অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
ডিসেম্বর মাসের গোড়ার দিকে নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত এক সভায় একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলায় খুব শোরগোল উঠেছিল। শিল্পের উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের নীতিতে কী ধরনের সংস্কার আনতে পারেন, এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভারতে বলিষ্ঠ সংস্কার সাধন করা খুব কঠিন।… আমাদের গণতন্ত্রের মাত্রা বড় বেশি— উই আর টু মাচ অব আ ডেমোক্র্যাসি।’’ এই মন্তব্যে সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার ঝড় ওঠে: গণতন্ত্রের মাত্রা কমাতে চাইছেন, এত বড় স্পর্ধা! বক্তাও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে নানান যুক্তি দেন। প্রথমে বলেন, তিনি একেবারেই ও-রকম কথা বলেননি, ওই উক্তিটি ছিল রফতানি নীতি সংক্রান্ত। তার পরে আবার সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখে জানান যে, তিনি নাকি বলতে চেয়েছিলেন, ভারতে গণতন্ত্র অত্যন্ত জোরদার, আর্থিক সংস্কারের ব্যাপারে চিনের মডেল এ-দেশে চলতে পারে না। তিনি যে প্রসঙ্গে যে ভাবে বিতর্কিত মন্তব্যটি করেছিলেন, তার সঙ্গে পরের ব্যাখ্যাগুলিকে মেলানো খুবই কঠিন। তাই এ-সন্দেহ থেকেই যায় যে, আসলে ভারতে ‘গণতন্ত্রের বাড়াবাড়ি’র কথাই তাঁর মনে ছিল, সেই মনের কথাটাই অসতর্কভাবে মুখে বলে ফেলেন।
বস্তুত, তেমনটা ঘটে থাকলে অবাক হওয়ার কিছুমাত্র কারণ নেই। সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে বাজারের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিলেই অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে— এমনটাই তাঁর বা তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস। অথচ ভারতে সেটা কিছুতেই কব্জি ডুবিয়ে করে ওঠা যায় না, নানা দিক থেকে বাধা আসে, প্রতিবাদ ওঠে, গণতন্ত্রের বাধ্যবাধকতায় সরকারকে পিছু হটতে হয়, আপস করতে হয়, সংস্কারের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে, প্রায়শই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অ্যাকসেলারেটরে চাপ দিয়েছেন, বিভিন্ন আইন পাল্টে বাজারের স্বাধীনতা বাড়িয়ে চলেছেন, কয়লাখনিতে বেসরকারি পুঁজিকে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে, শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকের অধিকার কেটে-ছেঁটে মালিকদের অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, কৃষি আইন পাল্টে কৃষিপণ্যের বাজারে এবং উৎপাদনে সরকারের ভূমিকা বহুলাংশে রদ করে বেসরকারি, বিশেষত কর্পোরেট পুঁজিকে অবাধে বিচরণের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এই সব ‘সাহসী’ পদক্ষেপের জন্য নীতি আয়োগের কর্তা তাঁর ওই ভাষণটিতেও প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারকে পঞ্চমুখে বাহবা দিয়েছেন। কিন্তু ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি যখন এই সভায় কথা বলছেন, তত দিনে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিবাদী আন্দোলন দানা বেঁধেছে, ভারতীয় কৃষিতে তথাকথিত উদার আর্থিক নীতির অভিযান বানচাল হওয়ার আশঙ্কা ঘনিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি তাঁর মনে হয়ে থাকে যে, এত বেশি গণতন্ত্রের বোঝা নিয়ে দ্রুত এগোনো যায় না, অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। তিনি একা নন, উদার অর্থনীতির প্রবক্তা ও চালকরা সাধারণভাবে এমন ধারণাই পোষণ করে থাকেন। তাঁদের দৃঢ়বিশ্বাস— সব ব্যাপারে গণতন্ত্রের দাবি মেনে চলতে গেলে অর্থনীতিকে ‘ঠিক পথে’ চালানো সম্ভব নয়। এই বিশ্বাসের কথা তাঁরা কেউ সচরাচর মুখে বলেন না, কারণ তাতে গণতন্ত্রের অমর্যাদা হয়। কিন্তু কখনও কখনও, বেশি চাপে পড়লে, সেই রীতি লঙ্ঘিত হয়, অন্তর-নিহিতবিশ্বাস লৌকিকতার হাঁড়ি ভেঙে হাটের মাঝে ফাঁস হয়ে যায়।
