তুষ্টি ভট্টাচার্য
ম্যাজিক রিয়্যালিটি নিয়ে ভাবতে বসলে প্রথমেই আমার ‘চাঁদমামা’র কথা মনে পড়ে। জানি না কী এক আকর্ষণ ছিল এই চাঁদমামা ঘিরে। একটা ছোট্ট পত্রিকা, অস্পষ্ট অক্ষর আর ধ্যাবড়ানো ছবি নিয়ে একটা অচেনা জগত খুলে দিত। পুরাণ বা মহাভারতের অনেক অ্যাডাল্ট লেখাই বেশ রসিয়ে রসিয়ে লেখা হত ওখানে। ফলে ওই ছয়/সাত বছর বয়সে একটা নিষিদ্ধ হাতছানিও দিত এই চাঁদমামা। সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে ছিল মানানসই ছবি। ওখানকার ছবি দেখে প্রথম জানলাম যে সে যুগের ছেলেরা ধুতি-চাদরের সঙ্গে মুকুট আর গয়নাগাটিও পরত। আর মেয়েরা শাড়ি পরত ধুতির স্টাইলে, ওপরে শুধু কাঁচুলি! মা-কাকিমাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বেশ লজ্জা পেতাম আর মনে মনে ভাবতাম কী অসভ্য ছিল ওরা! ওভাবে কেউ বাইরে বেরোয়? ছবির নিষিদ্ধ আকর্ষণের বাইরে গল্পগুলো যেমন টানত, তেমনই আরও একটা গোপন খেলা ছিল আমার ওই গল্পগুলো খুঁটিয়ে পড়ার ভেতরে।
আমার বাবার পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী সব সময়ে ঠোঁটস্থ থাকত যেন। গল্প শোনার নেশা ছিল আমার প্রবল। অনেক বিদেশী গল্পও বলত বটে বাবা, কিন্তু আমায় টানত পঞ্চতন্ত্র, মহাভারত। গল্প বলিয়ে হিসেবে বাবার বেশ নাম-যশ ছিল। বাবাকে ঘিরে কাকা বা দাদা-দিদিদের ভিড় জমে যেত গল্প শোনার জন্য। কাউকে তার বদলে পিঠ টিপে দিতে হত, কাউকে মাথায় মাসাজ করে দিতে হত। তো গল্পের সঙ্গে সঙ্গে এই টেপা বা মাসাজের ফলে বাবার হয়ত একটু চোখ লেগে গেছে, ওমনি একদঙ্গল উৎসুক চোখের ‘তারপর’, ‘তারপর’ প্রশ্ন ছুটে আসত। এরপর অবধারিতভাবে বাবার প্রশ্ন ছিল-– কোথায় যেন ছিলাম… সমস্বরে ধরিয়ে দিত সবাই কোথায় ছিল বাবা। এই রকম গল্পের আসরে বিদেশী গল্প বা ভূতের গল্পরই বেশি ডিম্যান্ড ছিল। আর রাতে বা দুপুরে আমি যখন একলা পেতাম তখন ওই পুরাণের গল্পই চলত। সে সময়ে বাবা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকত আর আমি খাটের ছত্রি ধরে বাবার পিঠ মাড়াই করতাম। তো এই সাদা ধবধবে পিঠ বেয়ে ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত চলাচলে আমার পুরাণ শোনা হত। আর পা ব্যথা হয়ে গেলে পেটের কাছে বসে বুকের লাল তিল খুঁটতে খুঁটতে আমার গল্প শোনার পর্ব চলত। এরপর যখন চাঁদমামায় বাবার বলা কোনও চেনা গল্প পেতাম, আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেলাতাম সব। কোনও নাম বা প্রসঙ্গ যদি না মিলত, ক্যাঁক করে ধরতাম বাবাকে। যেন বাবার ভুল ধরতে পারলেই আমার বিজয় অবধারিত। অবশ্য বাবা কোনওদিন ভুল স্বীকার করত না। বলত–- ধুর ধুর ওরা কিস্যু জানে না, ভুলভাল লিখেছে!
