Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“বাংলার সংস্কৃতি জগতের তো বটেই, সুধীর চক্রবর্তীর চলে যাওয়া আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি”

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়

 



বাংলা সংস্কৃতি জগতের ইন্দ্রপতন অব্যাহত৷ গত ডিসেম্বরের এক হিম রাতে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত গবেষক সুধীর চক্রবর্তী৷ যদিও বাউল-ফকির গবেষক— এটা সুধীর চক্রবর্তীর মূল পরিচয় হলেও একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর জীবন ও কাজের নানা দিক নিয়ে এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় অংশ নিলেন সুধীরবাবুর স্নেহধন্য, অনুজ লোকসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ, লেখক ও চলচ্চিত্রকার ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়। তাঁকে প্রশ্ন করলেন কবি বিপ্লব চৌধুরী৷ এই ঈথার আলাপের সাক্ষী রইল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম

 

 

 

বিপ্লব চৌধুরী: ল্যাডলীদা, প্রথমেই যে প্রশ্নটা রাখছি তা হল যে কোনও বড় মাপের মানুষ মারা গেলেই আমরা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুনতে পাই যে একটা অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি তোমার কাছ থেকে জানতে চাই সুধীরবাবুর চলে যাওয়ায় তোমার প্রথম প্রতিক্রিয়াটা কী?

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়: আমি প্রথম যখন এই খবরটা শুনলাম, আমারও একই কথাই মনে হয়েছিল। A great loss…  সত্যিই এক বিরাট ক্ষতি হল আমাদের। সুধীরদাকে আমি নানা পর্বে নানানভাবে দেখেছি। আমি যখন প্রথম সুধীরদাকে দেখি তখন আমার বয়স উনিশ কি কুড়ি বছর। তখন আমি মূলত বাউল গান শোনার জন্য বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। সে সময় নানা জায়গায় সুধীর চক্রবর্তীকে দেখেছি, তখন উনি খুব একটা accessible ছিলেন বলে মনে হয়নি। ওঁকে দেখে মনে হয়েছিল, একজন গম্ভীর মাস্টারমশাই বসে আছেন। লোকজন ওঁকে জানতেন, বাউলেরাও ওঁকে চিনতেন, সেই সূত্রেই তারা আমাকেও সুধীরদাকে চিনিয়ে দেন। আমি অবশ্য ততদিনে ওঁর কয়েকটি লেখা পড়ে ফেলেছি। কিন্তু ওঁর সঙ্গে যে সেইসময় খুব একটা যোগাযোগ হয়েছিল, তা নয়। আমি লক্ষ করতাম। আমি জানতে পেরেছিলাম যে বাউলদের মধ্যে যে গাঁজা খাওয়া, মদ খাওয়া ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে, উনি সেগুলির খুব বিরোধী৷ ওঁর লেখা পড়লেও সেকথা বোঝা যায়। যাই হোক, ওইভাবেই সুধীরদাকে আমার প্রথম দেখা।

তার বেশ কিছু বছর পরে, আমি তখন একটা ছবি করেছি। একটি সংস্থা গোর্কি সদনে ছবিটা দেখাবে। আমি তখন কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকি। প্রদর্শনের দিন বিমানবন্দরে নেমে আমি সোজা গোর্কি সদনে পৌঁছই। ওখানে পৌঁছে আমি জানতে পারি, আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হলেন সুধীর চক্রবর্তী। আমি ভাবলাম, সব্বোনাশ। কারণ ততদিনে আমি সুধীর চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে কিছু লেখালেখি করে ফেলেছি। বাউলদের সম্পর্কে ওঁর যে বক্তব্য; বিশেষ করে গৌর, সুবল, পবন এঁদের সম্পর্কে… সে সম্পর্কে আমার লেখায় আমি দ্বিমত পোষণ করেছিলাম। অথচ এই অনুষ্ঠানের শুরুতে সুধীরবাবুই বলবেন। প্রমাদ গুণলাম। যাই হোক, ওঁর সঙ্গে দেখা হতেই আমি ওঁকে প্রণাম করলাম, আমার সহজাত ভঙ্গিতে। এরপর উনি যখন বলতে উঠলেন, সেই বক্তৃতায় উনি আমার প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন। উনি বলেছিলেন— এত কাজ করছে ল্যাডলী, কিন্তু বাউলদের নিয়ে কেন ছবি করছে না? আমি অত্যন্ত ছোটবেলা থেকে ওকে দেখেছি৷ দেখেছি, ও অত্যন্ত নিবিষ্টমনে বাউল গান শোনে আর ডায়রিতে কীসব লেখে। সেগুলো ও কী লিখল, কী ভাবল সেসব তো আমরা জানতে পারলাম না। অবশ্য মাঝেমধ্যে আমাকে দুয়েকটা গালাগালিও করেছে, সেগুলোও আমি পড়েছি…।

