ্জা। ৮টি সিরি এ আর ৪টি সিরি বি ক্লাব জড়িয়েছিল এতে, পেরেজিয়াও। ৪টি নামী ক্লাব এ সি মিলান, জুভেন্টাস, নাপোলি আর লাজিও ছিল ওই ক্লাবগুলির মধ্যে। আমি ৩ বছর সাসপেন্ড হই, পরে ওটা কমে ২ বছর হয়। জুভেন্টাস কর্তা জামপিয়ারো বোনিপর্তি পাশে দাঁড়ান, জুভেন্টাস আবার নেয় আমাকে ১৯৮১-র শেষদিকে। এবং সাসপেনশন ওঠার পরে ১৯৮১-৮২-র সিরি এ চ্যাম্পিয়ন হতে জুভেন্টাসকে সাহায্য করি আমি। চার বছর জুভেন্টাসে খেলার পরে ১৯৮৫-৮৬-তে মিলান আর ১৯৮৬-৮৭-তে ভেরোনায় খেলেছিলাম আমি। তেমন ভাল ফরোয়ার্ড হাতে না থাকায় কোচ বেয়ারজোত আবার আমাকে চান জাতীয় দলে। এক অভিযুক্তও জানান যে আমি জড়িত ছিলাম না ওই বেটিংয়ে। বেয়ারজোত আমার কাছে সরাসরি জানতে চান আমি দোষী কিনা? আমি না বলি। কোনও কোর্টেও আমার বিরুদ্ধে আরোপিত অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। এরপরে বেয়ারজোতের অক্লান্ত চেষ্টার জন্য সব মিলে ২ বছরের আগেই সাসপেনশন উঠে যায়, আর আমি জাতীয় দলে আবার নির্বাচিত হই। আন্ডারওয়েট, অনুশীলনের অভাব, সব বাধা কাটাতে বেয়ারজোতের অবদান আজও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি আমি। প্রায় ছেলের মত তিনি দেখতেন আমায়, যেমন চার বছর পরে মারাদোনাকে দেখেছিলেন বিলার্দো। এবার তুমি বলো, শুনি।”
কৃশানু – “এখনও সবাই বলেন যে, পুরো আশির দশক আর নব্বইয়ের দশকের শুরুটা জুড়ে নাকি কলকাতার ঘেরা মাঠে বিকেল হলেই আমার ম্যাজিক শুরু হত। রেমপার্টের এক পায়ে খাড়া উপচে ভরা ভিড়টার সবকটা চোখ পলকহীন তাকিয়ে থাকত আর তিনদিকের ঠাসা গ্যালারি ফলের তোয়াক্কা না করেই চোখে চোখে রাখত আমার ছোট্টখাট্টো বাঁ পাটাকে, যা দেখে চমকাতেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার আর মিডফিল্ডাররা। কিন্তু চোখ ভরে দেখতেন প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডরা, যারা আমার বাঁ পায়ের ড্রিবলিং দেখেছেন, তারা নাকি আজও বলেন যে, সময় থমকে গিয়ে মুচকি হাসত চোখ মেলে আর বিস্ফারিত চোখে ফুটবল ঈশ্বর দেখতেন আর ভাবতেন ভুল দেশে ভুল সময়ে জন্মেছি আমি। সে যাই হোক, আমি যে বছর প্রথম বড় দলে আসি, সেবারই তো আপনি কামাল করে দিলেন স্পেন বিশ্বকাপে।”
পাওলো রোসি – “সেই ১৯৮২। তার আগে ১৯৭৮-এ, সেমিফাইনাল গ্রুপে হল্যান্ডের কাছে হারি আমরা আর আমি নেহাত খারাপ খেলিনি সেবারও। ১৯৭৯-তে জুভেন্তাসের হয়ে খেলার সময় বিশ্বে সর্বাধিক মূল্য ছিল আমার। ১৯৮০-তে সাসপেন্ড করলো সিরি এ-তে গটআপের অভিযোগে, জেলও খাটালো। আমি জানি, ভুল ছিল ওটা। সাসপেনসন তুলে ১৯৮২-তে ইতালি টিমে ফেরালো স্পেন বিশ্বকাপের জন্য। ভালো স্ট্রাইকার কোথায় তখন টিমে, কন্টি ছাড়া? ৩টে খেলে ৩ নিয়ে ইতালি কোনওমতে ২-য় রাউন্ডে গেল, পেরু ম্যাচে ১ অর্ধ আর ক্যামেরুন ম্যাচে পুরোটা খেললাম। গোল পাইনি, কথা