তো এই চাঁদমামার যে ম্যাজিক ছিল, সেই ম্যাজিক মিশে গেছিল আমার ভেতরে। আত্মস্থ করতে পেরেছিলাম বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। কখন কোন অজান্তে সেই ছোটবেলায় এভাবেই আমাদের জীবনে ম্যাজিক রিয়্যালিটি প্রবেশ করে, আর তা আমরা জানতেও পারি না। বড় হয়ে ভাবি ম্যাজিক রিয়্যালিটি বলে কিছু নেই আসলে। কিন্তু যত পরিণত হয় জীবন, দেখা যায় এই ম্যাজিক রিয়্যালিটি আমাদের তাড়া করে ফেরে, পিছন ছাড়ে না।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগে পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা পঞ্চতন্ত্র রচনা করেছিলেন ‘মহিলারোপ্য’ নামের দক্ষিণ ভারতের এক রাজ্যের অমরশক্তি নামক এক রাজার তিন মূর্খ পুত্রের শিক্ষাদানের জন্য। যেহেতু প্রচলিত ধারায় রাজার সেই তিন ছেলে এতদিন কিছুই শিখতে পারেনি, তাই বিষ্ণুশর্মা আশ্রয় নিলেন ম্যাজিক রিয়্যালিটির কাছে। তাদের নীতি শিক্ষা, হিতোপদেশ শেখালেন ৫ পর্বে। ১) মিত্রভেদ, ২) মিত্রপ্রাপ্তি, ৩) কাকোলুকীয়, ৪) লব্ধ-প্রণাশ ও ৫) অপরিক্ষিতকারক নামের পাঁচটি গ্রন্থে যে ছোট ছোট গল্পগুলি লিখলেন তার চরিত্র হিসেবে এসেছে কখনও বানর, কখনও কাক, কখনও গাধা। বিষ্ণুশর্মা বাঘ আর হরিণের বন্ধুত্বের কথা এনেছেন, সিংহ আর মানুষের যুগলবন্দী দেখিয়েছেন, শকুন আর বেড়ালের সম্পর্ক লিখেছেন, হাতির বোকামোর কথাও শুনিয়েছেন। প্রতিটি গল্প তাই ছোটদের মনে দাগ কেটেছে নিপুণভাবে। এভাবে না লিখলে বোধহয় এই গল্পের মাধ্যমে সেই তিন রাজপুত্রের শিক্ষা সম্পূর্ণ হত না। আর ছোটদের মনে গভীর প্রভাবও পড়ত না। এখানেই ম্যাজিক রিয়্যালিটির জয়। পশু আর মানুষকে একই আসনে বসিয়ে প্রতিটি পশুকে মানুষের ভাষা জুগিয়েছেন অথচ হাতি, সিংহ, শেয়ালের বা কাকের যা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তা রয়েছে যথাযথ। ফলে যে কাল্পনিক আবহের মধ্যে দিয়ে এই গল্পগুলি এগিয়েছে, সেগুলিকে আর আমাদের উদ্ভট, কাল্পনিক বলে মনে হয়নি। এক একটা চরিত্র যেন নিজস্ব স্বভাব নিয়েই আমাদের বন্ধু হয়ে উঠেছে। এই গল্পগুলিকে আমার সার্থক ম্যাজিক রিয়্যালিটির নমুনা বলে মনে হয়েছে।
এবার যদি বেতাল-পঞ্চবিংশতির কথা ধরা যায়, এর শুরুতেই ম্যাজিক রিয়্যালিটির চমক। বেতাল নামের এক শব শ্মশানের গাছে উল্টো হয়ে ঝুলছে। তাকে যদি রাজা বিক্রমাদিত্য গাছ থেকে নামিয়ে এনে তাঁর গুরুর কাছে নিয়ে যান, তবে তিনি প্রভূত ক্ষমতা লাভ করবেন। বিক্রমাদিত্য যখন মড়াকে গাছ থেকে নামিয়ে তাকে পিঠে করে নিয়ে যেতে থাকলেন, সেই সময়ে বেতাল কথা বলে উঠল। রাজার কাছে শর্ত দিল যে সে পঁচিশটি গল্প শোনাবে একে একে আর প্রত্যেক গল্পের শেষে একটি করে প্রশ্ন করবে। রাজা উত্তর দিতে পারলেই সে আবার গাছে গিয়ে ঝুলতে থাকবে। আর রাজা যদি ইচ্ছে করে উত্তর না দেন, তাহলে তাঁর বুক ফেটে যাবে। রাজাও কেন জানি রাজী হয়ে গেলেন। পঁচিশতম গল্পের শেষে প্রশ্নের উত্তর রাজা দিতে পারেননি। আর বেতালও তাই ফিরে