ঠিক এইভাবে সুধীরবাবুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ তৈরি হল, যা দ্রুত খুব ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্কের পর্যায়ে চলে যায়। সুধীরবাবু ক্রমে সুধীরদা হলেন। আমি যে কতবার গেছি কৃষ্ণনগরে ওঁর বাড়িতে গেছি তা আমি গুনে বলতে পারব না। নানা প্রজেক্টে ওঁর দ্বারস্থ হয়েছি, ওঁকে ডেকেছি— এটা সম্বন্ধে একটু উপদেশ দিন, এটায় একটু হেল্প করুন, উনি সবসময় ও সাগ্রহে তা করেছেন।

কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ওঁর মতামত যেমন আমার পছন্দ হয়নি, তেমনি একইসঙ্গে বাউল-ফকির নিয়ে কাজ করতে গিয়েও অনেককিছু আমি ওঁর কাছ থেকে শিখেছি। সেই শেখাটা যেমন ওঁর লেখা পড়ে, তেমনি ওঁর সাথে গল্প করে, আড্ডা মেরেও বহু কিছু শিখেছি। পরবর্তীকালে ওঁর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে, বা ওঁর সঙ্গে মিশেও দেখেছি উনি আসলে খুবই accessible। গান ছাড়াও কৌম সমাজের নানা দিক নিয়ে উনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। শুধু আমার যেটা মনে হয়েছে, ওঁর দেখাটা একটু দূর থেকে দেখা। যেহেতু উনি একজন মাস্টারমশাই মানুষ, আখড়ায় গিয়ে একেবারে পাছা পেতে বসে পড়ার মানুষ উনি ছিলেন না। সেখানে কখনও কখনও আমার অস্বস্তি হয়েছে, সেটা আমি ওঁকে বলেছিও। এমনকি তিনি আমার সেই সমালোচনা খুব স্পোর্টিংলি নিয়েছেন। এমন নয় যে সেসব কথার জন্য ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনওদিনও খারাপ হয়েছে৷ এটাও মানুষ হিসেবে সুধীরদার একটা বড় গুণ।

উনি আমার কোনও লেখা পড়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করেছেন। তুমি এটা লিখলে, কেন লিখলে ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সেটা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক করেছেন। উনি আমার কলকাতার আখড়ায় কতবার যে এসেছেন সে হিসেবও আমার কাছে নেই। আমার বইয়ের প্রকাশকালে উনি এসে বই উদ্বোধনও করেছেন।

বিপ্লব: বেশ। তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গাটা স্পষ্ট হল। একটা জিনিস বলো, বাউল-ফকির নিয়ে তো অনেকেই কাজ করেছেন, সুধীর চক্রবর্তীর আগেও এ নিয়ে কাজ হয়েছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে আলাদা করে ওঁর বিশেষত্বগুলো ঠিক কোথায়?

ল্যাডলী: সুধীরদার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল, যেখানে যত গান উনি শুনেছেন, সেই সমস্ত গানগুলোকে উনি খোঁড়বার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ গানগুলোর মানে, যে সামাজিক অবস্থা থেকে গানগুলো উঠে এসেছে, তিনি খুব ভালোভাবে তা ব্যাখ্যা করেছেন। এটা ওঁর কাজের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে আমি মনে করি।

দ্বিতীয়ত, বাউল-ফকিরদের যে অধ্যাত্ম, তাদের যে যাপন ও চর্চা, সেটাকে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা— এটাও বাউল-ফকির গবেষণায় সুধীর চক্রবর্তীর অত্যন্ত বিশিষ্ট সংযোজন।