উঠলো টিমে রাখা নিয়ে। ২-য় রাউন্ডে অন্য দুটো দল আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। আর্জেন্টিনাকে ২-১ হারালাম আমরা। ওই ম্যাচে ওরা দেখলো ১টা লাল আর ৩টে হলুদ কার্ড, একটা হলুদ কার্ড মারাদোনার। আমাদের দুটো হলুদের একটা দেখলাম আমি। কিছুই খেলতে পারিনি। কিন্তু তারপর থেকেই ম্যাজিক, ঈশ্বরের আশীর্বাদে। ব্রাজিল ম্যাচে হ্যাটট্রিক করলাম। প্রথম গোল ক্যাব্রিনির ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে, ৫ মিনিটে। জিকোর ফাইনাল পাসে সক্রেটিস গোল করে সমতা ফেরান ১২ মিনিটে। ২৫ মিনিটে একটা গোলা পাঠালাম ব্রাজিল গোলে, ওদের সেরেজোর ব্যাকপাস ধরে, ২-১। জিকো-সক্রেটিস-ফালকাও-জুনিয়র ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের ওই উইন অর এক্সিট ম্যাচটায়। ৬৮ মিনিটে ফালকাও করলেন ২-২, দারুণ শটে। ড্র হলে উঠে যাবে পরের রাউন্ডে, এই অবস্থাতেই রক্ষণ জমাট না করে মুহূর্মুহূ আক্রমণে গেল ব্রাজিল। খেলা শেষ হবার ১৬ মিনিট আগে কর্নার থেকে ভাসানো বলে ওদের গোলকিপার পেরেজকে এড়িয়ে হেডে ৩-২ করলাম। হ্যাটট্রিকও। তারপরে আমাদের আর একটা গোল বাতিল হয় আর একটা নিশ্চিত গোল বাঁচান আমাদের গোলকিপার দিনো জফ। অঘটন ঘটে গেল। ব্রাজিল আউট, আমরা সেমি-তে। আমার একটা বই আছে এটা নিয়ে, নাম ‘আই মেড ব্রাজিল ক্রাই’। বাকিটা শোনার আগে তোমার কথা কিছু বলো।”
কৃশানু – “তখন এক একটা ছোট্ট মোচড়ে নিশ্চিত ‘না’ রদ হয়ে ‘হ্যাঁ’ হয়ে যেত মাঠে, আমার ডজে, এটাও এখনো বলেন অনেকে। তারা এটাও বলেন, আট বছর ইস্টবেঙ্গলে (১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯৪) আর ছয় বছর মোহনবাগানে খেলা (১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৯২, ১৯৯৩ আর ১৯৯৫) আমাকে খেলতে দেখা আশি-নব্বইয়ের ময়দান নাকি একশ বছর পরেও গর্ব করবে আমার খেলা নিয়ে। ভারতের হয়েও খেলেছি অনেক এরই মধ্যে। ১৯৯৫-য়ের পরে আর মাত্র ৮ বছর ওখানে থাকার মেয়াদ ছিল আমার। পাততাড়ি গোটাতে হলো ২০০৩-য়েই। ২০ মার্চ ২০০৩ তারিখে ভারতের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ওঠার আনন্দ নাকি অনেকটাই ঢেকে গিয়েছিল আমার এখানে চলে আসার কান্নায়, আজও এটা অনেকেই বলেন। এবার আপনার বাকি কথা বলুন রোসিদা।”
পাওলো রোসি – “সেমি-তে পোল্যান্ডকে আমরা মারি ২-০ গোলে। ২২ আর ৭৩ মিনিটের দুটো গোলই ছিল আমার করা, যথাক্রমে কন্টি আর অ্যান্টোগনির পাস থেকে। ১১-ই জুলাই ১৯৮২-র ফাইনালে ৩-১ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে আমরা বিশ্বকাপ জিতি। প্রথম অর্ধ ০-০। তারপরে ৫৭ মিনিটে আমাদের প্রথম গোলটা আমিই দিই। দলের হয়ে একই বিশ্বকাপে ব্যাক টু বাক ৬ নম্বর গোল ছিল এটা আমার। আজও মনে হয়, আর কেউ এটা করেনি। টারডেলি আর আলটোবেলির গোলে ৩-০ এগিয়ে যাই ৮১ মিনিটে। ৮৩ মিনিটে ১টা গোল শোধ দেন ব্রাইটনার। মারাদোনা-বুরুচাগার আর্জেন্টিনা, জিকো-সক্রেটিসের ব্রাজিল, বোনিয়েকের পোল্যান্ড আর রুমেনিগের পশ্চিম জার্মানি, সবাই কুপোকাত হয়েছিল আমাদের কাছে। এটা “ডেল্লো স্পোর্ট” রিপোর্ট করেছিল তখন। বেটিং কাণ্ডে জড়িয়ে ২ বছর ফুটবল ভুলে যাওয়া আমি ৬ গোল দিয়ে ওই বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুট, দুটোই পাই। ব্যালন ডি’অর-ও পেয়েছিলাম সেই বছর। পুনর্জন্ম হয় আমার ফুটবলের। আমি চাইতাম, সময় যেন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক, আর না এগোয়। ওই সময়টাতে আমি গোলের গন্ধ পেতাম বক্সের মধ্যে আর সেই গন্ধ চিনে নিয়ে পৌঁছে যেতাম ঠিক জায়গাতে, ঠিক সময়ে আর ঠিকঠাক হেড বা শটটা নিতাম। প্রতিপক্ষ শুধু জাল থেকে বল ছাড়িয়ে আনত। কিন্তু ১৯৮৬-র বিশ্বকাপে আর খেলা হয়নি আমার। ইতালির হয়ে ৪৮ ম্যাচে ২০ গোল ছিল আমার, বিশ্বকাপে ৯টা, ১৯৮৬-র ৬টা আর ১৯৮২-র ৩টে। বাজ্জিও আর ভিয়েরি ছাড়া আর কোন ইতালিয়ানের বিশ্বকাপে ৯ গোল নেই। কোমো, ভিসেঞ্জা, জুভেন্টাস, মিলান, ভেরোনার হয়ে খেলে বুটজোড়া খুলে রাখি ১৯৮৭-তে, আমি তখন মাত্র ৩১। তার ৩৩ বছর পরে আজ এখানে এলাম। আমার আর ফ্রেডেরিকার একটা যুগ্মভাবে লেখা বই আছে, বাংলাতে সেটার নাম অনেকটা এরকম ‘একটা মুহূর্ত কতক্ষণ বেঁচে থাকে?’ এই বইতেই আমি বলেছিলাম ‘ইতালির নীল জার্সিতে গোল করে দু’হাত দোলাতে দোলাতে ছুটে আসছি আমি, এভাবেই মনে রাখুক সবাই আমাকে, এটাই চেয়েছি সারাজীবন’। ব্যস, আমার গল্প শেষ। আজ শুনলাম, ফেসবুক-ট্যুইটারে অনেকেই মনে করছে আমাকে। এটুকুই তো চায় একজন ফুটবলার, তাই না? তা, এখানে প্র্যাকটিসে নামতে চাই কাল থেকে। হবে তো রন্টু?”
কৃশানু – “হ্যাঁ, চলুন কাল থেকেই। মারাদোনা, প্রদীপদা, চুণীদা, সবাই তো প্র্যাকটিস করেন, রোজ। আমিও করি আর সেই সঙ্গে আমার সমসাময়িক একজন, সুদীপ চ্যাটার্জিও, যে এসেছে আজ থেকে ১৪ বছর আগে। কাল থেকেই আপনিও প্র্যাকটিস করবেন। লোকজন আজও আমাদের মনে রেখেছে, এটাই অনেক। চাইলে মারাদোনার টিম বনাম আপনার টিম, একটা খেলাও হবে, কিছুদিনের মধ্যেই। আমরাও ফিরে পাব ‘এসপানা ৮২’-র স্বাদ, ৩৮ বছর পরে।”
এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল ওই কথোপকথন। যারা পড়লেন, তারা বুঝবেন যে, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবার দর্শন শিখিয়ে গেছেন ‘গোলমেশিন’ পাওলো রোসি, তাঁর করা গোলগুলি দিয়ে। শিখিয়ে গেছেন মানসিক দৃঢ়তায় প্রতিকূল সময়কে দশ গোল দিতে। বিশ্ব ফুটবলের উপর কোনও বই লেখা হলে তার একটা বড় পরিচ্ছদ বরাদ্দ থাকবে তাঁর জন্য। তাতে একটাই ছবি থাকবে, গায়ে নীল জার্সি, দু’হাত আকাশে ছড়ানো অমর ‘পাবলিটো’। কোন ফুটবলপ্রেমিক পাওলো রোসিকে ভুলতে পারবেন না কোনওদিন।
এই দুনিয়ায় ফুটবল যতদিন, পাওলো রোসি ততদিন।