চার নম্বর নিউজডেস্ক
মিছিল। মুখের। তার মধ্যেও চেনা যায়। আলাদা করা যায়। হলদে রঙের চুন্নি। স্কার্ফ। তোয়ালে। টুথব্রাশ। টুথপেস্ট। কম্বল। এসব সম্বল করে সীমান্তে পড়ে থাকা পাঞ্জাবের ঘরাছোঁ গ্রামের গুরমাইল কউর আশি পেরিয়েছেন। বিক্ষুব্ধ কৃষকদের জন্য রুটি বানাচ্ছেন। কোনওদিন ঘর থেকে বেরিয়েছেন গুরমাইল? নাহ। বিয়ে বা শোকসভার জন্য হয়ত বা। তাও পরিবারের সঙ্গে। একা? নাহ। তাহলে এখন? কেন? জমির জন্য লড়তে হবে না? দরকার নেই চুন্নির। দরকার নেই লজ্জাশরম নিয়ে ভাবনার। লড়কে লেঙ্গে। গুরমাইলের ঘরে ছেলের ছবি। হ্যাঁ, ছবিই। পাঞ্জাব পুলিশে কাজ করা ছবির ভেতরের মানুষটা ২০ বছর হল দিগন্তের ওপারে কোথাও। গুরমাইল ওকে স্বপ্নে দেখেছেন। ছোট ছোট হাত পা খেলছে, বড় হচ্ছে। একসময় বৃদ্ধ হচ্ছে। গুরমাইল, মা গুরমাইলকে এসব দেখতে হবে? সন্তানমৃত্যু দেখতে হবে? গুরমাইলের যায় আসে না আর কিছু। লড়কে লেঙ্গে।
হিংস্র কিছু লেবার কোড আর ড্রাকোনিয়ান তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কীভাবে হাঁটছেন মহিলারা? কীভাবে লড়াই, চিৎকার, দাবিদাওয়া? ভাষায় প্রথাগত পেলব নারীত্ব? নাকি দাপুটে পৌরুষ? টিকরি, সিংঘু চেনাল অন্য নারীদের। লড়াই শুধু সরকারের বিরুদ্ধে না, লড়াই পৌরুষের বিরুদ্ধে, চোলাই মদের বিরুদ্ধে, জাতবিদ্বেষ এবং লিঙ্গবিদ্বেষের বিরুদ্ধেও।
সুভিতা নেহরা ৩৪ ছুঁয়েছেন। ঘরে কী করেন? গরু আছে। ওদের খাওয়ান, দুধ বিক্রি করতে দূরদেশে পাড়ি। তারপর? কেন? গেরস্থালি টুকিটাকি। বাকিদের খাওয়াতে হবে না? স্বামী, সন্তান, পরিবার? নিজে খান সময়মতো? সুভিতা হাসেন। রাজস্থানের স্বীকার জেলার প্রতাপপুরা গ্রামের ৩০ বিঘে জমির মালিক অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক উইমেন অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে লড়াই করা সুভিতা এনএইচ এইটের ওপর বসে অসম্ভব শীতে হাসেন। চোয়ালে পেলবতা নেই। দাপুটে কণ্ঠ। দাবি। কালাকানুন উপড়ে ফেলার। বছর পঞ্চাশের তারা ধয়াল ১০ বিঘে জমিতে গম, বাজরা চাষ করেন। বলছেন, ‘পুরুষদের সমান খাটনি খাটি, আমরা জানি যন্ত্রণা কাকে বলে। আমাদের চেয়ে সত্যের বোঝা আর কার আছে? কে নেবে দায়?’ সুভিতা ভিচারের কথায় অন্য সুর। ২০১৭ সালে গোরক্ষা আন্দোলনে গবাদি পশুর হত্যার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল সরকার থেকে। বেড়ে গেল প্রচুর স্ট্রে ক্যাটল। সব্জির খেতে, মাঠে ঢুকে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করা এই সব স্ট্রে ক্যাটলদের আটকাতে সরকার কিন্তু ব্যবস্থা নিল না। উল্টে ফেন্সিং করতে হল সুভিতাদেরই। ক্রোধ এমনি এমনি আসে না। কালাকানুন তিনটে না। তিন হাজার।