যায়নি গাছে। সবার আগে যা চোখে পড়ে আমার, বেতাল একজন মড়া হয়েও দিব্যি জ্যান্ত মানুষের মতো গল্প বলছে, কিন্তু তাকে ভূত বলেও ভাবা যাচ্ছে না। আর উত্তর পেলেই আবার কিন্তু সত্যিই ভূতের মতো গাছে গিয়ে ঝুলে যাচ্ছে! রাজার মড়া পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ছবিটাও বড় অদ্ভুত। একজন রাজা মড়া পিঠে বইবেন!! আবার দেখুন সব উত্তর দিলেন তিনি, কেবল শেষেরটাই পারলেন না কেন! নইলে যে পঁচিশটি গল্প বলা হয় না! অথচ পুরো ব্যাপারটাকে একবারও অসম্ভব বা গাঁজাখুরি বলতে ইচ্ছে করে না। এমন বাস্তবে হবে না বা হয় না জেনেও মেনে নিতে ইচ্ছে হয়, ভাল লাগে।
এরপরে যদি রূপকথার আসরে আসি, সেখানে তো পুরোটাই ম্যাজিক রিয়্যালিটি। পক্ষীরাজ ঘোড়া, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী, রাক্ষস-খোক্কস, কৌটো বন্দী ভীমরুলের বুকে প্রাণ, সোনার কাঠি-রূপোর কাঠিতে ঘুম… জলের তলায় প্রাসাদ, সাপের মাথায় মণি, উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। ঘোড়া ব্যবহার বহু যুগ ধরেই মানুষ করে আসছে। কিন্তু সেই ঘোড়ার গায়ে ডানা লাগিয়ে তাকে পাখির কল্পনায় আনা, আর নাম হিসেবে পক্ষীরাজই হোক বা ইউনিকর্ন, সে ঘোড়া উড়বেই। সে সময়ে তো আর প্লেন আবিষ্কার হয়নি, তবুও মানুষ কিন্তু ওড়ার স্বপ্ন বুকে জমিয়ে রেখেছিল। আর যেহেতু ঘোড়া বহন করে মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়, সেহেতু ওই ছুটন্ত ঘোড়াকে যদি ওড়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়, কী সুবিধেই না হয় মানুষের! তাই এই কল্পনাকে কখনই কষ্টকল্পিত মনে হয়নি। মনে হয়েছে, পক্ষীরাজ সত্যি সত্যিই আছে। আর পক্ষীরাজে চড়ার যোগ্যতা কী আর এলেবেলে মানুষের হতে পারে? স্বপ্নের রাজপুত্র ছাড়া এই ঘোড়ায় কাউকেই মানাবে না। তাই রাজপুত্ররা পক্ষীরাজে চেপে এসে রাজকন্যাকেই নিয়ে যায়, কোন সাধারণ নারীকে ওঁর পাশে মানাবে কেন! এবার ধরুন সেই স্বপ্নের রাজপুত্র কোনও গভীর জঙ্গলে গিয়ে পথ হারাল বা কোনও গুপ্তধন উদ্ধারে সে দিগভ্রান্ত হল, তখন তাকে উপায় বলে দেবে কে? কে আবার? ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আছে যে। ওরাও পাখি। কিন্তু স্পষ্ট মানুষের ভাষায় কথা বলে। একজন প্রশ্ন করে আর একজন উত্তর দেয়। আর প্রশ্নগুলো এমনই যে রাজপুত্র সেই প্রশ্নের উত্তর শুনে দিশা পেয়ে যায়। ঠিক এই ধরনের সহজ সমাধানই তো মানুষ চেয়ে এসেছে। সমস্যায় পড়লেই কেউ সহজে সেই সমস্যার সমাধান করে দেবে, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে! আর এই জন্যই ওই কথা বলা পাখি দুটিকে কল্পনা করে নিয়ে আসা– কঠোর বাস্তবের সহজ সমাধান হিসেবে।