হাটে হাঁড়ি ভাঙার এমনই আর এক কাহিনি শুনিয়েছেন ইয়ানিস ভারুফাকিস। গ্রিসের সন্তান এই অর্থনীতিবিদ এবং জনপ্রিয় প্রাবন্ধিক বামপন্থী দল সিরিজা-র নেতা অ্যালেক্সি সিপ্রাস-এর আবেদনে সাড়া দিয়ে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে স্বদেশের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে স্বদেশে নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার পরে আমেরিকা থেকে স্বদেশে পৌঁছে একটা মোটরবাইক নিয়ে ভোটের প্রচারে বেরিয়ে পড়েন তিনি। গ্রিসের অর্থনীতি তখন গভীর সঙ্কটে। আন্তর্জাতিক পাওনাদারদের কাছে, বিশেষ করে জার্মানির সরকার তথা ব্যাঙ্কের কাছে দেনার দায়ে দেশের মাথা বিকিয়ে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তারা চাপ দিচ্ছেন তাঁদের নির্দেশ মেনে কঠোর আর্থিক সংস্কার চালু করতে হবে, তবেই গ্রিস আরও ঋণ পাবে, তা না হলে ইইউ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হল। বামপন্থী সিরিজা প্রবল প্রচার চালাল: সংস্কারের নামে কৃচ্ছ্রসাধনের (অস্টারিটি) নীতি ‘মানছি না মানব না’। এবং আগেরবারের দ্বিগুণ আসন পেয়ে ক্ষমতায় এল। সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেন ভারুফাকিস। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস-এর সরকারে অর্থমন্ত্রীর আসন পেলেন তিনি। তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ হল ইইউ-এর প্রশাসনিক শাখা ইউরোপিয়ান কমিশন, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক (ইসিবি) এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ)— এই ‘ট্রয়কা’ বা ত্রিমূর্তির সঙ্গে আর্থিক নীতি নিয়ে বোঝাপড়া চালানো। ত্রিমূর্তির নেতারা প্রথমেই সাফ জানিয়ে দিলেন, ইইউ-এর সদস্য থাকতে হলে তাঁদের নির্দেশ মতো কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি মানতেই হবে। তাঁদের সঙ্গে গ্রিসের নবনির্বাচিত সরকারের টানাপড়েন চলল। সেই পর্বে এক দিন অর্থমন্ত্রী ভারুফাকিস বললেন, গ্রিসের মানুষের প্রতি তাঁদের সরকার দায়বদ্ধ, যে নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সিরিজা দেশের ভোটে জিতেছে, এখন তাদের পক্ষে কী করে সেই নীতিই চালু করা সম্ভব! জার্মানির ফেডারাল সরকারের দাপুটে অর্থমন্ত্রী উলফগাং শয়ব্ল জবাব দিলেন, ‘‘কোনও সদস্য দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম নির্বাচনের ফলে বদলে যাবে, এটা হতে দেওয়া যায় না।’’
ভারুফাকিস যত দিন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, ত্রিমূর্তির সঙ্গে প্রবল লড়াই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস অচিরেই নিজের গদি বাঁচানোর তাড়নায় আত্মসমর্পণ করেন, অর্থাৎ ‘কৃচ্ছ্রসাধন’-এর দাবি মেনে নেন। অর্থমন্ত্রীর আসনে পুরো ছ মাসও না কাটিয়ে ভারুফাকিস পদত্যাগ করেন। ওই ঝটিকাপর্বের নানা অভিজ্ঞতার কথা পরে চমৎকার করে লিখেছেন তিনি, বলেছেনও অনেক বার। তাঁর মতে, সেই সব কাহিনির মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ হল জার্মান অর্থমন্ত্রীর ওই মন্তব্যটি। তার কারণ— গণতন্ত্রের দৌড় আসলে কতটুকু, তা ওই একটি বাক্যে পরিষ্কার হয়ে যায়। একটি দেশের আর্থিক নীতি কেমন হবে, কীভাবে তার সঙ্কট মোকাবিলা করা হবে, সে বিষয়ে জনসাধারণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার— এটাই গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শর্ত হওয়া উচিত। অথচ সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচনে সেই বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খুব স্পষ্ট ভাবে যে মত দিয়েছেন, ক্ষমতার অধীশ্বররা জানিয়ে দিচ্ছেন, সেই মত মেনে দেশের নীতি নির্ধারণ করা চলবে না, ‘সেটা হতে দেওয়া যায় না’!