সরকার থেকে ঘরের পুরুষ। মেয়েদের লড়াই কৃষির প্রেক্ষিত থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর পৃথিবীতে। লিনিয়ার নিয়মে যাকে বেঁধে ফেলা যায় না। সুমন ৪৫ পেরচ্ছেন। কী করেন সারাদিন? কেন? ‘ফসল কি বুয়াই, সাফাই, কাটাই।’ আর ঘরের লড়াই? স্বামীর মদের টাকা। সুমনের নিজের আয়ের সবটুকু জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া মরদ। কাকে বলবেন? কোন সমাজ? বছর পঞ্চাশের বলজিৎ কউর এবং বছর ষাটের ফুলমতির একই গল্প। হরিয়ানার রেওয়াড়ি থেকে তাঁদের লড়াই চোলাই বন্ধ করার জন্যেও। পাশে আসছেন সুমন এবং আরও অনেক সহকর্মী। ছিনিয়ে নিতে হবে। কালাকানুন তোলার দাবি। গেরস্থালি হিংসে থেকে বেঁচে ওঠার দাবি।
মহিলা কিসান অধিকার মঞ্চ হিসেব দিচ্ছে, দেশের পঁচাত্তর শতাংশ কৃষিকাজ আসলে করেন মেয়েরাই। অধিকাংশ খাটুনি তাঁদেরই। অথচ জমির মালিকানা মাত্র ১২ শতাংশের। তাই, শেষমেশ হিসেবে তাঁরা অদৃশ্য। ইনভিজিবল। কালা কানুন এসে গেলে তাঁরা দেশের কৃষিব্যবস্থার ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সত্তাটিও খুইয়ে বসবে। যেটুকু টিকে আছে, সেটুকুও।
জলন্ধর থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার হেঁটে টিকরি এসেছেন কুলবিন্দর কউর, পারমিন্দর কউর। বলছেন, ‘খেতে গেলে কাজ করতে হবে। কিন্তু কাজ করেও খাবার পাব না? এ কেমন সরকার? কেমন নিয়ম? কেমন আইন?’ যশপাল কউর, সুরজিৎ কউর, পরমজিত কউর। বয়স যথাক্রমে ৫৮, ৬২, ৫২। তিনজনেই বাসন্তী রঙের দোপাট্টা পরে বসে আছেন। ট্রিবিউট টু ভগৎ সিং। অথবা বছর বাষট্টির মনজিৎ কউর। পাঞ্জাবি শেরনি। লায়োনেস। আরও বাকি চারজন মহিলার সঙ্গে জিপ চালিয়ে চলে এসেছেন পাতিয়ালা থেকে সিঙ্ঘুর দিকে। ভাইরাল। সোশ্যাল মিডিয়া। মনজিৎরা পারেন। মনজিৎরাই পারেন। প্রতিবাদ। কিশোরী, তরুণী মুখ। একসঙ্গে বসে আছেন অথবা কেউ লঙ্গরখানা চালাচ্ছেন। এখনও মাঝবয়স পেরোয়নি বা সবেমাত্র পেরিয়েছে রমনদীপ কউর, জসসি সাঙ্ঘা, নিকিতা জৈন, সোনিয়া মানের মতো তরুণীদের। সরাসরি কৃষক না হলেও কারও পূর্বসূরি কৃষক। অথবা এঁদের কারও বাবা কাকা ট্রেড ইউনিয়ন করেন। কারও মা অন্যের ঘরে খেটে খান। কিন্তু এঁরা পড়েছেন অনেকদূর। বুকে, হাতে প্ল্যাকার্ড। ‘উই আর নট গোদি মিডিয়া, অ্যান্ড উই নো ইংলিশ’।