আর রাক্ষস-খোক্কসের কল্পনা করাও তেমন অভাবনীয় নয়। দুনিয়ায় বদ লোকের, হিংস্র লোকের অভাব কখনওই ছিল না। আর শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যচারী মানুষ তার পূর্ব অভিজ্ঞতাও ভোলেনি। ফলে এই বিশালকায়, বড় দাঁত, বড় কান, লাল চোখ, ইত্যাদি যত বীভৎস রসের সমাহারে রাক্ষসের কল্পনা করে নেয় মানুষ। আর শ্বাপদের ভয়ে বা অধিক বলশালী মানুষের অত্যাচারে পালিয়ে যাওয়া, লড়াইয়ে হেরে যাওয়া সেই মানুষ তখন নিজের অসহায় অবস্থাকে করুণ করে তুলে ধরার জন্য রূপকথায় এই রাক্ষসদের হাতে বারবার বিতাড়িত হয়েছে। আবার নিজেকে ফিরে পেতে, নিজেকে জিতিয়ে দিতে গিয়ে এই রাক্ষসদের মেরেছেও প্রবল বিক্রমে। আর এই রাক্ষস নিধনকে যতদূর সম্ভব ঢাকঢোল পিটিয়ে লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজের প্রতিষ্ঠা করিয়েছে। এই সব কল্পনাও যেহেতু কষ্টার্জিত ও নিজের ইচ্ছের প্রতিফলন, তাই এই কল্পনাও খাপ খেয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে সুন্দরভাবে। নিজের প্রেমিকাকে না পেয়ে বা সেই প্রেমিকাকে তার নিজের বাড়িতে বন্দী হতে দেখে কল্পনায় এসেছে রাক্ষসপুরীতে রাজকন্যার ঘুমের। এক রাক্ষসী মাথার কাছে সোনার কাঠি আর পায়ের কাছে রুপোর কাঠি রেখে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে রাজকন্যেকে। আর সেই রাক্ষসীর প্রাণভোমরা লুকনো আছে রাজকন্যার বালিশের নীচে রাখা এক কৌটোতে। যতক্ষণ না ওই ভোমরাকে পিষে মারা হবে রাক্ষসীর মৃত্যু নেই। আবার রাজকন্যার মাথার আর পায়ের কাঠি দুটি বদল করলেই তার ঘুম ভাঙবে। এই রাক্ষসপুরী কোথায়? না, জলের নীচে। তো এই জলের নীচে রাজপুত্রকে কে নিয়ে যাবে? এক বিশাল মাছ পিঠে করে সেই জলপুরীতে নামিয়ে দিয়ে আসবে রাজপুত্রকে। আমাদের সুন্দর রাজপুত্র খোলা তলোয়ার হাতে ওই প্রাসাদের ভেতরে রাজকন্যাকে খুঁজে বেড়াবে আর সামনে যে আসবে কুচ করে তার গলা কেটে দেবে। এখন সব থেকে বড় ব্যাপার হল, এই যে যুদ্ধ যুদ্ধ একটা ভাব, এর মধ্যে কিন্তু কোথাও ভয়ঙ্কর কোনও হিংস্রতা নেই। যেন এ একটা খেলা। গলা কাটবে কিন্তু সেভাবে রক্তের স্রোত এসে আমাদের ভয় দেখাবে না। আর রাক্ষসীর প্রাণভোমরাকে টিপে মেরে দিলেই রাক্ষসী শেষ। এর মধ্যে যেন অমানবিক কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন তো রাজাকেই করতে হয়।
ধরুন মার্কোস কি লিখেছেন আমি পড়লাম না, গুন্টার গ্রাস কী লিখেছেন আমি পড়লাম না। সলমন রুশদির কথাও জানলাম না। আমি ম্যাজিক রিয়্যালিটি কী তাইই জানলাম না। কবে থেকে পশ্চিম দেশে এর চর্চা শুরু হল তাও আমি জানলাম না। তার মানে কি এই যে ম্যাজিক রিয়্যালিটি আমাকে ছেড়ে চলে গেল? বা ম্যাজিক রিয়্যালিটির মধ্যে আমি বাস করলাম না? নিশ্চয়ই তা নয়। সেই প্রথমেই বলা চাঁদমামার উদাহরণ যেমন রয়েছে, বড়দের মুখে শোনা রামায়ণ, মহাভারতের গল্পও রয়েছে ম্যাজিক রিয়্যালিটির জগতে অজান্তেই প্রবেশ করার জন্য। রামায়ণের রাবণের পুষ্পক রথে সীতাহরণের কথা ভাবুন একটু! সেই সময়ে এরোপ্লেনের ভাবনা এসে গেছিল মানুষের মস্তিষ্কে! কিম্বা পাখি হওয়ার চিরন্তন ইচ্ছা। জটায়ু পাখি হয়েও বিশালাকৃতির, লড়াইও করল রাবণের সঙ্গে। হনুমান বাহিনীর সমুদ্রে শিলা ফেলে ব্রিজ তৈরি, লাফ দিয়ে