জয়াশিস ঘোষ
কবি, গদ্যকার
লালি সিং। পাঞ্জাবের আকানওয়ালি গ্রামে তিন পুরুষের চাষ। সবুজ বিপ্লবের হাওয়া যখন ভারতবর্ষের জমিতে সোনা ফলাচ্ছে, কেউ ভাবেনি জমির নিচে ভারতবর্ষ শুকিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে গভীর নলকূপ। টেনে নিচ্ছে জল। বেড়ে যাচ্ছে চাষের খরচ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সারের দাম। ঋণে ঋণে জর্জরিত কৃষক পরিবারগুলোর থেকে মাঝে মাঝেই পাওয়া যাচ্ছে আত্মহত্যার খবর। লালি সিং বড় ঝুঁকি নিলেন। সব জমি বন্ধক রেখে ২০ লাখ টাকা ঋণ। যদি সোনা ফলে এবার, বিক্রি করে সব ধার মিটে যাবে। তার সঙ্গে মেয়ে গুরপ্রীতের বিয়েটাও।
কিন্তু প্রকৃতি বাদ সাধল। যতটা বৃষ্টি হওয়া দরকার, হল না। যেটুকু ফসল ঘরে উঠল, তার থেকে চাষের খরচটুকুও উঠল না। একদিন ভোরে লালি সিং রেললাইনে আত্মহত্যা করলেন। একদিন পরে গুরপ্রীত। না, এই ঘটনায় কোনও সাড়া পড়েনি। কেউ লালির স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিটও নীরবতা পালন করেনি। করার জন্য শোক বেঁচে নেই আর লালির গ্রামে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে ১০২১৮ জন ভারতীয় কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন ৩০ জন। প্রতি ঘন্টায় অন্তত ১ জন। এবং কে না জানে, সরকারী তথ্য মূল সিনেমার শুধু ট্রেলারটুকু। অধিকাংশ আত্মহত্যা রিপোর্ট হয় না। যারা আমাদের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছে, তাদের ঘরে ভাত নেই। না খেয়ে রয়েছে তাদের সন্তান…
আমরা খোঁজ নিই? কেন কৃষক রাস্তায় এসে দাঁড়ায়? জ্বালিয়ে দেয় গয়না বিক্রি করে ফলানো ফসল? কেন রেললাইনের ধারে রোজ পড়ে থাকে গরীব চাষির লাশ? আমরা বিজ্ঞাপন দেখি বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোর। শাহরুখ খানের হাসি, দীপিকার গাল। কেউ বলছে ১০০০ টাকার কেনাকাটায় এক কিলো পেঁয়াজ ফ্রি। কেউ বলছে সারা মাসের বাজার করুন, চিনি আমরা দেব। অথচ যারা এগুলো ফলাচ্ছে?