আরেকটা জায়গাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। উনি বাউল-ফকির নিয়ে একটা চলমান ম্যাপ ও ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিলেন। বছরের কখন কোথায় মেলা হচ্ছে, কোথায় কোন বাউল গাইছেন, তাদের গায়কীর নানা ঘরোয়ানা, জেলাওয়াড়ি ঘরোয়ানা… সেগুলোকে তিনি খুব সুন্দরভাবে সনাক্ত করেছিলেন। ওঁকে ছাড়া আমি আর কাউকে দেখিনি যিনি এই কাজটা এত নিপুণভাবে করতে পেরেছেন। শুধু শনাক্ত করেছেন এটা বললেও ভুল হবে, সুধীরবাবু এগুলোকে ডকুমেন্টও করেছেন, তাঁর বিভিন্ন বইয়ে এসব নিয়ে বিস্তর লিখে গেছেন।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম: এই কাজটা শক্তিনাথবাবুও অবশ্য করেছেন, যতদূর জানি…। দুজনের কাজের ধরনের মধ্যে কোনও তফাত আছে কি?

ল্যাডলী: হ্যাঁ, শক্তিনাথ ঝা-ও এই কাজটা করেছেন, ইন ফ্যাক্ট উনি প্র্যাকটিসের মধ্যেও যাওয়ার চেষ্টা করেছেন,  তার সঙ্গে আমি সহমত হই বা না হই সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই যে শক্তিনাথবাবুও এ নিয়ে দারুণ কাজ করেছেন। কিন্তু সুধীরদার ভাষা এতটাই প্রাঞ্জল যে সাধারণ পাঠকের বিষয়টা বুঝতে অনেকটা সুবিধে হয়েছে। শক্তিনাথবাবুর লেখা অনেক বেশি অ্যাকাডেমিক। সুধীরদাও অ্যাকাডেমিক্সেরই লোক, কিন্তু উনি যখন লিখেছেন, তখনও তাঁর লেখাগুলো আর সেই অর্থে অ্যাকাডেমিক থাকেনি৷ কোনও তুলনামূলক জায়গায় না গিয়েও আমি বলতে পারি, ব্যক্তিগতভাবে সুধীর চক্রবর্তীর গদ্যভাষা আমার খুব প্রাঞ্জল মনে হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা মনে এল। সুধীরদা কিন্তু সেই অর্থে বাউল-ফকিরদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ মেলামেশা বা ওঠাবসা করেননি। উনি মেলায় গেছেন, বাউলদের বাড়িতেও গেছেন, কিন্তু যা করেছেন সবই একটা দূরত্ব থেকেই করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওঁর বিশ্লেষণ, ওঁর বক্তব্য অনেক বেশি প্রাঞ্জল, অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি।

বিপ্লব: দাদা, তোমার নিজেরও তো বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সহযাত্রার একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাউল গান শোনা, তাদের সঙ্গে মেলামেশা, মেলায় মেলায় ঘোরা, তাদের নিয়ে পড়াশুনো, লেখালেখি, ছবি করা.. সবই তুমি করেছ। এবার তোমার নিজের এই চর্চার জায়গা থেকে তুমি কি সুধীরবাবুর দেখার সঙ্গে কোনও দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নমত পোষণ করো?

ল্যাডলী: কিছুটা করি তো বটেই। প্রথম থেকেই আমি যেটা বলার চেষ্টা করেছি, যে আমি বাউলদের নিয়ে যে কাজ করেছি, সেটা কখনওই কাজ করব এইরকম ভেবে নিয়ে যাইনি। প্রাথমিকভাবে যোগাযোগটা শুধুই গান শোনার ইচ্ছে থেকেই শুরু হয়েছিল। তারপর ক্রমশ তাদের জীবনযাত্রা ও জীবনধর্ম.. এগুলোকে আরও নিবিড়ভাবে দেখার চেষ্টা করছিলাম। ফলে আমি যেটা করেছি তা হল ওদের সঙ্গে থাকা, এবং সেটা মাসের পর মাস, একটানা। এমন নয় যে দুদিন থাকলাম, চলে এলাম, আবার গেলাম। তাই আমার দেখা অনেকটা ডিটেইলড, সেটা শুধুমাত্র ওপর থেকে ওদের গাঁজা খাওয়াটা দেখা নয়, তার ভেতরের একটা দিক আছে, সেটাও উপলব্ধি করতে পারা।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম: অর্থাৎ যেটাকে ‘সঙ্গ করা’ বলে… আপনি বাউল-ফকিরদের সঙ্গ করেছেন…