সমুদ্র পেরনো, পুরো গন্ধমাদন পর্বত হাতে করে নিয়ে চলে আসা, মেঘনাদের মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ, রাবণের দশ মাথা, একের পর এক উদাহরণ রয়েছে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের। আর মহাভারত তো ম্যাজিক রিয়্যালিজমের খনি। কৌরবের একশো ভাইয়ের ধারণাটাও যেমন অবিশ্বাস্য তেমন পাণ্ডবের পাঁচ ভাইয়ের জন্ম বৃত্তান্তটাও ‘ফিশি’। মাছের কথা এল যখন বলি, মৎস্যগন্ধী মেয়েকে যদি জেলের ঘরের মেয়ে বলে মেনে নিই, সে কীভাবে পদ্মগন্ধী হয়ে উঠল সেও আশ্চর্য। আর যে ঋষির অপ্সরার লাস্যে বীর্য নির্গত হল, সেই বীর্য পাতায় মুড়ে জলে ফেলে দিলে তা খেয়ে গর্ভবতী হয়ে গেল এক মাছ! আর কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধের সময়ে যে বাণগুলো ছোঁড়া হত, তাদের কনসেপ্ট থেকেই কি আজকের মিসাইলের সূত্রপাত? ভীষ্ম অতগুলো তীরের ওপরে কীভাবে অতদিন শুয়ে কাটিয়ে দিলেন, তাও আশ্চর্য। আর দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময়ে সত্যিই কি অদৃশ্য থেকে শ্রীকৃষ্ণ শাড়ির যোগান দিয়েছিলেন? নাকি এও নারীর মর্যাদা রাখার একটা দেখনদারি পরিকল্পনা বা শ্রীকৃষ্ণকে মহিমান্বিত করার ইচ্ছা? সত্যি বলতে কি, এই মহাভারতের এত বড় অনুষঙ্গ থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ম্যাজিক রিয়্যালিজম বোঝানো বাতুলতা। আর সেই ট্রয়ের ঘোড়ার কথা মনে পড়ে? যার পেটের মধ্যে পুরো ব্যাটেলিয়ন ঢুকে গেছিল! আমাদের মনের ভেতরে, সে যে যুগেই হোক, ম্যাজিক রিয়্যালিটির ভাবনার চাষ অনবরত হতে থাকে। প্রকাশ করার ক্ষমতা হয়ত সবার থাকে না, এই যা।
তবু যদি এর উৎপত্তি নিয়ে একটু ভাবি, তাহলে দেখা যাবে আক্ষরিক অর্থে ম্যাজিক রিয়্যালিজম-এর সূত্রপাত হয় ল্যাটিন অ্যামেরিকায়। ১৯২০/৩০ সালের মধ্যে ল্যাটিন অ্যামেরিকার লেখকরা প্রায়শই ইউরোপিয়ান সাংস্কৃতিক পীঠস্থান প্যারিস বা বার্লিনে যাতায়াত করতেন। ফলে তখনকার আর্ট মুভমেন্টের সঙ্গে ওঁরা জড়িয়ে পড়েন। কিউবান লেখক Alejo Carpentier ও ভেনিজুয়েলান লেখক Arturo Uslar-Pietry যেমন সুররিয়ালিজম মুভমেন্ট দ্বারা প্রচণ্ড প্রভাবিত হন। তারপর এক ভিন্ন ধারা হিসেবে ম্যাজিক রিয়্যালিজম প্রবেশ করে ধীরে ধীরে। এর এক বছরের মধ্যে বুয়েনার্স এয়ার্সের শিক্ষিত সমাজে ম্যাজিক রিয়্যালিজম অবশ্য পাঠ্য হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালে Historia universal de la infamia নামের পাবলিকেশন থেকে Jorge Louis Borges সমস্ত ল্যাটিন অ্যামেরিকান লেখকদের ম্যাজিক রিয়্যালিজম নিয়ে লিখতে ও বই প্রকাশ করতে উৎসাহিত করতে থাকেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের ম্যানিয়া শীর্ষ ছুঁয়ে ফেলে। পিয়েত্রি যেমন ফ্রাঞ্জ রো’র ম্যাজিক রিয়্যালিজম-এর প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন, তেমন ইতালিয়ান Massimo Bontempelli বিশ্বাস করতেন ম্যাজিক রিয়্যালিজম হল collective consciousness by “opening new mythical and magical perspectives on reality”।
