Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমরা এক ব্যাপক গণআন্দোলনের সাক্ষী থাকছি

শতাব্দী দাশ

 



প্রাবন্ধিক, গল্পকার, শিক্ষক, সমাজকর্মী

 

 

 

টিকরি সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকরা অঞ্চলটাকে যে ৫টি গ্রামে ভাগ করে নিয়েছেন। গ্রামগুলির নাম শুনুন:

বাবা বান্দা সিং বাহাদুর নগর— প্রায় তিনশো বছর আগের ভূমিহীন কৃষকদের আন্দোলনের নেতা বাবা বান্দা সিং বাহাদুর। এই আন্দোলনে ভূমিহীন কৃষকরা নিজেদের ফৌজ তৈরি করেছিলেন এবং গ্রাম থেকে সামন্তপ্রভু জমিদার জোতদারদের উৎখাত করেছিলেন। পাঠক, ভেবে দেখুন, যে কৃষক আন্দোলনকে ধনী কৃষক-কুলাকদের আন্দোলন বলে কত কথাই বলা হয়েছে, এমনকি যাঁরা এই আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়িয়েছে তাঁদেরও অনেকেরই এরকম একটা বিশ্বাস রয়ে গেছে, সেই আন্দোলনে একটি গ্রামের নামকরণ করা হচ্ছে সামন্তবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের প্রতিভূ এক ভূমিহীন কৃষক যোদ্ধার নামে!

চাচা অজিত সিং নগর— ১৯০৫-০৭-এর কৃষক বিদ্রোহ ‘পাগড়ি সামহাল জাঠা’-র নেতা। ভগত সিং-এর কাকা বলে গোটা পাঞ্জাব অজিত সিংজিকে চাচা অজিত সিং বলেই ডাকে।

গদরি গুলাব নগর— গুলাব কৌর, ১৯১৪ সালের গদর আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য কানাডা থেকে চলে এসেছিলেন এবং এই আন্দোলনেই শহীদ হন।

শহীদ ভগত সিং নগর— ভগত সিং-এর পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছি না। বরং পাভেলজির কথাতেই বলি—ও, পাভেলজি। সুর্খ লিগ পত্রিকার সম্পাদক। নিউজক্লিকের ভাষা সিং-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনিই শোনালেন এই গ্রামগুলির নাম সম্পর্কে—ভগত সিং হলেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক। আজ কৃষকরা লড়ছেন দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে, যাদের রাজনৈতিক রূপই হল সাম্রাজ্যবাদ। অতএব কৃষকরা ভগত সিং-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে চাইছেন।

শহীদ সাধু সিং তাখতোপড়া নগর— বছর দশেক আগে অমৃতসর জেলার পাকিস্তান সীমান্তের দিকে ভূমিহীন কৃষকরা সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছিলেন তার নেতা।

শুরু বাবা বান্দা সিং-কে দিয়ে, শেষ শহীদ সাধু সিং-কে দিয়ে। দুজনেই ভূমিহীন কৃষকদের নেতা, যাঁরা লড়াই করেছিলেন সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে।

 

সচরাচর ভূমির মালিক ও কৃষিমজুরের স্বার্থসংঘাত ঘটেই থাকে। তেমনটাই প্রায়শ দেখা যায় পাঞ্জাবে বা হরিয়ানায়। প্রায়শই মজুরি নিয়ে ঝঞ্ঝাট বাধে দুই পক্ষের। কিন্তু বর্তমান সময়ে  দিল্লির সীমানায় তিনটি কৃষি আইন বিরোধী কৃষকদের প্রতিরোধ মঞ্চ যদি দেখেন, তবে জমির মালিকদের সঙ্গে ক্ষেত-মজুরদেরও দেখা পাওয়া যাবে বহুল সংখ্যায়। কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক্ষেত্রে সবাই এককাট্টা।

ক্ষেত-মজুররা মনে করছেন, তিনটি কৃষি আইন ১৪৪৩২৯৮৩৩ ক্ষেতমজুরের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলবে (২০১১র আদমসুমারি অনুযায়ী ওটাই ছিল ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের সংখ্যা)। তাঁরা আরও মনে করছেন এই আইন চুক্তিচাষের দিকেই ঠেলে দেবে কৃষিব্যবস্থাকে, কারণ কৃষিক্ষেত্র থেকে সরকার তার সহায়তা তুলে নিচ্ছেন। এমতাবস্থায় আজ নয় কাল চাষি চুক্তিচাষের বশ্যতা স্বীকার করবেনই। আর লাগাতার চুক্তিচাষের ফলে ভুগবেন ক্ষেতমজুররাও। কীভাবে?