ল্যাডলী: একদমই তাই। আমি সেটাই বলতে চাইছি। আমি যেভাবে বাউল-ফকিরদের সাথে সঙ্গ করেছি, সুধীরদা সেটা করেননি। বাউল-ফকির বিষয়ে আরও যাঁরা ট্র্যাডিশনাল জায়গা থেকে আলোচনা-বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, যেমন ক্ষিতিমোহন সেন— সুধীর চক্রবর্তীও সেই একই ধারাবাহিকতায় এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম নয়। ক্ষিতিমোহন সেন-ই হোন বা পরে সুধীরদা-ই হোন, আমি আগে বাউল-ফকিরদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি, পরবর্তীকালে আমি তাদের নিয়ে নানা লেখাপত্র পড়েছি। অর্থাৎ যখন আমি বাউলদের সাথে সঙ্গ করা শুরু করেছি, তখন আমি যে প্রচুর বইপত্র পড়ে ফেলেছি এমনটা নয়। আমি একদম জীবন অভিজ্ঞতা থেকে বাউলকে দেখার চেষ্টা করেছি। এক বামপন্থী পরিবারে আমার জন্ম। আমি নিজেকেও এখন বামপন্থী বলি। ফলে আমি এই অভিজ্ঞতাটাকেও মেটেরিয়ালিস্টিক চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে সুধীরদার সঙ্গে একটা পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমি আবারও বলছি, আমি কোনও তুলনায় যাব না। সুধীর চক্রবর্তী অনেক বড় মানুষ, বিরাট ব্যক্তিত্ব। যেমন, আমার ধারণা ছিল, সুধীরদা আমার লেখা খুব একটা পছন্দ করবেন না৷ তাই আমি অবাক হয়েছি যখন সুধীরদা তাঁর রচনাসমগ্রের পঞ্চম খণ্ডটি আমাকে উৎসর্গ করলেন। আমি বিস্মিত হয়েছি, একইসঙ্গে আমি যে গর্বিত হয়েছি তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷

অথচ এখানেই আমাদের ভিন্নতা। একটা অ্যাকাডেমিক্সের জায়গা থেকে বাউলদের বোঝা বা ব্যাখ্যা করা, আরেকটা হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনযাপনের অবস্থান থেকে বাউলদের বোঝা, এবং সেটা তাদের প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রেও। যেমন, বাউলদের নিয়ে আলোচনায় তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের আচারের কথাও উঠে আসে৷ আমি নিশ্চিত, যারা বাউলদের নিয়ে কাজ করেন তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে এই শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাপারটা কী— তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিষয়টা সঠিকভাবে বলতে পারবেন না৷ একথা আমি বেশ জোর দিয়ে বলতে পারি। তার কারণ হল, এই প্র্যাকটিসটা তারা নিজের চোখে দেখেননি। শুধুমাত্র এক-দুদিন বাউলের বাড়ি গেলে এই প্র্যাকটিসটা দেখতে পাওয়া যায় না। আমি কিছুটা সৌভাগ্যবান যে আমি এমন কিছু বাউলের দেখা পেয়েছি, যাঁরা প্রকৃতই বাউল। ‘ফাউল’ নয় বা বাউল-গায়ক নয়। আমি খুব কাছ থেকে পূর্ণদাসকেও দেখেছি, গোষ্ঠগোপালকেও দেখেছি, এঁদের অনেককেই আমি দেখেছি। পূর্ণদাসের সঙ্গে আমার পারিবারিক যোগাযোগ, তাঁকে আমি অনেক ছোটবেলা, আমার বয়স যখন তিন-চার, তখন থেকে দেখেছি। ফলে আমার দেখাটা একদম সঙ্গ করে, একদম তাদের সঙ্গে থেকে দেখা। হ্যাঁ, অবশ্যই আমি খুবই আরবান, আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই কলকাতা শহরে। ফলে এই নাগরিক জীবনযাপনকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে গ্রামীণ জীবনে দীর্ঘদিন থেকে ওদের বোঝা, ওদেরই শাক-অন্ন খাওয়া, সেটা সুধীরদার মতো অ্যাকাডেমিশিয়ানরা সচেতনভাবেই কোনওদিন করেননি। ফলে সুধীরদাকে পড়তে গিয়ে আমি অনেক উপকার পেয়েছি, কিন্তু পাশাপাশি কোথাও একটা গ্যাপ থেকে গেছে।

বিপ্লব: এটা কি গ্যাপ, নাকি সীমাবদ্ধতা?