সমালোচকদের কাছে আজও ল্যাটিন অ্যামেরিকান লেখক Jorge Louis Borges এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোজ-এর নাম ম্যাজিক রিয়্যালিজম-এর আলোচনায় প্রথমেই আসে। মার্কোজ-এর উপন্যাস ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার অফ সলিটিউড’ পৃথিবী জোড়া খ্যাতি পেয়েছে প্রকাশ মাত্রই। মার্কোজ একসময়ে স্বীকার করেছিলেন, “আমার সব থেকে বড় সমস্যা হল যাকে বাস্তব বলে মনে হয় এবং যাকে মনে হয় ফ্যান্টাসি, তার মাঝের লাইনটাকে ভেঙে দিই।” Isabel Allende ছিলেন প্রথম মহিলা ল্যাটিন অ্যামেরিকান লেখক যাঁর খ্যাতি তাঁর দেশের বাইরেও ছড়িয়েছিল। তাঁর উপন্যাস ‘দ্য হাউস অফ স্পিরিট’ মার্কোজের লেখনরীতির অনুসারী ছিল। আর একজন লেখিকা যাঁর নাম না করলেই নয়, Laura Esquivel, যাঁর উপন্যাস ‘লাইক ওয়াটার ফর চকোলেট’-এ সাংসারিক জীবনকে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের সঙ্গে মিলিয়েছিলেন। মেক্সিকান লেখক Juan Rulfo-র নামও উল্লেখযোগ্য ম্যাজিক রিয়্যালিজম নিয়ে লেখার জন্য। ইংরেজিভাষী লেখকদের মধ্যে বৃটিশ-ইন্ডিয়ান লেখক সলমন রুশদির নাম না করলেই নয়। অ্যাফ্রো-অ্যামেরিকান লেখক টনি মরিসন ও গ্লোরিয়া নেলর, ল্যাটিন লেখক Ana Castillo, Rudolfo Anaya, Daniel Olivas, Helena Maria Viramontes, নেটিভ অ্যামেরিকান লেখক Louise Erdrich and Sherman Alexie; ইংলিশ লেখক Louis de Bernières এবং নারীবাদী লেখিকা Angela Carter-ম্যাজিক রিয়্যালিজম নিয়ে যথেষ্ট চর্চা করেছিলেন। সলমন রুশদির লেখায় ইউরোপের সুররিয়্যাল ধারার সঙ্গে ল্যাটিন অ্যামেরিকান মিথিকাল স্টাইলের মিশ্রণ ঘটেছে সুষমভাবে। আর মরিসনের গুরুত্বপূর্ণ গল্প ‘বিলাভেড’-এ রয়েছে এক মায়ের কথা যে এক ভূতুড়ে বাড়িতে তার মৃত সন্তানের আত্মার সঙ্গে কাটাচ্ছেন এবং তাঁর নিজের ছেলেবেলার ভয়ানক দাসত্বের স্মৃতি এসে আমাদের সমাজের অবহেলিত দিকগুলোকে মনে করাচ্ছে। নরওয়ের লেখক Erik Fosnes Hansen, Jan Kjærstad এবং যুবা ঔপন্যাসিক Rune Salvesen-এর নামও ম্যাজিক রিয়্যালিজম নিয়ে লেখার জন্য না করলেই নয়।
আগেই বলেছি লেখালেখির বাইরে ম্যাজিক রিয়্যালিজম নিয়ে আর্ট মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল ইউরোপে সেই ১৯২০/৩০ সালেই। শিল্প সমালোচক ফ্রাঞ্জ রো ১৯২৫ সালে ভিসুয়াল আর্টের এক ফর্মের নাম দেন ম্যাজিক রিয়্যালিজম। যে ফর্মে বাহ্যিক প্রকাশের বদলে অন্তর্লীন রহস্য তুলে ধরার চেষ্টা থাকে। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে এই ধারার কাজ গুলি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এই সময়ে বৃটিশ ও অ্যামেরিকান শিল্পীদের মধ্যে Bettina Shaw-Lawrence, Paul Cadmus, Ivan Albright, Philip Evergood, George Tooker, Ricco উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।