গ্রিসের দৃষ্টান্তটির বিশেষত্ব এইখানে যে, দেশের নির্বাচিত সরকারের ওপর অন্য দেশের বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তারা মাতব্বরি করেছেন এবং সরকার তা মেনে নিয়েছে। দেশের সরকারের এই অ-ক্ষমতার মধ্য দিয়ে সরাসরি প্রকট হয়েছে গণতন্ত্রের অ-ক্ষমতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকার দায় এবং তার সঙ্গে জড়িত বিপুল ঋণের দায় গ্রিসের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্বকে কার্যত অর্থহীন করে দিয়েছে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের দুর্বলতা কার্যত পরাধীনতার চেহারা নিয়েছে। এই ধরনের সঙ্কটের নমুনা বিশ্ব অর্থনীতিতে আমরা বার বার দেখেছি। এক সময় দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশেই আইএমএফ ইত্যাদির মাধ্যমে এমনশাসন অতিমাত্রায় প্রকট ছিল। এ-কথা বলা বাহুল্য যে, এই শাসনের প্রকৃত লাগামটি যার হাতে ধরা, তার নাম বিশ্ব-পুঁজি বা বিশ্বায়িত কর্পোরেট পুঁজি। গ্রিসের ক্ষেত্রেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইসিবি-র কর্তারা সেই পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করেই কৃচ্ছ্রসাধনের নিদান দিয়েছেন। সেই স্বার্থরক্ষা করতে গেলে জনস্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে, কারণ কৃচ্ছ্রসাধনের পথে আর্থিক সংস্কারের আসল মানেটাই হল এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পেটে কিল মেরে বিশ্বপুঁজির মুনাফার রসদ জোগানো চাই, অ্যালেক্সি সিপ্রাস শেষ পর্যন্ত যে দাবি মেনে নিয়ে সিরিজার সরকারকে বাঁচিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজির সংঘাত এ ক্ষেত্রে সরাসরি অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের চরিত্র নিয়েছে।
ভারতের দৃষ্টান্ত এর সঙ্গে মিলবে না। কোনও বিদেশি রাষ্ট্রশক্তি, ব্যাঙ্ক বা অর্থলগ্নি সংস্থা তার সরকারকে কোনও আর্থিক নীতি জারি করার হুকুম দিচ্ছে না। দেশের নির্বাচিত সরকারই আর্থিক নীতি স্থির করছে। নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের একমাত্র শর্ত হয়, তবে মেনে নিতেই হয় যে দেশের অর্থনীতি গণতন্ত্রের পথেই চলছে। কিন্তু যে গণতন্ত্র নির্বাচন-সর্বস্ব, সে তো নিতান্তই রোগা এবং রুগ্ণ। ভোটের মায়া কাটিয়ে যদি আর একটু এগোতে চাই, বহুজনের মতামত নিয়ে, বহুজনের সঙ্গে আলোচনা করে, বহুজনের স্বার্থ এবং কল্যাণকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়ে নীতি নির্ধারণের এবং সেই নীতি রূপায়ণের মধ্যে দিয়ে যদি গণতন্ত্রকে খুঁজতে চাই, তা হলে সরকারকে, কেবল কেন্দ্রীয় সরকার নয়, সমস্ত স্তরের প্রশাসকদের মানুষের, বিশেষত ভিন্নমতের মানুষের কথা অনেক বেশি শুনতে হবে এবং সেই কথাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যাঁরা সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের পথের কাঁটা মনে করলে চলবে না, ‘বড় বেশি গণতন্ত্র হয়ে যাচ্ছে’ ভাবলে চলবে না, ‘আমরা কেন চিনের মতো নই’ বলে হা-হুতাশ করলে চলবে না।
যথার্থ গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত হল, আর্থিক নীতি রচনা করতে হবে সত্যিকারের জনস্বার্থের কথা ভেবে। সরকার যদি সেই শর্ত পূরণের চেষ্টা করে, তবে দেখা যাবে গণতান্ত্রিক আলোচনার পথটাও অনেক প্রশস্ত হয়ে গেছে, সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে। সরকার যদি জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অতিকায় কর্পোরেট পুঁজির মালিক এবং অন্যান্য ক্ষমতাবানদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে তো বাধা আসবেই। সেই প্রতিস্পর্ধাই গণতন্ত্রের বেঁচে থাকার লক্ষণ। ক্ষমতার অধীশ্বর এবং তাঁদের মুখপাত্ররা সে-কথা বুঝবেন না, বুঝলেও মানতে পারবেন না, তাঁরা গণতন্ত্রের বাড়াবাড়িই দেখবেন। সেটাই তাঁদের ধর্ম। শ্রেণি-ধর্ম।