ল্যাডলী: না, আমি একে গ্যাপ-ই বলব। সুধীরদা এটা অতিক্রম করতে পারলে নিশ্চয়ই খুব ভালো হত। আমরা আরও বেশি সমৃদ্ধ হতাম। সুধীরদা সভা-সমিতিতে বলেওছেন যে ল্যাডলী যেভাবে দেখেছে, কাজটা করেছে, আমি সেভাবে পারিনি। কারণ আমি তো মাস্টারমশাই। ধুতি পাঞ্জাবি পরি। আমার পক্ষে ওটা করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এই বিষয়টি সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন ও মেনেও নিয়েছিলেন। সুধীর চক্রবর্তী যে কত উদার ও মহানুভব একজন মানুষ, যা ওঁর সঙ্গে না মিশলে বোঝা যায় না৷

বিপ্লব: তুমি তো ওঁর সঙ্গে অনেক মিশেছ। তুমি বললেও যে উনি কলকাতায় তোমার আখড়াতেও অনেকবার এসেছেন। ওঁর সঙ্গে কাটানো কোনও বিশেষ স্মৃতির কথা তোমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে? উনি তো খুব ভালো গান গাইতে পারতেন শুনেছি…

ল্যাডলী: হ্যাঁ, একবারের ঘটনা বলি। সুধীরদা আমার এখানে এসেছেন। আমি তখন একটা বিদেশি প্রজেক্ট করছি। একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার ব্যাপার ছিল। সেটা নেওয়া হল। তারপর আমি বললাম, সুধীরদা একটু গান শুনি আমরা। উনি কিন্তু খুব খেতে ভালোবাসতেন। খাদ্যখাবার এল। আমি বললাম, খাওয়াদাওয়ার আগেই বরং একটু গানবাজনা হোক। সুধীরদা রাজি হলেন, বললেন, আমি গান করব, তবে একটা শর্ত আছে, তুমি নাকি আজকাল গানও করো না, বাজনাও বাজাও না? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি শুধু নিজের জন্য গাই। সুধীরদা বললেন, তুমি যদি আজ আমার সঙ্গে বাজাও, তবেই আমি গান করব। আমার মনে আছে, সেইদিন একটা গাড়ি ঠিক করা হয়েছিল। উনি সেসময় একটু অসুস্থ ছিলেন। ঠিক ছিল, রাত নটা সাড়ে নটা নাগাদ গাড়িটা ওঁকে নিয়ে যাবে, কৃষ্ণনগর পৌঁছে দেবে। কিন্তু ওঁর গানে-গল্পে আমরা এতটাই মশগুল হয়ে পড়েছিলাম যে রাত এগারোটা বাজল। আমি নিজে গেলাম ওঁকে পৌঁছে দিতে। গান হল, গল্প হল, খাওয়াদাওয়া হল। তারপরেও ওই সারাটা পথ গান, সেইসব গানের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে সুধীরদা নানা কথা বলতে বলতে চললেন। সুধীরদাকে কৃষ্ণনগর পৌঁছে দিয়ে দুটো বা আড়াইটের সময় আমি আবার কলকাতা ফিরে এলাম। এরকম নানা অদ্ভুত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওঁর সঙ্গে।

বিপ্লব: আচ্ছা, ল্যাডলীদা, বাউল-ফকির তো সুধীরবাবুর মূল কাজের বিষয়। কিন্তু তার বাইরেও তো ওঁর কাজের একটা বিরাট ব্যাপ্তি আছে৷ সেই সম্বন্ধে যদি কিছু বলো…

ল্যাডলী: সুধীরদার কাজের অন্যতম একটা দিক হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, কিন্তু আমার সবসময়েই মনে হয়েছে যে সুধীরদা ভিন্ন। এমনকি শঙ্খবাবুর সঙ্গেও এই নিয়ে কথা হয়েছে। উনি বলেছেন, সুধীর একটু অন্যভাবে ভাবে, অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ওঁর ‘এলেম নতুন দেশে’ বইটাকে তো রীতিমতো হ্যান্ডবুক বলা যেতে পারে। আবার পুরনো বাংলা গান, তা নিয়েও সুধীরদার একটা উৎসাহ ছিল। পুরনো বাংলা গান নিয়েও অনেকেই লিখেছেন, বলেছেন। কিন্তু সুধীরদা যে দৃষ্টিকোণ থেকে পুরনো গানকে দেখেছেন, তার মধ্যে একটা দারুণ রসবোধ ছিল।