তো আবার যদি ফিরে আসি নিজের ঘরে, আবার আমি সেই নিজেদের দেশীয় ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত হই। সবার আগে তো আমি বাঙালি। তাই বাঙালির দুর্গাপুজোর কথা ভাবলেই ভেসে ওঠে মহিষমর্দিনীর সেই রূপ। ভাবুন তো, দশ হাতে দশ রকমের অস্ত্র নিয়ে, সিংহবাহিনী এই দেবী কী অসম্ভব বিক্রমে মহিষাসুরকে বধ করলেন! যে মহিষাসুরকে কেউ মারতে পারেনি, দেবতাদের ত্রাস হয়ে উঠেছিল, সেই মহিষাসুরকে মারলেন কি না এক নারী! আর যে সে নারী! দশ হাতের ধারণাটাই তো অদ্ভুত ছিল। আর কোমল, লাস্যময়ী নারীর বদলে যুদ্ধংদেহী দুর্গার ইমেজ তৈরিটাও এক অসাধারণ কল্পনা ছিল, যে দেবীকে আমরা এখনও আপন করে কোলের কাছে মেয়ের মতো রেখেছি। সেই দেবী আবার মর্তের কন্যা। তাঁকে বিয়ে করলেন স্বয়ং মহাদেব। ফলে বাপের বাড়ি আসার ছলে দেবী বছরে একবার কৈলাশ ছেড়ে চলে আসেন আমাদের কাছে। অমন প্রতাপ যাঁর, সেই কিনা আমাদের মেয়ে হয়ে রয়ে গেল। এই যে কল্পনা, যা আমাদের দূরে রেখে দেয় না, অসম্ভব মনে হয় না, প্রাণের টানে তাকে আমরা আপন করে নিই, সেই তো ম্যাজিক রিয়্যালিজমের আদর্শ উদাহরণ বলে আমার মনে হয়। আর দুর্গার ছেলেমেয়ের কথাও না বললেই নয়। লক্ষ্মীর বাহন হল পেঁচা। যে পদ্মাসনা লক্ষ্মী ধন, ঐশ্বর্য, যশের দেবী, যাঁর এক হাতে ধান তো অন্য হাতে গাছকৌটো, তাঁকে শেষ পর্যন্ত পেঁচার পিঠে চেপে যেতে হল! আর সরস্বতী, বিদ্যার দেবী চলেন হাঁসের পিঠে চেপে! কার্তিক সুপুরুষ, তিনি ময়ূরে চড়ে যুদ্ধ করতে যান। আর গণেশ! হাতীর মুখ আর হাতির চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থূল শরীরের এই হাতী-মানুষের বাহন কিন্তু সামান্য ইঁদুর! তাঁর সঙ্গে আবার বিয়ে হল কলাগাছের! যে কলা, বা কলাগাছ হাতির প্রিয় খাদ্য, তাকেই কল্পনা করা হল গণেশের স্ত্রী হিসেবে। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে যে বৈপরীত্য রয়ে গেছে তাদের একসাথে ভাবলে আমাদের তাক লেগে যায়। অথচ অবিশ্বাস করতেও মন চায় না।
ম্যাজিক রিয়্যালিজমের বিজ্ঞ কচকচির মধ্যে না গিয়ে যেটা আমাকে টানে, তা হল, সাধারণ থেকে অতি সাধারণ মানুষ, এমন কি অশিক্ষিত মানুষও একে অতিক্রম করতে পারে না। কোন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি না করেই আমাদের মননে, বিশ্বাসের কোনও এক গোপন ঘরে থেকে যায় এর যাদু। ঠিক যেভাবে ছোটবেলার বাস্তব জীবন আমাকে নিয়ে যায় ম্যাজিক রিয়্যালিজমের হাত ধরে এক অন্য জগতে। আজও যে তার ছায়া থেকে বেরনো গেল না! সেই ছোট মেয়েটির কথা শুনুন তাহলে একটু–
একটা কাস্ট আয়রনের গ্রিল দেওয়া দোতলা বারান্দা দেওয়া ঘর ছিল তাদের। নীচে নামা বারণ ছিল, সামনের বড় রাস্তা দিয়ে অজস্র গাড়ি, রিকশা, সাইকেল, টাঙা ছুটে চলেছে। বারান্দার ঠিক নীচেই কতগুলো টাঙাওলা দাঁড়িয়ে থাকত। মেয়েটা মন দিয়ে ঘোড়াদের দেখত। সেই হাড়জিরজিরে খচ্চরদের দেখে ও রূপকথার ডানাওলা ঘোড়াদের কেমন দেখতে হয় কল্পনা করার চেষ্টা করত। আর ঠিক এইরকম সময়ে একদিন ওর লাগানো প্রথম গাছটার সাথে ওর দেখা হয়ে গেল। সে এখন বেশ ডাগরটি হয়েছে। ওরই মতো সবুজ কচি হাত, কচি ডালপালা। দুজনের দুজনকে চিনতে ভুল হল না। অনেক খেলল সেদিন ওরা। তারপর সেই গাছ চলে গেলে ও আবার ঘোড়া দেখতে থাকল।
