ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
মাথার ওপরের ঐ মস্ত আকাশটা বদলে বদলে যায়। যখন জল নামে, তখন কাদামাটি গোলা রঙ হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় নরম ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা, সাদাটে; আর কখনও চড়চড়ে আগুনের মতো, তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যাবেই।
এই এখন যেমন। আগের বারে ৩০ পাঞ্জা খোদাই শেষ হবার আগেই জল নেমেছিল। আর এবার ৬৩ পুরোতে যায়। জল কি, একতাল মেঘেরও দেখা নেই।
একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে হুব্বালা ফের পাথুরে পাটাটা কোলের ওপর তুলে নেয়। পাঞ্জার শেষ দাগটা খোদাই করতে সময় লাগে বেশি। আড়াআড়ি যাবে বাকিগুলোকে কাটতে কাটতে। আজ রোন্নাম্মার জমায়েত বসবে। তার আগে শিলে খোদাই শেষ করে, দাগ ক’খানা ভালো করে গুণেগেঁথে কাল-গম্বুজে চিহ্ন এঁকে দিয়ে তবে ছুটি। কিন্তু জমায়েত করে কি জল নামানো যাবে? কত করে তো ডাকল সাংবুড়োর দল, রাতের পর রাত আগুন জ্বালিয়ে ঐ পুবপাহাড়ের টঙ্গে উঠে কত গান গাইল। অত উঁচু থেকেও জলের মুলুকে কারুর কানে সেই গান পৌঁছল না, এমনটা কি হয়!
জমায়েতে লোকের ঢল নেমে গেছে আজকে। সবার চোখেই ভয়, হতাশা– কি হতে চলেছে? গোলা গোলা দানা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাটিতে দানা বওয়া যাচ্ছে না, ওদিকে ফাট ধরছে এদিক ওদিক থেকে, যেন মস্ত কোনও খিদে ওত পেতে বসে আছে মাটির তলায়। একবার বেরিয়ে আসতে পারলে আস্ত আস্ত গিলে খাবে সব।
“মাড়ুপ্পা বলেছিল, জঙ্গলের মুখ একেবারে বন্ধ না করতে। কিন্তু ইঁট গাঁথার নেশা এমন পেয়ে বসল তোদের! এখন মাংস মেরে খেতে হলেও কেবল যেতে আসতেই কয়েকখানা চাঁদ গড়িয়ে যাবে। বাচ্চা-বুড়োগুলো তদ্দিনে চোখ উল্টোবে তো বটেই।” সিঙ্গাপ্পার গজগজানি ভিড়ের ভনভনানি ছাপিয়েই কানে আসে রোন্নাম্মার। জঙ্গলে থেকে জন্তু মেরে খাওয়া যেত বটে, কিন্তু, জন্তুর পেটে যাওয়ার গুনতিটাও নেহাত কম হত না। আর সব থেকে বড় কথা, ওভাবে ভাবলে নিজেদেরও কেমন জন্তু মনে হয়। শুধু খাওয়া, ঘুম, বাচ্চা দেওয়া আর ঝামেলা হলে একে অন্যকে আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে একসা করা। আর অন্যদিকে মাটি পুড়িয়ে চ্যাটালো চ্যাটালো ইঁট যখন সার দেওয়া থাকে, একটা পর একটা সারি জমিয়ে মাথার ওপর তোলা হয় ছাদ, চারধার ঘিরে উঠতে থাকে দেওয়াল, তখন বুকের ভেতরটা কেমন আনন্দে ছটফট করে-– আরও কত কি করতে ইচ্ছে করে, আরও কত নতুন কিছু! কিন্তু খাবার না জুটলে বসতি ভেঙ্গে যেতে বেশি সময় লাগবে না, আর বসতি ভেঙ্গে গেলে, কিছু করতে পারা না পারায় কি এসে যাবে আর!
“এ বসতি ছেড়ে যেতে হবে” শলা-সওয়াল পেরিয়ে যে কথাটা বারবার উঠে এল, তা মোদ্দা এই, “কদিন জঙ্গলে গিয়ে থাকা, অবস্থা ফিরলে ফিরে আসা, নয়তো অন্য পথ খুঁজে নেওয়া।”
সিঙ্গাপ্পার সঙ্গে এক মত প্রায় সকলেই। কিন্তু শুধু মতে মত মিললেই তো হল না, কিভাবে কি হবে সে তো এক মস্ত ভাবনা। এমন গোছানো বসতি ছেড়ে যেতে হলে অনেক কিছু ঠিক করে নেওয়ার আছে যা কিনা ভেবে তল পাওয়া যায় না। গোষ্ঠী তো কম বড় হয়নি এর মধ্যে। ধন্দে পড়া মুখগুলো রোন্নাম্মার দিকে ঘুরে যায়।
“বসতি ছেড়ে গেলে অনেক বিপদের জন্য তৈরি হতে হবে। আমরা পারব? সাংবুড়োর বাপের বাপ ছিল শেষ শিকারি। শিকার করতে শিখতে হবে নতুন করে। পাতা পুড়িয়ে আগুন জ্বালা, বর্ষা এলে গাছের আড়াল, পরনের কাপড় ছিঁড়লে ছালবাকল পরে থাকা– পারব?”