এবার যে প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই তা হল ‘ধ্রুবপদ’৷ আমি খুব কম সম্পাদককে দেখেছি পত্রিকার ব্যাপারে এত মেটিকুলাস। কোনও এক লেখককে সুধীরদা বলবেন একটা বিষয় নিয়ে লিখতে, সেক্ষেত্রে উনি বিষয়টি নিয়ে সেই লেখকের সঙ্গে দেড়-দু-ঘণ্টা আলোচনা করবেন, ওঁকে ব্রিফ করবেন যে উনি ঠিক কী চান। তা সে তিনি যে লেখকই হোন না কেন। আমি নিজে সাক্ষী যে একজন খুব বড় লেখক একটা লেখা পাঠিয়েছেন, আমি তাঁর নাম বলব না, লেখা পড়ে সুধীরদা সে লেখা ফেরত পাঠিয়েছেন এবং লেখককে বলেছেন এই এই জায়গাগুলো ঠিক করে দিতে। অনেক বড় বড় সম্পাদকও এরকম করার কথা ভাবতেই পারবেন না। সম্পাদনার ক্ষেত্রেও সুধীরদা যে অগ্রগণ্য ছিলেন, সেবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

বিপ্লব: এমনকি ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীদের নিয়েও ওঁর কাজ আছে…।

ল্যাডলী: হ্যাঁ, সেইজন্যেই সুধীর চক্রবর্তী যে শুধু একজন বাউল-ফকির গবেষক, তা মোটেই নয়। সামগ্রিক প্রান্তিক জীবন, কৌম জীবন প্রসঙ্গে উনি একজন বিশেষজ্ঞ। যেহেতু উনি নদিয়ায় থাকতেন, নদিয়ার বিভিন্ন ধরনের প্রান্তিক কারিগর গোষ্ঠীর কাজ নিয়ে উনি বিস্তারিত খোঁজ নিয়েছেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, কোন অবস্থায় তারা আছে, কোন দিকে যাচ্ছে, কী তাদের সমস্যা— এই সবকিছু নিয়ে উনি পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখেছেন ও বলেছেন। অর্থাৎ উনি শুধু বাউল গান, প্রাচীন বাংলা গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না৷ এমনকি যারা ধ্রুবপদ পড়েছেন তারা জানবেন, সেখানে নারী পুরুষের সম্পর্ক থেকে শুরু করে আইটি সেক্টরের প্রসার— এই সবকিছু নিয়ে তিনি লেখা প্রকাশ করেছেন৷

সুধীরদার বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহ ছিল। যেমন উনি আমাকে বলতেন, সিনেমাটা আমি ঠিক বুঝি না। অথচ উনি কিন্তু প্রচুর ক্লাসিক্স দেখতেন। এবং সেটাও দেখেছেন অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্রের মতো। এমনকি আমি নিজে একজন ফিল্মমেকার, সে যত ছোটই হই না কেন, আমরা ফিল্ম নিয়ে পড়াতে যাই দেশে বা বিদেশে… সুধীরদার কথা শুনে আমারও মনে হয়েছে, বাহ, এটা তো এইভাবে দেখা হয়নি। সুধীরদা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বার্গম্যান নিয়ে কথা বলতে পারতেন। পাশাপাশি, উনি আবার গোদারিয়ান স্টাইল একদম পছন্দ করতেন না। ওঁর মতে, সিনেমা হচ্ছে একটা গল্প। আমি অনেক সময়ই সুধীরদাকে বলেছি, না, আজকের পৃথিবীতে ন্যারেটিভই শেষ কথা নয়। নন-ন্যারেটিভও একটা গল্প তৈরি করতে পারে। হ্যাঁ, সেটাও একটা গল্প, তারও শুরু থাকে, শেষ থাকে, চড়াই-উৎরাই থাকে, কিন্তু সেটা গোল গোল গল্প না-ই হতে পারে৷ সেইদিক থেকে সুধীরদা অবশ্য একটু ট্র্যাডিশনাল ছিলেন।

সব মিলিয়ে, বাংলার সংস্কৃতি জগতের তো বটেই, সুধীর চক্রবর্তীর চলে যাওয়া আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম: সুধীরবাবুকে নিয়ে আলোচনা আরও এগোতেই পারে, কিন্তু আপাতত আমাদের একটা জায়গায় ইতি টানতেই হবে৷ ল্যাডলীদার কাছ থেকে আমরা ওঁর কাজ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আমাদের পত্রিকার তরফ থেকে আপনাদের দুজনকেই অসংখ্য ধন্যবাদ।