তাঁরা মনে করছেন, আরও বেশি মুনাফার জন্য চাষ হবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। ফলে তাঁদের হাতে কাজই থাকবে না। দ্বিতীয়ত, কর্পোরেটগুলি এমন শস্যের চাষেই আগ্রহ দেখাবে যাতে কম মজুর লাগে। যেমন ধান চাষে মজুর বেশি লাগে৷ তার বদলে অন্য ফসল চাষ হলে অনেকেই কাজ হারাবেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী শস্য উৎপাদনেই বাধ্য করা হবে চাষিদের।

অন্যদিকে ভাগচাষিদেরও বক্তব্য, ভাগচাষব্যবস্থাই উঠে যাবে। তাঁরা তো চাষ ছাড়া আর কিছু জানেনই না। তাহলে কোন পেশা বেছে নেবেন এবার?

ক্ষেতমজুররা এও বলছেন যে তাঁদের ন্যূনতম মজুরিও ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইজের’ (MSP) সঙ্গে জড়িত, যা সরকার আর মূল চাষিকে দিতে চাইছেন না। তা চাষি নিজে না পেলে, মজুরদের মজুরি দেবেন কী করে? এখনই ক্ষেতমজুরদের কোনও নির্দিষ্ট আয় নেই, পিডিএস (পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম)-এর মতো সমাজকল্যাণমূলক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে তাঁদের সংসার চলে। সেই ব্যবস্থাও নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির সামনে দুর্বলতর হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ভারিতের উপর চাপ বাড়াচ্ছে পিডিএস তুলে দিতে। এরপর তাঁরা আরও বিপদে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন।

এছাড়া তাঁরা এও আশঙ্কা করছেন যে এরপর খাদ্যশসের ঘাটতি দেখা যাবে। অথচ পিডিএস পদ্ধতিতে এই মজুররা হাতে খাদ্যশস্যই পেতেন। তাই তাঁদের কাছে তা ছিল খাদ্য-নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।

ভারতে ৩৬ শতাংশ শিশুর ওজন আদর্শ ওজনের চেয়ে কম। ৫৮ শতাংশ শিশুর আছে রক্তাল্পতা (জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য, ২০১৫-১৬)। এর পরের অসমাপ্ত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে শিশু-অপুষ্টি আরও বেড়েছে।

জাতীয় পুষ্টি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩৮.৪ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়েছে ও ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তাল্পতায় ভুগছে। এমতাবস্থায় তাঁরা খাদ্য সুরক্ষাও হারাতে চাইছেন না।

তাঁরা এও বুঝেছেন, ‘প্রয়োজনীয় পণ্য আইন’-এর সংস্কারের ফলে আর যথেচ্ছ পরিমাণ খাদ্য মজুত করতেও সমস্যা থাকল না। তখন খাদ্যশস্য স্বাভাবিকভাবেই আরও নাগালের বাইরে চলে যাবে।

জমির অধিকারের প্রশ্নও এক নতুন আকার নেবে বেসরকারিকরণের ফলে। যাঁদের জমি আছে, তেমন চাষিরা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, তাঁদের জমি আর তাঁদের হাতে থাকবে না, কর্পোরেটের হয়ে যাবে। এদিকে ভূমিহীন মজুরেরা কিন্তু এখনও আশা করেন যে সরকারি বিলিব্যবস্থার মাধ্যমে এক টুকরো জমি হয়ত কখনও তাঁরা পাবেন। কারণ স্বাধীনতার সময় সেই স্বপ্নই তাঁদের দেখানো হয়েছিল। বড় চাষিরাই যখন জমি হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছেন, তখন ভূমিহীনদের কখনও জমি পাওয়ার আর যে কোনও আশাই থাকছে না, তা বলাই বাহুল্য।