প্রশ্নটা আরও বাড়াত রোনাম্মা, কিন্তু বুকের টনটনানিটা আর সইতে না পেরে সাংবুড়োর ঘরের মা-মরা বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে টেনে নিল। রোন্নাম্মার বুকে বরাবরই খুব দুধ, নিজের বাচ্চাদের খাইয়েও থাকে অনেক।
খানিক চুপচাপ থাকার পর সিঙ্গাপ্পাই বলল প্রথম, তারপর বাকি সবাই, “পারতেই হবে। পারতেই হবে রোন্নাম্মা।”
মেয়েটার মরা পেট, বেশি দুধ টানতে পারল না, মা মরলে অমনটা হয়। বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিয়ে রোন্নাম্মা উঠে দাঁড়ায়, “অত কষ্ট যদি সইতে পারি, তাহলে অন্য একটা চেষ্টা করে দেখি? জল নামছে না ওপর থেকে, কবে নামবে আমাদের সংকেতও দিচ্ছে না। কিন্তু মাটির ওপর যে জল বইছে? পুবপাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে যে জলের ধার? তার থেকে কিছু যদি এদিকে নিয়ে আসি আমরা? সেই ধারে তো অনেক অনেক জল! কখনও ফুরোবেও না। সেই জল দিয়ে দানা বোনা যাবে না কি?”
রোন্নাম্মাকে আহাম্মক ভাবতে পারলে সুবিধে হত সকলের, কিন্তু কি ভেবে ভিড়টা শেষমেষ সওয়ালটাই করে ফেলে, “কি করে তা হবে? অত জল বইবে কে?”
“বইতে হবে কেন? ধারের গা থেকে মাটি কেটে ঢাল তৈরি করে নেব, বরাবর খেতের মাঝখানে এসে পড়বে সেই জল। একবারের খাটনি, কিন্তু তাতে বরাবরের জন্য জল থাকবে। দানা শুকোতে পাবে না আর। ফসল উঠবে সব সময়, বাচ্চা বুড়ো…”
হুব্বালা অবাক হয়ে শোনে। গোটাটা বোঝা তার হয়ে ওঠে না। কিন্তু মনটা কেমন ছটফট করে ওঠে মাটির তাল ছানার জন্য। রোন্নাম্মা যেন সবার মা। মা মানে জন্ম, মা মানে ফসল, মা মানে খাবার। নতুন পুতুল গড়ার পাগুলে ইচ্ছেটা চেপে বসে। চোখের সামনে যেন জলজ্যান্ত পুতুলটাকে দেখতে পায় হুব্বালা। আজ রাতেই বসবে মাটি ছানতে, এমন পুতুল গড়বে যাকে দেখলে কখনও কারুর চিনতে ভুল হবে না। আজও না, কালও না, তার পর যখন একদিন ও নিজেও আর বেঁচে থাকবে না চিনিয়ে দেবার জন্য, তখনও না।
……
রোন্নাম্মা সেদিন যা বলেছিল তার গোটাটা লিখতে বসলে বিধানসভার ভাষণ হয়ে যায়। তাছাড়া ওর সব কথা ঠিক ছিলও না। সিন্ধু, বা নীল, বা ইউফ্রেতিস-টাইগ্রিস, যাই হোক না কেন, তার গা থেকে খাল কেটে জমির মাঝ মধ্যিখানে জল এনে লাভ হয়নি, বরঞ্চ ছোট ছোট আলে ভাগ করে ছড়িয়ে দিতে হয়ে
এরই মধ্যে কিছু নিপাতনে সিদ্ধ সমীকরণ কখনও কখনও ঢুকে পড়ে। বর্ম পরে কখনও রাজদ্রোহ করতে চলে যান ফ্রান্সের বেপরোয়া কিশোরী, অঙ্কের নেশায় মেতে উঠে গ্রহনক্ষত্রের নাড়ীর হিসেব করে ফেলেন বিখ্যাত গ্রহবিদের পুত্রবধূ, আজীবন পুরুষের ছদ্মবেশে চিকিৎসা চালিয়ে ধন্বন্তরি শল্যবিদ গর্ভস্থ শিশুমৃত্যু ঠেকিয়ে দেন প্রথম সফল সিজারিয়ানে। কিন্তু সেসব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব গৌরবের হয়ে থাকতে পারেনি, অন্তত তাঁদের বর্তমান কালে তো নয়ই। কেউ পুড়ে মরেছেন, কেউ বা জিভ কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন, কেউ মৃত্যুর পরও কলঙ্কিত হতে থেকেছেন-– আরও কত কি!
