স্টেশন মাস্টার
বৎসরটি, অবশেষে, বৎসরের নিয়মেই ফুরাইল। বস্তুত তাহা কত দ্রুত ফুরায়, ফুরাইবার আগে আমাদের আর কী কী অনিষ্টসাধন করিয়া যায় তাহা লইয়া উদ্বেগের অন্ত ছিল না— ফলে, সচরাচর বর্ষবিদায়ের ক্ষণে যে স্মৃতিমেদুরতার প্রগাঢ় বিস্ফার আমরা দেখিতে অভ্যস্ত, এবার তাহার উলটা চিত্রই প্রত্যাশিত ছিল— পুরাতনকে স্মরণ করিয়া তাহার সুখস্মৃতিকে মনে স্থান করিয়া দিবার পরিবর্তে এবার বড় হইয়া উঠিয়াছিল অলক্ষ্মীবর্ষটিকে কুলার বাতাস দিয়া বিদায় করিবার ব্যগ্রতা। সে ব্যগ্রতার কারণ ছিল না তাহা নহে, বস্তুত, কারণ যথেষ্টই ছিল। কিন্তু, পুরাতনকে ত্যাগ দিয়া নূতনকে আঁকড়াইয়া ধরিবার পশ্চাতে যে নিহিত জাদুবিশ্বাস— যেন, কালরাত্রিটুকু পোহাইবার সঙ্গে-সঙ্গেই অতিমারি কার্যত অতীত হইবে, পৃথিবী পুনরায় তাহার অভ্যস্ত পথে ফিরিয়া আসিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিবে— এবংবিধ আশার পশ্চাতে কোনও যুক্তির অবলম্বন ছিল না, বরং অযুক্তিরই প্রাবল্য ছিল সমধিক। নিমজ্জমান ব্যক্তি যেইরূপ প্রবল স্রোতের মুখে কুটাটি ধরিয়াই বাঁচার আশা করে, ত্রাসে ও আতঙ্কে জর্জরিতপ্রায় আমরাও বুঝি বা তেমনই ধরিয়া লইয়াছিলাম জানুয়ারির প্রথম প্রভাতটি হইতেই টীকা-অস্ত্রে বলীয়ান আমরা অতিমারির মোকাবিলায় বাহির হইয়া পড়িতে পারিব। এ ভাবনার উৎস কী, ইহার স্বপক্ষে সহজ পাটীগণিতের যুক্তির জোর কতটুকু— বিশ্বের কথা বাদই দিলাম, দেশের সকল মানুষকে অতিমারির টীকা দিতে গেলেও তাহার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, আর্থিক প্রস্তুতি, টীকার জোগান ও সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা কীরূপ হওয়া উচিত— সেসব আমরা ভাবিয়া দেখিবার অবসর পাই নাই। বুঝি নাই, কোভিডের ভাইরাস ক্যালেন্ডার পড়িতে জানে না— বুঝিলে বর্ষবিদায়ে অমন অকারণ নৃত্যপর হইয়া উঠিতে পারিতাম না।
কিন্তু, সে প্রসঙ্গ আপাতত সরাইয়া রাখা যাক। বরং উল্লেখ থাকুক যে, বছরটিকে যেন-তেন-প্রকারে বিদায় করিতে উৎসুক আমরা খেয়াল করিয়া দেখি নাই, কী মস্ত এক শিক্ষার বছর সদ্য-সদ্য পার করিয়া আসিলাম। শুনা যায়, কোনও-কোনও চিকিৎসাপদ্ধতিতে এরূপ ঔষধের নিদান আছে, যাহারা দেহের সকল লুক্কায়িত ব্যাধিকে সমূলে টানিয়া বাহির করিয়া আনে, এবং রোগনির্ণয়ে চিকিৎসকের কাজ সহজ করিয়া দেয়। ভাবিয়া দেখিতে গেলে, সন ২০২০-ও যেন সেই এক মহৌষধের রূপে আসিল, যাহা নিমেষে আমাদের সমাজজীবনের সকল ব্যাধি, ক্লেদ, পঙ্কিলতার একেবারে নড়া ধরিয়া টানিয়া আনিয়া আমাদের চক্ষের সম্মুখে খাড়া করিয়া দিল— যেন এক ঈশ্বরপ্রেরিত আয়না আমাদের সম্মুখে ধরিয়া বলিল, দ্যাখো, নিজের আসল রূপটি প্রত্যক্ষ করিয়া লও। এমনকী বনের পশুও প্রকৃতির স্বাভাবিক কিছু বিধান মানিয়া চলে, কিন্তু আমাদের অন্তর্নিহিত ক্রূরতা, লোভ, হিংসা, মাৎসর্য, মিথ্যাচার, অসহিষ্ণুতা ও অন্যান্য সর্বপ্রকার কদর্যতা যে কী প্রকারে আমাদের স্বাভাবিক মনুষ্যত্বকে ঢাকিয়া ফেলিয়াছে, এই অলৌকিক আয়না তাহা দিনের আলোর ন্যায় লজ্জাহীন প্রতিভাত করিয়া দিল।