ঘোড়াদের যে ডানা হয় না, মেয়েটা জানল অনেক পরে। সেই যে তার বাবা-মা হিন্দি দেশ থেকে বাংলায় ফিরে এল-– ও নাকি ভালো করে বাংলা বলতে পারছে না, কথায় হিন্দি টান এসে যাচ্ছে, বাংলা না শিখলে কী চলে! অতএব সেই থেকে নাস্তাউস্তার বদলে জলখাবার বলা শুরু হল। আর টাঙাদের, টাঙার ঘোড়াদেরও সে ভুলতে থাকল। এখানেও ট্রেন, রেললাইন আর স্টেশন ঘিরে ওদের কোয়ার্টার। এখানে অবসর সময়ে লাইনের ওপর ব্যালেন্সের খেলায় সহজেই পাখি হয়ে যেত ও। দুষ্টুমি পেলে মাটির ভাঁড় কুড়িয়ে এনে লাইনে সাজিয়ে রাখত আর তার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যেত বোমা ফাটাতে ফাটাতে। স্টেশনে বাবার কাছে গিয়ে টরেটক্কা দেখে, তার টকটক শব্দে বার্তা পাঠানো শুনে তার মনে হয়েছিল, সে কেন অমন ভাষায় কথা বলতে পারে না! যদি এমন হত-– ও মুখ খুললেই টরেটক্কা টকটক… ছন্দের বোল ফুটত!
এখানে এসে ও যেমন জেনেছিল ঘোড়াদের ডানা হয় না, জেনেছিল সেই প্রথম লাগানো গাছটিকে দেখে চিনতে না-পারার ভান করতে হয় অলিখিত নিয়মের মতো, তেমনই জেনেছিল ট্রেনের ডানা হয়। ট্রেনের ডানা ছিল সেই প্রথম থেকেই, ও দেখতে পায়নি। আজ বেশ বুঝতে পারে, ও যখন বেড়াতে যেত ট্রেনে চেপে বাবা-মায়ের সাথে, তখন সেই ট্রেনের ডানা গজাত। ট্রেনের ভেতরে বসে থেকে সেটা ও বুঝতে পারেনি। স্টিম ইঞ্জিন থেকে কয়লার গুঁড়ো যখন ওর চোখে এসে পড়ত জানলা দিয়ে, বাবা একটা ভিজে রুমাল ধরিয়ে দিত হাতে। তাই দিয়ে ও চোখ ঢেকে রাখত বলে দেখতে পায়নি ট্রেনের ডানা। আবার যখন মালগাড়িটা কয়লা নামাতে আসত ওদের সেই কোয়ার্টারে, তখন ডানা গুটিয়ে রাখত এমনভাবে যাতে ও দেখতে না পায়। এসব লুকোচুরি খেলা, ওর আর ট্রেনের মধ্যে এখনও চলে। আজ ও ট্রেনের পাশে থাকে না, স্টেশনের পাশে থাকে না, কিন্তু শুনশান দুপুরে বা নিশুতি রাতে যখন দূর থেকে ইলেকট্রিক ট্রেনের বাঁশি শোনা যায়, ও বোঝে, সেই খেলাটা এখনও চলছে। শুধু এই খেলায় এখন ওর হেরে যাওয়াই নিয়ম। আসলে হেরে যেতে হয়। সেই যে ছোটবেলায় ও ট্রেনের ডানা দেখতে পায়নি, সেই থেকে ভীষণ অভিমানে বুঝি ওকে আর ডানা দেখাতে চায় না ওর ট্রেন। ট্রেন আর মেয়েটার মাঝে এখন একটা দূরত্ব থাকে। সেই দূরত্ব অবশ্য মনের নয়, পরিমাপের। এখন মেয়েটা ট্রেন লেখে। ট্রেনের ডানা আঁকে। সেই প্রথম গাছটিকে লিখে রাখে, লিখতে লিখতে ও ভাবে একদিন কোনও লাস্ট ট্রেন ধরতে গিয়ে ও ফেল করবে। আর ওরই চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনের লেজটা অদৃশ্য হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। ফাঁকা নিশ্চুপ স্টেশনে ও একা দাঁড়িয়ে থাকবে, কয়েকটা কুণ্ডলী পাকানো কুকুর আর ভিখিরির ঘুমের পাশে।