পৃথিবী তার নিয়মে ঘুরপাক খেয়েছে, ক্যালেন্ডারে সন তারিখ বদলে গেছে, খানিক সময়ের নিয়মে, খানিক বাজারের প্রয়োজনে জঁরগুলোও এদিক ওদিক ফস্কাতে শুরু করেছে। কিন্তু মাঝখানে যে অনেকখানি সময় বয়ে গেছে, বহুমূল্য সময়! জেনেটিক ইভোল্যুশন হোমো ইরেকটাসের স্ত্রীলিঙ্গকে যেখানে পৌঁছে দিয়েছিল, উৎপাদনের গুরুভারে সে দীর্ঘদিন সেই ধাপখানারই কাছেপিঠে দাঁড়িয়ে থেকে গেছে। বিশ্বসভ্যতার ক্যারিয়াটিড।
এই দেরীটুকু পুষিয়ে নেওয়া খুব সোজা কথা নয়। আর সেইজন্যেই জেন্ডার ডাইভারসিটির সরল ভগ্নাংশের অঙ্কে ডাহা ফেল মেরে চলেছে গোটা দুনিয়া। লেখাপড়া শিখতে আসাটাই মেয়েদের কাছে মেরেকেটে শতেকখানেক বছরের ইতিহাস মাত্র-– তার ওপর তো সেদিন পর্যন্তও কিছু বিশেষ বিষয় অবধি কোরাণ, গীতা, বাইবেল ছুঁয়ে মিথ্যা বলার মতো মহাপাপ ছিলও মেয়েদের জন্য। বিদ্যে তবু কালেদিনে অনুমোদন পায়, কিন্তু ঘাম ছুটে যায় তারপর সেইসব পড়াশুনো নিয়ে কাজ কারবার করতে। গুণবন্ত হয়ে থাকলেই শুধু হবে কেন! লক্ষ্মীমন্ত হতে হবে না! আর সবথেকে অস্বস্তির জায়গা যেটা, সেটা হল যুগযুগান্তের অভ্যাসে থমকে গেছে কিছু কিছু মানবিক প্রকাশ বা বিকাশের ধরণ। যেমন সাহস। একা একা ফিরতে পারব না, ভয় করে। ওকে পালটা মারব কি করে, ভয় করে! না বলতে ভয় করে। বলে ফেলতে ভয় করে। বদলাতে ভয় করে। এমনি করে করে এক এক সময় দায়িত্ব নিতেও হয়ত ভয় করে।
তাই তলে তলে একটা ছোট্ট সওয়াল খুটখুট করে টোকা মারে মাঝেমধ্যে, সভ্যতার হাতেখড়ির সময় তো বেশ কিছুদিন হল পেরিয়েছে, তাই না? এবারে তবে মাতৃমূর্তির নাক চোখ মুখ গুলো খোদাই করা যাক? কিন্তু এখানেই একখানা বিরাট ফাঁক-– গর্ভধারণ বন্ধ করে দেওয়া তো এর উত্তর নয়, জন্মানো শিশুগুলোকে নিজের ভাগ্য নিজে বুঝে নিতে দেওয়াও এর উত্তর নয়, উত্তর আসলে এই গুরুদায়িত্বের ভাগের মধ্যে আছে। এই দায়িত্বের ভাগ নেওয়া না নেওয়া নিয়ে প্রচুর তর্ক বিতর্ক নিত্য হয়ে চলেছে। স্বামী স্ত্রীর সমান অধিকার, সমান দায়িত্ব, ইত্যাদি, প্রভৃতি, ক্রমশঃ। মুশকিল হল, চাইলেই কি কাল থেকে এমন দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া যায়? সমাজের একরকমভাবে অনেকদিনের জমা ধ্যানধারণা তো আছেই, কিন্তু তার ওপরেও আছে এক অব্যর্থ অদৃশ্য হস্তক্ষেপ। যে হস্তক্ষেপের কারণে পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা শুধুমাত্র পরিবারের সেই কটি সদস্যের ভদ্রলোকের চুক্তির ওপরে নির্ভর করে না। মেয়েটির স্বামী শতপ্রতিশত সদিচ্ছা নিয়েও হয়ত চরম প্রয়োজনের সময়েও বাড়িতে থেকে যেতে পারে না, চাকরিটুকু বাঁচাতে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়। মাথার ওপরের ছাদ, পেটের ভাত, বাচ্চার দুধ। মেয়েটিকে ইস্তফা দিতে হয় সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন থেকে-– কারণ বহুজাতিকের স্যালারি স্লিপ কখনও কখনও দাবী করে বসে তার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত অবসরটুকুও। ফলে নিজের জ়ীবনের সিদ্ধান্তগুলোও আর একান্ত ব্যক্তিগত থাকে না-– অনিবার্য হয়ে পরে এমন কিছু শর্ত যা কখনও কারুর ব্যক্তিজীবনের অংশ ছিল না। এমনটাও তো হওয়ার কথা ছিল না। এখানে রাষ্ট্র কেন কিছুই করার খুঁজে পায় না? কেন পায় না? যথেষ্ট কারণ তৈরি করা যায়নি বলে নাকি যথেষ্ট সশব্দে কারণ তৈরি করা যায়নি বলে?
তাই, মাটির তালটা ফের ছানতে মনটা যদি একটু হলেও ছটফট করে তবে মাটিটাকেই আগে গোটাগুটি বদলাতে হবে। নইলে ওতে চোখমুখ ফোটাতে গড়িয়ে যেতে পারে আরও আরও কয়েক শতাব্দী।