এই বিচারে ২০২০ কেবল একটি ধ্বংসের বৎসরই নহে, বস্তুত তাহা মানবসমাজকে নগ্ন করিয়া তাহাকে প্রকাণ্ড অটপ্সি-টেবিলের উপর চিৎ করিয়া শোয়াইয়া তাহার যাবতীয় রোগনির্ণয়ের এক মস্ত কেসস্টাডি রূপে আবির্ভূত হইল। আমরা সে পাঠ নিষ্ঠাসহ অনুধাবন করিলাম কি না, তাহার নিষ্কর্ষ হইতে কিছু গ্রহণ করিলাম কি না, আপনাদিগের ব্যাধিগুলিকে অতিক্রম করিবার প্রশ্নে কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রস্তুত করিয়া উঠিতে পারিলাম কি না, তাহাই হইতে পারিত সর্বাপেক্ষা গুরুতর সমীক্ষার বিষয়— কিন্তু হায়, আমরা সেই পথ মাড়াইলাম না— সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা বিশ এবং বিষের সস্তা শ্লেষে মোহিত হইয়া ভুলিয়া রহিলাম যে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাস নহে, এই বিষ বস্তুত বহু শতাব্দের অক্লান্ত শ্রমে সঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছি আমরাই— ভাইরাসের হানা কেবল সেই বিষ্ফোটকটির আবরণ বিদীর্ণ করিয়া পুঞ্জীভূত যাবতীয় রক্ত-ক্লেদ-বসা-পুঁজ বাহিরে আনিয়া ফেলিল।
কত উদাহরণ দিব? বস্তুত, এই করোনাকাল দেশের সরকারের জনবিরোধী রূপটি যেভাবে প্রকাশ্যে আনিয়াছে তাহা সর্বার্থেই এক বিরল ঘটনা— রাষ্ট্রের চরিত্র-আচরণ-কার্যপদ্ধতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সমাজবিদ্যার নিবিষ্ট ছাত্রের কাছে এক অপ্রত্যাশিত সুযোগও বটে। গত মার্চের শেষে লকডাউন কার্যকর হইতে না-হইতেই দেশব্যাপী অভিবাসী শ্রমিকদের ঢল নামিয়াছে, জীবিকাহীন দরিদ্র মানুষের চরম অর্থসঙ্কটের ঋতুতে তাঁহাদের হস্তে নগদের সংস্থান না-করিয়া সরকার তাঁহাদিগকে ঋণগ্রহণে উৎসাহিত করিয়াছে, কর্মক্ষেত্র হইতে তাঁহাদের আপনার গৃহে প্রত্যাবর্তনের বন্দোবস্ত না-করিয়া পরন্তু তাহা লইয়া সস্তার রাজনীতি করিয়াছে, একের পর এক লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে পেটোয়া শিল্পগোষ্ঠীগুলির হস্তে তুলিয়া দিবার বন্দোবস্ত করিয়াছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলিকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়া তাঁহাদের বিনা-বিচারে কিংবা বিচারের নামে প্রহসনের কুনাট্য ফাঁদিয়া জেলে পুরিয়াছে, লকডাউনের নামে দীর্ঘদিন সংসদ বন্ধ রাখিয়া কিংবা সংক্ষিপ্ত অধিবেশন ডাকিয়া ও প্রশ্নোত্তরপর্ব ছাঁটাই করিয়া বিরোধী দলগুলির কণ্ঠরোধ করিয়াছে ও সেই সুযোগে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-শ্রমবিধি প্রভৃতি বিষয়ে একের পর এক জনবিরোধী নীতি-প্রণয়ন করিয়া গিয়াছে, বশংবদ সংবাদমাধ্যমগুলিকে কাজে লাগাইয়া আপনার কৃতকর্মের স্বপক্ষে জনমত গঠনের খেলায় মাতিয়াছে, বিচারব্যবস্থাকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে নির্লজ্জ অপব্যবহার করিয়াছে, বছরের শুরুতে রাজধানী দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও হননপর্বের অত্যন্ত সুচারু আয়োজন করাইয়াছে, বছরের শেষে পঞ্জাব-হরিয়ানা-সহ গোটা দেশের কৃষকদের ক্ষেপাইয়া তুলিয়া দিল্লির উপকণ্ঠে তাঁহাদিগকে মরণপণ ধরনায় বসাইয়াছে— বস্তুত সমাজজীবনের এমন একটিও ক্ষেত্র অবশিষ্ট রাখে নাই যেখানে সরকারের নীতিকলুষতার পাপস্পর্শ না-লাগিয়াছে। একটি সরকার তাহার ধারাবাহিক উৎপীড়নমূলক কর্মসূচিকে কোন উচ্চতায় লইয়া যাইতে পারে, এই কোভিডকাল না-আসিলে তাহার এরূপ স্পষ্ট চিত্র ধরা পড়িত কোন উপায়ে?