শেষ কুড়ি বছরে এঁদের অবস্থা আরওই খারাপ হয়েছে। ভূমিহীন কৃষিমজুরের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৯ শতাংশ হয়েছে। দলিতদের অবস্থা খারাপতর। ৫৮ শতাংশ দলিত কৃষিমজুর ভূমিহীন।

এই ভূমিহীন কৃষকেরা সরকার, জঙ্গলরক্ষা-বিভাগ, জমির মালিক বা জমি মাফিয়া সবার দ্বারাই উৎপীড়িত। কিন্তু এদের সকলের চেয়েও তাঁরা বেশি ভয় পাচ্ছেন বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে। পাঞ্জাবের মতো কিছু জায়গায় সরকার ইতোমধ্যেই সেইসব জমি কর্পোরেটকে দিয়ে দিয়েছে, যা একদিন ক্ষেতমজুরেরা বিলিব্যবস্থার মাধ্যমে পাওয়ার আশা করেছিলেন।

এই সময় ভারত ক্ষুধা ও বেকারত্বের সর্বকালীন ঊর্ধ্বতম রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে। সরকারের উচিত ছিল কৃষিতে আরও ভর্তুকি দিয়ে, কৃষিব্যবস্থাকে উন্নত করে, ক্ষুধা সূচককে নামাতে সাহায্য করা। আসন্ন অনাহারে মৃত্যুগুলি এড়ানো। এমএসপি নিশ্চিত করা। ফসল নষ্ট হতে না দেওয়া। প্রতিটি নাগরিককে খাদ্য সুরক্ষা দেওয়া। অথচ তারা করছে ঠিক তার উল্টোটা। তারা স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের দারিদ্র ফিরিয়ে আনতে চাইছে, বা আরও বেশি ভয়ঙ্কর দিন আনতে চাইছে।

তাই ভূমিহীন কৃষক ও ভাগচাষিরাও আজ ভূমি-মালিক কৃষকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ে।

 

এবং সঙ্গে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরাও।

“যবে থেকে কৃষকভাইদের এই আন্দোলন শুরু হয়েছে পাঞ্জাবের সমস্ত লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরাই সেই আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছেন। আমরা এর আগে রেল অবরোধে ছিলাম, এখানে রয়েছি, স্ট্রাইকে সামিল হয়েছি, সমস্তরকমভাবেই আন্দোলনের সঙ্গে থাকছি।” বললেন পাঞ্জাবের লেখক সুখদেব সিং সিরসা। কেন? “কৃষকরা দেশের সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করেন। পাঞ্জাবের তো বটেই, সারা দেশের বহু লেখকই কৃষক পরিবারের সন্তান। ফলে আমরা কৃষকদের সমস্যা, তাঁদের যন্ত্রণা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। আর আরও একটা কথা। আমরা লেখকরা কৃষক পরিবার থেকে এলেও সাধারণত সুবিধাভোগী হয়ে যাই। শহরে বসবাস শুরু করি, কৃষকদের কথা আওয়ামের কথা আমাদের আর মনে থাকে না। কিন্তু এই আন্দোলন আমাদের সেই বিবেকে গিয়ে আবার ধাক্কা মেরেছে। একদিকে তো প্রচুর নতুন লেখক উঠে এসেছেন। এই আন্দোলনকে ঘিরে চমৎকার সব নতুন নতুন কবিতা, গান রচিত হয়েছে, হচ্ছে। আরেক দিকে পুরনো লেখকরা যাঁরা কৃষকদের ভাষা ভুলে গেছিলেন, তাঁরাও আবার সেই ভাষায় লিখছেন যা কৃষকদের উপলব্ধিতে আসে, তাঁদের স্পর্শ করে।”

গত ৮ তারিখের ধর্মঘট দেখেছে কৃষকদের পাশে প্রায় সারা দেশকে দাঁড়াতে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশ কৃষকদের বিক্ষোভস্থলে যেতে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে কাল সারাদিন গাজিপুরে অবস্থানরত কৃষকরা সর্বাত্মক অবরোধ করেছিলেন। ওদিকে মহারাষ্ট্র থেকে বিশাল সংখ্যক কৃষক এই বিক্ষোভে যোগ দিতে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন…

কৃষক আন্দোলন সর্বার্থেই দিনে দিনে এক ব্যাপক গণ-আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে।