কালীকৃষ্ণ গুহ
লেখক কবি ও গদ্যকার
কবি নাসের হোসেন বলা যায় অকালেই চলে গেলেন সম্প্রতি। তাঁর চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এই শহরের শিল্পসংস্কৃতির বিস্তৃত প্রাঙ্গণ থেকে একটা সদাহাস্যময় দয়ালু মুখ চিরতরে হারিয়ে গেল। তাঁকে গত তিন দশক ধরে চিনতাম। সব থেকে বড় কথা, তাঁর সঙ্গে কথা হলে আনন্দ হত। একথা বলতে পারা কিন্তু কম কিছু নয়৷
আমাদের বন্ধু যিনি উত্তরাধুনিকতার রাগি তাত্ত্বিক একজন- সেই প্রভাত চৌধুরীর সঙ্গে নাসের মিশে ছিলেন বলা যায়। প্রভাতের বিখ্যাত “কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার সঙ্গে নাসের জড়িত ছিলেন। ‘কবিতা পাক্ষিক’-এর যাবতীয় প্রকাশনার দায়িত্বও, যতদূর জানি, তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। কবি হিসেবেও নাসের প্রভাত চৌধুরীর তাত্ত্বিকতাকে রূপদান করে গেছেন। তত্ত্ব বা তাত্ত্বিকতা যদি কারও কোনও সর্বনাশ করে থাকে বা মঙ্গলসাধন করে থাকে তাহলে তা নাসেরকে করেছিল- সর্বনাশ অথবা মঙ্গলসাধন। সেই বিচার পাঠকের ও সময়ের হাতে। আমরা দেখেছি নাসের দিনের পর দিন আনন্দের সঙ্গে কবিতা পাক্ষিকের দপ্তরে তথা প্রভাতের পটলডাঙ্গার আস্তানায় বসে প্রুফ সংশোধন করছেন অথবা প্রয়োজন হলে, কবিতা বা সম্পাদকীয় নিবন্ধ বা কোনও বিষয়ে প্রতিবেদন লিখছেন।
কবিতা ছাড়া ছবি ছিল নাসেরের প্রিয় বিষয়। প্রথম জীবনে নাসের ছবি আঁকতেন৷ তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছিল। কেন জানি নাসের ছবি আঁকা ছেড়ে সারাক্ষণের কবিজীবন বা কবিতাকর্মীর জীবন বেছে নেন। তাঁর হস্তাক্ষর ছিল আশ্চর্য সুন্দর। ফলে তাঁর উপর একটি গ্রন্থের বা পত্রিকার যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যেত। শুধু প্রভাত চৌধুরী নন, আরও অনেকে তাঁর উপর বই বা পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছেন৷ নাসেরও বন্ধুদের কাছ থেকে কাজের দায়িত্ব পেয়ে, নিশ্চিন্তে, সানন্দে, সেই কাজ সম্পাদন করে গেছেন৷ এখানে উল্লেখ করা দরকার, নাসের বিবাহ করেননি। ফলে তাঁর কোনও পারিবারিক দায়িত্ব কিছু ছিল না। বন্ধুদের নিয়েই ছিল তাঁর সংসার, তাঁর বাঁচার নীরব আনন্দ। নাসের কথা খুব কমই বলতেন। নীরবতাই ছিল তাঁর চারিত্রিক ধর্ম। নীরবতাতেই ছিল তাঁর একা মানুষের ধর্মপালন।
এখানে নাসেরের দুটি ছোট কবিতার উদাহরণ রাখছি:
নারী
——
নারীই তো প্রকৃতি
ঝড় এবং
শান্তি।
শ্রী
—-
শ্রী ব্যাপারটা এমনই
যেখানে মন্দের সঙ্গে
ভালোর ভাগ বেশি।
হ্যাঁ, নারীই ঝড় এবং শান্তি। আর জীবনে ভালোর ভাগ বেশি থাকা নিয়েই কথা। নাসেরের জীবনে ভালোর ভাগ এত বেশি ছিল যে তা নিয়ে কিছু বলার নেই। নাসেরের মেলামেশার পরিধি বুঝতে হলে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নিচের কবিতাটি পড়তে হবে।
আমাদের হাতের লেখা
——————————-
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তআমাদের যাদের
বয়সের গাছপাথর নেই, তাদের জন্যে আছে
নাসের হোসেন আনাচেকানাচে।আমাদের হাতের
লেখা যতই ক্ষুদ্রকায় হয়ে আসছে সান্ত্বনা এই ভেবে
নাসের হোসেন প্রেস কপিটা তৈরি করে দেবে।একদিন নাসের এসে বলল, তখন ঈষৎ সূর্যোদয় :
‘সুনীলদার এই লেখাটার এক এক জায়গায়
পড়তেই পারছি না, আপনি দেখে দিলে ভীষণ ভালো হয়।প্রকাশিত হবার দু’দিন পরে
পথের বাঁকে যখন দেখা হল
সপ্রশংস ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মনে পড়ছে, এককালে কবি উৎপলকুমার বসুর নেতৃত্বে দু-তিনদিনের একটি আলোচনাসভা করা হত কলকাতার বাইরে কোনও জায়গায়, যেখানে যোগ দিতেন অনেক চিত্রকর কবি লেখক অধ্যাপক গায়ক- যাঁরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর একটি আলোচনায় যোগ দিতেন শ্রোতা অথবা বক্তা হিসেবে। সকলেই ছিলেন চিন্তাশীল মানুষ। বেশ কয়েক বছর চলেছিল সেই ‘কলোক্যুয়াম’ ডাকনামের আড্ডাটি। সেই আড্ডাগুলির এক নীরব চরিত্র ছিলেন নাসের। কত লোকের সঙ্গে যে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল তা ভাবা যায় না। কে তাঁকে কী বলল বা কে তাঁকে পাশ কাটিয়ে গেল, তা নিয়ে তাঁর মাথা ঘামানোর কিছু ছিল না।
গত কিছুকাল যাবৎ তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাঁর শরীরে রক্তের লোহিত কণিকা কমে যেতে লাগল। বারবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রক্ত নিতে হত। কারা তাঁর জন্য রক্ত দিতেন? বন্ধুরাই ছিল তাঁর প্রকৃত আত্মীয়স্বজন- লেখক বা সহকর্মী যারা। তাঁরাই নাসেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগের দিন তিনি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর হাসপাতাল। মৃত্যু। পাশে হতচকিত বন্ধুরা। পাশে এই কোলাহলময় নির্দয় শহর। পাশে তাঁর দিনের রাস্তাঘাট, রাত্রির আস্তানা। পাশে দেবেশ সেনশর্মা আর নির্বাক প্রভাত চৌধুরী। তারপর অনিশ্চয়তার ভিতর দিয়ে শেষযাত্রা।
[কৃতজ্ঞতা: চন্দ্রদীপা সেনশর্মা]