ল ইন্ডিয়া প্রোগ্রেসিভ উইমেন অ্যাসোসিয়েশনের নরিন্দার সিং একটা অন্য সমস্যার কথা বললেন। লকডাউনে পাঞ্জাবের বহু মহিলা ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা থেকে কখনও কখনও বাধ্য হয়েই এমনকী একশো শতাংশ সুদের হারে ঋণ নিতেন। কোনওমতে শোধ করতেন। অতিমারিতে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের মাথায় হাত। যেমন টিকরি সীমান্তে বসে থাকা মনপ্রিত কউর। মোষ কিনতে ৬০০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। আগে শোধ করে দিচ্ছিলেন মাসিক কিস্তির টাকা। লকডাউনের সময় থেকে আর পারছেন না। বছরে ১৫ থেকে ২০ দিন আয় হয়েছে। কীভাবে দেবেন? এঁরাই একসময় নরিন্দরের কাছে এলেন। মহীয়সী এই মহিলা গড়ে তুললেন ‘অউরত কর্জ মুক্তি আন্দোলন’। মহিলাদের এককাট্টা করে ব্যাঙ্ক বা সংস্থাগুলির কাছে প্রতিবাদে এলেন। পুলিশ দিয়ে খেদিয়ে দেওয়া হল। আটকানো গেল না। তিন মাস সময় চাওয়ার দাবি জানানো হল। লকডাউন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়সীমাও অপ্রতুল হয়ে গেল। শেষমেশ লোন ওয়েভিং-এর দাবি। ব্যাঙ্কগুলি বাধ্য হয়েছে মেনে নিতে। নারীত্বের জয়। গরিবির জয়। প্রতিবাদের জয়।
আরও অনেক মুখ। টিকরিতে বসে থাকা বছর আশির মুখতিয়ার কউর পাঞ্জাবের পাতিয়ালার কাঁকরালা ভাইকা গ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন। ‘বুকে বড় ব্যথা করে গো। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। শীত। আর পারছি না। তবু, থাকব।’ ঘরাছোঁ গ্রামের বছর সত্তরের তেজ কউর। গত ছাব্বিশে নভেম্বর সিটুর ডাকা হরতাল থেকেই পথে নেমেছেন। পাঞ্জাবের জমিন প্রাপ্তি সংঘর্ষ কমিটির সদস্য হিসেবে লড়াই করছেন অনেকদিন। পাঞ্জাব ভিলেজ কমন ল্যান্ডস (রেগুলেশন) অ্যাক্ট, ১৯৬১ অনুযায়ী দলিতদের দেওয়া জমি অধিকার কায়েম রাখার লড়াই। নারীত্বের সঙ্গে দলিত হিসেবে অন্য এক লড়াই। লেয়ারের পর আবার একটা লেয়ার। বুকে বিশ্বাস। কথা। উচ্চারণ। ‘আমি পুলিশকে ভয় পাই না। শ্বাস ছাড়া আর কিছু বাকি নেই এই বয়সে। সেই শ্বাসটুকুও কেড়ে নেবে? নিক।’
শুরু করেছিলাম গুরমাইলকে দিয়ে। গত আটই ডিসেম্বর কালাঝড় টোল প্লাজার কাছে প্রতিবাদ সভার মধ্যে এনএইচ সেভেনের উপর হঠাৎ কার্ডিয়াক আরেস্ট। গুরমাইল চলে গেছেন। ঘরে ছেলের ছবির ভেতর ঢুকে গেছেন। আবার বছর কুড়ি পর দেখা হওয়া দুজনের সে কী আদর …
শ্বাসটুকু আছে ওঁদের। প্রিয় সরকার, অবগতির জন্য জানাই, সেটুকু থাকবে…