জয়রাজ ভট্টাচার্য
সমাজকর্মী, নাট্যকর্মী
মেলাই মনে হবে, কোনও প্রতিবাদস্থল নয়। অথবা প্রতিবাদস্থলের তো মেলা হয়ে ওঠার কথাই ছিল, আমাদের ভাবগম্ভীর আদর্শের ঠেলায় সে এক শ্রাদ্ধবাসরের চেহারা নিয়েছে! অনেককাল পর রাজধানীতে সে নিজের চেহারা ফিরে পেয়েছে। ডিজে স্পিকারে বাজছে ভাঙড়া গান, আর তার সঙ্গে নাচছে হাট্টাকাট্টা শিখ তরুণ আর ফুল ফুল ছাপ সালোয়ার পরা বৃদ্ধা। তাঁরা কি মা আর বেটা? হতেও পারে, জানি না। অথবা অতটা অনুসন্ধানে মন সায় দেয়নি, কারণ তাঁরা মা আর বেটাই! ভারতের মা আর বেটা।
দিল্লি থেকে দু ঘন্টা লাগল গাড়ি করে সিঙ্ঘু বর্ডারে পৌঁছতে। পঞ্জাব-হরিয়ানা আর দিল্লির বর্ডার। কংক্রিটের গার্ডরেল আর লোহার কাঁটাতার দিয়ে আড়াআড়ি রাস্তায় ব্যারিকেড করা হয়েছিল, দিল্লির দিকে পুলিশ/আর্মি আর পঞ্জাবের দিকে কৃষকরা অতন্দ্র থাকবেন মনে করে। কিন্তু সে বন্দোবস্ত টেঁকেনি। দুই পক্ষই অবাধ যাতায়াত করছে, পায়ে হেঁটে। পুলিশের দিক থেকে কৃষকদের দিকে এগোলেই মেলার চেহারাটা স্পষ্ট হবে। প্রথমেই চোখে পড়বে সারি সারি তাঁবু, আর তাতে বিশাল বিশাল কড়াই, হাণ্ডি, গামলা, খুন্তি। বিশাল মানে বিশাল! নরকে গরম তেলে পাপীদের ডিপ ফ্রাই করার কড়াইগুলোর যেমন সাইজ হয়, তার চেয়ে সামান্যই ছোট। রান্না হচ্ছে। আলু কপির তরকারি, রুটি, চানা, ভাত, ডাল, পোলাও। বেশি দুধ দিয়ে চা। চিনির বদলে গুড় দিয়ে বানানো লস্যি। গুরুদ্বার থেকে লঙ্গর চালানো হচ্ছে, সংগঠিত কৃষক সংগঠনগুলোর লঙ্গর চলছে। পাশাপাশি ট্রাকটরে ট্রাকটরে রান্না হচ্ছে ছোট ছোট দলের। তারাও পাশ দিয়ে গেলেই গেলেই হাঁক দিচ্ছেন— আও জি, মকাই কা রোটি খাও, হামারা খেতি কা ফ্রেশ মকাই কা আটা সে বনায়া। কোনও কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে জলের গ্লাস নিয়ে, পিয়াস লাগলে টোল পড়া গালের হাসি নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে জল, বিদ্রোহী সহযোদ্ধাকে।
বক্তৃতা চলছে মূল মঞ্চে। শ্রোতাদের মধ্যে পুরুষের সামান্য আধিক্য থাকলেও, বক্তাদের বড় অংশই মহিলা। তাঁরা কৃষকনেত্রী। লড়াইয়ের রূপরেখা তৈরি করছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন, মোটিভেট করছেন— “ইয়ে হক হ্যায় হামারি, আউর ইয়ে হক আগর আপ বাতো সে নেহি মানোগে তো হাম ছিন কে লেঙ্গে।” স্লোগান উঠছে— আওয়াজ দো! সবাই সমস্বরে বলছেন— হাম এক হ্যায়।
দূর থেকে অনেকেই দাগিয়ে দিচ্ছেন, এই লড়াই শুধু সম্পন্ন চাষিদের। এটা এক রাবিশ বকওয়াস। এই মতামত পোষণ করার অর্থ— সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের ন্যারেটিভকে সাবস্ক্রাইব করা। সম্পন্ন চাষিদের পাশাপাশিই আছেন দরিদ্র ক্ষেতমজুর, আছেন ছোট খেতের মালিক মধ্যকৃষক, যেসব পরিবারের সকলে মিলে চাষ-আবাদ করেন। এদের নিজেদের মধ্যেও স্বার্থের সংঘাত আছে, সংঘর্ষ আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই বিভেদ বিভাজনের প্রতি জনতার আদালতে স্থগিতাদেশ জারি করে তারা রাস্তায় নেমেছেন ‘এক’ হয়ে। যদি কয়েক একর জমির মালিক, সম্পন্ন কৃষক হাইওয়েতে শীতের রাতে ট্রাকটরে ঘুমোন, তাহলে সেটাও একটা বড় প্রাপ্তি, এই দেশের রাজনীতিতে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের পর এমন নজির তো নেই আর।
খুব ছোটখাটো মাপের অবস্থান বিক্ষোভও যারা সংগঠিত করেন, তাদের মাথাব্যথা হয় কোথায় খানা পাই আর কোথায় পাইখানা? আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেই নিশ্চয়ই মনে আছে, ধর্মতলায় কোনও অবস্থানের ডাক দিলেই রাজ্য সরকার প্রথমেই সুলভ কমপ্লেক্সটি বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে! আর এখানে তো লাখ লাখ মানুষ রাস্তায়! খানা পাই নিয়ে তাঁদের সমস্যা নেই। তাঁরাই গোটা দেশকে খানা জোগান। কিন্তু এত মানুষ পাইখানা কোথায় করছেন? এও এক নজির। একভাবে দেখলে কর্পোরেট সেক্টরের বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন। আর সিঙ্ঘুতে দেখবেন, কর্পোরেট সেক্টরের শোরুম বন্ধ অবরোধে, কিন্তু কর্মীরা গেট খুলে দিয়েছেন, যাতে বিদ্রোহী কৃষকরা প্রসাব পাইখানা করতে পারেন। আমি জানি না, শেষ কবে ‘শ্রেণিস্বার্থ’ সচেতন মজদুর এইভাবে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে!
যে পুলিশ আচ্ছাসে লাঠিপেটা করার জন্য প্রস্তুত, তার কাছে প্রবীণ শিখ সর্দার করজোড়ে গিয়ে বলছেন— “থোড়া খানা খা লিজিয়ে পহেলে।” অফিসারের হাতেই রুটি ভর্তি পাত্র ধরিয়ে ধর্মগুরু অনুরোধ করছেন— “আপ থোড়া বাঁট দেঙ্গে রোটি?” রাজনীতির একটা নতুন বয়ান তৈরি হচ্ছে। রাজধানীর সীমানায় একধরনের সীমানা অতিক্রম হচ্ছে। গোমড়ামুখো পলিটিশিয়ানরা যে ‘সীমানা’ এঁকেছেন এতদিন, ভারতের পলিটিকাল পিপল, পলিটিকাল পেজান্টরা সেই সীমানা লঙ্ঘন করছেন। লড়াই শুধু স্টেটের সঙ্গে নয়, স্টেটিস্টদের সঙ্গেও।
যার যেমন সাধ্য তিনি ততটুকু কনট্রিবিউট করছেন এই মুভমেন্টে, আর যতটুকু প্রয়োজন ততটাই নিচ্ছেন ওঁরা। এক জায়গায় দেখলাম ডাঁই করে রাখা আছে মাজন, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, স্যানিটারি ন্যাপকিন। যার যেটা প্রয়োজন তুলে নিচ্ছেন। আড়াই হাজার লিটার দুধ নিয়ে হাজির একটা কো-অপারেটিভ। এক ট্রাক কমলালেবু নিয়ে কয়েকজন তরুণ। আবার তার পাশেই জীর্ণ পোশাকে, ভাঙাচোরা সাইকেলে করে কেউ নিজের জমি থেকে তুলে এনেছেন এক বস্তা ছোলা। বিলিয়ে দিচ্ছেন। যেমন দিয়ে এসেছেন কয়েক শতাব্দী ধরে।
শত শতাব্দী-প্রাচীন সেই আবহমান ভারতবর্ষকে কাছ থেকে দেখে এলাম।