Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শিশুশ্রমের উপর অতিমারির অভিঘাত

স্বপ্নিল লোহানি

 


ছাত্র, আইআইএম-আমেদাবাদ। মূল ইংরাজি থেকে লেখাটি তর্জমা করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।

 

 

 

ক্রমবর্ধমান কোভিড-১৯ সংক্রমণ এবং ভারতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্টের বন্যায় গত নয় মাস যাবত সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়াগুলি ডুবে ছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সময়ে কর্মচ্যুত হয়েছে অথবা কম মাইনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কয়েকশো কিলোমিটার পথ হেঁটে নিজেরে ঘরে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন অভিবাসীরা। গ্রামীণ ভারতে অর্থনৈতিক কার্যাবলি স্তব্ধ হয়েছে।

দৃশ্যমান এই বিষয়গুলি নিয়ে সংবাদ সংস্থাগুলি বিস্তৃত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু যে বিষয়গুলি অদৃশ্য, সেগুলি স্পর্শও করেনি। এমনই একটি বিষয় হল শিশুশ্রমের উপর কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত।

গত কয়েক দশক ধরে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে সেই আন্দোলনে পিছু হঠার সম্ভাবনা প্রবল। আন্দোলনের ইতিবাচক চিহ্নগুলি ইতিমধ্যেই মুছতে শুরু করেছে এবং অধিকাংশ জায়গায় পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সেই কারণে অতিমারির অভিঘাতের এই দিকটিকে স্বীকৃতি দিয়ে শিশু এবং তাদের পরিবারগুলিকে সুরক্ষা দেওয়ার পদক্ষেপের আশু প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

অতিমারির নেতিবাচক অভিঘাতে অর্থনীতি তো জর্জরিতই। এর জেরে বিতরণ ব্যবস্থা গভীর ভাঙনের সম্মুখীন। উৎপাদনের গতিও স্তব্ধ। এর ফলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে অত্যন্ত বেশি অনুপাতে কর্মীর কারণে অতিমারিতে জোর ধাক্কা লাগা অর্থনৈতিক এবং শ্রমবাজারগুলিতে ভারতের অবস্থা বিশেষত নড়বড়ে হয়ে গেছে।

আগেকার মহামারি এবং আর্থিক সঙ্কটগুলির অভিজ্ঞতা মনে রাখলে ধরে নিতে হবে করোনাভাইরাসের এই অতিমারির জেরে শিশুশ্রমের আধিক্য ঘটবে। ২০১৪-১৬ ইবোলা অতিমারির সময়ে এক বড় সংখ্যক শিশুর অবস্থা সঙ্গীন হয়েছিল এবং শিশুশ্রম অধ্যুষিত ক্ষেত্রগুলি বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত শতকের আট ও নয় দশকে বিশ্ব জুড়ে এইচআইভি/এইডস অতিমারিতে আর্থিক বৃদ্ধি কমতে থাকে, যার ফলে শিশু ও যুবাদের উপর তার ব্যাপক অভিঘাত পড়ে। বহু শিশু তাদের অভিভাবকদের হারায় এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে নিজের বাড়ি, অসুস্থ অভিভাবক এবং ভাইবোনদের দায়িত্ব বর্তায় তাদের নরম কাঁধে। স্কুল না গিয়ে কম বয়সে কোনও দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই কাজে যোগ দেওয়ার ঘটনার বহু রিপোর্ট বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়। ২০০৭-৮-এ বিশ্ব জুড়ে আর্থিক সঙ্কটের সময়েও শিশুশ্রমের ঘটনা বাড়ে, যাতে উল্লেখযোগ্যভাবে বালিকাদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি।

বর্তমানে করোনাভাইরাস অতিমারিতে শিশুশ্রমের সমস্যাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছাবে নিম্নোক্ত আর্থ-সামাজিক অভিঘাতগুলির ফলে:

১। জীবনযাত্রার মানের অবনমন

অবৈধ বসতিব্যবস্থা এবং অপ্রতুল বাসস্থানের কারণে ভারতে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঝুপড়িতে থাকেন অতিমারিতে তাঁরা পঙ্গুত্বে পৌঁছেছেন। আমাদের দেশে এখনও অসংখ্য মানুষ আছেন, যাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। অপরিসীম দারিদ্রের মধ্যে বসবাসকারী মানুষদের সংখ্যাও এই অতিমারির সময়ে আকাশ ছুঁয়েছে। দারিদ্রের সঙ্গে শিশুশ্রম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কারণ পরিবারের প্রত্যেকেই বাঁচার জন্যে সহজলভ্য উপায়গুলি গ্রহণ করবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে এক শতাংশ দারিদ্র বৃদ্ধি পেলে ০.৭ শতাংশ শিশুশ্রম বৃদ্ধি পায়।

২। কর্মসংস্থানের অধোগামিতা

বর্তমান অতিমারির কারণে যেহেতু আর্থিক কাজকর্মে ও কর্মসময়ের অভূতপূর্ব পতন ঘটছে এবং যেহেতু আর্থিক সঙ্কোচনে শ্রমবাজারে সুযোগ কমে যায়, তাই বেশি সংখ্যক শিশুদের বিপজ্জনক এবং শোষণভিত্তিক কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মাইনে কমে যাওয়ার ফলে অধিক সংখ্যায় পরিবারের মানুষগুলি এমনিতেই টিকে থাকার জন্যে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে কম বয়সের শিশুদেরও কাজে পাঠানো হচ্ছে। বস্ত্র উৎপাদন, ময়দাকল ইত্যাদি অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে কর্মদাতাদের ব্যবসায় আর্থিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় সস্তা শ্রমের উৎস হিসেবে শিশুদের শোষণ করা হচ্ছে। তাছাড়াও, যে শিশুরা এখন কর্মরত, তাদেরকে কম পয়সা দিয়ে বেশি সময় খাটিয়ে নেওয়ার ঘটনাও বাড়তে পারে।

৩। অসংগঠিত কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি

সাম্প্রতিক সঙ্কট অবৈধতার নানা উপায় খুঁজে বার করেছে। মূলধনভিত্তিক ছোট ব্যবসাগুলির পতনের ফলে আত্ম-কর্মসংস্থান বাড়ছে, তার সঙ্গে বাড়ছে শিশুদের কাজে জড়িয়ে নেওয়ার ঘটনাও। দেশজ এবং আন্তর্জাতিক বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়াতে খাদ্যের সরবরাহ এলোমেলো হয়েছে। এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে কর্মনিয়োগের সুযোগ আর নেই এবং কৃষকদেরও রোজগার কমতে থাকায় শেষ অবধি শিশুশ্রমের বৃদ্ধির রাস্তা প্রশস্ত হচ্ছে।

৪। ঋণ সঙ্কট

বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের ছায়ায় বৃহৎ আকারে রয়েছে ঋণ সঙ্কট, বিশেষত দারিদ্র অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে। ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি ঋণ শোধ করতে না পেরে ঋণখেলাপি হচ্ছে। অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা ধার দিতে ইতস্তত করছেন। এভাবে ঋণ সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার ফলে পরিবারগুলি স্কুলশিক্ষায় খরচ কমাচ্ছে, যার অবিমিশ্র ফল হবে শিশুশ্রমের বৃদ্ধি।

৫। স্কুলগুলি বন্ধ

সারা দেশ জুড়ে স্কুলগুলি বন্ধ হওয়ার ফলে প্রায় তিন কোটি কুড়ি লক্ষ প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীর জীবন প্রভাবিত হয়েছে। সরকারি স্কুলগুলির সুযোগবঞ্চিত শিশুরা এর ফলে মাত্রাতিরিক্ত হারে বাধাগ্রস্ত। এদের অধিকাংশই বরাবরের মতো স্কুলছুট হয়ে কাজে নিযুক্ত হয়েছে।

এই হেতুগুলি ছাড়াও অন্যান্য কারণে যখন পরিবারগুলির রোজগার কমছে, শিশুরাও সংসারে টাকা জোগান দিক— এই প্রত্যাশা তীব্রভাবে বাড়তে পারে। আরও বেশি সংখ্যক শিশুদের শোষণভিত্তিক এবং বিপজ্জনক কাজে ঠেলে দেওয়া হতে পারে। যারা এযাবৎ কাজে নিযুক্ত তাদের আরও বেশি সময় ধরে আরও খারাপ পরিবেশে কাজ করতে হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে লিঙ্গ-অসাম্য আরও গভীর হতে পারে, যেখানে মেয়েদের থেকে আশা করা হতে পারে যে তারা ঘরকন্নার পাশাপাশি মাঠেতেও কাজ করুক।

সন্দেহ নেই বর্তমান সঙ্কট শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে, সরকারকে আজকে ভাবতে হবে অতিমারির গতিপথ অনুযায়ী কোন পথ তারা বাছবে, কোনদিকে যাবে, এবং তার ফলশ্রুতি কী হতে পারে। এই বাছাইয়ের মধ্যে সেই সচেতন প্রয়াসগুলিকে অন্তর্গত করতে হবে যা দিয়ে শিশুশ্রম প্রথাকে আটকানো যায় এবং বর্জন করা যায়। জনসাধারণের খাতে ব্যয়ে যদি অত্যন্ত বেশি সঙ্কোচন ঘটানো হয়, তাহলে তা শিশুদের আরও অসহায় অবস্থায় ফেলে বিপজ্জনক এবং শোষিত হওয়ার দিকে ঠেলে দেবে। ভেবেচিন্তে পথ বাছলে এই ঝুঁকিগুলি কমানো যেতে পারে। যেমন দরিদ্র পরিবারগুলির জন্যে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প রূপায়ণ।

এছাড়াও সরকারকে এই ব্যাপারগুলিতে মনযোগী হতে হবে:

১। দরিদ্র পরিবারগুলি যাতে সংস্থাদের থেকে ঋণ চাইতে পারে, তার নিশ্চয়তা;
২। যে প্রাপ্তবয়স্করা ছাটাই হয়েছেন, তাঁদের জন্য উপযুক্ত শালীন কর্ম সৃষ্টি;
৩। প্রতিটি শিশু যাতে শিক্ষা পেতে পারে তা নিশ্চিত করা;
৪। শ্রমদপ্তরের প্রশাসন এবং ক্ষমতা পোক্ত করা;
৫। কর্মীদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং
৬। সামাজিক কর্মীদের পরিষেবাকে আপৎকালীন করে টাকা জোগান দেওয়া

সঠিক আর্থ-সামাজিক এবং শিশু নিরাপত্তা নীতিগুলি বেছে নিলে তাৎক্ষণিক সঙ্কট থেকে পরিবারগুলি এবং তাদের শিশুদের রক্ষা করা যাবে। এতে যে উপকারগুলি পাওয়া যাবে, তার জের চলবে অনেক দিন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে উপযুক্ত ও শালীন কর্মসংস্থান এবং কাজে ফেরত যাওয়ার নীতিগুলি নিশ্চিত করা, শিশুদের স্বার্থে নিরাপদ উপায়ে স্কুলগুলিকে আবার চালু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং সামাজিক কর্ম এবং ক্যাশ ট্রান্সফারের মতো সামাজিক নিরাপত্তার উপায়গুলিকে সঙ্কট সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আরও ক্ষমতা প্রদান করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে পরিবারগুলির রোজগার কম, তারা নিজেদের মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর জন্যে যাতে শিশুশ্রম অথবা শিশুদের বিপদ ঘটায় এমন ক্ষতিকর উপায়গুলি দিকে না ঝোঁকে, তাদের জন্যে এই ব্যবস্থাগুলি নেওয়া অতীব জরুরি।