করোনা ভাইরাসের কারণে এমনিতেই চাষের মরশুম সোনালী মাঠ কালো করে দিয়েছে। ট্রেন না চলায় চাষি তার ফসল আনতে পারছে না বাজারে। জ্বালানির দাম বাড়ছে। বেড়ে চলেছে ঋণের বোঝা। এত খরচ করে যদিও বা বাজারে নিয়ে আসছে ফসল, বিক্রি হচ্ছে না। তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সংবাদপত্রেও এর টিআরপি নেই। শুধু বাজারে গিয়ে দেখছি, যে বুড়ি মাসি শাকসব্জি নিয়ে বসত, হঠাৎ তার জায়গা ফাঁকা।
তার মধ্যে সরকার কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের বিল এসেছে। বলছে চাষি বৃহত্তর জায়গায় তার ফসল বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই হবে? চাষি দাম পাবে তার ফসলের? কর্পোরেট চাষের জমিতে ঢুকে পড়া মানে কৃষককে নিজের জমিতে শ্রমিক বানিয়ে দেওয়া। বড় বড় কোম্পানিগুলো চাষের জমিতে তাড়াতাড়ি বেশি ফসল পাওয়ার জন্য বিনিয়োগ করবে। চাষি ঋণের জালে নিজেকে আরও জড়িয়ে ফেলবে কর্পোরেট চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য। দাম নির্ধারণ করবে বাজার। কারণ সরকার আর এদেরকে আবশ্যিক পণ্যের মধ্যে ফেলবে না।
কর্পোরেট প্রতিযোগিতায় চিরকাল শ্রমিকই সবথেকে কম দাম পায়। কারণ এই শাহরুখ খানের যে বিজ্ঞাপন আমরা দেখি, তার খরচও পণ্যের দামের মধ্যেই ধরা থাকে। থাকে প্যাকেজ কস্ট, ডিস্ট্রিবিউশন কস্ট, বা শপিং মলের এসির খরচও। তাই চাষি দাম পাবে না। চক্রব্যূহের মত একবার এই বৃত্তে ঢুকে পড়লে কর্পোরেট মালিকের দাসত্ব করে যেতে হবে আজীবন।
একবারও ভেবেছেন, বাজারের থেকে কম দামে কী করে পেঁয়াজ আপনার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে এরা? কারণ চাষির হাতে আর গুদাম থাকছে না। এটা আগেই কর্পোরেটের হাতে চলে গেছে। ওরা ঠিক করছে কখন কোনটার দাম বাড়বে। ভারতীয় আইন অনুযায়ী পণ্য সরিয়ে রেখে কৃত্তিম দাম বাড়ানো অপরাধ। কিন্তু যদি সেটা আবশ্যিক পণ্য না হয়, তাহলে কেউ বলার থাকবে না। হঠাৎ দেখবেন বাজারে আলু নেই। যে তিনগুণ দাম দিয়ে কিনতে পারবে, প্লাস্টিকের র্যাপারে মুড়ে তার বাড়ি আসবে। যে পারবে না, সে বাজারে কর্পোরেটের খারাপ হয়ে যাওয়া আলু খুঁজবে। গরীব চাষি কিন্তু বাধ্য থাকবে নামমাত্র মূল্যে তার সমস্ত ফসল কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
এই কারণেই আজকে ভারতের চাষিরা রাস্তায় নেমেছে। আন্দোলন করছে। ওদেরও খাবার চাই। চাই সন্তানের শিক্ষা। আজকে ওরা যদি ভালো থাকে, আমি, আপনি সঠিক খাবার সঠিক মূল্যে পাব। নাহলে বিষ কিনতে বাধ্য থাকব আকাশছোঁয়া দামে।
ওদের পাশে দাঁড়ান। আমাদের পাতে যারা ভাত তুলে দেয়, তাদের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকলে, তার দায় কি একটুও আমাদের নয়? ভাবুন।
ধান বোনা শেষ হলে পাক দেয় শকুনের দল
নদী জানে কবে তার শুকিয়েছে বুক ভরা জল
জলের ভেতর থেকে কান্নার স্বর গিলে খায়
কারা যেন ফিসফিস কথা বলে রাতের হাওয়ায়
চলে গেছে ঘর দোর পূর্নিমা রাতে দিয়ে ফাঁকি
মেয়ের ওড়না ওড়ে বটগাছে, কালবৈশাখী
তবুও তো ক্ষিদে পায়, জমির বসন চলে যায়
নায়িকার লিপস্টিক শহরের মাসের খাতায়
খাতা খোলে ফুটপাথে শপিং মলের গেটে ভিড়
শূন্য ক্ষেতের মাঝে কৃষকের মুঠো অস্থির
তবুও দরজা খোলে কাঁকড়ের ঋণ বাড়ে ভাতে
রক্ত ও ঘাম মেশে আমাদের সুগন্ধী পাতে
যদি তারা মাঠ ছেড়ে দলে দলে বসে রাস্তায়
কত ধান পড়ে থাকে শাসকের লাভের খাতায়?