আমাদের কাছে, অতএব, অতিমারির গত দশমাস কেবল কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরই ঋতু নহে, তাহা দেশের জনবিরোধী শাসকের চরিত্র-উন্মোচনেরও কাল। এবং, ইতিহাসের শিক্ষা শিরোধার্য করিয়া যদি স্মরণে রাখি যে, এমত প্রতিকূল পরিস্থিতিই পারে বিচারের স্রোতঃপথ খুলিয়া নূতন প্রতিবাদের জন্ম দিতে, তবে বুঝা কঠিন নহে কীভাবে ধ্বংসপথ হইতেই সৃজনপথ জন্ম লয়— কীভাবে ধ্বংসের প্রেক্ষাপটেই রচিত হইয়া উঠে সৃজনেরও পটভূমি। এই ভাবনা হইতেই চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের এই সংখ্যার কেন্দ্রীয় বিষয় ‘ধ্বংসপট, সৃজনপট’-এর পরিকল্পনা। আমাদের ভাবনায় সাড়া দিয়া এই কোভিড অতিমারির সময়কালের বিভিন্ন দিক লইয়া লিখিয়াছেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, শুভাশিস মৈত্র, কুমার রাণা, স্বাতী ভট্টাচার্য, মধুমিতা দোবে ও অম্লান বিষ্ণু।
এই সংখ্যার স্মরণ বিভাগে রহিল সদ্যোপ্রয়াত সঙ্গীতগবেষক ও চিন্তক সুধীর চক্রবর্তীকে লইয়া বিপ্লব চৌধুরী-কৃত ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়-এর একটি ভিন্ন স্বাদের সাক্ষাৎকার এবং প্রবুদ্ধ বাগচীর একটি নিবন্ধ। একই বিভাগে সন্নিবেশিত হইল প্রয়াত চলচ্চিত্র-পরিচালক কিম কি দুক-এর জীবনকৃতি বিষয়ে অনিন্দ্য আরিফ-এর রচনা। প্রয়াত গোয়েন্দাকাহিনিলেখক জন লি ক্যারে-কে স্মরণ করিলেন বিষাণ বসু এবং বিশ্রুত পর্বতারোহী ডাগ স্কটকে লইয়া লিখিলেন অভীক ভট্টাচার্য।
২০২১-এর জানুয়ারি সংখ্যায় এতদ্ব্যতীত রহিল গল্প, কবিতা, নিবন্ধ-প্রবন্ধ, ধারাবাহিক গদ্য ও উপন্যাস, অণুগল্প, অনুবাদ-সহ সবক’টি নিয়মিত বিভাগ।
পরিশেষে জানাই, সম্পাদকীয় রচনার কপি প্রস্তুত করিতে করিতে খবর পাইতেছি দিল্লি ও হরিয়ানা জুড়িয়া জানুয়ারির হাড়-কাঁপানো ঠান্ডার সহিত যুক্ত হইয়াছে প্রবল বৃষ্টি— এবং প্রকৃতির এই যুগ্মরোষের মুখেও অবিকল্প দীপশিখার ন্যায় স্থির আন্দোলনকারী কৃষকদের অবস্থান ধর্মঘট, যাহা ইতিমধ্যেই চল্লিশদিনের সীমা স্পর্শ করিয়াছে। অতিপ্রবল শৈত্যপ্রবাহে সিংঘু-টিকরি-গাজিপুর সীমানায় এ-যাবৎ প্রাণ হারাইয়াছেন পঞ্চাশেরও অধিক কৃষক, কিন্তু এই মৃত্যুমিছিল তাঁহাদের শপথকে টলাইতে পারে নাই। সরকার ও তাহার চাটুকার সংবাদমাধ্যমের বিষোদ্গার ও পরিকল্পিত মিথ্যাভাষণ যাঁহাদের প্রত্যয়ের প্রাচীর হইতে একটি ইটও খসাইতে পারে না, প্রকৃতির প্রতিকূলতা কৃষি-আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তাঁহাদের ক্রান্তিকারী লড়াইকে যে দমাইতে পারিবে না, তাহাতে সংশয় কী? চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ আমরা তাঁহাদের এই আশ্চর্য সংগ্রামের সংবাদ নিয়মিত প্রকাশ করিতেছি আমাদের স্পেশাল ট্রেন ‘যদি দু-একটা বীজ ভিজে ওঠে’-তে— অনুরোধ, আপনারা সেগুলি পড়ুন ও আগ্রহীদিগকে পড়ান। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই দীর্ঘজীবী হউক।
শুভেচ্ছাসহ, ইতি।